প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

লখনঊ

এই পর্যায়ের লখনঊ ভ্রমণ আমরা রেসিডেন্সি থেকে আরম্ভ করিনি, যদিও এই রচনা সেখানকার কথা দিয়েই শুরু করেছি। এর দুটি কারণ আছে। প্রথমত প্রথমেই বলেছি এই জায়গাটা আমার মনে এখনও অনুরণন সৃষ্টি করে আর দ্বিতীয়ত, এখানকার কথা বলতে গেলে লখনঊ-এর ইতিহাসের কথা বলতে হয়। আর লখনঊ দর্শনে এসে লখনঊ-এর ইতিহাসে কথা না জানলে কি চলে? কোন জায়গায় তাহলে প্রথম গিয়েছিলাম? গাড়ির চালকেরা প্রথমেই নিয়ে যায় ‘বড়া-ইমামবাড়া’-তে। আমরাও সেখান থেকেই লখনঊ দর্শন আরম্ভ করলাম।
রাস্তার ধারে গাড়ি রাখার জায়গা, পরিষ্কার, পিচ দিয়ে বাঁধানো। ইমারতের প্রবেশ মূল্য জন প্রতি ৫০ টাকা (বড়-, ছোট-ইমামবাড়া, বাওলি ও আর্ট-গ্যালারি, এই চারটি স্থানের জন্যে এই একবারই প্রবেশ মূল্য দিতে হয়)। বিরাট আকারের দরজার মধ্যে দিয়ে ইমামবাড়ায় চত্বরে প্রবেশ করলাম। প্রবেশ করেই ডান দিকে একটি ঘরের মধ্যে হাত-ব্যাগ ইত্যাদি জমা রাখার জায়গা। হ্যান্ডিক্যাম ব্যবহারের জন্যে ২৫ আর স্থির ক্যামেরা জন্যে ৫ টাকা দিয়ে অনুমতি-পত্র নিতে হল। সামনে সুন্দর বাগান। বাগান ঘিরে বাঁধানো রাস্তা। বাগানের সীমানা পেরিয়ে এক দীর্ঘ বাড়ির মাঝে বিরাট এক কাঠের দরজা, কিছুটা উঁচুতে, অনেক গুলো ধাপ সিঁড়ি ভেঙ্গে এই দরজায় পৌঁছতে হয়। বাঁধানো রাস্তা তার সামনে দিয়ে ঘুরে এসেছে (Pic-9, Garden & inside Entrance)।

ছবি ৯

এই দরজা ইমামবাড়ার দ্বিতীয় প্রবেশ দ্বার। এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেই পথের দুই ধারেই নানা ধরনের সুন্দর ও ‘সব কিনে নেব’ মনে করার মতো প্রধানত ‘কিউরিও’ সামগ্রীতে ভরা অনেক দোকান। আমাদের মধ্যে কয়েকজন সেই সব দোকানে হাজিরা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তাদের মনে করিয়ে দিলাম যে এখানে সময় ব্যয় করলে দর্শনের সময়ে ঘাটতি পড়বে। এই বলে আমি এগিয়ে গেলাম। সামনে আবার বাগান। এবার রাস্তা বাগান ঘিরে নয়, বাগানের মাঝ দিয়ে। সোজা পৌঁছচ্ছে আবার এক বেশ উঁচু ও বিরাট লম্বা বাড়ি, অনেক ধাপ সিঁড়ির প্রান্তে (Pic-10, Bara-Imambara, main building 1 ও Pic-11, Bara-Imambara, main building 2)।

ছবি ১০

ছবি ১১

এইটিই হলো আসাফ-উদ্‌-দৌলা নির্মিত আসাফি ইমামবাড়া, যা বেশি প্রসিদ্ধ বড়া-ইমামবাড়া ও ভুল-ভুলাইয়া নামে। ইমামবাড়ার চত্বরে পৌঁছলাম। ফিকে নীল রঙের সাফারি স্যুটের মতো স্যুট পরা অনেক সংখ্যক গাইড ঘুরে বেড়াচ্ছে, অবশ্য তারা কাছে এসে বিরক্ত করছে না। ওর মধ্যে থেকে নেতা মতো একজন আমার কাছে এসে গাইডের প্রয়োজন আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলো এবং তার সঙ্গে এও বলে দিল যে ‘ভুল-ভুলাইয়াতে’ ঢুকতে গেলে গাইড ছাড়া যেতে দেওয়া হয় না। টাঙিয়ে দেওয়া আছে বিভিন্ন সংখ্যার দর্শকের জন্য গাইডের পারিশ্রমিকের রেট-চার্ট। আমাদের ৮ জনের জন্য লাগবে ২৫০ টাকা। ইমামবাড়া ও বাওলি, দুইই সে দেখাবে। আমার মনে পড়ে গেল ১৯৫৭র কথা। তখন গাইডের কোনও গোষ্ঠী ছিল না। কেবল মাত্র ইমামবাড়া (ভুল-ভুলাইয়া সহ) দেখিয়ে নিয়ে আসার পর বাবা গাইডকে একটা সিকি দিচ্ছিলেন। গাইড লখনঊ সুলভ শিষ্টাচার দেখিয়ে অত্যন্ত মৃদু স্বরে পয়সার প্রয়োজন নেই বলেছিল। আমার কৈশোর মন চমৎকৃত হয়ে গিয়েছিল। পর মুহূর্তেই চমকে গেলাম যখন বাবা তাকে এক টাকা দিলেন আর সে আদাব করে টাকাটি পকেটস্থ করলো। যাক বর্তমানে ফিরে আসি। আমি রাজি হলাম, অবশ্য তা না হয়ে উপায়ও নেই। সেই নেতা-গাইডই আমাদের নিয়ে যাবে বলল। পারিশ্রমিক কেন্দ্রীয় ভাবে জমা দিলাম। রসিদটি গাইডই নিজের কাছে রাখলো। গাইড নেতা বলে কথা, তিনি বেশ কিছুক্ষণ কি যেন কাজে ব্যস্ত রইলেন, তার পর আর এক পরিবার আমাদের কাছে দাঁড় করালেন ও পারিশ্রমিক জমা করালেন। আরও কিছু সময় আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে অবশেষে দুই গোষ্ঠীকে ভিন্ন পারিশ্রমিক কিন্তু এক সঙ্গে (একের মধ্যে দুই) প্রদর্শন করতে আরম্ভ করলেন। তাঁর প্রদর্শনের ধারাবিবরণী দেবার কোনও প্রয়োজন নেই, ভিডিও ছবি কিছুটা নিয়ে ছিলাম, কিন্তু তাঁর কথা বিভিন্ন শব্দের মধ্যে ভিডিওতে কেন আমাদেরও বুঝতে অসুবিধেই হচ্ছিল। যা দেখলাম ও কিছুটা শুনলাম, বাকি বই পড়ে ও ইন্টারনেট থেকে জ্ঞান আহরণ যা করেছি, আপনাদের পেশ করি।

আগেই বলেছি যে অবধের চতুর্থ নবাব আসাফ-উদ্‌-দৌলা এই ইমামবাড়া নির্মাণ করা আরম্ভ করেন ১৭৮৫তে। এর নির্মাণ এবং বিরাট করে নির্মাণ করার এক মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। ওই সময়ে ওই অঞ্চল ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল। দুর্ভিক্ষ কবলিত সকল মানুষের রোজগারের ব্যবস্থা হলো এই নির্মাণ। লোকে বলে যে আম আদমিরা সারা দিন যা গড়তো, তা রাতে রইস আদমিরা ধ্বংস করতো। তবে মনে হয় এ সম্পূর্ণ গল্প কথা কেননা ইমামবাড়া নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় ১৭৯১ সালে। গড়া-ভাঙ্গা যদি চালু থাকত তাহলে মাত্র ৬ বছরে এর নির্মাণ সম্পূর্ণ হতো না। এর বিরাটত্ব আমার বর্ণনা সম্পূর্ণ হলে নিশ্চয় বুঝতে পারবেন। যদিও আশ-পাশে মোট আটটি বড় ঘর আছে যেগুলো বিভিন্ন শৈলীতে এবং উচ্চতা সহ নির্মিত এবং প্রত্যেকটির ছাদ গম্বুজাকার, তা হলেও কেন্দ্রীয় ঘরটিই ইমামবাড়ার বৈশিষ্ট্য। ৫০X১৬X১৫ মিটার৩ এই হলের পরিমাপ এবং এর ছাদ খিলান যুক্ত এবং মাঝে কোনও থাম নেই। সম্ভবত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ খিলান যুক্ত ও থাম শুন্য এই ঘর বা হল। মোটামুটি ১০/১২ মিটার উচ্চতায় হলের চারিদিক ঘিরে ১ মিটার প্রস্থের রেলিং যুক্ত বারান্দা, যেখান থেকে ঘরের ভিতরের দৃশ্য সুন্দর দেখা যায়। কিছু পরে সেই সমস্ত দৃশ্যের ছবি আপনাদের কাছে পেশ করবো। ইমামবাড়া নির্মাণে কোনও লোহা ব্যবহার হয়নি, অবশ্য তখন গৃহ নির্মাণে লোহার ইস্তেমাল নিশ্চয় জানা ছিল না, তা ছাড়া কংক্রিটের তরকিবই আবিষ্কার হয়নি, কাজেই লোহার ইস্তেমাল হবেই বা কেন। তবে পাথরের ব্লক লোহার হুক দিয়ে আটকানো অনেক সময় হতো। মোগল বাস্তু শৈলীতে ইমামবাড়া নির্মাণ করতে ইঁট, চুন-সুরখি আর ছাদে ধানের তুষের বহুল ব্যবহার হয়েছে। ইমামবাড়া জলা জমির ওপর নির্মিত হয়েছে, প্রধানত সেই কারণে এবং মোটা খিলান গুলোর ভার সহন করার জন্যে ভীষণ মোটা, প্রায় ৪/৫মিটারের দেয়াল গাঁথতে হয়েছে। আবার এই মোটা দেয়ালের নিজের ভার কমাবার জন্যে ফাঁপা করা হয়েছে। দেয়ালের মধ্যে এই ফাঁপা জায়গা গুলো একই প্রকারের ৪৮৯টি গলি পথ হয়ে গেছে যার অনেক গুলোয় নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ আছে। বেহদ কৌশলতার সঙ্গে এই গলিপথ গুলো ব্যবহার হয়েছে বাতাস পরিচলন করাতে যা সমগ্র বাড়িটিকে ঠাণ্ডা রাখে।
পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে ১৮৫৭এর পর থেকে এই গলিপথ গুলো লুকোচুরি খেলার জায়গা হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। গলিপথ গুলোর আন্ত-সংযোগ নিয়ম মাফিক গঠিত বলেই মানুষ এমন ভাবে এর ব্যবহার করতে পারছে। আর তাই এই ইমামবাড়া ‘ভুল-ভুলাইয়া’ নামে খ্যাতি লাভ করে। এমনকি বড়া-ইমামবাড়া ও আসাফি ইমামবাড়া নামও পিছনে পড়ে যায়। অনেকে বলে থাকেন যে নবাবেরা তাঁদের হারেমের জেনানাদের নিয়ে এখানে মৌজ করতেন। আমার অবশ্য তা ভাবতে মন চায়না কেননা সাধারণ ভাবে অবধের নবাবেরা পরিশীলিত রুচির মানুষ ছিলেন যাঁদের প্রধানত মুশায়েরা-নাচ-গান-বাজনা নিয়ে মাতামাতি করাই মন পসন্দ ছিল। আর এই Labyrinths মোটেই খেলার মত জায়গা নয়। এখানে একটি সুড়ঙ্গের অবস্থানের কথাও উল্লেখ করা হয় যে সেটির নাকি গোমতী নদীর ধার পর্যন্ত এমন কি নাকি রাজত্বের প্রাচীন রাজধানী ফৈজাবাদ, এলাহাবাদ ও দিল্লির সঙ্গেও যোগযোগ আছে। সুড়ঙ্গের মুখ এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
বিশেষ উল্লেখের যোগ্য যে নবাব আসাফ-উদ্‌-দৌলা এই ইমামবাড়া নির্মাণ করার জন্যে স্থপতি নির্বাচিত করেন রীতিমতো প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে দিল্লির কিফায়তউল্লাকে। এও উল্লেখযোগ্য যে প্রাসাদের মালিক ও স্থপতি দুজনকেই দফন করা হয়েছে পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ঘরের মাঝে।

ইমামবাড়ার বৈশিষ্ট্য, রমজানের জুলুসে যে সব তাজিয়া ব্যবহার করা হয় সেগুলোর মধ্যে কিছু এখানে সংরক্ষিত থাকে। প্রধান ঘরে রাখা কয়েকটি তাজিয়ার ছবি আপনাদের খিদমতে পেশ করলাম (Pic-12, Tazia 1, Pic-13, Tazia 2, ও Pic-14, Tazia 3)।

ছবি ১২

ছবি ১৩

ছবি ১৪

বারান্দার কথা আগেই বলেছি, গাইড ভুল-ভুলাইয়া ঘোরাতে নিয়ে গিয়ে সেই বারান্দাতেও আমাদের হাঁটালো। বারান্দা থেকে নিচের দৃশ্যের দর্শন আমাদের করালো, আমি আপনাদের করাচ্ছি এই ছবিগুলোর সাহায্যে (Pic-15, View from Verandah 1, Pic-16, View from Verandah 2, ও Pic-17, View from Verandah)।

ছবি ১৫

ছবি ১৬

ছবি ১৭

কাগজ ছিঁড়লে বা দেশলাই জ্বালালে যে বৈশিষ্ট্যযুক্ত শব্দ হয়, প্রায় ৫০মিটার দৈর্ঘ্যের বারান্দার এক প্রান্তে তা সংঘটিত করলে অন্য প্রান্তে সেই শব্দ শুনতে পাওয়া যায়, গাইড তা আমাদের প্রদর্শন করলো। “দিওয়ারোঁ কে ভী কান হোতে হৈঁ,” বলে ভুল-ভুলাইয়ার মধ্যে দেয়ালে আমাদের কান ঠেকিয়ে দিয়ে নিজে আমাদের দৃষ্টির অগোচরে গিয়ে কথা বলে প্রমাণ করে দিলো। ভুল-ভুলাইয়ার মধ্যে অন্ধকার, তা ছাড়া ছোট ছোট কালো রঙ্গের দেয়াল সহ গলি পথ, তাই ছবি তোলা যায়নি। এখান থেকে আমরা প্রথমে ইমামবাড়ার ছাদে গেলাম। বিশাল বড় ছাদ, চারিদিক উঁচু অলিন্দয় ঘেরা। অলিন্দয় আবার সার দিয়ে খিলানযুক্ত বড় বড় তোরণের মতো ফাঁক আর সামনে অনেকগুল শিখর যুক্ত গম্বুজ, মোগল বাস্তু শৈলীর পরিচায়ক (Pic-18, View of Imambara Roof)।

ছবি ১৮

(চলবে)

ড. শুভেন্দু প্রকাশ চক্রবর্তী

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।