নানা রঙের দিন

নানা রঙের দিন

পুবের দিগন্ত-রেখায় দেখা দিল আলোর আভাস। এসে পড়ল আর এক নতুন দিন।
দরজা খুলে পায়ে-পায়ে এসে দাঁড়ালাম ঘর ছেড়ে বাইরে।
বাগানে ফুলেদের হাতছানি জানালে সুপ্রভাত। খুশি মনে আমিও বললাম – “এই যে!”
সামনের পথে চোখ মেলতেই দূর থেকে আসতে দেখলাম এক শিশুকে – গাড়ি ঠেলে নিয়ে আসছে তার সঙ্গী। কয়েকদিন হল চেনা-পরিচয় হয়েছে এদের সঙ্গে। আমায় দেখে শিশুটির মুখে ফুটে উঠল একগাল হাসি। আলো হয়ে গেল আমার দিনের শুরু।
সঙ্গীটি বললে – “ও তোমার নাম জানে, জানো?”
আমি অবাক হয়ে বললাম – “তাই নাকি?”
সে বললে – “হ্যাঁ। শুধু তাই নয়; ও ধরেই রেখেছে – তুমি ওকে একটা ফুল দেবে তোমার বাগান থেকে – যখনই দেখা হবে!”
মনে পড়ল, গত কয়েকদিন তাই দিয়েছিলাম বটে। বাগান থেকে কেটে ওর ছোট্ট হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলাম ছোট্ট একটা গোলাপ-কুঁড়ি, ওর সঙ্গে মানানসই। বিনিময়ে উপহার পেয়েছিলাম ওর ঐ একগাল হাসি। বুঝলাম, আজকের হাসিটি অগ্রিম! মুখে তার কথা ফোটেনি এখনও। ঐ সরল হাসিতেই সে বাঙময়।
সঙ্গীটি বললে – “ঐ ফুল দিয়েই ও তোমাকে মনে রেখেছে, এমনকি তোমার নামও।”
অস্ফুটে বললাম – “সে আমার পরম সৌভাগ্য। আমার পরিচয় রইল শিশুর মনে।” মনে পড়ল –

 

“ইহাদের করো আশীর্বাদ।
ধরায় উঠেছে ফুটি শুভ্র প্রাণগুলি,
নন্দনের এনেছে সম্বাদ,
ইহাদের করো আশীর্বাদ।”

দিন গড়িয়ে চলল ভোর থেকে দুপুরে। প্রত্যহের কাজকর্মের মাঝে চিঠি পেলাম এক বন্ধুর। লিখেছে – “বছর-কয়েক আগে তোমাদের দেওয়া ছোট্ট গোলাপগাছটা পুঁতে দিয়েছিলাম বাগানের মাটিতে –এই দেখ এখন তার ছবি।” দেখি, ফুলে ফুলে ভরে আছে বড়-হয়ে ওঠা গাছটা – চেনা যায় না তাকে আর। বন্ধু লিখেছে – “তোমার নামেই ডাকি আমরা গাছটাকে – সে-ই ওর পরিচয়।”
স্বীকার করি – এ-ও আমার একান্ত সৌভাগ্য। আমার পরিচয় রইল মাটির বুকেও।

আমার বাড়ির পেছনেই আছে ছোটো একটা পার্ক – শিশুদের মেলা বসে সেখানে প্রায় প্রতিদিনই। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসে যখন – খেয়াল-খুশিমত কোনো কোনো দিন বসি গিয়ে সেখানে। বেশ লাগে ছোটোদের কলকাকলি – খেলার মাঝে ওদের ব্যস্ততা – আমি বসে থাকি তার এক কোণে। একমুঠো ফুলের মত সারা মাঠ জুড়ে ওদের খেলার আসর – আমিও যেন মনে-মনে ছোটো হয়ে, ওদের সঙ্গী হয়ে যাই। নিজের বয়স মনে থাকে না আর, তখনকার মত। সাদাচুলের এই পরিণত-বয়সিকে নির্দ্বিধায় পেছনে ফেলে, অবশ্যম্ভাবী ফুরিয়ে-যাওয়ার আগে – অবিস্মরণীয় লাগে মনে-মনে এই হারিয়ে-যাওয়ার খেলা। মন যেন বলে ওঠে – শরীরটা বিকল হয় হোক, আমি হার মানছি না অত সহজে! বুড়ো হওয়ার হাত থেকে এ যেন এক দুষ্প্রাপ্য অব্যাহতি – ভাবি, এ-খেলা যদি শেষ না হত কোনদিনও!

পাশের বেঞ্চিতে বসেছিলেন এক মহিলা – চোখে পড়েনি আগে – নিজের ভাবনায় মগ্ন ছিলাম এতক্ষণ। হঠাৎ চোখাচোখি হতে সৌজন্যের বশে জিজ্ঞেস করলাম – “তোমার ছেলেমেয়েকে এখানে নিয়ে এসেছ বুঝি?”
মহিলা বললেন, কতকটা আনমনেই – “আজ নয়; তবে আগে আনতাম।“ আর কোনো কথা নয়। এরপর আমিও আর কিছু বলার খুঁজে পেলাম না। কিছুক্ষণ পরে উনি নিজেই যোগ করলেন – “সি ডায়েড লাস্ট উইক।” আমার স্তম্ভিত-ভাব কাটতে না কাটতে, মুখে হাসি এনে উনিই আবার বললেন – “বাট, ডোন্ট ওয়রি, সি ইজ কামিং ব্যাক।”

মুখে তাঁর অটুট বিশ্বাসের ছবি – দেখে ভাল লাগল, কিছুটা আশ্বস্ত হলাম আমি। লক্ষ্য করে দেখলাম, উনি আভাসে যা বললেন – মহিলা সন্তান-সম্ভবা।

বসে রইলাম আরো কিছুক্ষণ – দূরে অলস দৃষ্টি মেলে, মাঠের ধারে সেই নিরালায়। মাটি থেকে উঠে আসছে একটা সোঁদা গন্ধ, হাওয়াটাও জোলো-জোলো – আসন্ন বৃষ্টির পূর্বাভাস। আকাশে দেখা দিয়েছে রামধনুর আভাস – রংগুলো অস্পষ্ট অস্তিত্বে রয়েছে সেখানে। চারদিকে চেয়ে দেখি, কখন বুঝি ভেঙে গেছে শিশুদের মেলা – একে একে ওরা ফিরে গেছে যে-যার বাড়িতে। হঠাৎ চোখে পড়ল, একটু দূরে একটি ছোট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একা – আর কী আশ্চর্য, ঠিক যেন আমারই দিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে !
কিছুটা সময় কেটে যাওয়ার পরে, ছোটো ছোটো পায়ে আমার বেশ কাছে এগিয়ে এল সেই শিশুটি। তার একমাথা অবিন্যস্ত কালো চুল, পরনে সামান্য একটা ফ্রক, পায়ে লাল জুতো। আরও ভাল করে আমাকে যেন দেখতে লাগল সে – মুখে তার এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি ! আমি তখন প্রায় হতবাক, কিছুটা বিব্রত, স্থাণুবৎ – অস্ফুটে হয়ত ‘হ্যালো’ বলেছিলাম মেয়েটিকে। তার কিন্তু ভ্রুক্ষেপ নেই কোনোদিকে। সে স্থিরদৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে, আমার একেবারে কাছটিতে এসে, হঠাৎ আমার পায়ের ঠিক সামনের মাটি থেকে একমুঠো কাঠের গুঁড়ো ছোট্ট হাতে তুলে নিয়ে, আমার মাথার টুপিটায় রাখল। মাথা নীচু করে, স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম আমি। ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ অবস্থাটার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় হল আমার – জীবনে এই প্রথম!
ইতিমধ্যে নজরে পড়ল, এক যুবক এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটির পেছনে। ওর হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে, যুবকটি বিব্রতমুখে এগিয়ে এসে আমার কাছে যেন ক্ষমা চাইলেন; বললেন –“কিছু মনে কোরো না, তোমাকে দেখে ওর কিছু একটা মনে হয়েছে, তাই … এরকম ওর মাঝে মাঝে হয় – ওর বছর-দুয়েক বয়েস থেকেই লক্ষ্য করছি। ওর ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে, একজন মনস্তত্ব-বিশারদের পরামর্শও নিচ্ছি আমরা এখন – দেখি কী হয় …এনিওয়ে, আই অ্যাম সরি…।” কথা বলতে বলতে হঠাৎই মেয়েটির হাত ধরে চলে গেলেন তিনি। আমি সেই-অবস্থায় বিশেষ কিছু বলার সুযোগও পেলাম না। শুধু দেখলাম – মেয়েটি যেতে যেতে পেছন ফিরে তাকাল – বেশ কয়েকবার।
আমি যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম কিছুক্ষণ। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি নামল – অগত্যা বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। ফিরে এসে বউকে বললাম এই আশ্চর্য অভিজ্ঞতার কথা। সবটা শুনে, একটু ভেবে সে যা বলল – তাতে আমি আশ্চর্য হলাম আরও।
সে বলল – “মেয়েটি বোধহয় জাতিস্মর – আগের জন্মে তোমার মা ছিল – তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে, তোমাকে আশীর্বাদ করে গেলেন।“
শুনে আমি স্তম্ভিত হলাম এবার, নতুন করে। মেয়েদের সত্যিই কি সিক্সথ সেন্স থাকে?
বইয়ের তাক থেকে জন ডান-এর কবিতার বইটা হাতে তুলে নিলাম – খুললাম ‘ডেথ, বি নট প্রাউড’ নামে কবিতাটা। চোখের সামনে ফুটে উঠল তার শেষ লাইনটা – ‘ডেথ, দাউ স্যাল্ট ডাই’- মরণ, তুমি মর!’

আসন্ন সন্ধ্যার মুখোমুখি আচ্ছন্নের মত আবার এসে দাঁড়ালাম ঘরের বাইরে। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গিয়ে গোধূলির তোড়জোড় চলছে আকাশে। দিনের শেষ সঞ্চয়ের মত মুছে-আসা সোনারঙ মেঘের গায়ে মেখে নিয়ে সেজে উঠেছে পশ্চিমের দিগন্ত। সেদিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে পথে পা বাড়ালাম, বিদায়ের আগে দিনটাকে শেষ সম্ভাষণের জন্যে।

হঠাৎ পেছন থেকে বেজে উঠল এক নারীকণ্ঠ – “শুভ-সন্ধ্যা।“
আসা-যাওয়ার পথে আগে কখনো চোখে পড়েনি এঁকে। চেহারায় বয়সের ছাপ – চোখের কোলে, মুখের পাশে অজস্র বলিরেখা। রাস্তার ধারে আমার চিঠির বাক্সের পায়ের কাছে অযত্নে ফোটা একরাশ বনফুলের দিকে আঙুল দেখিয়ে তিনি বললেন – “তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভাল হল। একটা কথা তোমায় জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে ছিল।”
বললাম – “বেশ তো – কী কথা?”
উনি বললেন – “এই ফুলগুলো শুকিয়ে যাবে যখন, আমি কি এর বীজ নিতে পারি তোমার গাছের থেকে – অবশ্যই যদি তোমার আপত্তি না থাকে …”
আমি বললাম – “নিশ্চয়ই; কোনো আপত্তি নেই আমার। আমি তো জানি এ’ বুনো ফুল – এ’বছর বর্ষার জল পেয়ে আপনিই হয়েছে এখানে। আমি এর নামও জানি না।“
ম্লান হেসে মহিলা বললেন – “বোটানিক্যাল নাম আমিও জানিনা – তবে আমি জানি এর নাম ‘ফরগেট মি নট।’ আমার তো বাগান নেই – ছোট একটা টবে ছড়িয়ে দেব এর বীজ – রাখব আমার ঘরে, জানলার পাশে। হয়ত পরের বছর ফুল দেবে, কিংবা…।” উদাসীন ভঙ্গীতে হাত নেড়ে চাপা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে যেন স্বগতোক্তি করলেন – “এই ফুল আমার বড় প্রিয়…।”
মহিলা ধীর-পায়ে এগিয়ে, চলে গেলেন গোধূলির ওপারে – আমার চোখের আড়ালে।
বুঝলাম, ওঁর ফেলে-আসা জীবনের কোন প্রিয় স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই ফুলের সঙ্গে। সন্ধ্যার ছায়া মিলিয়ে গিয়ে আকাশ জুড়ে নামল অন্ধকার। শেষের মুখে এসে দাঁড়াল আরো একটা দিন।

এমন সময়ে ফোন করল আমার মেয়ে, আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে থাকে ওরা। জানাল – আমার দুবছরের নাতিটার সক্কাল থেকে জ্বর, কাঁদছে আর অনুযোগ করছে – ‘দাদুকে চাই।’

ওর মা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে – ‘সন্ধ্যাবেলা নিয়ে আসবে আমাদের বাড়ি।’ এখন কিছুটা শান্ত হয়ে সে ঘুমিয়েছে। বললাম – ‘নিশ্চয়ই এসো।’
ঐ-বয়সে কোন কিছু পেতে গেলে যে অপেক্ষা করতে হয় – তা ওরা বোঝে না, সে-শিক্ষা তার হয়নি। কেঁদে কেঁদে দুর্বল-শরীরে ঘুমিয়ে পড়েছে ছোট্ট মানুষটা – ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এবার প্রতীক্ষার পালা আমার নিজের – সন্ধে হওয়ার জন্যে।
সন্ধে প্রায় পার করে এল ওরা। নাতির মুখে গালভরা হাসি – শরীর খারাপের চিহ্নমাত্র নেই কোনো দেহে-মনে। আমার একটা আঙুল মুঠোয় ধরে অমনি একগাল হেসে বলল – ‘লেটস গো প্লে।’ চারিদিকে খেলনা-ছড়ানো খেলাঘরে এলাম দুজনে – মনে এল সেই প্রিয় গান – ‘খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি, মনের ভিতরে…‘ – যে সুর মনে গুণগুনিয়ে চলেছে সেই দুপুর থেকে। আমার ছোটো হওয়া এখন আর আটকায় কে?
পায়ে পায়ে নেমে এল রাত। পরম শান্তি এখন আমার মন জুড়ে। বিচিত্র অনুভূতির পারম্পর্যে এক আশ্চর্য সুন্দর দিন কাটল আজ। যুক্তি-তর্ক অবলীলায় পেছনে ফেলে, দেশ-কালের ব্যবধান অকাতরে অগ্রাহ্য করে – শৈশব থেকে বার্ধক্য, জীবন থেকে মরণ – সব মিলিয়ে, স্মরণ-বিস্মরণের দোলায় দোলায়িত মহাকালের এক খণ্ড-স্বরূপ যেন মূর্তি ধরে দেখা দিল আমার চোখের সামনে – একটি দিনের এই স্বল্প-পরিসরে।
মাথা পেতে নিলাম এই অমূল্য উপহার।

মনে হল – ‘আমি ধন্য!’

জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই দক্ষিণ কলকাতার চক্রবেড়েয়। কর্মসূত্রে দেশত্যাগ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগমন। লেখালেখির শখ বরাবরই। ‘শঙ্খ’-নামে পত্রিকা সম্পাদনার ভার নিয়েছিলেন। তবে অবসর জীবনে চুটিয়ে লেখালেখি করে সেই শখ পূর্ণ হচ্ছে। বেশকিছু লেখা - ‘মাতৃশক্তি’, ‘উৎসব’, ‘সাংবাদিক’ ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত। প্রকাশিত গ্রন্থ - ১৫১টি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ইংরেজী অনুবাদ - "Lyrics to Love"। আরো অনুবাদ নিয়ে আর একটি বই বেরোবে খুব শীঘ্রই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *