‘সাহিত্যে ছোটগল্প’ ও নারী
দিনটা ৮ই মার্চ – আন্তর্জাতিক নারী দিবস।
বইয়ের তাক গোছাতে বসে এক অমূল্য সম্পদ কোলে এসে পড়ল। ‘সাহিত্যে ছোটগল্প’ – লেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। নৌ-নীল মলাটের ২৬৬ পাতার বইটি আমায় দিন দুই বুঁদ করে রাখল। আজ যে এমন সুন্দর একখানা বই পড়তে পারছি, এত কথা লিখছি এইজন্য নিজের ভাগ্যকে ধন্য মানি।
ছোটগল্প কী বলার আগে অধ্যাপক গঙ্গোপাধ্যায় নিয়ে গেলেন গল্প কী তার অনুসন্ধানে। গল্প কেন, কোথা থেকে এল সেই সব কথায়। শরীরের যেমন দরকার খাদ্য, মনের তেমন – গল্প। তাই গল্পের দাবি কখনো শেষ হবার নয়। গল্পের মধ্য দিয়ে মানুষ ভাল-মন্দ, ভয়-ভক্তি, ভালবাসার অর্থ খুঁজে পেয়েছে। এই হল, গল্প কেন, তার উত্তর।
গল্প এল কোথা থেকে? তার জবাবে লেখক বলছেন, গল্পের উৎসস্থল ভারতবর্ষ আর তার মূল ‘জাতকের কথা,’ শুরু বুদ্ধের জন্মের আগে, বোধিসত্ত্বের গল্পে। সংখ্যায় তা শ’পাঁচেকের মত। এর কাল যে খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকেরও আগে তা প্রতিষ্ঠিত।[i]
জাতকের গল্প অধিকাংশ নীতিমূলক হলেও উত্তরকালে তা কী ভাবে পরিব্যাপ্ত তার উদাহরণ রয়েছেঃ
১) বেদান্ত জাতকের সঙ্গে ক্যানটারবেরি টেল-এর মিল রয়েছে;
২) সীহচম্প ও কচ্ছপ জাতকের ছাপ পঞ্চতন্ত্র ও পরে ইশপ-এর গল্পের সঙ্গে;
৩) অন্ধভূত জাতক-এর মিল ডেকামেরন ও আরব্য উপন্যাসের সঙ্গে;
৪) পরিশোধক জাতক গল্পের ভ্রূণ দেখি রবীন্দ্রনাথের শ্যামায়; এবং
৫) কুশ জাতকের আদল রয়েছে রবীন্দ্রনাথের রাজা ও অরূপরতনে।[ii]
উত্তরকালে ‘ছোটগল্প’ কী বুঝতে বা সে প্রদীপ জ্বালাতে যে সলতে পাকানোর প্রস্তুতি তার জন্য এই পূর্ব ইতিহাস বোঝা দরকার। লেখক তা বুঝিয়েছেন অপূর্ব মুনশিয়ানায়, আমি সেই বিস্তারে যাচ্ছি না। তবে এর সঙ্গে নারীর কী সম্পর্ক তা উদঘাটন করার চেষ্টা করব এই প্রবন্ধে। শ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে জাতকের গল্পে সমাজস্থিতির কেন্দ্রবর্তিনী নারী চরিত্র এসেছে স্বাভাবিক ভাবেই। সেই সঙ্গে নিঃসঙ্কোচে নারী-নিন্দা এবং তার আরও প্রকট রূপ দেখা যায় পরবর্তী কালের পঞ্চতন্ত্রের গল্পে। পঞ্চতন্ত্রের গৃহী বিষ্ণুবর্মা ও জাতকের বৈরাগ্যব্রতী বৌদ্ধ সন্ন্যাসী স্ত্রী জাতিকে বিষবৎ পরিহার করেছেন এবং সেভাবেই এঁকেছেন। জাতকের গল্পগুলি মূলত ধর্মভিত্তিক, পুরুষ তখনও পুরোপুরি গৃহী হয়ে বসেনি। পঞ্চতন্ত্রের সঙ্গে অমিল এইখানে। জাতকের গল্পে মানুষের যাযাবর বৃত্তি নারীর মধ্যে প্রকৃতির আদল দেখেছে যা পঞ্চতন্ত্রের গল্পে সম্পূর্ণ অপহৃত। যদিও লেখকের মতে সচেতন কথাশিল্পীর রচনাগুণে পঞ্চতন্ত্রের গল্পগুলির সাহিত্যমূল্য বেশি।
এরপর শ্রী গঙ্গোপাধ্যায় দেখিয়েছেন এইসব ভারতীয় গল্পগুলি কী ভাবে পশ্চিমে পরিবর্তিত হয়েছে। যদিও আরব্য উপন্যাস প্রহেলিকাময়ী নারী চরিত্রের রহস্যভেদে বিভ্রান্ত, রোমান্স ও রূপকথার সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়েও তার মর্মবাণী সেই একই – নারীর ছলনা, চাতুরী, পাপ ইত্যাদি। সেই চিরন্তন অপবাদের প্রয়াস। তফাৎ কেবল এর গীতি কবিতাগুলিতে। আরব্য উপন্যাসের রচয়িতা নারীর যে রূপই আঁকুন, কখনো দাসী, কখনো পিশাচিনী, কখনো রাজেন্দ্রাণী, সাহিত্যের গুণে তা সফল ও সমৃদ্ধ।[iii]
এর পরবর্তী কালে প্রাচ্য হয়ে দাঁড়াল প্রতীচ্যের কাঁচামাল যোগাবার ঘাঁটি। ঔপনিবেশিক পশ্চিম ফেলল জাল, শিল্পবিপ্লব তার নিজের ঘরে। রাজা-প্রজার বদলে এল ধনিক-শ্রমিক। এর মাঝে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী জীবন সংগ্রামে কাহিল। সাহিত্যের ওপর এতদিন ছিল গল্পের দাবি। এবার এল জীবনের দাবি। ছোটগল্পের বীজ বোনার কাল। রামায়ণ মহাভারত বা আমাদের পুরাণের গল্পের মত গল্প আছে গ্রিকদেরও, কিন্তু তফাৎ ভারতীয় গল্পগুলি মূলত উপদেশ মূলক। গ্রীক উপকথা দিল তাকে অন্য মাত্রা। ছোটগল্প বোঝার জন্য এটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
ধরা যাক সাবিত্রী সত্যবানের গল্প – সেখানে শুধু উপদেশ। পতিব্রতায় সাবিত্রী সম ভব। এর সমান্তরাল গ্রিকদের অরফিউস আর ইউরিদিসের গল্প নিখাদ প্রেমের গল্প। সেখানে অরফিউসের কান্না, প্রিয়-বিরহের মর্মান্তিক শোক পাহাড়ে পাহাড়ে ধ্বনিত হয়ে বাজতে থাকে বীণার তারের ঝঙ্কারে। সে প্রতিধ্বনি আকুল করে তোলে উত্তরকালের শিল্পী সাহিত্যিকদের, তাদের প্রেরণা দেয়। যেমন, ‘আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী, মহা-সিন্ধু উতলা ঘুম্-ঘুম্ ঘুম্ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম্, মম বাঁশরী তানে পাশরি’ (নজরুল)। এই হল ছোটগল্পের বুনিয়াদ।
ইয়োরোপের সাহিত্যের গভীর বিশ্লেষণ করেছেন অধ্যাপক গঙ্গোপাধ্যায় এক একটি দেশ ধরে – চসার, সেক্সপিয়ার, শেলি, কিটস, মোপাসা, চেখভ, হেমিংওয়ে। বলেছেন, উনিশ শতক হল ছোটগল্পের জন্মলগ্ন। কেন? এর উত্তর বড় সরল নয়।[iv] দান্তের তিমির অভিসার, পেত্রার্ক-এর বিদগ্ধ রোমান্টিকতার যুগে জীবনসন্ধানী শিল্পী বোকাচ্চো চার্চের দিকে তুলে ধরেছিলেন তাঁর অঙ্গুলি। এই জিজ্ঞাসা চিহ্ন থেকে ছোটগল্পের আবির্ভাব।[v]
ঊনবিংশ শতাব্দীর আকাশে ছোটগল্প লেখক যেন সপ্তর্ষির জিজ্ঞাসা রচনা করে চলেছেন অন্তরজ্বালায় জ্বলে, ধ্রুবতারাটি কোথায় তার খোঁজে। এই সময়ে ছোটগল্পে আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-কল্পনা থাকলেও মূলত তা দুঃখবাদী। শুধু ছোটগল্প নয়, সঙ্গীতের রাজ্যে শপ্যাঁর মেলডি, সপেনহাওয়ারের দর্শন, হার্ডির উপন্যাস বেদনায় ভারাক্রান্ত। ‘Our sweetest songs are those that tell of saddest thoughts’ – লিখলেন শেলি।
এসব গল্পের মূলে আত্মকেন্দ্রিকতা, কখনো বা বিষণ্ণ অবচেতনার ছায়া সঞ্চালন। গল্পের আয়তন শীর্ণ, ব্যাপ্তি সীমিত, ভাবের গভীরতাই আসল। এর আরেক কারণ সংবাদ পত্রে জায়গার অসংকুলান। তাছাড়া ছোটগল্প সাহিত্যের আঙিনায় আরেক আঙ্গিক আনল। গল্পের পরিসর ছোট হলেই তা ছোটগল্প নয়। এল তার নির্দিষ্ট বিশেষত্ব:
১) ছোটগল্প হবে প্রতীতিজাত (impressionistic);
২) এর চরিত্রে থাকবে প্রতীতির সমগ্রতা (unity of impression);
৩) লেখক একটি মাত্র কাঙ্ক্ষিত সত্যকে আবিষ্কার করবেন; এবং
৪) লেখকের ব্যক্তিত্বের একটি পরিস্রুত রূপ প্রতিভাত হবে।
ছোটগল্প হবে একমুখী, তীব্র এবং একাগ্র। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-
ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা
নিতান্ত সহজ সরল
সহস্র বিস্মৃতি রাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু’চারিটি অশ্রুজল
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘন ঘটা
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
নানান উত্তীর্ণ ছোটগল্পের অপূর্ব বিশ্লেষণ করেছেন লেখক – চেকভ, মোপাসা, ও’হেনরি থেকে শুরু করে বাংলায় রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন রচনা। কেন তা উৎকৃষ্ট বা নয় তার গভীর আলোচনা। কিন্তু আমায় যা অবাক করেছে তা হল এই সম্পূর্ণ বইটিতে একবার মাত্র Kathleen Mansfield Murray (1888)র এক আঁচড় নামোল্লেখ ছাড়া আর কোন মহিলা লেখকের উল্লেখ নেই।
বাংলায় হঠু, হটি বিদ্যালঙ্কারের মত নাম কোটিকে গুটিক, এবং রবীন্দ্রোত্তর যুগের পর আলোচনা বেশি দূর এগোয়নি, ফলে আশাপূর্ণা দেবী বা মহাশ্বেতা দেবীর মত লেখিকাদের অবদান আসেনি। একই যুক্তিতে বিশ্ব সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ছোটগল্পে আধুনিক মহিলা লেখকদের নামও বাদ দিলাম। কিন্তু তার আগের যুগে?
কেট সঁপা (১৮৫০-১৯০৪), যাঁর Awakening বইটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল? সে যুগে লেখা তাঁর ‘The Story of an hour’ বা ‘একঘন্টার গল্প’ একটি অনবদ্য ছোটগল্প। আনা আখমাতোভা (১৮৮৯-১৯৬৬), লুইস মে এলকট (১৮৩২-১৮৮৮), এমিলি ব্রনটি (১৮১৬-১৮৫৫) – এঁদের অবদান কি উড়িয়ে দেবার?
ষোড়শ শতকে চন্দ্রাবতী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি মহিলা কবি। বাংলা ভাষায় তিনি যে রামায়ণ রচনা করেছিলেন শোনা যায় পরবর্তী কালে তা মাইকেল মধুসূদন দত্তকে অনুপ্রাণিত করে রাম ও রাবণকে অন্য ভাবে দেখতে। ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে (1932) মাইকেল মেঘনাদবধ কাব্যে সীতা ও সরমার কথোপকথনের অংশটি চন্দ্রাবতীর রামায়ণ থেকে গ্রহণ করেছিলেন।[vi]
চন্দ্রাবতী জনসংস্কৃতিতে জড়িয়ে আছেন। তাঁর গীত ও পালা ঘরেঘরে পঠিত হয়েছে। তাঁর রামায়ণের পালাগান বাঙালি মেয়ের গলায় গুঞ্জরিত হয়েছে। তবু তিনি উপেক্ষিতা। পরবর্তী যুগে নবনীতা দেবসেন তাঁর গবেষণায় যদি তাঁকে তুলে না ধরতেন, হয়ত তাঁর কথা জানতেই পারতাম না। একদিকে যেমন দেখেছি বিধবা হবার ভয় দেখিয়ে নারীর হাত থেকে বই কেড়ে নিয়েছে পুরুষ শাসিত সমাজ, আবার কিছু হৃদয়বান মানুষ এগিয়ে এসেছেন তা ভাঙতে। সতীদাহ, বিধবা বিবাহ এবং মেয়েদের অক্ষর পরিচয় যে কত বড় সোপান তা একবিংশ শতকে বসে আমরা অনুধাবন করতে পারিনা।
কিন্তু এই সঙ্গে পশ্চিমে মেরি উলস্টনক্রাফটের (Mary Wollstonecraft) সংগ্রাম ও অবদান ভুলে গেলে চলবে না। ‘The Vindication of Women’s Right’ বইটি সে সময়ে অনেকে উড়িয়ে দিলেও ব্রিটেন ও ফ্রান্সে তার ঢেউ এসে লেগেছিল। মনে রাখতে হবে রামমোহন রায় এই সময়ে ব্রিস্টলে। নিঃসন্দেহে এর আঁচ লাগে তাঁর মননে।
সেদিন পাশ্চাত্যে নাথানিয়েল হথর্ন (Nathaniel Hawthorne) ভয় পেয়েছিলেন “… that damn mob of scribbling women”, [vii] আর একালেও যখন নয়পালের মত লেখকের মন্তব্য পড়ি, “…women’s sentimentality, the narrow view of the world… and inevitably for a woman, she is not a complete master of a house, so that comes over in her writing too” [viii] তখন কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাইনা। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। আজও J.K.Rowling-কে দুটি আদ্যাক্ষরের আড়ালে পরিচয় লুকোতে হয়।
মাঝে মাঝে মনে হয় যে নারী সংসারের অর্ধেক, যে মা রক্ত দিয়ে, বুকের দুধ দিয়ে পুত্রকে জন্ম দিল, পালন করল, যে স্ত্রী সব ফেলে, সব মায়া ছিঁড়ে ছেড়ে এল স্বামীর সংসার করতে, তার প্রতি এত অবজ্ঞা, অনীহা ও বিদ্বেষ কেন পিতৃতান্ত্রিক সমাজের? নারীর সুললিত, লবঙ্গলতা লাবণ্যের ওপারে তার সত্যিকারের শক্তিকে বোধহয় তারা ভয় পায়। কিশোরী মালালা ইউসুফজাইয়ের কথাই বোধ হয় ঠিক। “Extremists have shown what frightens them most: a girl with a book.” চরমপন্থিরা দেখিয়েছে কীসে তাদের সবচেয়ে ভয় – একটি মেয়ের হাতে একটি বই।
*****
পাদটীকাঃ
[i] গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ। সাহিত্যে ছোটগল্প। ১৪০৫ (বং)। কলকাতাঃ মিত্র ও ঘোষ।
[ii] ঐ
[iii] ঐ
[iv] ঐ
[v] ঐ
[vi] হোসেন, সেলিনা ও ইসলাম, নুরুল (সম্পাদক)। চরিতাভিদান। ১৯৯৭। ঢাকাঃ বাংলা একাডেমী।
[vii] Coates, Ta Nehisi. (2011, June 3). ‘The damned mob of scribbling women.’ The Atlantic. Available: https://www.theatlantic.com/entertainment/archive/2011/06/the-damned-mob-of-scribbling-women/239882/
[viii] Fallon, Amy. (2011, June ). “VS Naipaul finds no woman writer his literary match – not even Jane Austen.” The Guardian. Available: https://www.theguardian.com/books/2011/jun/02/vs-naipaul-jane-austen-women-writers
1 Comment