পড়শী-পুরাণ

পড়শী-পুরাণ

কিছু কিছু মানুষের স্বভাব জন্ম হইতেই ত্রুটিপূর্ণ।  ইহারা কাহাকেও কোনও অবস্থাতেই না-বলিতে পারে না। হয়তো ইহাদের চক্ষুলজ্জাও অন্যদের তুলনায় কিঞ্চিৎ বেশি। সত্য কথা বলিতে কী ইহারা যে খুব ভালোমানুষ এমনটাও নহে, হয়তো বা ইহারা সর্বজনপ্রিয় হইবার জন্য লালায়িত।   

স্বভাবের এই ত্রুটির কথা আবার চাপিয়া রাখা যায় না। গন্ধগোকুল যেমন তার গায়ের গন্ধ লুকাইতে পারে না ঠিক তেমনি যাঁহারা অতিরিক্ত চক্ষুলজ্জায় ভোগেন তাঁহাদের স্বভাবের কথাও লুকাইয়া রাখা যায় না। ধীরে ধীরে নিকটজন হইতে পরস্য পরের কর্ণগোচর হইয়া যায় এবং তাহার পর সকলে মিলিয়া তাঁহাদের মস্তকে পনস বা কন্টকি ফলটি ভাঙিয়া খায়।

আমার চরিত্রের প্রধান দুইটি দুর্বলতা হইল অযাচিতভাবে অন্যের উপকার করিবার চেষ্টা এবং কাহাকেও  মুখের উপর না-বলিতে পারার অক্ষমতা। উদাহরণস্বরূপ কিছু ঘটনা বলিতে ইচ্ছা করিতেছি! 

কয়েকদিন পূর্বে আমার  প্রতিবেশিনী উত্তর ভারতীয় যুবতী শেফালী গর্গ আসিয়া আমাকে সুমিষ্ট স্বরে বলিয়াছিল, 

“ভাবি, মুঝে আপসে এক ফেভার চাহিয়ে!” 

আমার এই প্রতিবেশিনীটিকে আমি রীতিমতো সমীহ করিয়া চলি। অন্যকে দিয়া উটপটাং কাজকর্ম করাইতে ইহার জুড়ি মেলা ভার। 

চিন্টু শেফালীর একমাত্র পুত্র। কয়েক মাস পূর্বে শেফালী ভালোমানুষ সাজিয়া আসিয়া আমাকে বলিয়াছিল, “চিন্টুর পাপা ট্যুরে গেছে আর আজই চিন্টুর স্কুল রিলেটিভ ডে। আমার তো কোনও আত্মীয় এখানে থাকে না, চিন্টুর পাপা আমাকে ফোনে বলল যে আমি যেন আপনাকে এসে বলি! এই প্রবাসে আপনিই তো আমাদের সত্যিকারের রিলেটিভ।”

অতএব স্বজন প্রমাণ করিতে শেফালীর পিছন পিছন আমিও গিয়াছিলাম চিন্টুর প্লে স্কুলে। স্কুলের সম্মুখে রঙিন ব্যানারে যাহা লিখা ছিল তাহা দেখিয়া আমার হৃৎকম্প শুরু  হইয়া গিয়াছিল। বড় বড় অভ্র খচিত অক্ষরে ‘গ্র্যান্ড পেরেন্টস ডে’ দেখিয়া কম্পিত হৃদয়ে আমি শেফালীকে বলিয়াছিলাম,  “হ্যাঁরে, বয়েস হলেও চিন্টুর ঠাকুমা দিম্মা সাজাটা বাড়াবাড়ি রকমের মিথ্যে কথা হয়ে যাবে না? এরা কী বলবে?  একটা বুর্খা কি নিদেনপক্ষে শাড়ির ঘোমটা দিতে পারলেও ম্যানেজ করা যেত। “

শেফালী এইসব অবান্তর প্রলাপ ফুৎকারে উড়াইয়া  দিয়া উত্তর দিয়াছিল,–  ” ছোড়িয়ে ভাবি!  ইঁহা আধারকার্ড কৌন মাঁঙ্গেগা! “

তথাপি আমার ভয় লাগিতেছিল। লক্ষ করিলাম, চিন্টুর প্লে স্কুলের প্রোপ্রাইট্রেস কাম প্রিন্সিপাল আকৃতিতে মহিলা গামা পালোয়ানের সমান। নিজের কর্কশ কন্ঠস্বরকে যতদূর সম্ভব মিহি করিয়া তিনি আমাদের অভ্যর্থনা করিয়াছিলেন, “হেঃ হেঃ, মিসেস গর্গ ইউ আর লেট বাই হাফ অ্যান আওয়ার।” শেফালিকাও প্রত্যুত্তরে খানিক ক্ষীণ হাসিয়া আমাকে বলিয়াছিল, “যাইয়ে ভাবি, আপনি ভিতরে যান। চিন্টু ওখানে আছে।”

আমি খানিকটা অস্বস্তি, খানিকটা নকল দিম্মা ঠাম্মা সাজিবার ভয়ে মিনমিন করিয়া বলিয়াছিলাম, “তুই যাবিনে অন্দরে?” 

সঙ্গে সঙ্গে প্রবল কাংসনিন্দিত কণ্ঠ কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল, “নহী আজ আপলোগোঁকো দিন হ্যায়, আপ অন্দর যাও, উঁহা খেল হোগা।”

বলিয়া লেডি গামা আমাকে ভিতরে লইয়া যাইলেন। চিন্টু থুড়ি দেবাংশ আমাকে দেখিয়া রুষ্ট হইয়া চিৎকার আরম্ভ করিল, “তুম কিঁউ আয়ী, মামাকো বুলাও।” ইতিমধ্যে চিন্টুর এক শিক্ষিকা আসিয়া আমাদের বলিয়াছিলেন, কিছু গেম খেলিতে হইবে, ফার্স্ট রাউন্ডে মুকুট মেকিং। ছুরি, কাঁচি, সেলোটেপ, রঙিন কাগজ, শলমা জরি ইত্যাদি সামগ্রী প্রচুর পরিমাণে টেবিলে উপর রাখা ছিল।  

কাগজের মুকুট বানাইতে হইবে। 

প্রবেশিকা পরীক্ষায় সিলেবাসের বাহিরে প্রশ্নপত্র আসিলে পার্শ্ববর্তী সহপাঠীর উত্তরপত্র নকল করিবার প্রচেষ্টার সদৃশ আমিও অর্ধেক নয়নে বিভিন্ন দিকে তাকাইয়া আপ্রাণ চেষ্টা চালাইয়াছিলাম, কিন্তু শিল্পকলায় চিরকালই অদক্ষ তাই টুকলি করিয়াও যাহা বানাইয়াছিলাম তাহা চিন্টুবাবার পছন্দ হয় নাই। সে এখনো শিশু, মায়ের ন্যায় মিশ্রির ছুরিকা হইতে তাহার এখনো অনেক দেরি, আমার অক্ষম প্রচেষ্টা দেখিয়া বালক ক্রোধে রক্তবর্ণ হইয়া  চিৎকার করিয়াতাহার মাকে ডাকাডাকি করিতে লাগিল।

বহুবার চেষ্টা করিয়াও একটিও ভদ্রস্থ মুকুট আমি বানাইতে পারি নাই। ততক্ষণে প্রায় সব শিশুর দিদিমা ঠাকুরমারা সুদৃশ্য মুকুট বানাইয়া নিজ নিজ নাতি বা নাতিনীর সহিত আলোকচিত্র তুলিয়া হইতে বিদায় লইয়াছেন। অতঃপর আমি কুবুদ্ধি কাজে লাগাইয়া টেবিল হইতে সবার অগোচরে একটা সুদৃশ্য মুকুট তুলিয়া চিন্টুর মস্তকে পরাইয়া দিলাম। ‘চুরিবিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা ‘ আমার হাত সাফাই বিশেষ কেহ লক্ষ্য করে নাই।  মুকুট পরিহিত চিত্র বিদ্যালয়ের ফেসবুক পেইজে ছাপা হইবে সেইকারণে ছবিও তুলিতেই হইবে। এইসব করিয়া বাহিরে আসিয়া দেখি  শেফালী পলায়ন করিয়াছে।  মেসেজ পাঠাইয়াছে “ভাবি, ম্যায় খতম হোনে তক গাড়ি লেকে আ যাঁউঙ্গি আউর দের হোনে সে আপ এক অটো লেকে চলে আনা।” বুঝিতে পারিলাম যে সবই পূর্বপরিকল্পিত।

অতঃপর  দুই ঘন্টা ধরিয়া  চিন্টুর পিতামহী বা মাতামহী  হইবার  মাশুল হিসেবে নানাপ্রকার  অত্যাচার সহিতে হইল। বাচ্চাকে  সঙ্গে লইয়া  নানারকম গেমস খেলিতে হইল। খেলাধুলার পরে শুরু হইল দাদু দিদাদের নাচ-গানের আসর।  আমি চমৎকৃত  হইয়া দেখিয়াছিলাম  পঞ্চাশ ষাটের বুড়ো বুড়িরা হাত-পা ছুঁড়িয়া কী সাঙ্ঘাতিক  উদ্দাম নৃত্য করিতে পারেন। 

এতদিন শুনিয়াছিলাম উত্তর ভারতের লোকজন নাচা-গানায় এক্সপার্ট, এবার তাহা প্রত্যক্ষ দেখিয়া শঙ্কিত হইয়া ভাবিয়াছিলাম ইহাদের একজনও যদি নৃত্যরত অবস্থায় আমার পা মাড়াইয়া  দেয় তাহা হইলে দুর্দশার অন্ত থাকিবে না। ভয়ে ভয়ে নৃত্যরত দাদু-দিদাদের সঙ্গে ব্যবধান রাখিয়া আমি ডান্সফ্লোরের এক প্রান্তে চিন্টুর সহিত নাচের অভিনয় করিয়াছিলাম।

স্কুলের হলঘরে অনুষ্ঠানের  আয়োজন করা হইয়াছিল। ক্রমাগত মানুষজনের আসাযাওয়া লাগিয়াই রহিয়াছে বলিয়া ঘরের দরজা খোলা, ফলত এসিও বন্ধ।  গরমে তিন ঘন্টা সিদ্ধ হইয়া বাহিরে আসিয়া দেখি যথারীতি  শেফালী আসে নাই। আমার অবশ্য সন্দেহ ছিলই যে ও আসিবে না। চিন্টুকে লইয়া একটি ই রিক্সা ভাড়া করিয়া ঘরে ফিরিয়া দেখি শেফালী দরজা বন্ধ করিয়া নিদ্রা দিতেছে। বারংবার ডোরবেল বাজাইবার পর নিদ্রায় চক্ষু বোয়াল মাছের মত লাল শেফালী দরওজা খুলিয়া  আমার প্রতি  সপ্রতিভ হাসি হাসিয়া বলিয়াছিল  “সরি ভাবি, বহুৎ শরদর্দ হো রহা থা। ইসলিয়ে যা নহী পায়ে।” 

 উপরোক্ত ঘটনাই নয়, আরও বহুবার শেফালী আমাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলিয়াছে। শেষ পর্যন্ত আমি উহার সহিত দূরত্ব রাখিব বলিয়া  মনে মনে স্থির করিয়াছিলাম কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাইত যে ও কিছু বলিলেই আমি তাহা পালন করিতে চাহিতাম। 

এইবারও তাহাই হইল, শেফালী ফেভার চাহিবামাত্র আমার  ভিতরকার লুক্কায়িত স্বভাবটি তৎক্ষণাৎ উপকার করিবার জন্য লালায়িত হইয়া উঠিল। নিজেই অবাক হইয়া দেখিলাম যে আমি সাগ্রহে  বলিতেছি, “সিওর সিওর, সার্টেনলি, সার্টেনলি। আমার ক্ষমতায় কুলাইলে আমি নিশ্চয়ই সেটা করব।”

শেফালিকা  আমার প্রতি শিশুর মতো অবোধ, সরল দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিয়া উঠিল,”ভাবি, আগে আমার একটা প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দাও দিকি!” 

এ আবার কী আবদার ! 

মধ্য বয়েসে আসিয়া আবার ভাইভায় বসিতে হইবে নাকি! স্কুল কলেজে ভাইভার নামে আমার গাত্রে জ্বর আসিত। ভাইভার সময় বদনকান্তিকে বেচারাথেরিয়ামের মতো করিয়া এক্সামিনারের প্রতি ছাগশিশুর ন্যায় এমন করুণ চক্ষে তাকাইতাম যে একদম পাষাণ হৃদয় না হইলে আমাকে তিনি অপেক্ষাকৃত সহজ সরল প্রশ্নই  করিতেন কিন্তু শেফালী আমার করুণ দৃষ্টিকে উপেক্ষা করিয়া প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিল, “বোলিয়ে ভাবি ইউ পি কা সিগনেচার ডিশ ক্যায়া হ্যাঁয়? 

এ তো সোজা প্রশ্ন! একগাল হাসিয়া উত্তর দিলাম, “এ তো সব্বাই জানে। লক্ষ্ণৌ ঘরানার কাবাব আর বিরিয়ানির কথা সারা ভারতের মানুষ জানে!”

শেফালী আমার উত্তর শুনিয়া তাহার সুন্দর বদনশশীকে কুঞ্চিত করিয়া বলিয়া উঠিল, “আপ বিলকুল আপডেট নহী হো! ওই জমানা আর নেই! আজকাল সব স্টেটে আলাদা আলাদা  ধরনের বিরিয়ানি তৈরি হয়। আর আমি ননভেজ খাবারের কথা জিজ্ঞেস করিনি, শুদ্ধ শাকাহারী খাবারের কথা জিজ্ঞেস করেছি। হর স্টেট মেঁ কুছ সিগনেচার ডিশ হোতা হ্যায় জ্যায়সে বাঙ্গাল কী শুক্তো,  মিষ্টি দই, রসগুল্লা। বিহার কী লিটঠি্  চোখা, ওড়িশাকা ছানা পোড়ে। ইউ পি কা অ্যায়সা কুছ হ্যায়?”

সবিনয়ে স্বীকার করিতেই হইল — আমার জ্ঞানের ভাণ্ডার সীমিত। 

আমাকে ফার্স্ট রাউন্ডে পরাভূত করিতে পারিয়া শেফালীর মেজাজ ততক্ষণে শরীফ হইয়া উঠিয়াছে। সে আমার প্রতি তিরছি নজর হানিয়া বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ নাড়িয়া  উত্তর দিল, “কুছ নহী, এয়স্যা কুছ ভী নহী হ্যায়!” 

শেফালী গোবলয়ে জন্মিয়াছে, গোবলয়ের একনিষ্ঠ সমর্থক হইয়াও সে যখন নিজ জন্মস্থানের নিন্দা করিতেছে যখন, তখন তাহার পশ্চাতে লুক্কায়িত অভিসন্ধিটি গুরুতরই হইবে বুঝিতে আমার বিলম্ব হইল না। শঙ্কিত হইয়া কোনও প্রকারে চিঁ চিঁ করিয়া বলিলাম, “ও তো ঠিক হ্যায়  কিন্তু তুমি যে অন্য কিছু বলতে এসেছিলে।”

শেফালী সুযোগ পাইয়া ভূমিকা বানাইল, “ভাবি, আপ তো মেরে লেডিস গ্যাং কো জানতি হো?” 

মনে মনে বলিলাম, ‘তা আবার জানি নে!’ 

 স্বামী পুত্র ঘর হইতে বাহির হইবার পর শেফালী সাজগোছ করিয়া টো টো কোম্পানি হইয়া ঘুরিতে বাহির হয়। উত্তর প্রদেশের আটচল্লিশ ডিগ্রির লু প্রবাহও তাহাকে প্রতিহত করিতে পারে না। স্কিন হাগিং লো ওয়েস্ট জিনস আর শর্ট ক্রপ টপ পরিহিতা শেফালীকে পিছন হইতে কুড়ির ছুকরিরর মতো লাগে। তাহার অজস্র বান্ধবী আর প্রায় প্রতিদিনই কিটি পার্টি লাগিয়াই থাকে। 

মুখে বলিলাম, “হাঁ জানতি হুঁ!” 

শেফালী উৎসাহ পাইয়া সোফায় গ্যাঁট হইয়া বসিয়া সবিস্তারে বলিল যে তাহাদের লেডিস ক্লাবে প্রায়ই নতুন নতুন ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে নানা প্রদেশের রান্নার ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হইতেছে। সকলে আপন আপন রন্ধন শৈলী প্রদর্শিত করিয়া অন্যান্য সদস্যাদের চমৎকৃত করিতে কোমর কষিয়া লাগিয়াছে। বেচারি শেফালীর আপন প্রদেশের জনপ্রিয় রন্ধন রাজমা চাউল ঘরে ঘরে প্রতিদিনই তৈয়ারি হয় তাই সে ক্লাবের সদস্যাদের কাছে বড় মুখ করিয়া বলিয়া আসিয়াছে সে বাঙালি খানা বানাইবে যাহা সে তাহার বাঙালিন প্রতিবেশিনীর কাছ হইতে শিখিয়াছে। বাঙালি খানার মতো এতো সুস্বাদু রান্না ভারতে বিরল। এক শুক্তো যাহা কিনা অ্যাপেটাইজারের কাজ করে তাহাতেই পাঁচ ছয় রকম বৈচিত্র্য আনা সম্ভব। আরও যেসব বাঙালি খানা আছে সেসকলও অপূর্ব বলিলে কম বলা হইবে, দেবভোগ্য বলাই বিধেয়। শুনিতে শুনিতে ভাবিতেছিলাম, “মেরে বিল্লি, মুঝেই ম্যাঁও!” কয়েক দিবস পূর্বেই আমিই বাংলার রন্ধন শৈলী সম্বন্ধে এইসব জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করিয়াছিলাম।  

আমাকে ঠিক দোষ দেওয়াও যায় না। শেফালী  কথায় কথায় বলিয়াছিল যে আমার পাকশালা হইতে জিহবা রসসিক্ত হইবার মতো অতীব সুগন্ধ প্রায়শই নির্গত হয়। ইহা শুনিয়া আমার পূর্ব স্মৃতি মনে পড়িয়া হৃদয় আলোড়িত হইয়া উঠিয়াছিল। ঘটনাটি এইরূপ, আমার পিতৃগৃহের প্রতিবেশিনীরা আমাকে  বলিয়াছিলেন যে আমার দিদিমার রন্ধনের সুবাস লইবার জন্য রন্ধনের সময় তাঁহারা পাকশালার নিকটতম কক্ষে আসিয়া বসিয়া থাকিতেন। সেই স্মৃতি মনে পড়িয়া আমি বাঙালি রন্ধন শৈলী সম্পর্কে উহাকে কিছু জ্ঞান দিয়াছিলাম। 

শেফালী বলিতে লাগিল বাঙালি খানার যশোগাথা শুনিয়া তাহার বান্ধবীর দল অত্যন্ত আগ্রহী। তাহারা সদলবলে আসিতেছে বাঙালি খানা আস্বাদন করিতে অতএব শেফালীকে এই বিপদ সমুদ্র হইতে বাঁচাইবার ভার আমাকেই লইতে হইবে। রাঁধিতে আমার কখনো কখনো ভালো লাগিলেও সবসময় রন্ধনশালায় ঢুকিতে ইচ্ছা হয় না। সেই কথা বলিয়া পাশ কাটাইতে চাহি কিন্তু ভবি ভুলিবার নহে। শেফালী তেজোদীপ্ত স্বরে বলিতে লাগিল বাঙালি খানার নিন্দা হইলে তাহা আমার পক্ষেও অমর্যাদাকর হইবে। 

ম্রিয়মাণ হইয়া ভাবিতেছিলাম প্রতিবারই আমার সহিত এইরূপ ঘটনা কেন ঘটে! বাঙালি রান্নার গৌরবময় ইতিহাস রক্ষার ভার কি একা আমারই স্কন্ধের উপর আরোপিত! আমি হারা বংশী কুম্ভ নই, অতি সাধারণ একজন বাঙালি রমণী কিন্তু প্রায়ই এইরূপ দায় আমার উপর আসিয়া বর্তায়। 

বিবাহের পর যে আধা জংলা পরিবেশে আমি থাকিতাম সেইখানেও এইরূপ ঘটনা ঘটিয়াছিল। আমার পার্শ্ববর্তী বাংলোটিতে অন্ধ্র প্রদেশীয় প্ল্যান্ট ম্যানেজার দানাইয়া থাকিতেন। তিনি স্যুটেড বুটেড হইলেও তাঁহার পিতা ছিলেন অন্ধ্রের একজন কৃষক যিনি ধুতিকে লুঙ্গির মতো পরিধান করেন। দানাইয়ার বাংলোর পশ্চাতের জমিতে প্রচুর কলাগাছ। উহারা থোড়, মোচা যে খাদ্যদ্রব্য তাহাই জানিত না। আমি আগ্রহ প্রকাশ করায় আমাকে একটি মোচা দিয়াছিল । রন্ধনের পরে এক বাটি মোচার ঘন্ট উহাদের দিয়াছিলাম। মোচার ঘন্ট  উহাদের এতটাই পছন্দ হইয়াছিল যে তাহার পর হইতে মোচা হইলেই উহারা সেটিকে আমার গৃহে চালান করিতেন। একবার দানাইয়া সস্ত্রীক কোথাও গিয়াছেন কিন্তু দানাইয়ার পিতা গৃহেই ছিলেন। তিনি আমাকে দুইটি মোচা দেওয়ায় আমি রন্ধন করিয়া আরও কিছু অবাঙালি গৃহে পাঠাইয়াছিলাম। পরের দিন দানাইয়ার পিতা আসিয়া উপস্থিত। তিনি ঠেঁট তেলেগু ছাড়া অন্য ভাষা জানেন না। সেই ভাষা এবং হাত পা নাড়িয়া তিনি যা বলিলেন তাহার সঠিক অর্থ না বুঝিতে পারিলেও আমার বোধগম্য হইয়াছিল। তাঁহার সোজা হিসাব একটি মোচায় এক বাটি ঘন্ট হইলে দুইটি মোচায় দুই বাটি প্রাপ্য হয়। তিনি তাই আর এক বাটি লইতে আসিয়াছেন। সেদিন মর্মান্তিক লজ্জিত হইয়া শপথ লইয়াছিলাম যে আরও কখনো কাহাকেও রন্ধন শৈলী দেখাইতে যাইবো না কিন্তু শেফালীর বাকচাতুর্যে আমি পুনরায় ফাঁদে পা দিয়া ফেলিলাম। 

তবুও প্রাণপণে চেষ্টা করিয়াছিলাম যাহাতে খানিকটা হইলেও দায়িত্ব উহার স্কন্ধে আরোপ করা যায়। বলিয়াছিলাম, সব প্রক্রিয়া লিখিয়া দিতেছি। প্রয়োজন পড়িলে পাশাপাশি ফ্ল্যাট, গিয়া দিখাইয়া দিতে অসুবিধা হইবে না। শেফালী চতুর খেলোয়াড়দের মতন আমাকে ডজ করিয়া বাহির হইয়া গেল। মুখে বলিল, “ভাবি কাউকে খেতে ডেকে এক্সপেরিমেন্ট করাটা সমঝদারি কী বাত নহী। খারাপ হলে বেঙ্গলি ক্যুজিনেরই বদনাম হবে। চিন্তা করো না, আমি হেল্প করে  দেব। 

অতঃপর পেন আর নোটবুক লইয়া শেফালী মেনু সেটিং করিতে বসিল। উত্তর ভারত সুগন্ধি বাসমতী চালের জন্য বিখ্যাত। সাদা চাউল, সুক্তানি, নারিকেল দিয়া ছোলার ডাল, বেগুনি,  স্টাফড পরওল ( পটলের দোলমা), ছানার ডালনা ( নিরামিষ রান্না যাহা ছাড়া অপূর্ণ বলিয়া মনে হয়), আমের  চাটনি। শেফালী অভয় দিয়া কহিল, “চিন্তা মত করো। চাউল আর  বেগুনি ম্যাঁয় কর লুঙ্গি। আপ ডেজার্ট মেঁ কেয়া বানাওগে?“ 

 এইসকল রাঁধিতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত হইয়া যাইবে। ইহার উপর আবার ডেসার্ট?  

মুখে বলিলাম, “পায়েস বানাব।“ 

“না, না,  প্লেন ক্ষীর আচ্ছা নহী লাগেগা। ম্যাঙ্গো ফিরনি বানাও আর মকরের সময় যেটা বানিয়েছিলে ওটা খুব ভালো হবে।” 

কী বানাইয়াছিলাম সত্যই তাহা স্মরণ নাই। 

আমি ভুলিলেও কমলী ভুলে নাই। তাই শেফালী বলিয়া উঠিল, “ওহি যো ফ্রায়েড সুইটস। ভিতর মেঁ নারিয়েল!”

বুঝিলাম গোকুল পিঠের কথা বলিতেছে।

রাগ চাপিয়া ফর্দ লিখিতে বসিলাম। লিস্ট তৈয়ারী হইলে শেফালী তাহার স্কুটিটি লইয়া বাহির হইয়া গেল। সে আমার মতো ঢ্যাঁড়স নহে, দ্বিচক্র চারিচক্র সবকিছু চালাইতে ওস্তাদ। অর্ধেক জিনিস না লইয়া ফিরিয়া আসিল। খোয়া ক্ষীর দুকান মেঁ মিলতা নহী। খোয়া আবার কবেইবা দোকানে পাওয়া যায়! 

কিটিপার্টি আর ফ্যাশন লইয়া মশগুল শেফালী এসকল খবর রাখে না। 

লিস্ট মোতাবেক অনেক কিছুই নাই । অতএব নিজ সঞ্চয় হইতে বাহির করিতেই হইল। পূর্ব দিন ম্যাঙ্গো ফিরনি আর গোকুল পিঠা বানাইতে গিয়া এতোই পরিশ্রান্ত হইয়া গিয়াছিলাম যে আমাদের রাত্রের খাবার অর্ডার দিতে হইল। 

পরের দিন মহারণ। শেফালী পটলের দানা বাহির করিতে জানে না বলিয়া কর্তাকে উলের কাঁটা ধরাইয়া দিলাম। এই কার্যটি এযাবৎ সেই করিয়া আসিতেছে এবং এই কার্যে  রীতিমতো বুৎপত্তি লাভ করিয়াছে। শুধু চা বিস্কুট খাইয়া সে অফিসের উদ্দেশ্যে বাহির হইয়া গেল। অন্য কোন দিকে তাকাইবার সময় নাই। বাঙলার রন্ধন শৈলীর ইজ্জত বলিয়া কথা। সমস্ত শেষ করিতে প্রায় দ্বিপ্রহর হইয়া গেল। যতক্ষণ আমি রাঁধিতেছিলাম ততক্ষণ শেফালী একটি চেয়ার টানিয়া বসিয়া মোবাইল লইয়া ব্যস্ত রহিল। সামান্য সাহায্যও করিল না। 

গরমে ঘর্মাক্ত শরীরে ততক্ষণে প্রচণ্ড বিরক্তি আসিয়াছে। রান্না হইবার পর বলিলাম, “সকল কিছু লইয়া এইবার আপন গৃহে প্রস্থান করো!”

শেফালী বলিল, “ভাবি এক চিজ আপ ভুল গয়ী। আমারও খেয়াল ছিল না।  ওয়েল কাম ড্রিংক কী হবে?” 

মেজাজ ততক্ষণে তিতকুটে হইয়া গিয়াছে। বলিলাম, “আম পোড়ার শরবত হইতে যেকোনো কোল্ড ড্রিংক দিয়া কাজ চালাইয়া লইয়ো। আমার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব নহে!”

শেফালী হাসি হাসি মুখে বলিল, “ভাবি লাস্ট ফেভার কর দিজিয়ে।  দেবদাসে ঐশ্বর্য রাই যেরকম বেঙ্গলি টাইপ কী  শাড়ি পরেছিল, আমাকেও ওইরকম পরিয়ে দেবে প্লিস!”  

দেড় দিন ধরিয়া আগুনের তাতে রান্না, বাড়ির অপর দুই সদস্যদের  বিদ্রুপ, নিজেকে ইউজড টু হইতে দিবার ক্ষোভ সব মিলিয়া মেজাজের পারা তখন সপ্তমে। তবু রাগ দমন করিয়া বলিলাম, “শাড়ি আজও ঠিকঠাক পরিতে পারি না। হয় তাহা লেহেঙ্গা নয় স্কার্ট হইয়া যায়। ইউ টিউবে শাড়ি পরিবার অনেক ভিডিও আছে, তাহা দেখিয়া পরিয়া লহ!”

সামান্য ক্ষুণ্ণ শেফালীকে উহার ঘর পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য পৌঁছাইতে সাহায্য করিয়া আসিয়া ঘর রুদ্ধ করিয়া শুইয়া পড়িলাম। কোনো কিছু মুখে দিবার ইচ্ছা ততক্ষণে চলিয়া গেছে। মনে মনে নিজের উপরই প্রচণ্ড ক্ষোভ হইতেছিল। ভাবিতেছিলাম মুখ দেখিলেই কি মানুষ বুঝিতে পারে ইহাকে দিয়া যাহা ইচ্ছা তাহা করাইয়া লওয়া যায়!  

 

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Mohammad Kazi Mamun , October 18, 2022 @ 6:38 pm

    পুরো লেখাটিতেই একটা হাসির হাওয়া ছিল, মানে, লেখক নিজে হাসেন না, কিন্তু পাঠককে হাসান প্রচুর।
    খুব খুব ভাল লাগলো, দিদি। শিখলাম, উপভোগ করলাম।

  • দেমলীনা দাস , October 19, 2022 @ 5:21 pm

    শুদ্ধ ভাষার ব্যবহার লেখাটিকে আরও সম্ভ্রান্ত করে দিল

Leave a Reply to Mohammad Kazi Mamun Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *