সরল কথা

সরল কথা

প্রতিমাসে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে টাকা তোলার দিন মিনতি সব কাজের বাড়িতে বলে রাখে, যে সেদিন সে কাজ সেরে তাড়াতাড়ি বেরোবে। মিনতির মত এমন হাজারো দরিদ্র মহিলা রাজ্য সরকারের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের ৫০০ টাকা অনুদানের অপেক্ষায় থাকে।

লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের প্রকল্প শুরু করেন সরলা দেবী ১৯০৪ সালে। যদিও তার উদ্দেশ্য ভিন্ন ছিল। তৎকালীন বাংলার মহিলাদের হস্তশিল্পে উজ্জীবিত করতে ও বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলন সফল করার জন্য ও স্বদেশী জিনিসের ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য কলকাতার বউবাজার অঞ্চলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার সংস্থা গড়ে তোলেন। শুধু তাই নয়, ১৯১০ সালে দুঃস্থ নারীদের অর্থ উপার্জনের জন্য ভারত স্ত্রী মহামণ্ডলও গঠিত হয় সরলা দেবীরই সচেষ্ট প্রয়াসে।
সেই সময় কালে যে মহিলা একক প্রচেষ্টায় ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে যে নির্ভীকতা, তেজদীপ্তির প্রদর্শন করেছিলেন, তার বড় হয়ে ওঠা যে কোনো সাধারণ পরিবারের ছত্রছায়ায় হয়নি তা তো বলাই বাহুল্য।

আত্মীয়তার সূত্রে তিনি ঠাকুর পরিবারের মেয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজা সাহিত্যিক স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সন্তান হলেন সরলা দেবী। ঠাকুর বাড়ির অন্য শিশুদের মতোই তার শৈশবকাল ঘটনা বহুল ও রঙিন ছিল। তবে পিতা ও মাতার দুই পরিবারের সংস্কৃতির বিস্তর বৈপরীত্যের দরুন শিশু সরলা দেবীর দ্বিধান্বিত মন দুলেছে সংশয়ের দোলাচলে।

কৃষ্ণনগরে ব্রাহ্মসমাজের স্থাপনকালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেখানকার জমিদার জয়চন্দ্র ঘোষালের সুপুরুষ, সুশিক্ষিত পুত্র জানকীনাথকে দেখে এতই পছন্দ হয় যে তিনি তার কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবীর সঙ্গে তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। জানকীনাথ বিবাহে মত দিলেও ঠাকুরবাড়ির নিয়ম অনুযায়ী ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণে ও শ্বশুর গৃহে থাকতে অসম্মত হলেন। দেবর্ষি এক বাক্যে তা মেনেও নিলেন।

ঠাকুরবাড়ির আঁতুড়ঘরে জন্ম নিলেও ও ঠাকুরবাড়ির অন্য সদ্যজাতদের ন্যায় জন্মকালে মাতৃস্তন্যের পরিবর্তে ধাত্রী স্তন্য পান করলেও পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত তাই ছোট্ট সরলা ঠাকুরবাড়ির সীমানার বাইরে মিনার্ভা থিয়েটারের পাশের গলিতে সিমলার বাড়িতে একটু একটু করে বড় হয়ে উঠছিলেন।
পিরালি ব্রাহ্মণ কন্যাকে বিয়ে করার অপরাধে তাঁর বাবা পিতামহ কর্তৃক ত্যাজ্য হন। তবে ক্ষণকাল পরেই পিতা পুত্রের বিরোধ কোন অজানা কারণে মিটে যায়।

ছোট থেকেই সরলা বুঝেছিলেন তাঁর মা ঠাকুরবাড়ির মেয়ে, তাই তিনি তাঁর জেঠিমাদের থেকে আলাদা। তিনি জেঠিমাদের মতো সরলাকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন না, আদর করেন না। কেবল এক মনে ঘরে বসে লিখে চলেন। তাই ছোট্ট সরলার মনে কিঞ্চিত ক্ষোভ ছিল। মায়ের স্নেহের পরশ পাবার আকন্ঠ তৃষ্ণা ছিল। তবে মনকে তিনি বুঝিয়েছিলেন, ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা বুঝি এমনই কঠোরপ্রাণা হয়। আদর,স্নেহের পরিবর্তে শাসনের ঘেরাটোপে যখন সরলার ছোট্ট মন হাঁপিয়ে উঠতো, সেসময় তাঁর দাদু জয়কৃষ্ণ ঘোষালের আগমন ঘটতো সিমলার বাড়িতে। দাদুর ‘দিদি’ ডাকটা যেন শীতের সকালের খেজুর রসের মতোই মিঠে ও মন ভোলানো। দমবন্ধ পরিবেশে যেন এক হিমেল হাওয়া বয়ে আনতেন তাঁর দাদু।
আরেকজন আসতেন, ত্রিপুরা স্টেটের ডাক্তার, তাঁর পিসেমশাই পরেশনাথ মুখোপাধ্যায়। যাঁর কাছে বালিকা সরলার হাতে খড়ি হয় ও একদিনেই বর্ণপরিচয়ের পাঠ শেষ হয়।

সিমলের বাড়িতে ঠাকুরবাড়ির আত্মীয়রা যখন আসতেন, তখন স্বর্ণর ঘরের বিশাল পালঙ্কে মজলিস বসত। সেখানে সরলার প্রবেশ মানা ছিল। এভাবেই তিনি সিমলের বাড়িতে মনের গোপন কোণে মায়ের প্রতি অভিমান লালন করে বড় হতে থাকেন।

তাঁর বাবার বিলেত যাওয়া স্থির হলে তাঁরা সিমলের বাড়ি ছেড়ে জোড়াসাঁকো অর্থাৎ তাঁর জন্মস্থানেই ফিরে আসেন। এ বাড়ি যেন এক রূপকথার বাড়ি। যেন এক বৃহদাকার বটবৃক্ষ, যার শাখায় শাখায় প্রতি মহলের ঘরে ঘরে ছেলে-মেয়ে, জামাই-বউ, নাতি নাতনি, দাস দাসীদের বাস। যে মহীরুহের ছায়ায় অহরহ চলছে সাহিত্য সংস্কৃতি, সংগীত চর্চা। এবাড়ির নিয়ম আর পাঁচটা সাধারণ বাড়ির মত নয়। এ বাড়ির সকলে চলে, ঘড়ির কাঁটার তালে পা মিলিয়ে।

বিশাল রান্নাঘরে ভোর হতেই দশ বারোজন বামুন ঠাকুর এই বৃহৎ পরিবারের উদারপূর্তির জন্য মহাযজ্ঞে নিয়োজিত হয়। রান্নাঘরের দুপাশের মেঝেতে ভাত ঢালা হয়। তারপর সেই ভাত ব্যঞ্জনাদি সহকারে পাথরের থালায় ঘরে ঘরে পরিবেশিত হয়।

ঘড়িতে সাতটার ঘন্টা বাজলে মহিলারা বিবাহকালে প্রাপ্ত চেলি পরে সকলে উপাসনা গৃহে উপস্থিত হন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে উপাসনা ও উপদেশে উপাসনালয় মন্দ্রিত হয়। প্রার্থনা শেষে রান্নাঘরের বহির ভাগে অন্যদের সঙ্গে বালিকা সরলা মাসিমাদের কোল ঘেঁষে বসে পড়াশোনা করতেন। উৎসব ব্যতীত স্বর্ণকুমারী দেবীর রান্নাঘরে আগমন ঘটত না।

ঠাকুর বাড়িতে এসেও মা মেয়ের দূরত্ব কিন্তু ঘুচল না। সিমলা বাড়িতে স্থান সংকুলানের জন্য মা-মেয়ের মানসিক দূরত্ব প্রকট ছিল। কিন্তু এ বাড়িতে সেই দূরত্ব ছিল প্রায় এ পাড়া ও পাড়ার মতো। অন্য ভাই বোনদের সঙ্গে খেলার ছলে বালিকা সরলা মায়ের অনাদর ভুলে থাকতেন।

স্বর্ণকুমারী দেবী
সরলা দেবী

কথায় বলে,’মামার বাড়ি ভারী মজা কিল চড় নাই’। কিন্তু মাতুল গৃহে সরলা দেবীর অত সৌভাগ্য হয়নি। তাঁর দায়িত্বপ্রাপ্তা কৃষ্ণবর্ণা হিন্দুস্থানি দাসী মঙ্গলার হাতের মার ও তার শিক্ষক সতীশ পণ্ডিতের রুলের বারিও তার কপালে জুটেছে।
সরলাদেবী তখন শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ করেছেন। অব্জবাবু ও রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের স্কুলের ভীমবাবুর কাছে সংগীতের তালিম নিচ্ছেন। মায়ের তেতালার ঘরে এক মেম শিক্ষিকার কাছে পিয়ানো শিখছেন মা স্বর্ণদেবীর তত্ত্বাবধানে, মায়ের সেটুকু সাহচর্যেই তিনি তুষ্ট। তারপর হোম টিউটরের কাছে নটার ঘন্টা বাজা অবধি অধ্যয়ন, কোন কিছুতেই ত্রুটি নেই তাঁর।

সাড়ে সাত বছর বয়সে বেথুন স্কুলে ভর্তি হলেন। অল্পকালের মধ্যে তার সুমিষ্ট স্বভাবের জন্য সকল মেয়ের প্রিয় হয়ে উঠলেন। জোড়াসাঁকো থেকে স্কুলে যেতেন পালকি চড়ে। চিতপুর রোড পার করে বারানসি ঘোষ স্ট্রিট হয়ে দোলা চলতো মানিকতলা স্ট্রিটে। পথে বেহারাদের থামিয়ে জেম বিস্কুট ও লবেনচুস কেনা যেন কুড়িয়ে পাওয়া এক ছোট্ট স্বাধীনতা।

সেই ছোট্টবেলায় তার মনে স্বদেশ প্রেম জাগ্রত হয়। তাই নতুন মামা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে জেদ করেন যে তিনি সাহেবের সার্কাস না দেখে বাঙালির সার্কাস দেখতে যাবেন। বেথুন স্কুলে কামিনী রায় ও অবলা বসুকে অনুসরণ করে ইলবার্ট বিলের আন্দোলনে সুরেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জেল হওয়ার প্রতিবাদে হাতে কালো ফিতে বাঁধেন।

এরপর ঠাকুরবাড়িতে বিলেত থেকে সরলা দেবীর রবি মামার আগমন ঘটলো। শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়। বাড়ির ছাদের স্টেজে নানা গীতিনাট্য, বাল্মিকী প্রতিভা মঞ্চস্থ হলো। ব্রহ্ম সংগীত, ধর্ম সঙ্গীত ছাড়াও দেশি-বিদেশি সংগীত চর্চায় রবীন্দ্রনাথ ছোটদের উৎসাহিত করতেন। রবিমামার লেখা নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গকে পিয়ানোতে প্রকাশ করে তাক লাগিয়ে দিলেন সরলাদেবী। তখন তার বয়স মাত্র বারো। ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে’ মামার লেখা এই ব্রহ্ম সংগীতকে অবলীলায় ইংরেজি পিসে্ পরিণত করে পিয়ানোয় বাজিয়ে শোনালেন। 

বন্দে মাতরম গানটি রবি ঠাকুরের সুরারোপিত বলেই সর্বজনবিদিত। কিন্তু তা আংশিক সত্য। প্রথম দুটি পদ ব্যতীত বাকি অংশে সুর দেন সরলা দেবী। সংগীতই ছিল মামা-ভাগ্নির হৃদয়ের মেলবন্ধন। এক বিরল প্রতিভার স্ফুরণ এই কিশোরীর সৃষ্টিতে অবলোকন করেছিলেন বলেই হয়তো তাকে ভরসা করে গুরু দায়িত্ব অর্পণ করতে দ্বিধাবোধ করেননি রবি ঠাকুর। তাঁকে পরিচিত করিয়েছিলেন আর্নল্ড, ব্রাউনিং, শেলি, কিটসের সাহিত্যরসের সঙ্গে।

বেথুন কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক হন ও পদ্মাবতী স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হন। সে সময়ের সপ্তম গ্রাজুয়েট মহিলা হলেন সরলা দেবী। পরবর্তীকালে ভারতী পত্রিকাতে সরলা দেবী লেখালেখি শুরু করেন। দিদি হিরণ্ময়ী দেবীর সঙ্গে কিছুকাল যুগ্মভাবে ও পরবর্তীতে একাকী সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। তাঁরই জোরাজুরিতে ভারতী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখেন ‘চিরকুমার সভা’। ভারতী পত্রিকার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে শরৎচন্দ্রের ‘বড় দিদি’। তিনিই প্রথম লেখকদের সাম্মানিক দেওয়ার প্রথা চালু করেন। বঙ্কিমচন্দ্র সরলা দেবীর লেখার প্রশংসক ছিলেন।

ঠাকুর বাড়ির পরিমণ্ডলে বড় হয়ে উঠলেও চিন্তায়, মননে, সৃজনে তিনি স্বতন্ত্র ছিলেন। ঠাকুরবাড়ির কোন মহিলাই বেলুড় মঠ দর্শন করেননি। কিন্তু তিনি বিবেকানন্দ ও নিবেদিতার আদর্শে আকৃষ্ট হন। তাঁদের বিদেশ সফরেও সরলা দেবী আমন্ত্রিত হন। যদিও পরবর্তীকালে এই সম্পর্কের অবনমন হয়।

ঠাকুর পরিবারের তিনিই প্রথম ব্যতিক্রমী মহিলা যিনি মহীশূরের গার্লস কলেজে শিক্ষয়িত্রী রূপে কর্মরতা হন, ঠাকুর বাড়ির প্রবল আপত্তিকে উপেক্ষা করে। স্বদেশী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করেন। শুধুমাত্র সাহিত্যকর্ম ও সংগীত চর্চায় নিজেকে বেঁধে রাখেননি। আত্মবিস্মৃত বাঙালি যুবকদের ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে বলেছেন। শুরু করেছেন বীরাষ্টমী ব্রত, শিবাজি উৎসব।

প্রয়োজনে রবিমামার বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। কাশীতে বিশ্বনাথের পুজো দেওয়ার জন্য রবি ঠাকুরের ভর্ৎসনাও শুনতে হয়েছিল তাঁকে। রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবী আন্দোলনের বিরুদ্ধে মত পোষণ করলেও তিনি বিপ্লবীদের টাকা জুগিয়েছেন। সেকালের প্রচলিত রীতির পরিবর্তে ৩৩ বছরে বিবাহ করেন।

আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে যে নারী জন্ম গ্রহণ করেছিলেন তার জীবনকালের কর্মবৈচিত্র্য পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায় তাঁর চিন্তাধারা এতটাই আধুনিক ছিল, যা বর্তমান যুগেও সমান ভাবে প্রযোজ্য। তিনি দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী, অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যা, দশপ্রহরণ ধারিণী।

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • JHILIK GOSWAMI , October 16, 2022 @ 9:01 am

    খুব সুন্দর লেখা।
    তথ্যপূর্ণ লেখার স্বাদ আস্বাদন করতে বেশ ভালই লাগে।
    লেখিকাকে জানাই অনেক ধন্যবাদ, এইরকম একটি লেখা উপহার দেওয়ার জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *