মনে তো রাখবই, সুমিতদা

সালটা বোধহয় ২০১১। তখন আমি বাংলালাইভের মজলিশে একটু আধটু লিখতে শুরু করেছি। ফেসবুকে ততটা রপ্ত হইনি। নেদারলান্ডে গিয়েছিলাম ছেলের বাড়িতে। ওখান থেকে টুকটাক বেড়ানোর গল্প লিখছি মজলিশে। অনেকের ভালো লাগছে জেনে উৎসাহিত বোধ করছি। সে সময় যতদূর মনে পড়ছে একটা লেখা লিখেছিলাম ষাটের দশকে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করার ধরন এবং তখনকার রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ক গায়িকাদের গায়কীর বিশেষত্ব নিয়ে। সেই লেখাটা পড়ে প্রায় নিজে থেকেই আলাপ করলেন আমার সঙ্গে শ্রী সুমিত রায়। খুব সম্ভবত এই লেখাটার মধ্যে দিয়ে উনি তাঁর ফেলে আসা কলকাতার সঙ্গে খানিকটা connect করতে পেরেছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকায় থাকেন এবং একজন প্রবীন মানুষ, তখন এর বেশি আর কিছুই জানা ছিল না। আমার লেখায় উল্লেখ ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা বনানী ঘোষের নাম। উনি আমাকে জানিয়েছিলেন অ্যামেরিকায় বসে উনি বনানী ঘোষের কাছে দু’বছর রবি ঠাকুরের গান শিখেছেন। এটুকু বুঝেছিলাম দেশ ছেড়ে আসার সময় রবীন্দ্রনাথ নামের একটা ব্যাগেজ সবার দিঠি এড়ায়ে, বুকে করে নিয়ে এসেছিলেন। সেটা বয়ে বেড়াচ্ছেন এখনো।

তারপর প্রায় আমার প্রত্যেক লেখার পরেই উনি মন্তব্য করতেন। সে সময় একটা একটু বড় লেখা লিখেছিলাম সেটার শীর্ষক ছিল ‘এবং ধীরে বহে রাইন।’ জার্মানির কোলন শহরে বেড়াতে গিয়ে সেখানের কথা নিয়ে লেখা। লেখাটা পড়ে উনি জানালেন সে লেখাটা উনি ওনাদের ওয়েব পত্রিকা ‘অবসর’-এ দিতে চান। ‘অবসর’ পত্রিকা সম্মন্ধে বিশেষ কিছুই জানা ছিল না। তার পর থেকে মাঝে মাঝেই লেখা পাঠাতাম এবং ‘অবসর’-এ বেরত। লেখা না পাঠালে তাগাদাও দিতেন। তারপর কবে যেন একদিন সুজনদার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। লেখার ব্যপারে সুজনদার সঙ্গেই যোগাযোগ হতে থাকল। কিন্তু এই সময়ে নানা ভাবে একটু একটু করে জানা হতে থাকল সুমিতদাকে। অবসরের বিকাশ রায় সংখ্যায় ‘বিকাশবাবু’ নামের একটি লেখা পড়ে অনেকটাই জানা হয়ে গেল একজন বিখ্যাত পিতার বিখ্যাত পুত্রের সম্মন্ধে। এই মানুষটি আমার লেখা পড়ে আমার সঙ্গে যেচে আলাপ করেছেন, এটা ভেবেই বক্ষদেশ কিঞ্চিৎ স্ফীত হয়ে উঠল।

দেখা তো হয়নি কখনো। এমন কী ফোনেও কথা হয়নি। সেবার নেদারল্যন্ডে থাকার সময় বলেছিলেন এতটা যখন এসছ মার্কিন দেশটাও ঘুরে যাও। সেটা সম্ভব হয়নি। আমি বলেছিলাম যখন দেশে যাবেন তখন দেখা করব। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সোজাসাপটা উত্তর দিয়েছিলেন – দেশে তো আর এ জীবনে যাবো না। একটু চমকে গেছিলাম। এত স্পষ্ট করে তো কেউ বলেন না। যিনি বাংলা ভাষা, বাংলা গান, বাংলা সাহিত্যকে, আর সব ছাড়িয়ে রবীন্দ্রনাথকে এত তীব্র ভাবে ভালবাসেন তিনি তো বার বার দেশেই যেতে চাইবেন। একটু যেন চাপা অভিমানের আভাস পেয়েছিলাম। তাই আর প্রশ্ন করিনি।

দেখা না হলে চেনা হয় না, এমন তো নয়। হ্যাঁ, একজন সুমিতদাকে আমি আমার মত করে চিনছিলাম। একটি বিশাল অবয়ব আর ততোধিক বিশাল হৃদয়ের অধিকারী সুমিতদাকে।

সুমিতদার লেখা যতটা পড়েছি, তার মধ্যে একটা রাজশেখরীয় ব্যাপার ছিল। যেন রসিকতার আড়ালে পাণ্ডিত্যকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা। তবে ওঁর আরো অনেক লেখার কথা ছিল। এত বড় এবং বিস্তৃত একটা জীবনের কথা, দেশে বিদেশে ছড়িয়ে থাকা অভিজ্ঞতার কথা প্রায় কিছুই তো লেখেননি। লিখলে কিন্তু, আমার মনে হয় বাংলা সাহিত্য আরো একটু সমৃদ্ধ হত।

বছর দুয়েক আগে আমার হৃদয়ে একটি অস্ত্রোপচার হয়েছিল। অনেকদিন লেখালেখি বন্ধ ছিল। তারপর একটু সুস্থ হয়ে একটা পোস্ট করেছিলাম। পরিচিতরা সবাই তাড়াতাড়ি সেরে ওঠার জন্যে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। যেমন এই রকম ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। কিন্তু সুমিতদা যা লিখেছিলেন তা একেবারে অন্যরকম। লিখেছিলেন,

সোমেন:

“জ্বালিয়ে দিলে নূতন তারা ব্যথায় ভরে” — বলেছিলেন কবি।

ফোতো জ্ঞানের মতো শোনাতে পারে জেনেও বলছি, এই অভিজ্ঞতা অতি মূল্যবান, একে ব্যবহার করে জীবনদর্শনের নবীকরণ করে জীবনের প্রবাহ আরো প্রার্থিত উত্তরণের দিকে বহানো যায়। আমার সে অভিজ্ঞতা আছে। আশা করছি শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্য সব আশু কমে আসবে আর এই অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন করে সব কিছু দেখে আনন্দ পাবে।

— প্রীত্যন্তে, সুমিতদা

আমার মনে হয়েছিল এমন কথা একমাত্র সুমিতদাই বলতে পারেন। এ ভাবেই আমার সুমিতদাকে চেনা। অনেক দূরের ভৌগলিক দূরত্ব থাকা একজন মানুষকে অন্তরের নৈকট্যে নিয়ে এসে চেনার চেষ্টা বলা যেতে পারে।

কাল জানতে পারলাম সুমিতদা, নিজের বাসভূমি ছেড়ে কোথাও যেন একটা চলে গেছেন। যেমন নির্লিপ্তির সঙ্গে কোনোদিন কলকাতায় না ফেরার কথা বলেছিলেন, তেমনি ভাবেই মার্কিন দেশেও আর ফিরবেন না, বলে গেছেন।

সুমিতদা, বেশ না হয় নাই ফিরলেন। কিন্তু আমার আর আপনার মাঝখানে একটা রবীন্দ্রসেতু তো খোলাই রইল। আপনি ওপার থেকে এপারে আসতে না চাইলেও আমার এ পার থেকে ওপারে যেতে তো কোনো বাধা নেই। দেখা হবে নিশ্চয়।

চাকুরী জীবন বেসরকারি এবং আধা সরকারি কর্পোরেট জগতের বিভিন্ন পদে। এখন অবসরপ্রাপ্ত। লেখেন নেহাতই মনের খিদে মেটাতে। লেখেন নানান বিষয় নিয়ে। তবে যাই লেখেন বিষয় নির্বাচনে কিছু অভিনবত্ব থাকে। গান , চলচ্চিত্র, ভ্রমণ, দিন বদলের ছবি, বাঙ্গালিয়ানা এ রকম আরও অনেক বিষয় এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। তথ্যকে কৌতুকের মোড়কে এবং ভাবনা কে স্বচ্ছতার আবরণে পরিবেশন করতে চেষ্টা করেন। বিষয় যাই হোক ভাষা সব সময়েই ঝরঝরে, রসস্নিগ্ধ এবং মনোগ্রাহী। বেশ কয়েকটি ওয়েব পত্রিকাতে লেখেন। দেশ বিদেশে অনেক গুণগ্রাহী পাঠক আছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *