আরে, পেয়ারে পেয়ারে...
কয়েক বছর ধরে জীবনটা একেবারে আলুনি হয়ে গিয়েছিল সুবর্ণার। চাকরি আর বাড়ি, বাড়ি আর চাকরি। থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়। আট বছর আগে তার ম্যাদামারা স্বামী সৌম্য বদলি হয়ে ভুবনেশ্বর চলে যাওয়াতে প্রথম প্রথম জীবন খানিক উজ্জ্বল হয়েছিল বটে, কিন্তু কয়েকবার পচা শামুকে পা কেটে সে নাক কান মুলে প্রতিজ্ঞা করে, ওই দামড়া বিবাহিত পুরুষদের সঙ্গে সে কিছুতেই আর পরকীয়ায় জড়াবে না। কিছুতেই না। মেয়েকে বড় করে তারপর দেখা যাবে। মেয়ে খানিক বড় হল, বেশ লায়েক হল। কিন্তু এই মাঝ চল্লিশে এসেও এমন দুর্বার গতিবেগে জীবন বয়ে যাবে সে কি ভাবতে পেরেছিল? হ্যাঁ, তাকে দেখতে ভারী ভাল লাগে এটা ঠিক, পাঁচ ফুট ছয়ের সটান শরীর আর দুধে আলতা গায়ের রং দেখলেই যে কেউ ফিরে তাকাতে বাধ্য। তারপর ভাল করে মুখের দিকে তাকালেই, হয়ে গেল…। ঘন কাজল পরা বড় বড় চোখ ভাসিয়ে প্রকৃতিদত্ত ঈষৎ পুরু ঠোঁট কামড়ে একবার তাকালেই পুরুষের হৃদয়ে ঝড় উঠতে বাধ্য।
আসলে কিনা সুবর্ণার বন্ধু বান্ধব আছে বটে , কিন্তু তারা চাকরি বাকরি কিংবা ঘর সংসারের বাইরেও ইদানীং খুব ব্যস্ত। চল্লিশ পেরোবার পর সবাই নিজেদের শখের কথা ভাবছে। কেউ কেউ অফিসিয়াল নাইটি কাকিমা হয়ে গিয়ে ভ্লগ করছে, কেউ বা একটার পর একটা পরকীয়া করে জীবনের নিগূঢ় অর্থ খোঁজার চেষ্টায় ব্যস্ত। এমনকি পাতি গৃহবধূ পর্ণাকে আজকাল ফোন করলেই বলে, “আমি ফেসবুকে কাজ করি ভাই! আমার সময় কোথায়?” সময় আর কোথায়! সারাদিন নোটি পাঠায়, প্লিজ ফলো অমুক তমুক, প্লিজ ফলো সাদ্দাম হোসেন, প্লিজ ফলো বিন লাদেন টু, প্লিজ ফলো ফুলু মিঁয়া। কী যে যন্ত্রণা! আপনি ফলো পায় না আবার শঙ্করাকে ডাকে! ওদিকে মেহুলী তার ইয়ং বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে হুটহাট রিসর্টে বেড়াতে চলে যায়, ঠিক সেই সময় ওর দুই সদ্য যুবতী মেয়ে তাদের বয়ফ্রেন্ডদের সঙ্গে উধাও হয়, আর তাদের বাবাকে গুবলু দেওয়া হয় যে সকলে সমবেতভাবে মামাবাড়ি যাওয়া হচ্ছে। মামাটিও সরেস, বোন আর বদের বাসা বোনঝিগুলোর ঢাল হয়ে অ্যালিবি তৈরি করে চলে। সবখানে সেটিং মাইরি! লোকে শুধু কেন্দ্র- রাজ্য দেখে! মেহুলির বর এদিকে পয়সা কামাতে ব্যস্ত! চোখ তুলে তাকানোর টাইম নেই! শুভেচ্ছা তার নিজের নামটিকে নিয়ে আজকাল একটু সংকুচিত থাকে। কথায় কথায় মানুষ তাকে জানিয়ে দেয়। মানে সর্বত্র খালি ,”শুভেচ্ছা জানাই!” কিন্তু মা গো মা! সে পর্যন্ত একটি খাদ্যরসিক বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে ফেলেছে। দুপুরবেলায় বর অফিসে গেলেই সে মাল টুক করে চলে আসে। শুভেচ্ছা তাকে চুনো মাছের চচ্চড়ি করে খাওয়ায়। এটা শোনার পর সংহিতা বলেছে, “না ভাই! আমি ওই কুট্টি কুট্টি মাছ কেটে রান্না করতেও চাই না, পরকীয়া করতেও চাই না। আমি পারব না চোখের এত পেইন নিতে।”
সুবর্ণার মেয়ে এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। এখন সে বোদ্ধা হয়ে গেছে, তাই মায়ের সঙ্গে বিশেষ ভাটায় না। আজকাল ছুটিতে বাবার কাছে ভুবনেশ্বর ঘুরতে যায়। বাবা এখানে এলে বাবার কাছ থেকে এটা ওটা বাগানোর চেষ্টা চালায়, এদিকে বাপ ম্যাদামারা হলে কী হবে, কিপটের হদ্দ! ওয়ান পাইস ফাদার মাদার! সুবর্ণার কাছেই মেয়ের শুধু এটা কিনে দাও, ওটা কিনে দাও আবদার। কী খাঁই রে ভাই! এত পারা যায় নাকি! এই বয়সে তারা ছিল ল্যাদবেদে মায়ায় ভরা! সকলের দুঃখে চোখে জল চলে আসত। ভাবলেই এখন বিরক্ত লাগে তার, আফসোস হয়! এই বিরক্তি অথবা আফসোস থেকেই নাকি কে জানে ছুৎমার্গ ছুঁড়ে ফেলে একসময় সে ফেসবুকে কমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে মেসেঞ্জারে গল্প করতে শুরু করে টুকটাক। সৌহার্দ্য অসম্ভব ভদ্র ছেলে! কোথা থেকে ফ্রেন্ডলিস্টে এল জানা নেই। সাজেশন এসেছিল।
বয়সটা তার থেকে অনেকটাই কম। মানে খুবই আর কী! ভদ্র ভাষায় আলাপ থেকে ওই ইন্টুসিন্টু কথাগুলোর দিকে যেতে খানিক সময় নিয়েছিল, মানে ওই মাস দুইখানেক নিয়েছিল আর কী। দামড়াগুলোতো আলাপের দুই ঘণ্টা পরেই চুদুর বুদুর শুরু করে দেয়। তারপর মেসেজ পাঠায়, “dakha karba?” ওই মুরাদ টাকলায় মাত্রাহীন টেকো মেসেজ দেখলেই গা পিত্তি জ্বলে ওঠে তার। এখন তো হোয়াতে পর্যন্ত এসে গেছে সেই ছেলে। মানে মেসেঞ্জার থেকে হোয়াতে। সৌহার্দ্য থেকে সোহার্ড! অনেকটা সময় ধরে আর কী! ছ’মাসের মধ্যেই ওয়োতে বার সাতেক সো হার্ড ধস্তাধস্তিও হয়ে গেছে। উফ! সো ইয়ং ব্লাডের হার্ডনেসই আলাদা!
তারপর একদিন কী কেলো! সাউথ সিটি মলে নারিস বলে একটা বার আছে, সেখানে দোঁহায় মিলে মাল খেতে গিয়ে কী ছড়াছড়ি অবস্থা! বারের উত্তরমুখী দেওয়ালের বড় স্ক্রিনে তখন গান হচ্ছে, বেলা চাও, বেলা চাও…, সৌহার্দ্য হঠাৎ হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করল। না কী এটা তার প্রাক্তন প্রেমিকার প্রিয় গান! তারপর সুবর্ণাকে জড়িয়ে ধরে আরো একপ্রস্থ কান্না। বার থেকে বেরিয়ে সোয়ারভস্কিতে টানতে টানতে নিয়ে গেল সুবর্ণাকে। একটা সোয়ান লকেট কিনে গলায় পরিয়ে দিল। পরিয়ে বলল, “সে চেয়েছিল এত করে, আমি দিতে পারিনি। তাই ছেড়ে চলে গেল! তোমাকে এটা দিলাম, পছন্দ না হলে ভাসিয়ে দিও জলে।” চোখদুটি তখনও লাল সে ছেলের। সুবর্ণা ভারী অস্বস্তি বোধ করছিল। কারোর থেকে দামি উপহার নিতে তার ভারী মানে বাধে। সে বড় বাপের ছেলে হলেও বা কী! তার চেয়ে ওয়োতে গেলে কাজের কাজ হত। এগনি আন্ট প্রেমিকা হয়ে কাজ নেই বাবা! লকেটটা তারপর ড্রেসিং টেবিলে পড়েছিল, মনে মনে ভাবছিল সে পরবে মাঝেসাঝে।
এরপর যা হল! একদিন অফিস থেকে ফিরে মেয়ের ঘরে তার দুই বন্ধুকে কফি দিতে গিয়ে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে সুবর্ণার কানে এল মেয়ে বলছে, “এই দেখ, এই সোয়ারভস্কির এই রাজহাঁস কানের দুলটা বাগিয়েছি। মালটা এত বড়লোকের ছেলে। তাও পয়সা বার করল না! এত করে চাইলাম! এইবার তো খোদ বড়লোকই… হে হে…”
মেয়ের এক বন্ধু বলল, “দিল না যখন তখনই নিশ্চয়ই তুই প্রতিজ্ঞা করলি যে তুই ওটা আদায় করবিই। যার থেকেই হোক। আচ্ছা, তখনও কি তুই জানতিস যে তোর সুগার ড্যাডি প্রেমিক সৌরভ মজুমদার আসলে সৌহার্দ্যের বাবা!
মেয়ে অমনি বলল, “প্রথমে জানতাম তো না। ওর বাড়িতে ফিটফাট আর হ্যান্ডু লোকটাকে দেখে ভাবতাম ওর কাকা বা মামা হবে। বুড়োর নজর ভাল, কচির দিকে। আমাকে ঠিক মেপে নিয়েছে। একদিন কলেজ থেকে ফিরছি, রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে লিফট দিল। তখন জানলাম। যাকগে! ভালই হল, ও দেয়নি, ওর বাপ দিয়েছে। মায়ের কাছে সেম সোয়ানের এই লকেটটা দেখলাম, এইটার সঙ্গে পেয়ার করে পরব ভাবছি। দেখ, কী সুন্দর দেখতে দুটোই! কানের দুল আর লকেট! টু গুড! হয় দুল নয় লকেট যে কোনও একটা চেয়েছিলাম, ভগবান পুরো সেট জুটিয়ে দিল। মা আর আমি দুজনেই পরতে পারব, বল…”
দরজার এ পাশ থেকে তখন একটা আওয়াজ এল। সুবর্ণার হাত থেকে তখন কফির কাপ আর ট্রে পড়ে চুরমার…
2 Comments