বন-গামী রাম অযোধ্যা থেকে
বেরিয়ে ক্রমশ প্রয়াগে ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে এসে উপস্থিত হন।
মুনি রামকে আরও দক্ষিণে চিত্রকূটের প্রাকৃতিক শোভা ও আধ্যাত্মিক
গুণাবলীর বর্ণনা করে সেখানে গিয়ে অত্রী মুনি ও তাঁর পত্নী সতী
অনসূয়ার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। মুনির কথানুসারে সীতা ও লক্ষণ
সহ রাম চিত্রকূটে তাঁদের কাছে আসেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরা রাম
ও সীতাকে উপদেশ দিয়ে বনবাস কাল চিত্রকূটেই কাটাতে বলেন। বাল্মীকির
লেখায় ভরদ্বাজ মুনি কর্তৃক বর্ণনায় চিত্রকূট সম্পর্কে যেমন যেমন
ছিল, রাম তেমনটিই প্রত্যক্ষ করেন। লক্ষ্মণ ও সীতাকে তিনি বিশদ
ভাবে সেই কথা বলেন। তুলসীদাসের রামচরিতমানসেও প্রায় একই ভাষায়
চিত্রকূটের শোভা ও আধ্যাত্মিক বাতাবরণের বর্ণনা পাওয়া যায়। আমাদের
বাংলা ভাষায় কৃত্তিবাসী রামায়ণে কিন্তু ঠিক এমন ভাবে চিত্রকূটের
উল্লেখ নেই। পূর্বের কথা মতো অযোধ্যা থেকে বেরোবার তিন দিন পরে
মিতা গুহকের কাছে এসে সারথি সুমন্ত্রকে ফেরার পথ ধরতে বললেন।
সুমন্ত্র ফিরে যাবার পর রাম চিন্তা করলেন যে কয়েকদিন পর থেকেই
এখান থেকে দেশের নৈকট্যের কারণে অনেক লোক জন আসতে আরম্ভ করবে।
তা ছাড়া ভরত ফিরে আসলেই আমাদের ফিরিয়ে নিতে আসবে। তাই এখানে
থাকা চলবে না। রামের বক্তব্য কৃত্তিবাস লিখলেন (কৃত্তিবাস পণ্ডিত
মহানুভব কর্তৃক “সচিত্র সপ্তকাণ্ড রামায়ণ”, প্রবাসী প্রেস, ১৩৫৩
সাল, পাতা ১১৪),
যাবত সুমন্ত্র পাত্র
নাহি যায় দেশে।
গঙ্গাপার হৈয়া চল যাই বনবাসে ।।
গুহকের প্রতি তবে বলেন শ্রীরাম।
চিত্রকূট শৈলে গিয়া করিব বিশ্রাম।।
রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ সহ
গুহকের সাহায্যে গঙ্গা পার হয়ে আর কিছু দূর এগিয়ে ভরদ্বাজ মুনির
আশ্রমে এলেন। নিজেদের পরিচয় দিয়ে কারণ বর্ণনা করে যত শীঘ্র পারা
যায় এখান থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন
এবং তেমন জায়গার খোঁজ করলেন। ভরদ্বাজ মুনি বললেন,
যথা মুনিগণ বৈসে
বটবৃক্ষ-তলে।
মৃগ পক্ষী বনজন্তু আছে কুতূহলে।।
নানা ফল মূল পাবে বড়ই সুস্বাদ।
তপোবন দেখি রাম ঘুচিবে বিষাদ।।
মুনি-সকলের সঙ্গে থাক সেই দেশ।
ভরত তোমার তথা না পাবে উদ্দেশ।।
এই দেশে নাহি রাম নৌকার সঞ্চার।
ভেলা বান্ধি যমুনায় হও তুমি পার।।
ভরদ্বাজ মুনি চিত্রকূটের
নাম না করে স্থানের বর্ণনা যা করলেন, হুবহু এমনই বর্ণনা বাল্মীকি
ও তুলসীদাস তাঁদের বিরচিত রামায়ণে করেছেন। এঁরা অবশ্য চিত্রকূটের
নাম করে মুনির এই বর্ণনা করার কথা উল্লেখ করেছেন। কৃত্তিবাসের
বর্ণনার সঙ্গে বাল্মীকি ও তুলসীদাসের এই ব্যাপারে পার্থক্য রয়েছে।
যাই হোক, পরবর্তী
কালে দেখা যায় যে ভরত, ভরদ্বাজ মুনির কাছ থেকেই খোঁজ পেয়ে রামের
সঙ্গে এই চিত্রকূটেই দেখা করতে আসেন। সে কথা পরে আবার হবে। রামায়ণের
কালে চিত্রকূটের উল্লেখের পর মহাকবি কালিদাসের “রঘুবংশম”-এও
এর প্রাকৃতিক শোভার উল্লেখ পাওয়া যায়। এ পর্যন্ত আমি আপনাদের
জানাবার চেষ্টা করেছি যে চিত্রকূট এক অতি প্রাচীন ও রমণীয় স্থান।
তবে প্রয়াগ, অর্থাৎ এলাহাবাদের অল্প দক্ষিণে এর অবস্থানের কথা
ছাড়া সঠিক স্থিতির কোনও উল্লেখ এখনো পর্যন্ত করা হয়নি।
এবার প্রাচীন কাল থেকে
বর্তমানে চলে আসি। চিত্রকূটের অবস্থানের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে।
মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশ জুড়ে আছে ছোট কিন্তু প্রাকৃতিক ও আধ্যাত্মিক
সম্পদে ভরপুর এই শহর। শহরের বসতি এলাকা প্রধানত উত্তরপ্রদেশের
চিত্রকূট জেলায় থাকা সত্ত্বেও অধিক ভূভাগ ও ধর্মীয় স্থানগুলো
আছে মধ্যপ্রদেশের স্তনা জেলায়। বাঁদা-স্তনা রাস্তা শহরের মধ্য
দিয়ে গিয়েছে, এবং এই রাস্তাই প্রায় সমস্ত দর্শনীয় স্থানের মধ্যে
যোগাযোগ রক্ষা করছে। চিত্রকূট মোট পাঁচটি ছোট পর্বতের সমষ্টি।
স্থানীয় মানুষ অবশ্য এই পর্বতগুলোকে উত্তুঙ্গ পর্বত বলতেই অভ্যস্ত।
বিন্ধ্য পর্বতমালার এই পাঁচটি পর্বতের নাম যথাক্রমে কামদগিরি,
হনুমান ধারা, জানকী কুণ্ড, লক্ষ্মণ পাহাড় ও দেবাঙ্গণা। প্রত্যেকটি
পর্বতেই কিছু না কিছু ধার্মিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে।
আমরা চিত্রকূটে এলাম হনুমান
ধারা পাহাড়ের দিক থেকে। এই দিক থেকে এখানে আসা স্বাভাবিক নয়,
যদিও এমন ভাবে আসায় কোনও বাধা নেই। অবশ্য রাস্তার হাল বেশ খারাপ
কিন্তু আশপাশে প্রচুর গাছপালা এবং পাহাড়ি উঁচু-নিচু ঢেউ খেলান
পথ। আমাদের বাঁকা পথে এখানে আসার করণ হোল এলাহাবাদের দিক থেকে
এখানে আসার সাধারণ পথে সেদিন যানজট থাকা। এলাহাবাদে মহাকুম্ভে
তার আগের দিন শিবরাত্রির (১০ মার্চ, ২০১৩) বিশেষ স্নান ছিল,
এবং সেদিন স্নান ফেরতা প্রচুর যাত্রী চিত্রকূটে আসছিল আমাদেরই
মতো। আমাদের গাড়ির চালক তাই যানজট এড়াবার জন্যেই এই পথে আসলেন।
আমাদের অবশ্য ভালই হোল, কারণ তা না হলে পরে আবার চিত্রকূটে হোটেল
থেকে অনেকটা দূরে এখানে আসতে হতো। এই পথেই হনুমানধারা পর্বত
এবং সেখানে চিত্রকূটের এক প্রধান দর্শনীয় স্থান আছে। আমরা পরে
চিত্রকূট শহরে যেখানে থাকলাম, সেখান থেকে এই পাহাড়ের দূরত্ব
প্রায় ৪/৫কিমি.। পাহাড়ের পাদদেশে মন্দির বা পাহাড়ে ওঠার সিঁড়ি
থেকে প্রায় ৭৫মি. দূরে স্ট্যান্ডে আমাদের গাড়ি থামলো ১১টা ৩০
মিনিটে। ভিড় খুবই রয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছে প্রচণ্ড রোদ। নিচে
থেকেই আঁকা বাঁকা পথে সিঁড়ি দিয়ে যাত্রীদের যাতায়াত করতে দেখা
গেল (চিত্র-১, হনুমানধারা)।
চিত্র-১,
হনুমানধারা
প্রায় ৩৫০ ধাপ সিঁড়ি।
যেমন এখানে আসার রাস্তার ধারে গাছ-পালা, তেমনই সিঁড়ির আশপাশেও
রয়েছে।
কাছ দিয়েই চওড়া ঝর্ণা
নেমে আসছে, যদিও পর্যাপ্ত জল নেই তাতে। উঁচুতে বেশ কিছু বড় বড়
বাড়ি, ধর্মশালা ইত্যাদির। এগুলো দেখে জম্মু-কাশ্মীরের বৈষ্ণোদেবীর
গুহা-মন্দিরের আশপাশের স্মৃতি এসে যায়, যদিও সেখানকার তুলনায়
এ অতি সামান্য। কথিত যে লঙ্কাদহনের পর বীর হনুমান রামের কাছে
ফিরে এসে তাঁর সর্ব শরীর দগ্ধ হয়ে যাবার কারণে প্রচণ্ড উষ্ণতা
ভোগ করতে হচ্ছে বলেন। প্রার্থনা করেন এর কোনও বিহিত করার। রাম
তাঁকে এই স্থানে এসে এই স্নিগ্ধ ও শীতল জল ধারায় স্নানে শরীর
শীতল করবার উপদেশ দেন। এখনও প্রতীক স্বরূপ তাঁর বাম হস্তের উপরদিয়েই
এই ঝর্ণাধারা বয়ে যাচ্ছে। আরও প্রায় ১০০ ধাপ উপরে উঠলে এক স্থানের
নাম “সীতা রসুই,” কথিত যে এইখানে বনবাস কালে সীতার রান্নাঘর
ছিল। রামায়ণী কাহিনির প্রলেপ না থাকলেও প্রাকৃতিক পরিবেশ অতি
রমণীয়। কেবল মাত্র এই কারণেও হনুমানধারার সিঁড়ি ভাঙ্গার কষ্ট
সহ্য করা যায়।
হনুমানধারা থেকে প্রায়
দুপুর ১টা ১৫মিনিটে চিত্রকূটের দিকে আবার যাত্রা আরম্ভ হলো।
দুপুর দেড়টা নাগাদ এক ব্রিজের ওপর এসে উঠলাম। নিচে ছোট নদী,
জল নোংরায় কালো হয়ে গেছে । অবশ্য অল্প দূরেই জল বেশ পরিষ্কার
লাগলো এবং নদীর দুই পার বাঁধানো। সুন্দর ঘাট। বারাণসীর কথা মনে
করিয়ে দেবার মতো কিন্তু দুই পারেই (বারাণসীতে এক পারে) সুউচ্চ
ও সুদৃশ্য মন্দির। অবশ্য ঘাটের দৈর্ঘ্য বারাণসীর ঘাটের চেয়ে
অনেকটাই কম ।
আর হ্যাঁ, শ্রীনগরের মতই
প্রচুর সংখ্যক শিকারা। কিছু ভেসে বেড়াচ্ছে নদীতে ও আর কিছু বাঁধা
রয়েছে দু দিকেরই ঘাটে। গাড়ি ঘুরিয়ে এক দিকের ঘাটের থেকে বেশ
কিছুটা ওপরের রাস্তার ধারে রাখা হলো। আমরা ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে
কিছুটা নামতেই কয়েকজন যুবক আমাদের সামনে এসে তাদের শিকারায় চাপতে
বলল। শিকারা করে তারা আমাদের নাকি মন্দির দেখাতে নিয়ে যাবে।
আগেই আমাদের ট্রাভেরার চালক বলে দিয়েছিল যে নদীর ধারের কোনও
জায়গায় আমাদের থাকবার ব্যবস্থা করে দেবে। কাজেই এখন এই প্রচণ্ড
রোদে আমরা শিকারা বিহার করা থেকে বিরত থেকে অল্প পরেই সেখান
থেকে আবার ব্রিজ পার করে শহরের দিকে এগোলাম। ইতি মধ্যে জানতে
পারলাম যে এই নদীর নাম “মন্দাকিনী” আর বিপরীত দিকে “রামঘাট”
আর আমরা “ভরতঘাট” থেকে নদীর দৃশ্য দেখলাম (চিত্র-২, ভরতঘাট থেকে
রামঘাট ১, চিত্র-৩, ভরতঘাট থেকে রামঘাট ২)।
চিত্র-২,
ভরতঘাট থেকে রামঘাট ১
চিত্র-৩,
ভরতঘাট থেকে রামঘাট ২
ব্রিজ পার করার সঙ্গে সঙ্গেই
তেমাথা রাস্তা। যাত্রীর ভিড়ে গাড়ি প্রায় স্থির। চালক ডান দিকে
মোড় নেবার চেষ্টা করলো, কেননা ওই দিকেই ঘাট এবং থাকবার হোটেল
প্রায় সমস্ত। কিন্তু পুলিস ওই দিকে গাড়ি নিয়ে যেতে দিলো না।
বাধ্য হয়ে আমাদের গাড়ির চালক বাঁ দিকে (স্তনার পথে) মিনিট পাঁচেক
এগিয়ে “শান্তি গেস্ট হাউসে” দাঁড় করালো। আমরাও আমাদের সাধ্যর
মধ্যে ঘর পেয়ে গিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম। পরে আমরা জানতে পেরেছিলাম
যে আমাদের ডান দিকে না যেতে পারা শাপে বর হয়েছিল। কেননা ওই দিকে
ওই সময় হোটেল প্রায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিল।
বিকেল বেলা আমরা বেরলাম এখানকার প্রধান আর বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান
মন্দাকিনীর পারে রামঘাট দেখার জন্যে। অবশ্য এখানে আসার পথেই
এই ঘাট একবার দেখা হয়ে গেছে। গেস্ট হাউসের থেকে এক মিনিট হাঁটা
দূরত্বে দেখলাম বড় আকারের অটোরিক্সা যাচ্ছে রামঘাটের জন্যে,
জন প্রতি ৫ টাকা ভাড়া। সেই তেমাথার মোড়ে, ঠিক রামঘাটের পিছনে
পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম। মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের রেস্ট
হাউস ওই তেমাথায়, বেশ বড় পরিসর লক্ষ করলাম। মিনিট কয়েক হাঁটার
পর মন্দাকিনীর পারে ঘাটের সিঁড়ির ওপরে এসে গেলাম। সিঁড়ির কাছে
পৌঁছবার আগেই রাস্তা থেকে ঘাটের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে
(চিত্র-৪, রাস্তা থেকে মন্দাকিনীর পারে রামঘাট)।
চিত্র-৪,
রাস্তা থেকে মন্দাকিনীর পারে রামঘাট
চিত্র-৫,
রামঘাটে যাত্রীর ভিড়
তীর্থযাত্রীর ভিড় ভালই
(চিত্র-৫, রামঘাটে যাত্রীর ভিড়)। দৃশ্যও সুন্দর। বাঁধানো এবং
পরিষ্কার ঘাটের ধারে ধারে সুন্দর এবং বিভিন্ন ধরনের চূড়াযুক্ত
একাধিক মন্দির পরস্পর রয়েছে। কয়েকটা মন্দির প্রাচীন ভিতের ওপর
নতুন করে গড়া হয়েছে মনে হলো। অবশ্য পুরানো মন্দিরেরই সংস্কার
করা হয়ে থাকতেও পারে। যদিও কোন প্রামাণ্য নথির উপস্থিতির কথা
জানতে পারিনি, তাহলেও শুনলাম মধ্য প্রদেশের পান্না রাজের অধিকারে
এই অঞ্চল থাকার সুবাদে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি রাজা সভা
সিং এবং তাঁর উত্তরাধিকারী অমান সিং মন্দাকিনী নদীতীরে ঘাট ও
মন্দিরের জীর্ণোদ্ধার করান। অবশ্য স্বাভাবিক ভাবেই এর পরেও নিশ্চয়
মন্দির ও ঘাটের সংস্কার হয়েছে। রামঘাটে একটা বোর্ডে লেখা দেখতে
পেলাম মাত্র কিছু দিন আগেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় (উত্তর প্রদেশ
জল নিগমের উদ্যোগে) মোট ৪ কোটি ৪০ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা খরচ করে
রামঘাটের আশপাশের কিছু মন্দির, পথ ইত্যাদির সংস্কার ও সৌন্দর্যমণ্ডিত
করা হয়েছে। সমানে ঘোষণা করা হচ্ছে যেন নদীর জলে সাবান মাখা,
কাপড় কাচা ইত্যাদি না করা হয়, জল পরিষ্কার রাখার জন্যে, অথচ
ঠিক ঘাটের অংশ ছাড়া নদীতে জলজ উদ্ভিদ ও প্লাস্টিক বর্জ্য পদার্থের
কদর্য উপস্থিতি প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। রামঘাটেরই এক অংশ রাঘবপ্রয়াগ
নামে খ্যাত। বলা হয়ে থাকে এখানেই শ্রীরাঘব অর্থাৎ রাম দশরথের
উদ্দেশে পিণ্ড দান করেছিলেন। প্রয়াগ মানেই একাধিক নদীর মিলন
স্থল। এই রাঘবপ্রয়াগও নাকি তিনটি নদীর মিলন স্থল। প্রথমে আমার
মনে হয়েছিল শহরের নোংরা জলের এক খোলা নালা এখানে এসে মিশছে (চিত্র-৬,
পয়শ্রবণী না কি পয়-নালি?), পরে যখন শুনলাম প্রয়াগের কথা তখন
বুঝলাম যে এই নালাই বাকি দুটির একটি, পয়শ্রবণী অথবা গায়ত্রী
নদী।
চিত্র-৬,
পয়শ্রবণী না কি পয়-নালি?
মন্দাকিনী ছাড়া এই একটিই
জলধারা এখানে মিশেছে, যদিও জলধারা বলা যায় কি না দশ বার ভাবতে
হবে। তৃতীয় নদীর দর্শন পেলাম না। অনতিদূরেই ওপর দিকে দেখতে পেলাম
লেখা রয়েছে, ‘পিতৃ-স্মৃতি বিশ্রাম গৃহ।’ এই গেস্ট হাউসের কথা
আগেই শুনেছিলাম আমার এক সহকর্মীর এখানে থাকার সুবাদে। গেস্ট
হাউসটির অবস্থান মন্দাকিনীর ধারে হবার কারণে থাকার জন্যে বেশ
লোভনীয় (+৯১৯৪৫০২২৩২১৪)। যে বাড়িতে এটি অবস্থিত, তার সংলগ্ন
প্রাসাদোপম বাড়িটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে।
আমরা জানি যে মোগল সম্রাট
আওরঙ্গজেব অসংখ্য হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। কিন্তু সম্ভবত
এক মাত্র এখানেই এক হিন্দু মন্দির নির্মাণও করেছিলেন। এই সম্পর্কে
এক কাহিনি প্রচলিত আছে। কোনও এক সময়ে সম্রাট সৈন্য-সামন্ত নিয়ে
এখানে আসে সমস্ত মন্দির ধ্বংস করার অভিলাষে। কিন্তু যে কোনও
কারণে হোক, প্রত্যেক সৈন্য-সামন্তের ভীষণ পেট খারাপ হয়। সবাইকার
মর-মর অবস্থা। এক মন্দিরের প্রধান পূজারি সাহস করে আওরঙ্গজেবকে
বলেন যে স্থানীয় আর এক মন্দিরের পূজারি সন্ত বালক দাস রোগ সারাতে
পারবেন। অগত্যা তাঁকে ডেকে পাঠানো হলো এবং তিনি সকলকেই রোগমুক্ত
করতে পারলেন। সম্রাট খুশি হলেন আর তিনি যে লক্ষ নিয়ে চিত্রকূটে
এসেছিলেন তা সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে সেই সমস্ত সৈনিক দিয়েই বালাজীর
মন্দির নির্মাণ করলেন ১৬৮৩ খ্রিষ্টাব্দে। বিশ্রাম গৃহের পাশেই
সেই মন্দিরে এখনও নিত্য পূজা হয়ে থাকে। আওরঙ্গজেব মন্দিরের নিত্য
ভোগের জন্য দৈনিক এক টাকা বরাদ্দ করেন আর মন্দিরের নামে মোট
আটটি গ্রাম দান করেন সম্পূর্ণ রূপে ‘লাগান’ ছাড়া। এই সমস্ত দানের
কথা বলে তিনি এক ফর্মান জারি করেন যা এক তাম্রপত্রে লেখা আছে।
মন্দিরের প্রধান পূজারির হেফাজতে এখনো সেটি রক্ষিত এবং চাইলে
সেটি দেখাও যায় বর্তমান পূজারি মহন্ত নারায়ণ দাসের কাছে। তবে
কেন জানিনা মন্দিরের এখন অবস্থা ভাল নয়।
চিত্র-৭,
ভরত-মিলাপ মন্দিরে মিলাপের স্থান
চিত্র-৮,
পদচিহ্নের স্থান
কাছা কাছি আর একটি মন্দির
আছে। মন্দিরটি তিন তলা, নাম ‘ভরত মন্দির’। উঁচু উঁচু প্রায় ৫০/৬০
সিঁড়ি দিয়ে তিন তলায় বড় উঠানে পৌঁছবেন। তার মাঝে উঁচু বেদির
ওপর পাথরের গায়ে কয়েকটা পায়ের ছাপ, রাম ও সীতার (চিত্র-৭, ভরত-মিলাপ
মন্দিরে মিলাপের স্থান, চিত্র-৮, পদচিহ্নের স্থান)। সামনে ও
দুপাশে দুটি বড় ঘর। ডান দিকের ঘরে শিবের মন্দির। সামনেরটি দিগম্বর
আখাড়ার। আর বাঁ দিকেরটির নামেই মন্দিরের নাম, ‘ভরত মন্দির’।
এখানেই নাকি এই মন্দাকিনীর পারে রামের সঙ্গে ভরতের দেখা হয়েছিল
এবং রামের পাদুকা নিয়েই ভরত অযোধ্যায় ফিরে যেতে বাধ্য হন। সেই
মিলনের মুহূর্ত স্মরণ করবার জন্যে এই ঘরে কয়েক মুহূর্ত আসন গ্রহণ
করার জন্যে পূজারি ও পাণ্ডারা যাত্রীদের অনুরোধ করে থাকেন। দুতলায়
আর একটি মন্দির ‘তোতামুখি সংকটমোচন মন্দির’। মন্দিরে তুলসীদাসের
ও সংকটমোচনের সামনাসামনি দুটি মূর্তি। দুটি মূর্তিই শিল্পীর
দক্ষতার পরিষ্কার পরিচয় দেয়। মন্দিরের গুরুত্ব বুঝতে গেলে মন্দিরের
পূজারি পণ্ডিত বিজয় শঙ্কর ত্রিপাঠীর সঙ্গে আমার বার্তালাপ শুনতে
হবে ।
এবং
সংক্ষেপে ব্যাপারটা হলো
যে তুলসীদাস বারাণসীতে সংকটমোচনের কাছে রামের দেখা পাবার জন্যে
প্রার্থনা করেন। সংকটমোচন বলেন যে রামের দেখা বারাণসীতে নয়,
উনি চিত্রকূটে পাবেন। তার জন্যে চিত্রকূটে ছয় মাস রামের দর্শনের
জন্যে তপস্যা করতে হবে। যথারীতি তুলসীদাস তপস্যা করেন, রাম দর্শনও
দেন কিন্তু তুলসীদাস রামকে চিনতে পারেন না। সংকটমোচনের কথা মতো
আবার ছয় মাস তপস্যা করেন, রাম দর্শন দেন এবং উনি আবার চিনতে
পারছেন না দেখে সংকটমোচন তোতার রূপ ধারণ করে একটি দোহার সাহায্যে
তুলসীদাসকে রামের ছদ্মবেশের কথা বলে চিনিয়ে দেন। যেখানে এখন
তুলসীদাসের মূর্তি আছে সেখানেই তিনি রামের দর্শন পান। আমার ধারণা
ছিল যে রাম স্বাভাবিক কারণে অযোধ্যা থেকে অনেক দূরে বাস করার
চিন্তায় চিত্রকূট থেকে দক্ষিণে দণ্ডকারণ্যে চলে যান। এখানে বলা
হয় যে বনবাসের সাড়ে এগারো বছর রাম চিত্রকূটেই কাটিয়েছিলেন। সেই
সম্পর্কে আমি ত্রিপাঠীজীকে প্রশ্ন করি। ওনার বক্তব্য Chitrakoot
5 ভিডিওতে শুনতে পাবেন।
ক্রমশ সন্ধ্যা হয়ে যায়। ভরত মন্দিরের সামনেই মন্দাকিনীর পাড়ে
সন্ধ্যারতির ব্যবস্থা হচ্ছে দেখতে পাই। অপেক্ষা করি। সন্ধ্যারতি
দেখি এবং সন্ধ্যারতির ও রাতের সময় রামঘাটের দৃশ্য হ্যান্ডিক্যামে
বন্দি করি ।
রাঘবপ্রয়াগের কাছে এক
শিব মন্দিরে আরতির চলচ্চিত্রও রেকর্ড করি ।
চিত্র-৯,
শ্রী সদ্গুরু সেবা সঙ্ঘ ট্রাস্ট
গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে
যেখান থেকে আমরা রামঘাটে যাবার জন্যে অটোরিক্সা চেপেছিলাম, সেখানটায়
অনেকগুলো ছোট বড় ধাবা ও রেস্তঁরা রয়েছে আর রয়েছে অনেকগুলো ওষুধের
দোকান। তার কারণ রাস্তার বিপরীত দিকে আছে এই অঞ্চলের প্রসিদ্ধ
হাসপাতাল, “শ্রী সদ্গুরু সেবা সঙ্ঘ ট্রাস্ট”-এর অধীন “সদ্গুরু
নেত্র চিকিৎসালয়।” এই সেবা সঙ্ঘের স্থাপক এই অঞ্চলের প্রসিদ্ধ
ব্যক্তি শ্রীরণছোড়দাস। এখানে উনি শ্রীরণছোড়দাসজী মহারাজ নামেই
পরিচিত। এই সেবা সঙ্ঘের গেটটিও বেশ বড় (চিত্র-৯, শ্রী সদ্গুরু
সেবা সঙ্ঘ ট্রাস্ট)। নেত্রালয়ের বাড়ি বিরাট বড় এবং সব সময় প্রচুর
রোগীর ভিড় লেগেই আছে।
নেত্রালয়ের সামনে থেকে
অটোরিক্সা করে রামঘাটে যাবার সময় ‘চারধাম’-এ যাবার কথা অটোরিক্সার
ড্রাইভারদের বলতে শুনেছিলাম। চার ধাম? আমরা জানি দুইপ্রকারের,
বিষ্ণুর আর হিমালয়ের। হিমালয়ে বদরীনাথ, পশ্চিমে গুজরাটের দ্বারকা,
পূর্বে পুরীর জগন্নাথধাম আর দক্ষিণে রামেশ্বেরধাম। এই বিষ্ণুর
চারধাম। উত্তরাখণ্ডের যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী, কেদারনাথ আর বদরীনাথ
হলো হিমালয়ের চার ধাম। এখানে আবার কেমন চার ধাম? জানতে পারলাম
এ হলো চিত্রকূটের চার ধাম, ‘রাম-দর্শন’, ‘স্ফটিক-শিলা’, ‘সতী
অনসূয়া আশ্রম’, আর ‘গুপ্ত-গোদাবরী’। এগুলো কি, সময় এলেই বুঝতে
পারবেন। আজ ১৩ মার্চ, সকালে ঠিক করা হলো দেখে আসি এখানকার চার
ধাম। অটোরিক্সা ভাড়া করলাম। এমনিতে জনপ্রতি ৬০ টাকা ভাড়া, এখন
বিশেষ সময় চলছে বলে ১০০ টাকা করে লাগবে অটো-ড্রাইভার গম্ভীর
মুখে বলে বসলো। তবে আমরা পাঁচ জনই যাত্রী হবো একটা রিক্সায় তাই
আমাদের লাগবে ৮০০ টাকা। দরাদরি করতে অটো-চালক বলল যে ওরা একটা
রিক্সায় ১৫ জন পর্যন্ত চাপায়, কাজেই ও নিজের ক্ষতি করেই আমাদের
নিয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে আমাদের ওই ভাড়াই মেনে নিতে হলো।
যাই হোক প্রায় ১০টা নাগাদ
আমরা চার ধাম যাত্রা শুরু করলাম। রামঘাট এখান থেকে উত্তর দিকে।
আমাদের গাড়ি চলল দক্ষিণ দিকে। বাঁদা-স্তনা রাস্তা এখানে কংক্রিটের।
অল্প সময় পরেই প্রায় সাড়ে দশটার সময় পৌঁছলাম প্রথম ধামে, ‘স্ফটিক
শিলা’, মন্দাকিনীর ধারেই। শিলার কাছে পৌঁছবার মিনিট কয়েক আগে
রাজ্য সড়ক ছেড়ে পূর্ব দিকে নদী পার করে রাস্তা। নদীর পারেই শিলার
কাছে পৌঁছলাম ৩০/৪০ মিটার গভীর জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা দিয়ে। রাস্তার
পাশে এক দিকে ফুল ইত্যাদির দোকান এবং তার পিছনে মন্দাকিনীর ধারা
বয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারা যায়। অন্য ধারে ক্রমশ উঁচু উঠে যাওয়া
পাহাড়ের গায়ে জঙ্গল। সামনেই এক মন্দির, রাধা-কৃষ্ণের। বিগ্রহ
খুবই সুন্দর (চিত্র-১০, রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ)।
চিত্র-১০,
রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ
যদিও রাম ও কৃষ্ণ একই,
তা হলেও রাম-সীতার বদলে রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি দেখে আমার কিছুটা
আশর্চযই হলো। মন্দিরের সামনে আর রাস্তার বাঁ দিকে একটু উঁচুতে
বাঁধানো, ঢাকা দেওয়া কিন্তু চারিদিক খোলা এক বেদি। বেদি সিমেন্টের
নয়, প্রায় সমতল। ফিকে ঘিয়ে রঙের প্রকাণ্ড এক ঘসা কাচের মত পাথর
(Rock-crystal), ‘স্ফটিক-শিলা’ (চিত্র- ১১, স্ফটিক-শিলা ১ ও
চিত্র-১২, স্ফটিক-শিলা ২)।
চিত্র-
১১, স্ফটিক-শিলা ১
চিত্র-১২,
স্ফটিক-শিলা ২
শিলার ওপর মানুষের পায়ের
ছাপের মতো গোটা তিনেক ছাপ, বলা হয় রাম ও সীতার। ভক্ত যাত্রীরা
শিলা প্রদক্ষিণ করছে আর দু-চার পয়সা প্রণামী দিচ্ছে। কথিত যে
বনবাস কালে কিছু সময় এর কাছেই এক পর্ণ-কুটিরে বাস করতেন এবং
অনেক সময়েই তাঁরা এখানে বিশ্রাম গ্রহণ করতেন। পরিবেশ বেশ মনোরম,
বিশেষ করে নদী ও জঙ্গল থাকার কারণে। আরও কথিত যে ইন্দ্রপুত্র
জয়ন্তকে এখানেই সীতার শ্লীলতাহানি করার কারণে রামের হাতে একটা
চোখ হারাতে হয়। যদিও আমাদের যাওয়া সেখানে সম্ভব হয়নি, তাহলেও
উল্লেখ করার মতো যে জয়ন্ত-জায়া দেবাঙ্গণা হনুমানধারার এক স্থানে
রামকে পতি রূপে পাবার জন্যে তপস্যা করেন। ফল স্বরূপ পরবর্তী
জন্মে দেবাঙ্গণা রাধারূপে কৃষ্ণরূপী রামের সঙ্গ লাভ করেন। স্ত্রী
হতে পারেননি, কারণ লক্ষ্মীদেবীর জন্যে সেই পদ তো পাকা।