বৃষ্টি ঝরে মনের মাটিতে

বৃষ্টি ঝরে মনের মাটিতে

রাস্তা ভিজে আছে এখনো, এমন রাস্তার নাম মন খারাপ। এই রাস্তা আমায় কোথাও নিয়ে যায় না, নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দেয় শুধু। রডোডেনড্রনের দিন শেষ হল এখানে, আর দু’একদিনের মধ্যে ঝরে পড়বে। ঝরে পড়ার মধ্যে কি কোনো গ্র্যাঞ্জার আছে? আকাশের কোল খালি করে বৃষ্টি ঝরে, জলের ফোঁটা লেগে থাকে পাতার গায়ে। পাতা থেকে আবার ঝরে যায় মাটিতে, মাটি তাকে গ্রহণ করে মা সীতার মতো। আমার মৃত্যুর পর মাটি সহায় হোক। আপাতত, বৃষ্টি মানে ঝরে পড়া অবিরাম।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল শহরের উপকণ্ঠ। শ্রাবণী সংখ্যার জন্য লিখতে বসেছি বটে, তবে বর্ষা যাই-যাই। এখানে শীতই বর্ষা, বর্ষাই শীত, গাভীর মতো মেঘেরা চরে বেড়ায় বছরভর। এখন তাদের বিদায়কাল, ভিজে আঁচলের মেয়ে টুপটুপ করে জলের রেখা ফেলতে ফেলতে যাবে সুদূরের দেশে। এখানে বনঝাউ, পাইন, দেওদারের মাথা আকাশ ছুঁয়েছে, বৃষ্টি তাদের গায়ে লাগে না। তারা প্রাচীন পিতামহের মতো আগলায় মেপল, মিষ্টি মেপল, আর গোলাপি সাদা চেরিদের। পর্ণমোচী গাছেরা রঙিন পাতা ঝরিয়ে মাটিতে লাল কমলা ভেলভেটের চাদর বিছিয়ে দেয়, দেশ বিদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ এই ঝরা পাতা দেখতে আসে। বলছিলাম কীনা, ঝরে পড়ার গৌরব কম নয়?

পাতাঝরা গাছেদের পাতা এখন সবুজ, বৃষ্টিস্নাত। সবুজে আর সজলে হাত ধরাধরি ভাব দেখি ব্যালকনিতে বসে, বাটারকাপের জঙ্গল থেকে ভিজে গন্ধের ভাপ উঠছে, অনেকটা সেই শৈশবের ব্রতচারী গ্রামের মাঠে ছেলেদের পায়ে পায়ে ধুলো ওড়ার পর যখন ঝুপ করে এক পশলা জল হয়ে যায়, তখন মাটি থেকে উঠে আসে এই রকমের বাস। বাড়ির অদূরে এক সরু জলের ধারা বয়ে যায়, পথে হাঁটতে তার শব্দ পাই। পোষাকি নাম কোল ক্রিক ফলস। সারা বছর সে রূপালি সাপের মতো শীতঘুমে থাকে, বর্ষায় তার বুকে বান ডাকে। তখন বারান্দাতেই তাকে শুনতে পাই। আমার বারান্দায় তাকে সঙ্গত করে কাঠের ছোটো টেবিল, ট্রে, দুটো কাপ, রেকাবে বাদাম একমুঠো, সাজানো টিপয়।

বৃষ্টি হয়ে গেছে কিছুক্ষণ, আবারও হবে — মাঝের এই বিরতিটুকু বেশ মোলায়েম। বড়ো নীল ক্লেমাটিসের ফুল জোলো হাওয়ায় দুলছে, ঠাকুমা বলতেন জোলো হাওয়া গায়ে লাগলে ঠাণ্ডা লাগবে। এই আকাশমুখী গাছগুলো ঠাকুমার মতো, সে আজ কতোক্কালের কথা। দুপুর দেড়টার সময়ে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল, একটু চকোসা দেখে সাদা থানকাপড় বাইরে শুকোতে দেওয়া ছিল, ভিজে গেল ঝাপ্পুস। বড়ো অন্ধকার করে এসেছে, সেজোপিসি পরপর দরজাগুলো বন্ধ করে দিলেন। বন্ধ দরজার ভিতর গুমোট অন্ধকারে টেবিলঘড়ির টিকটিক শোনা যাচ্ছে। তক্তপোষের এধার থেকে ওধার মশারি টাঙানোর হুক, সেখানে দড়ি বেঁধে টানটান করে মেলে দেওয়া হল সেই ভিজে যাওয়া সাদা কাপড়। সেই দিন থেকে আমার বৃষ্টির সঙ্গে সাদা রঙের বড়ো গলাগলি।

বৃষ্টি ধরতেই দেখা গেল, কচুপাতার বনে কতশত মুক্তোর বিন্দু জ্বলজ্বল করছে। দুই পয়েন্টে পাখা চলছে ঘরে, বাংলা ক্যালেন্ডারের ভিতর অপূর্ব ময়ূর কুঞ্জবনে খেলা করে বেড়াচ্ছে, পাশে পীতধড়া কৃষ্ণ আর নীলাম্বরী শ্রীমতী। ঠাকুমা ক্যালেন্ডারে পাতায় খুঁজছে স্নানযাত্রার তারিখ, দশহরা, শ্রাবণ সংক্রান্তি। দশহরার দিন জল না হলে সাপের বিষ বাড়ে, ঐ দিন ঘটিদের মনসাপুজো। পাশের বাড়ি খুলনা আর বরিশাল, সংক্রান্তির দিন দুধকলা দিয়ে তাঁর পুজো। পুজো দিয়ে কিছুক্ষণ ঘর বন্ধ করে দিতে হয়, মায়ের বাছারা এসে খেয়ে যায়।

আমেরিকায় বসে বর্ষার বাতাসে তেলেভাজা ফুলুরির গন্ধ মিস করি তো বটেই, খিচুড়ি-বেগুনি নিজের হাতে করি, তবে বৃষ্টি ধরতে পাড়ার চায়ের দোকানের সে গুলতানি তো নেই। এখানে বরং পা জড়িয়ে ধরে পেরিউইংকলের ছোটো নীল ফুল, হাওয়ার দোলায় তাদের লতিকাগুলি পর্চ পেরিয়ে চেয়ার অবধি চলে আসে। পাশের চেয়ার এখনো ফাঁকা, সেই যে চা দেবে বলে উঠে গেল, আমি অপেক্ষায়। মহাসমারোহে প্রেম কখন যে আসে!

মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা উপন্যাসের উপর গবেষণা সম্পন্ন করে বর্তমানে উত্তর আমেরিকার সিয়াটল শহরের বাসিন্দা। ১৪ বছর কলিকাতার একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তদানীন্তন প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা ও সেই সঙ্গে লেখালেখির শুরু। মূলত প্রাবন্ধিক, এছাড়া বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা ও গল্প লেখেন নিয়মিত। প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘সিগমুন্ড ফ্রয়েড: জীবন ও কাজ’। ব্যক্তিগত জীবনে দুই কন্যার জননী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *