অং সান সু চি-র মহান উত্তরাধিকারে ও কিসের দাগ?

অং সান সু চি-র মহান উত্তরাধিকারে ও কিসের দাগ?

“It is not power that corrupts but fear. Fear of losing power corrupts those who wield it and fear of the scourge of power corrupts those who are subject to it.” Aung San Suu Kyi

অং সান সু চি। এই নামটা শুনলেই একটা রূপকল্প ভেসে ওঠে চোখের সামনে, “খাঁচায় বন্দি এক ডানা ঝাপটানো পাখি”; আমাদের মনে কত না ছবি ভিড় করে আসে, সেগুলোর কিছু সূর্যের মতো জ্বলজ্বলে, কিছু আবার গ্রহণ লাগা চাঁদের মতো ধোঁয়াশার কুয়াশায় আচ্ছন্ন। একটা সময় ছিল যখন বিশ্বের দরবারে সু চি মানেই ছিল স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র, বার্মার দমিত জনগোষ্ঠীর আশা-ভরসার শেষ উৎস, শান্তি ও পুনর্মিলনের এক জীবন্ত প্রতিমূর্তি। তিনি তাঁর  মহামূল্যবান প্রচেষ্টার জন্য অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, তার মধ্যে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু পরবর্তীতে সেই মানুষটাই হয়ে ওঠেন মিথ্যার সঙ্গে আপস করা এক দুর্বল চরিত্র। সব কেমন গুলিয়ে যায়, মানতে কষ্ট হয় এই পরিবর্তনের দুর্জ্ঞেয় কারণ। সু চি এখন ৭৯ বছরে পৌঁছেছেন, তাঁর গলা শোনা যায়নি বহু বহু কাল।

সু চিকে গভীরভাবে চিনতে হলে তাঁর উত্তরাধিকারের ইতিহাস ছুঁয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে । আমাদের এও জানতে ইচ্ছে করে, কেমন ছিল সু চি র ছোটবেলা, তাঁর বড় হয়ে ওঠা? কবে কেমনভাবে রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটল সু চি র? 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি রাষ্ট্র বার্মা বা ব্রহ্মদেশ, ২০১১ থেকে যেটি মিয়ানমার প্রজাতন্ত্র নামে সকলের কাছে পরিচিত। ১৯৪৫ সালের ১৯ জুন ব্রিটিশ বার্মার রেঙ্গুনের (বর্তমানে ইয়াঙ্গুন) বাইরে ছোট এক গ্রাম হিময়ায় সাউং-এ জন্মগ্রহণ করেন অং সান সু চি। সু চি র বাবা জেনারেল বোগিওক অং সান ছিলেন একজন বার্মিজ রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতা কর্মী এবং কট্টর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবী। ব্রিটিশ শাসন থেকে মিয়ানমারকে স্বাধীন করার সংগ্রামে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র ছয় মাস আগে, ১৯ জুলাই, ১৯৪৭, মিয়ানমারের স্বাধীনতার জনক, অং সান হত্যাকাণ্ডের শিকার হন । ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ব্রিটিশ শাসন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে বার্মা। বার্মিজ জনগণের কাছে আধুনিক মিয়ানমারের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আজও  বিবেচিত হন অং সান। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি যে, মিয়ানমারের সামরিক সরকার গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে তাঁর স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করে গেছে । অথচ মজার ব্যাপার এই যে, মিয়ানমারের কুখ্যাত সেনাবাহিনীর (তাতমাদো) প্রতিষ্ঠাতা কিন্তু  তিনিই। 

সু চি র মা দা খিন চি দশ ভাই-বোনের মধ্যে অষ্টম । খিন চি ইরাবদি র ব-দ্বীপ শহর মায়াংম্যায় বড় হয়েছেন । তিনি রেঙ্গুনের আমেরিকান ব্যাপটিস্ট মিশন-চালিত কেমেনডাইন গার্লস স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং মৌলমেইনের টিচার্স ট্রেনিং কলেজে তার শিক্ষাগ্রহণ করেন । এরপর খিন চি তাঁর নিজ শহরের ন্যাশনাল স্কুলেই একজন শিক্ষিকা নিযুক্ত হন। ওদিকে তাঁর দুই বড় বোন তখন নার্সিং পেশার প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। তাঁদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে, মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে খিন চি নার্সিং পেশায় যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং সেইমত নার্স হন। এরপর দা খিন চি রেঙ্গুনে চলে আসেন এবং রেঙ্গুন জেনারেল হাসপাতালের নার্সিং প্রোবেশনার হিসেবে যোগ দেন।

ভাবছেন সু চির কথা লিখতে বসে তাঁর বাবা মায়ের সম্বন্ধে এত বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার কী কারণ? আছে, আছে, ভাগ্যদেবতা কেমন পাশার চাল চলছিলেন এই দুই মানুষের জীবনের চলার পথে, সেটা একবার দেখবেন না? ১৯৪২ সালে অং সানের সাথে  দা খিন চি র প্রথম দেখাটা তো এক ছায়াছবির কল্পকাহিনির মতোই চমকপ্রদ। ঘটনাস্থল রেঙ্গুন জেনারেল হাসপাতাল, বার্মা ক্যাম্পেইনের সংঘর্ষে আঘাতপ্রাপ্ত অং সান ডাক্তারদের চিকিৎসায় শরীরের ক্ষত থেকে ক্রমে ক্রমে সেরে উঠছিলেন, আর হবি তো হ, সেখানেই একজন সিনিয়র নার্স হিসাবে তখন কর্মরত খিন চি।  দেখামাত্রই নিজের থেকে দুই বছরের বড় খিন চি র প্রেমে পড়ে গেলেন ২৭ বছর বয়সী নেতা অং সান। আর এই প্রথম সাক্ষাতের কয়েক মাস পরেই, সেই বছরেরই ৭ই সেপ্টেম্বর ঝটপট বিয়েটা সেরে এক সাথে জীবনের পথ চলার সিদ্ধান্ত নিলেন এই অসাধারণ দম্পতি।

অং সান ও খিন চি র চারটি সন্তান হয়, দুটি ছেলে: অং সান ওও এবং অং সান লিন (যিনি ৮ বছর বয়সে ডুবে মারা যান) এবং দুই কন্যা: অং সান সু চি এবং অং সান চিট (প্রসবের পাঁচ দিন পরেই মারা যান)। পরিবারের সবচেয়ে ছোট সন্তান সু চি, হেসেখেলে বেশ বেড়ে উঠছেন বার্মায়।  এমন সময় হঠাৎ খুন হলেন অং সান। তখন সু চি র বয়স মাত্র দু বছর। সেদিন ছিল ১৯ জুলাই, ১৯৪৭, দেশের স্বাধীনতা অর্জনের আর মাত্র ছয় মাস বাকি ছিল, আপামর জনসাধারণকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন মিয়ানমারের স্বাধীনতার জনক, সু চির প্রথিতযশা বাবা। সদ্যবিধবা খিন চি পরিবারের সব ভার মাথায় তুলে নিলেন।

স্বামী অং সানের যোগ্য সহধর্মিনী ছিলেন খিন চি। তিনি ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত দেশের প্রথম স্বাধীনতা-উত্তর সরকারে সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, রেঙ্গুনের লানমাডাও টাউনশিপের প্রতিনিধিত্ব করেন, যে আসনটি তার স্বামী জিতেছিলেন। ১৯৫৩ সালে, বার্মার প্রথম সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। খিন চি ১৯৪৭-১৯৫৩ সাল পর্যন্ত বার্মা মহিলা সমিতির পরিচালক, ১৯৫৩-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত সমাজকল্যাণ পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ার, ইউনিয়ন অফ বার্মা সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের চেয়ার, মা ও শিশু কল্যাণের চেয়ার সহ আরও বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।  

১৯৫৩ সালে, দ্বিতীয় ছেলে, অং সান লিনের মৃত্যুর পর, কান্দাউগি লেকের কাছে টাওয়ার লেনের (বর্তমানে বোগয়োক মিউজিয়াম লেন) বাড়ি থেকে পরিবারের সকলকে নিয়ে ইয়াঙ্গুনের ইনিয়া লেকের তীরঘেঁষা, ৫৪ ইউনিভার্সিটি অ্যাভিনিউয়ে, ঔপনিবেশিক-শৈলীর এক ভিলায় চলে আসেন  দা খিন চি। এই বাড়িটি মিয়ানমারের গণতন্ত্রের লড়াইয়ের সাক্ষী এক ঐতিহাসিক স্থান এবং মিয়ানমারের জাতীয় প্রতীক।  ১৯৮৮ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই বাড়িতেই থাকতেন দা খিন চি। আর তাঁদের টাওয়ার লেনের প্রাক্তন বাড়িটি ১৯৬২ সালে বোগিওক ‘অং সান মিউজিয়ামে’ রূপান্তরিত হয়। 

১৯৬০ সালে দা খিন চি দিল্লিতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন। তিনিই দেশের প্রথম মহিলা যিনি কূটনৈতিক মিশনের প্রধান হিসাবে কাজ করার জন্য নির্বাচিত হন। সু চি মায়ের সঙ্গে ভারতে চলে আসেন। ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু নয়াদিল্লির ২৪, আকবর রোডের ঔপনিবেশিক যুগের এক বাড়িতে মা-মেয়ের বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের এক চমৎকার নমুনা এই বাড়িটি তৈরি করেন স্যার এডউইন লুটিয়েন্স। ১৯১১-১৯২৫ সালের মধ্যে নির্মিত এই বাড়িটিকে আধুনিকতার প্রথম যুগের এক অন্যতম সেরা শিল্পকর্ম হিসাবে বিবেচনা করা হয়। দা খিন চি র বিশেষ মর্যাদার স্বীকৃতিস্বরূপ নেহেরু বাড়িটির নামকরণ করেছিলেন ‘বার্মা হাউস।’ ১৯৬১ থেকে শুরু করে পরবর্তী দুই বছর পঞ্চদশী সু চি র ঠিকানা হয়ে ওঠে এই বাড়ি। নয়াদিল্লিতে হাই স্কুল শেষ করে লেডি শ্রী রাম কলেজে ভর্তি হন সু চি এবং পরবর্তীতে অক্সফোর্ডের সেন্ট হিউজ কলেজ থেকে দর্শন, রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। 

অক্সফোর্ডে সু চির ব্রিটিশ অভিভাবক ছিলেন বার্মার প্রাক্তন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার পল (পরে লর্ড) গোর-বুথ এবং তাঁর স্ত্রী প্যাট্রিসিয়া। এঁদের বাড়িতেই সু চি থাকতেন এবং তিব্বতি সাহিত্যের ছাত্র মাইকেল অ্যারিসের সাথে সেখানেই তাঁর দেখা হয় পারস্পরিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু পল ও প্যাট্রিসিয়ার ছেলে ক্রিস্টোফারের মাধ্যমে। 

এই মাইকেল লোকটিও কিন্তু কোনো সাধারণ ব্যক্তি ছিলেন না। ১৯৬৭-৭৩ সাল পর্যন্ত, ভুটানের রাজপরিবারের একজন ব্যক্তিগত গৃহশিক্ষক ছিলেন মাইকেল। ভুটান  কিন্তু তখন ছিল এক নিষিদ্ধ রাজ্য। ভুটানি ইতিহাস নিয়ে গবেষণা শুরু করে মাইকেল শেষে ভুটান সরকারের অনুবাদ বিভাগের প্রধান হয়ে যান। যাই হোক, সু চি র সাথে তাঁর বন্ধুত্বে কক্ষনো ভাঁটা পড়েনি এবং চিঠিপত্র আদানপ্রদানের মাধ্যমে পরিচালিত দীর্ঘ প্রেমপর্বের পর, ১৯৭২ সালের নববর্ষের দিন, গোর-বুথের লন্ডনের পারিবারিক বাড়িতে, একটি সাধারণ বৌদ্ধ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন সু চি ও মাইকেল। শুরু হয় সু চির নতুন জীবন – অক্সফোর্ডের অভিজাত সমাজের এক ব্রিটিশ গৃহিণী। এরপর মাইকেল লন্ডন ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে তিব্বতি সাহিত্যে তাঁর পিএইচডি শুরু করেন এবং পরবর্তী দশকের বেশিরভাগ সময় এই দম্পতি এবং তাঁদের দুই ছোট ছোট ছেলে আলেকজান্ডার অ্যারিস (জন্ম ১৯৭৩) এবং ড্যানিয়ান কিম অরুন্ডেল অ্যারিস (জন্ম ১৯৭৭) ভুটান, নেপাল, লাদাখ এবং অরুণাচল প্রদেশ সহ প্রত্যন্ত হিমালয় অঞ্চলে যাত্রা ও বসবাসের সময়কাল নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। ১৯৭৩ সালে, উত্তর নেপালের কুটাং এবং নুব্রি জেলায় ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযানের নেতৃত্ব দেন ডঃ অ্যারিস। ১৯৭০ এর দশকের শেষের দিকে অক্সফোর্ডে ফিরে, তিনি সেন্ট জন’স কলেজে (এবং পরে উলফসন কলেজ) একজন গবেষণা ফেলো হিসেবে নির্বাচিত হন। একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ ও বই লিখে বিদগ্ধ সমাজে তিনি রীতিমতো হইচই ফেলে দেন, এগুলোর মধ্যে ছিল ‘ভুটান: হিমালয়ান কিংডমের প্রারম্ভিক ইতিহাস.’ ‘মধ্যযুগীয় ভুটানের দৃশ্য,’ ‘স্যামুয়েল ডেভিসের ডায়েরি’ এবং ‘অঙ্কন, ১৭৮৩ এবং ভুটানের ইতিহাসের সূত্র।’ ১৯৮৫-৮৭ সালের মধ্যে, ডঃ অ্যারিস সিমলার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজের একজন ফেলো নির্বাচিত হন। 

সু চিও বসে থাকেননি। সন্তানদের লালনপালন করার সঙ্গে তিনি জোরকদমে তাঁর লেখালেখি ও পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ‘অং সান’ শিরোনামে তিনি তাঁর বাবার জীবনী এবং আরও বিভিন্ন ভ্রমণ বই এই সময়েই প্রকাশ করেন। 

সময় থেমে থাকে না। ১৯৮৮, ৩১ মার্চ। হঠাৎ টেলিফোন আসে সু চির কাছে, গুরুতর স্ট্রোক আক্রান্ত দা খিন চি। মায়ের যত্ন নেওয়ার জন্য পড়ি কী মরি করে পরের দিনই রেঙ্গুনাভিমুখী  বিমানে চড়ে দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন উতলা সু চি। দা খিন চি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তাঁকে নিয়ে সোজা ইনিয়া লেকের তীরের ৫৪ নম্বর পারিবারিক বাড়িতে চলে আসেন তিনি। 

প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে, ব্রিটিশ সরকারের কাছে থেকে স্বাধীনতার পর বার্মায় গণতান্ত্রিক সরকারই ক্ষমতায় আসীন ছিল, কিন্তু, ১৯৬২ সালে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল নে উইনের অধীনে সামরিক বাহিনী দেশের নিয়ন্ত্রণ হস্তগত করে। ১৯৮৮ র ২৩-এ জুলাই এতকালের ক্ষমতাসীন সামরিক একনায়ক জেনারেল নে উইন পদত্যাগ করেন। বার্মার রাজনীতির আঙিনায় যেন হঠাৎ দমকা ঝড় ওঠে। ৮ই আগস্ট সারাদেশে গণ-অভ্যুত্থান হয়। প্রতিবাদী জনতাকে ঠেকাবার জন্য সামরিক বাহিনী সহিংস দমননীতি প্রয়োগ করে, হাজার হাজার বেসামরিক লোককে হত্যা করে মিয়ানমার জান্তা। পরের মাসে, ১৫ই আগস্ট সু চি তাঁর প্রথম রাজনৈতিক পদক্ষেপটি নেন, বহুদলীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য স্বাধীন এক পরামর্শদাতা কমিটি গঠনের জন্য মায়ানমার সরকারকে খোলা চিঠি পাঠান তিনি। এরপরই ২৬শে আগস্ট, ১৯৮৮ সু চি শ্বেদাগন প্যাগাডোর বাইরে কয়েক লাখ মানুষের সামনে তাঁর প্রথম জন-ভাষণটি দেন। একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের আহ্বান জানান তিনি। ইয়াঙ্গুনে দেওয়া এক বক্তৃতায় সু চি বলেছিলেন, “আমার বাবার মেয়ে হিসাবে চারপাশে যা কিছু চলছে তার প্রতি আমি  উদাসীন থাকতে পারিনি।” মাইকেল এবং তাঁর দুই ছেলে তখন সুদূর ইংল্যান্ডেই রয়ে গেছে। ২৪ সেপ্টেম্বর ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সু চি এর  নির্বাচিত মহাসচিব হন। মার্কিন নাগরিক অধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এবং ভারতের মহাত্মা গান্ধীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কৌশল হিসেবে, শক্তিশালী প্রতিরোধের পরিবর্তে অহিংসা ও নাগরিক অসহযোগ নীতির পথ বেছে নেন সু চি। উন্নত, ভারসাম্যপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক একটি সমাজের পথ তৈরি করে জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর  করতে হবে – জান্তা সরকারের কাছে এই ছিল সু চি র দাবি। সামরিক বাহিনীও কিন্তু মোটেই বসে ছিল না, ১৮ই সেপ্টেম্বরেই তারা রাজ্য আইন ও শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার কাউন্সিল (SLORC) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চারজনের বেশি লোকের রাজনৈতিক সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেয়। সেই সঙ্গে যখন তখন বিনা বিচারে গ্রেফতার এবং সাজাও লাগু হয়ে গিয়েছিল।

এই সব গোলযোগের মধ্যেই ২৭ ডিসেম্বর ১৯৮৮, মারা যান দা খিন চি, মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। ২ জানুয়ারি ১৯৮৯ তারিখে অনুষ্ঠিত তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় দুই লাখেরও বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল, যদিও সামরিক ট্রাক এই সমাবেশকে প্রতিরোধ করার জন্য চেষ্টার কোনও কমতি করেনি। ইয়াঙ্গুনের শ্বেদাগন প্যাগোডা রোডের কান্দাউমিন গার্ডেন মৌসোলিয়াতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ২০১২ সালে, সু চি মায়ের সম্মানার্থে ‘দা খিন চি ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। মিয়ানমারের জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কল্যাণের উন্নয়নে কাজ করে চলেছে এটি।

রাজনৈতিক প্ররোচনা রোধ করার প্রয়াসে জনসমাবেশের উপর যে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছিল, সু চি সেই আইন অমান্য করেন এবং দেশ সফর করে বিপুল শ্রোতাদের সঙ্গে কথা বলা ও তাঁর প্রতিষ্ঠান বিরোধী অবস্থান অব্যাহত রাখেন। ৫ এপ্রিল, ১৯৮৯-এ, ইরাবদি ডেল্টায় এমনই একটি সফরে থাকাকালীন সু চি সশস্ত্র তাঁতমাদ র মুখোমুখি হন। সৈন্যদের রাইফেলের গুলি তাঁরই দিকে তাক করে রয়েছে, তবুও, দৃঢ় পায়ে নিঃশব্দে হাঁটতে হাঁটতে সেনাবাহিনীর দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন অকুতোভয় সু চি। যদিও মাত্র দুই বছর বয়সে বাবা কে হারিয়েছিলেন সু চি, কিন্তু নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাবার মতো একই রকম প্রতিরোধ প্রদর্শন করেছিলেন তিনি। প্রিয় নেত্রীর সাহসের পরিচয় পেয়ে গর্বে ফুলে উঠেছিল সমবেত জনতার বুক। 

২০ জুলাই, ১৯৮৯ তারিখে, কোনো বিচার বা অভিযোগ ছাড়াই সু চি কে গৃহবন্দী করা হয়। বুঝতে কষ্ট হয় না যে, সু চি র বিপুল জনসমর্থনের কারণেই সামরিক সরকার প্রমাদ গনে ও তাঁকে গ্রেফতার করে। সুচির ছেলেরা এইসময় তাঁর সঙ্গেই ছিল। মাইকেল যখন রেঙ্গুনে উড়ে এলেন,  সু চি তখন তাঁর অনশনের তৃতীয় দিনে পদার্পণ করেছেন। তাঁর বাড়িতে গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্রদের সঙ্গে তাঁকেও কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হোক, কর্তৃপক্ষকে এই অনুরোধ করছেন তিনি। সরকার ছাত্রদের সঙ্গে ভালো আচরণ করবে, এই প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর তবে সু চি তাঁর ধর্মঘট শেষ করেন। 

সেই প্রথম সু চি র বন্দিদশা, কে জানত পরবর্তীতে, জীবনের কত কত দিন, মাস, বছর তাঁকে কাটাতে হবে এরকমই বন্দিনী হয়ে? সেবারে তিনি গৃহবন্দী থাকেন ছয় বছর আর এর বেশিরভাগ সময়টাই তাঁকে কাটাতে হয় বাধ্যতামূলক নির্জন কারাবাসে। যদিও তাঁর কর্মকান্ডের ডানা এভাবেই ছেঁটে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, তবু মিয়ানমারে পরিবর্তন আনার চেষ্টা সতত চালিয়ে গেছেন সু চি। সু চিকে আটক রাখা সত্ত্বেও, ১৯৯০ সালের ২৭ মে, সাধারণ নির্বাচনে এনএলডি সংসদীয় আসনের ৮২ শতাংশ অর্জন করে’ বিশাল বিজয় লাভ করে। SLORC ভোটের ফলাফলকে মান্যতা দিতে অস্বীকার করে৷ সু চিকে মুক্তি দিতে অস্বীকার করার পাশাপাশি, এনএলডি র আরও অন্যান্য বিশিষ্ট সদস্যদের গ্রেপ্তার করে জান্তা।

গণতন্ত্রের জন্য সু চি র লড়াইকে সম্মান জানাতে এবার এগিয়ে আসে বিশ্ববাসী আর এসবের পিছনে স্বামী মাইকেলের যে কত বড় অবদান ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৯৯০ তে ‘রাফটো’ মানবাধিকার পুরস্কারে ভূষিত হন সু চি। ১৯৯১ সালে ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’ দেওয়া হয় তাঁকে । যেহেতু সু চি তখনও ঘরবন্দি ছিলেন, তাই তাঁর জায়গায় তাঁর বড় ছেলে আলেকজান্ডার অ্যারিস পুরস্কার গ্রহণ করেন। সু চি সেই পুরস্কারের ১.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ মিয়ানমারের জনগণের জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ট্রাস্ট গঠনের জন্য ব্যবহার করেন ।

১৯৯৫ সালে কারাবাস থেকে মুক্তি পেলেও, সু চির গতিবিধি কড়া নজরে রাখা হয়েছিল। তাঁর নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার বই ‘ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার’, যেখানে তিনি গণতন্ত্রের মূল্য এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের কথা বলেছেন, সেই বছরই প্রকাশিত হয়েছিল।

২৭ মার্চ, ১৯৯৯, সু চি র ‘নাইট ইন শাইনিং আর্মার’ ডঃ মাইকেল অ্যারিস, তাঁর ৫৩-তম জন্মদিনে, লন্ডনে প্রোস্টেট ক্যান্সারে মারা যান। ১৯৯৫ সালে ক্রিসমাস সফরের পর থেকে তিনি সু চি কে আর দেখেননি। স্ত্রীর সাথে শেষবারের মতো দেখা করার জন্য, বার্মিজ কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি অনেক অনুরোধ উপরোধ করেছিলেন, কিন্তু সে সবই নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়।  

এইখানে এসে আমার হৃদপিন্ড স্তব্ধ হয়ে যায়, একটা দারুণ ব্যথায় মন ছেয়ে যায়, তীব্র যন্ত্রণায় চোখ ভরে ওঠে জলে। গণতন্ত্রের জন্য সু চি যে কতটা আত্মত্যাগ করেছিলেন, সেটা বুঝতে এক ফোঁটাও কষ্ট হয় না। ভাবছেন, আচ্ছা, মাইকেল অ্যারিস না হয় নাই বা আসতে পারলেন রেঙ্গুনে, সু চি নিজে কি যেতে পারতেন না লন্ডনে, মুমূর্ষু স্বামীর শয্যাপাশে একটু বসার জন্য? নাকি, তাতেও অনুমতি দিত না জান্তা সরকার? না, না, তা কেন হবে? সরকার তো তাঁকে বিদেশে তাঁর পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য ক্রমাগতই অনুরোধ করছিল, কিন্তু সু চি ভয় পেয়েছিলেন যে, একবার বার্মার বাইরে পা রাখলে তাঁকে আর দেশে ফিরে আসতে দেওয়া হবে না। চিরকালের জন্য তাঁকে নির্বাসিত করবে সরকার। স্বৈরাচারমুক্ত গণতান্ত্রিক বার্মার জন্য তিনি তাঁর প্রাণের চেয়ে প্রিয় পরিবারের থেকে এই বিচ্ছেদকে বুকে পাথর চেপে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। বার্মার স্বাধীনতার জন্য শুধু সু চি নয়, মাইকেল, এবং ছেলেরা সকলেই একসঙ্গে তাঁদের স্বাভাবিক জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, ইংল্যান্ড থেকে বার্মায় প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৮৯ থেকে ২০১০ – এই একুশ বছরের মধ্যে প্রায় পনেরটি বছরই ইয়াঙ্গুনের ওই লেকসাইড ভিলাতে সু চি কে গৃহবন্দী থাকতে হয়েছিল, যখন পরিবার এবং নিকটতম সম্পর্কের মানুষগুলোর সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিল ন্যূনতম। কী অসম্ভব মহান এই আত্মত্যাগ!

২০১৫ সালে মায়ানমারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিরঙ্কুশভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন সু চি, কিন্তু তাঁর দুই ছেলে বিদেশি নাগরিক হওয়ার কারণে তাঁকে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নিতে নিষেধ করা হয়েছিল। পরিবর্তে, তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় পরামর্শদাতার (State Counsellor) পদ দেওয়া হয়, যদিও এটা স্পষ্ট ছিল যে তিনিই মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো নেত্রী, যেমনটি কয়েক দশক আগে ছিলেন তাঁর মর্যাদাশালী বাবা অং সান। ২০১৭ সালে সু চি রাষ্ট্রীয় পরামর্শদাতা হিসাবে থাকাকালীনই, সেই সাংঘাতিক গণহত্যার ঘটনা ঘটে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বেশ কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়ির অফিসারদের উপর হামলার পর দৃশ্যত প্রতিশোধ হিসাবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানকে ধর্ষণ ও হত্যা করে। সু চি কিন্তু তখন একটিও কথা বলেননি, এক্কেবারে চুপ করে থাকেন। মানুষ রোষে ফেটে পড়ে, সু চি কে ঘিরে রাগ, হতাশা ও প্রবল বিতর্কের জন্ম হয়। সু চি র অনুসারীরা ব্যাপারটাকে লঘু করার জন্য তাঁদের যুক্তি খাড়া করেন যে, একে তো দেশে জান্তা শাসনের একটা সহিংস ইতিহাস রয়েছে, তাঁর উপর বহু-জাতিগত একটা দেশ পরিচালনার যথেষ্ট অসুবিধাও রয়েছে। কিন্তু এগুলো ধোপে টেকার মতো কোনো কারণই ছিল না। এরপর ৭৪ বছর বয়সী সু চি নিজে যা করেছিলেন, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। ২০১৯ সালে হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে, সারা বিশ্বের ১৭ জন বিচারকের একটি বেঞ্চকে সম্বোধন করে, সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন সু চি এবং সাম্প্রদায়িক শক্তি দ্বারা সৃষ্ট বিদ্রোহকেই তিনি সংঘাতের জন্য দায়ী করেছেন। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আনা রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগগুলোকে তিনি “অসম্পূর্ণ এবং প্রকৃত অবস্থার এক বিভ্রান্তিকর চিত্র” বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর এত দিনের মহান উত্তরাধিকারে একেবারে কালি ঢেলে দিয়েছিল তাঁর নিজেরই এই অসত্য উক্তি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখের মণি ছিলেন সু চি কিন্তু এ ঘটনায় তাঁর এতদিনের নৈতিক দৃঢ়তার ভাবমূর্তিটি সর্বসমক্ষে লজ্জাজনকভাবে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ১৯৯১ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী সু চি এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে  জাতিগত সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে, এই নির্মম সত্যের প্রধান অস্বীকারকারী আজকের সু চি। একই মানুষের দুটি অবস্থানের মধ্যে এমন আকাশ পাতাল ফারাক দেখে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। একটা সময়ে তিনি ছিলেন মানবজাতির এক বিরাট অনুপ্রেরণা। কিন্তু মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার বিষয়ে নীরবতার কারণে তিনি এখন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত। জেনেবুঝে রোহিঙ্গাদের প্রতি সু চি অনেক বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। ২০১৮ সালে ‘ইউএস হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়াম’ সু চি র ‘এলি উইজেল’ পুরস্কার প্রত্যাহার করে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দ্বারা গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনের পরে বহু গুণীমানী মানুষ সু চির নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রত্যাহার করার পিটিশনে স্বাক্ষরও করেছিলেন। নেহাত নোবেল কমিটি অতীতে ভালো কাজের জন্য অর্জিত পুরস্কার পরে আর ফিরিয়ে নেয় না, তাই সু চির পক্ষে তা বাঁচোয়া। কিন্তু গোটা ব্যাপারটার সাথে যে চরম হতাশা ও লজ্জা জড়িয়ে আছে তার কী হবে? 

সমালোচকরা দাবি করেন যে, অং সান সু চি ভালোভাবে নথিভুক্ত গণহত্যার দাবিগুলির প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আদালতে উপস্থিত হওয়ার আশ্চর্যজনক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কারণ তিনি জানতেন যে, তাঁর এই অস্বীকার বৌদ্ধ-সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের ভোটারদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা আরও অনেকগুণ বাড়িয়ে তুলবে। হ্যাঁ, ঠিক সেটারই পরিচয় পাওয়া গেল ২০২০ সালের ৮ নভেম্বরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে যখন সু চি র এনএলডি বিপুল সংখ্যাগরিষ্টতা পেয়ে জয়ী হয়। ২০১১ সালে নিরঙ্কুশ সামরিক শাসন শেষ হওয়ার পর থেকে এটি ছিল দ্বিতীয়বারের প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন। প্রধান জাতীয় বিরোধী দল, জান্তা-প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি), ২০১৫ সালের তুলনায় আরও বেশি অপমানজনক পরাজয়ের সম্মুখীন হল। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, ভোটার জালিয়াতির বদনাম দিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এনএলডিকে হঠিয়ে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল করে। সু চি এবং এনএলডির অন্যান্য সদস্যদের গ্রেপ্তার করে জান্তা। বিভিন্ন অভিযোগে ৩৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় সু চিকে। নেপিডোর কারাগারের নির্জন কক্ষই হয়ে ওঠে “লেডি’’র ঠিকানা। “লেডি” নামেই সু চি কে ডাকে সকলে মিয়ানমারে। এসময় জাতিসংঘ, বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সু চির গ্রেপ্তার, বিচার এবং সাজাকে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উচ্চৈঃস্বরে নিন্দা করে। বাধ্য হয়ে পয়লা আগস্ট ২০২৩-এ সু চির সাজা কমিয়ে ২৭ বছর করে দেয় জান্তা প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং। আচ্ছা, কেন এমন ভালোমানুষিটা করল জান্তা? রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে হ্লাইং-এর মনুষ্যবিরোধী কাজকর্মকে বহির্বিশ্বের কাছ থেকে সু চি অতীতে ঢেকে রেখেছিলেন বলে? নাকি গোটা পৃথিবী বা আসিয়ানের সাথে তেতো হয়ে যাওয়া সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক করার জন্যই এই কৌশল? কে জানে! সময় বলবে।

পশ্চিমি নীতিনির্ধারকদের কাছে প্রায় ৭৯ বছর বয়সী সু চি এখনও গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বিচ্ছিন্নতাবাদী অশান্তি, ও অস্থিরতা থেকে আজও মুক্তি পায়নি মিয়ানমার। কিন্তু মিয়ানমারে এখন নতুন প্রজন্মের নেতাদের আবির্ভাব হয়েছে, যাঁরা বেশি মনোযোগের দাবি রাখছেন। আগের মতো সু চি র আর তেমন প্রভাব নেই। নেপিডো র লক আপে বন্দি এবং খুব সাবধানে যাচাই করা ব্যক্তিরা ছাড়া আর কারুর সঙ্গে কথা বলার অনুমতি নেই সু চি র, সুতরাং তিনি নিজে কী ভাবছেন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করছেন, তা জানতে পারা দুরূহ। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার। রাজনৈতিকভাবে দুর্বল, নৈতিকভাবে আপোষকারী এবং পাবলিক স্টেজ থেকে অনেক দূরে সরে গেলেও, মায়ানমারে এবং তার আশেপাশে যে শক্তির খেলা চলছে তার কারণ হিসেবে অং সান সু চিকে কিন্তু এখনও খারিজ করা সম্ভব নয়।

তথ্যসূত্র: 

BBC News. (2021, December 6). “Aung San Suu Kyi: Myanmar democracy icon who fell from grace.” Available: https://www.bbc.com/news/world-asia-pacific-11685977

Bonne, A. G. (2010). “Aung San Suu Kyi. Lady of No Fear.” Kamoli Films. Available: https://www.imdb.com/title/tt1789697/

Bowcott, O. (2019, December 6). “Aung San Suu Kyi tells court: Myanmar genocide claims ‘factually misleading.’ The Guardian. Available: https://www.theguardian.com/world/2019/dec/11/aung-san-suu-kyi-tells-icj-myanmar-genocide-claims-factually-misleading

Clough, E. and Gentner, L. (ND). Aung San Suu Kyi: Two takes. Open Rhetoric. Pressbooks. Available: https://pressbooks.pub/openrhetoric/chapter/aung-san-suu-kyi/

Horsey, R. (2020, November 12). “Another landslide victory for Aung San Suu Kyi’s party in Myanmar – But at what cost?” Crisis Group. Available: https://www.crisisgroup.org/asia/south-east-asia/myanmar/another-landslide-victory-aung-san-suu-kyis-party-myanmar-what-cost

Kidwai, R. (2021, December 8). “Aung San Suu Kyi’s link with 24, Akbar Road.” India Today. Available: https://www.indiatoday.in/world/story/aung-san-suu-kyi-jailed-myanmar-junta-nehru-1885529-2021-12-08

Maizland, L. (2022, January 31). “Myanmar’s troubled history: Coups, military rule, and ethnic conflict.” Council on Foreign Relations. Available: https://www.cfr.org/backgrounder/myanmar-history-coup-military-rule-ethnic-conflict-rohingya

Pletcher, K. (2024, October 27). “Aung San Suu Kyi. Myanmar politician and opposition leader.” Britannica. Available: https://www.britannica.com/biography/Aung-San-Suu-Kyi/Greater-freedom

Selth, A. (2023, July 18). “Has history left Aung San Suu Kyi behind?” The interpreter. Available: https://www.lowyinstitute.org/the-interpreter/has-history-left-aung-san-suu-kyi-behind

Smith, M. (1999, March 28). “Michael Aris obituary.” The Guardian. Available: https://www.theguardian.com/news/1999/mar/29/guardianobituaries1

Strangio, S. (2023, August 2). “Why did Myanmar’s military reduce Aung San Suu Kyi’s prison sentence?” The Diplomat. Available: https://thediplomat.com/2023/08/why-did-myanmars-military-reduce-aung-san-suu-kyis-prison-sentence/

চিত্রঋণ: অন্তর্জাল
নূপুর রায়চৌধুরীর জন্ম, পড়াশুনো কলকাতায়। বোস ইনস্টিটিউট থেকে বায়োকেমিস্ট্রিতে ডক্টরেট করে প্রথমে পুরুলিয়ার নিস্তারিণী কলেজে ও পরে বিশ্বভারতী ইউনিভার্সিটির শিক্ষাভবনে, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। ২০০৩ সালে আমেরিকায় বায়োমেডিক্যাল সাইন্স-এ গবেষণা করার জন্য ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়া, লস এঞ্জেলেসে এসে যোগদান করেন, তারপর ২০০৯ সালে ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানে চলে আসেন এবং দীর্ঘদিন সেখানেই গবেষণা করেছেন। বর্তমানে মিশিগানের একটি হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। বাংলায় লেখালিখির নেশা। প্রথম বই 'সেরেঙ্গেটির চোরাশিকারি' ২০২৪-এর বই মেলায় প্রকাশ পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *