প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

লখনঊ

আপনাকে যদি বলি যে কিছুদিন আগে আমি চতুর্থ বার লক্ষ্মণপুর থেকে ঘুরে এলাম, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন যে সে জায়গাটা আবার কোথায়। আর যদি বলি লখনঊ থেকে ঘুরে এলাম তাহলে হয়ত শুনবো আপনিও সেখানে একাধিক বার গেছেন। হ্যাঁ, লখনঊ বেশ বিখ্যাত শহর, স্বাধীনতার পর থেকেই উত্তর প্রদেশের রাজধানী। তবে এর খ্যাতি বা পাদ-প্রদীপে আসা মোগল সাম্রাজ্যের শেষ ভাগ থেকে আর বিশেষ করে ১৮৫৭ সালের ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে, যে সংগ্রামকে অনেক পুরানো পন্থী ঐতিহাসিকগন এখনও সিপাহি বিদ্রোহ বলতে অভ্যস্ত।

ভারতের অনেক স্থান বা শহরের নাম তার পুরানো নামে বা স্থানীয় নামে পরিবর্তিত হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও শুনিনি লখনঊ-এর নাম লক্ষ্মণপুরে পরিবর্তিত হবে। আসলে তেমন ভাবে স্থির নয় যে এই জায়গাকার এই নাম সত্যই প্রাচীন কালে ছিল। তা ছাড়া স্থানীয় মানুষ এই স্থানের নাম লক্ষ্মণপুর বলেন, তাও নয়। তা হলে আমি হঠাৎ এই নাম ব্যবহার করলাম কেন? কিংবদন্তী আছে যে পুরাকালে লক্ষ্মণ গোমতী নদীর পারে এই স্থানে নাকি বসতী স্থাপন করেছিলেন। যাক, এ বিষয়ে এর বেশি আর কিছু ঐতিহাসিক তথ্য নেই, তাই আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। বাংলায় এই শহরের নাম বিভিন্ন বানানে লেখা হয়, লখনৌ, লখনউ, লখনঊ ইত্যাদি। তবে আমি যে বানান ব্যবহার করেছি, আমার মনে হয় নামের উচ্চারণের সঙ্গে সবথেকে বেশি মিল পাওয়া যায়।

লখনঊ-এ আমার কয়েকটি জায়গা খুব ভাল লাগে। তার মধ্যে ‘রেসিডেন্সি’ অন্যতম। প্রথম বার বাবার হাত ধরে ১৯৫৭ সালে লখনঊ-এ এসে রেসিডেন্সি দেখতে এসেছিলাম। তখনই এর কথা আমার জানা হয়ে গিয়েছিল এবং এখানে পৌঁছে আমার মনে সেই যে অনুরণন জেগে ছিল তা এখনও সমান ভাবে কাজ করে।

রেসিডেন্সিতে ঢোকার আগে এই জায়গাকার ইতিহাস সম্পর্কে দু-চার কথা মনে করে নিলে, এখানকার দর্শন সার্থক হবে। লখনঊ, মোগল রাজত্বের সময় অওধ, ঔধ, অবধ বা অযোদ্ধার শাসন ক্ষেত্রের অন্তর্গত ছিল। ১৭২০ সালে তদানীন্তন মোগল সম্রাট (মুহম্মদ শাহ, ১৭১৯-১৭৪৮) অঞ্চলের সুশাসনের জন্যে অওধের নবাব নিযুক্ত করলেন। ১৭৩২-এ পারস্য দেশের খোরাসানের মোহম্মদ আমির সাদাত খান, যিনি তখন মোগল সৈন্য দলে কর্মরত ছিলেন, নবাব নিযুক্ত হয়ে লখনঊ-এর (আসলে অওধের রাজধানী ফৈজাবাদের) ভোল পালটাতে আরম্ভ করেন এবং চতুর্থ নবাব আসফ-উদ-দৌলা ১৭৫৫ থেকে, লখনঊকে, লখনঊ-এ পরিণত করতে থাকেন। লখনঊ-এর যে বৈভব, লখনঊ-এর যে শিক্ষা, সংস্কৃতি, লখনঊ বলতে যে বোলচালের বৈশিষ্ট্যের কথা আমরা জানি, তা ঐ নবাব আসফ-উদ-দৌলার সময় থেকে পরিস্ফুট হতে আরম্ভ করে। সংস্কৃতি মানেই শিষ্টাচার নয় কিন্তু এই দুই অঙ্গাঙ্গী রূপে জড়িত, একের অভাবে আর এক অসম্পূর্ণ। যদিও আজকাল অনেক সময় ঠাট্টার ছলে ব্যবহার হয় ‘আপ পহলে,’ তা কিন্তু লখনঊ-এরই উদ্ভব, শিষ্টাচারের চূড়ান্ত রূপ। এখানকার আপামর জনসাধারণ উর্দু ভাষাকে যেমন এক সুললিত, মার্জিত ও পরিশীলিত রূপ দান করেছিলেন যে সাধারণ বক্তব্যও সাহিত্য রূপে বিবেচিত হবার দাবী করতে পারত। আধুনিক ইংরাজি লেখক সালমান রুশদিও তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনীমূলক বই ‘Midnight’s Children’-এ শুদ্ধ-ভাষার উদাহরণ দিতে গিয়ে লখনঊ-এর উর্দুর কথা বলেছেন। ভাষার মতই কাপড়-পোশাক-পরিচ্ছদ ও আহার-পানের উৎকর্ষতারও তো সীমা নেই এখানকার। যাই হোক আবার একবার সংস্কৃতির জগত থেকে শাসনের জগতে ফিরে আসি।

ইতিমধ্যে ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্রমশ তুলা দণ্ড ত্যাগ করে রাজ দণ্ড ধারণ করতে আরম্ভ করেছে। অবধের জৌলুষের দিকে তাদের শ্যেন দৃষ্টি পড়তে দেরি হল না। সুযোগ এসে গেল যখন ব্রিটিশ প্রথমে পলাশী ও পরে অবধের তৎকালীন নবাব সুযা-উদ-দৌলাকে ১৭৬৪-র বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত করল। অবধের প্রচুর পরিমাণ ভূমি ব্রিটিশ গ্রাস করে নিল এবং ১৭৭৩-এ লখনঊ-এ ব্রিটিশ সৈন্য মৌরুসি পাট্টা করে ঘাঁটি গাড়ল ‘রেসিডেন্ট’ নাম নিয়ে। তবে নবাবকে আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অনেকটা স্বাধীনতা প্রদান করলো। এই সুযোগ নিয়ে ১৭৭৫-এ সুযা-উদ-দৌলার পুত্র আসফ-উদ-দৌলা ফৈজাবাদ থেকে সরিয়ে রাজধানী লখনঊ-এ নিয়ে আসলেন। এবং তখন থেকে লখনঊকে লখনঊ-এ পরিণত করার গতি ত্বরান্বিত হয়ে গেল কারণ আসফ যেমন সুশাসক ছিলেন তেমনই সমস্ত প্রকারের শিল্পের প্রতিপালক ও পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। ইনিই বিখ্যাত বড়া-ইমামবাড়া, তার সঙ্গে পাশেই বিরাট এক মসজিদ, রুমী-দরওয়াজা ইত্যাদি নির্মাণ করান প্রধানত জনসাধারণকে কর্মের বদলে রোজগারের সংস্থান করে দেবার জন্যে। সেই সময় ওই অঞ্চল প্রচণ্ড খরা কবলিত হয়েছিল। এর পর আরও বেশ কয়েকজন নবাব এলেন ও গেলেন হয় ইন্তেকাল হবার কারণে অথবা ইংরাজদের অপছন্দ হবার জন্যে। তবে প্রায় প্রত্যেকেই আসফ বা তাঁর পূর্বসূরিদের লখনঊ-এর সর্বপ্রকার উন্নতি সাধন করা অব্যাহত রেখেছিলেন যদিও সমানে ইংরাজ প্রভুদের বিশেষ করে অর্থের লালসা চরিতার্থ করতে করতে রাজ্যের ভাঁড়ার শূন্যের দিকে এগোতে থাকে। বিশেষ উল্লেখ্য যে এঙলো-নেপাল যুদ্ধের (১৮১৪-১৮) জন্যে বিশ লক্ষ টাকা ইংরাজদের ‘ধার’ হিসাবে দিতে হয়।

শেষে ফেব্রুয়ারি ১৩, ১৮৪৭-এ ওয়াজিদ-আলি-শাহ নবাব নিযুক্ত হলেন যিনি সম্ভবত ‘লখনঊ ঘরানা’-র সর্বোচ্চ স্তরের শিল্পী ছিলেন। স্বাভাবিক ভাবে রাজ ধর্মে কিছু গাফিলতি এসে পড়তো, যার জন্যে ওনার থেকে ওনার মালিক, ইস্ট ইণ্ডিয়া কম্পানি বেশি দায়ী, কারণ কর্তৃত্বের রাশ তাদের হাতেই ছিল। প্রায় ৯ বছর পর ফেব্রুয়ারি ১১, ১৮৫৬তে ডালহৌসি অরাজকতার দোহাই দিয়ে অওধ সম্পূর্ণরূপে অধিকার করে নিল আর কলকাতার মেটিয়াবুরুজে ওয়াজিদ-আলি-শাহ-কে অন্তরীন করে রাখল। অবশ্য ওয়াজিদের এক বেগম, বেগম হজরত মহল লখনঊ-এই রয়ে গেলেন।

আসুন, লখনঊ-এর সম্পর্কে এই ইতিহাস মনে রেখে আমরা রেসিডেন্সির চত্ত্বরে প্রবেশ করি। গোমতী নদীর পারে রাস্তা পার করে একটু ঘুরপথে রেসিডেন্সির প্রবেশ দ্বার। যথারীতি কাউন্টার থেকে টিকিট নিয়ে অল্প উঁচু প্রবেশ পথ হয়ে আমরা এগোলাম। ডান দিকেই রাস্তার সঙ্গে লম্ব ভাবে দেয়ালে অসংখ্য গর্ত সহ ইঁটে গড়া বেশ বড় এক বাড়ি (Pic-1, Treasury Building)। বাবার কাছ থেকে দেয়ালে ওই গর্ত গুলোর হবার কারণ শুনে সেই যে শিহরণ অনুভব করেছিলাম, তা যেন এখনো আবার আমার সারা শরীরে বয়ে গেল এখানে প্রবেশ করে এই বাড়ি দেখে।

ছবি ১

আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো ব্যারাকপুর থেকে বরখাস্ত করা ওঔধের অসংখ্য যুবক কোথা থেকে যেন লুট করা বন্দুক হাতে পাঁচিলের বাইরে থেকে এই বাড়ির দিকে গোলা-গুলি ছুঁড়ছে, চারিদিক বারুদের গন্ধে আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। সঙ্গে ইংরেজ আর ভারতীয় সৈন্যদের প্রচণ্ড চিৎকার। দিনটি ছিল ৩০ মে, ১৮৫৭ (আমি বাবার সঙ্গে ওখানে গিয়েছিলাম ১৯৫৭-র অক্টোবর মাসে)। রেসিডেন্সিতে তখন ইংরাজ ও দেশি মিলিয়ে প্রায় ১৭০০ জন সৈন্য ও তাদের পরিবার-বর্গ উপস্থিত ছিল কমিশনার হেনরি লরেন্সের অধীনে। এই আক্রমণ অবশ্য সফল হয়নি। জুলাই ১ এমনিই এক আক্রমণের সময় লরেন্সের শরীরে গুলি লাগে এবং জুলাই ৪ তার মৃত্যু হয়। সিপাহিরা রেসিডেন্সি ঘিরে রেখেছিল যা থেকে এই স্থান উদ্ধার পায় ২৭ নভেম্বর ১৮৫৭য়। যদিও লখনঊ সম্পূর্ণরূপে অধিকার পেতে ১৮৫৮র মার্চ হয়ে যায়। বিভিন্ন পর্যায়ে উদ্ধারের জন্যে ইংরেজদের প্রায় ২৫০০ জীবনের বলিদানের প্রয়োজন হয়। ভারতীয়দের মধ্যে শহিদের সংখ্যা সঠিক জানা নেই।
Treasury Building-এর মধ্যে কেন্দ্রীয় অংশটি রেসিডেন্সির ঘেরাওএর সময় এনফিল্ড রাইফেলের গুলি তৈরি করার কারখানা হিসাবে ব্যবহার হতো। এই রাইফেলের গুলিই মঙ্গল পাণ্ডে ও অন্যান্য সিপাহিদের বিদ্রোহের একটা বড় কারণ। স্কুল পাঠ্য ইতিহাসের বইয়েও এই বিষয়ের উল্লেখ আছে। এই বাড়ির সামনে ঘাসের মাঠ এবং মাঠে কাছাকাছি দুটো স্মৃতি স্তম্ভ ইংরাজ আমলেই গড়া হয়েছিল (Pic-2, Memorial for Colonel Hope, Pic-3, Epitaph on memorial for Colonel Hope ও Pic-4, Memorial for Loyal Sepoys।

ছবি ২

ছবি ৩

ছবি ৪

যদিও স্মৃতিস্তম্ভ দুটিতেই আমার কোনও আকর্ষণ নেই, কিন্তু দুটিই বেশ শিল্প সমৃদ্ধ। এই কারণেই দুটির ছবিই আপনাদের দেখালাম। ক্রমে পরিসরের আরও ভিতর দিকে গেলাম আর বেশ কিছু বাড়ি দেখতে পেলাম, কাছাকাছি না যাবার জন্যে সামনে লেখা ফলক গুলো পড়তে পারলাম না। ছবি অবশ্য তুললাম (Pic-5, Building 1& Memorial, Pic-6, Building 2 ও Pic-7, A Memorial) বেশিভাগ বাড়িরই ছাদ নেই, অর্থাৎ ভেঙ্গে পড়ে গেছে।

ছবি ৫

ছবি ৬

ছবি ৭

১৯৫৭র পর থেকে অনেক সবুজায়ণ হয়েছে, দেখতে আর বেড়াতে ভালই লাগে। নব যুবক-যুবতীদের পছন্দের জায়গা হয়েছে এখন। কয়েক বছর আগে এক অটো-চালক আমাকে কিছুতেই এখানে নিয়ে আসেনি, কারণ “অব এয়হ ‘জঙ্গল মে মঙ্গল’ হোনে কী জগহ হুই হয়, আপ ক্যায়া করেঙ্গে উধর?” ‘জঙ্গল মেঁ মঙ্গল’-এর মানে নিশ্চয় আপনাদের বোঝাতে হবে না। রেসিডেন্সির মধ্যে আমাদের দর্শনের কিছু অংশ, উপস্থিত ভিডিওতে দেখতে পাবেন এবং বৈকালিক ভ্রমণের কিছু উদাহরণও চোখে পড়বে।

পরিসরের প্রায় শেষের দিকে এক পুরানো বাড়িতে মিউজিয়াম, “১৮৫৭ স্মৃতি সংগ্রহালয়, রেসিডেন্সি, লখনঊ”-এর উদ্ঘাটন করা হয়েছে। এখন অবশ্য বাড়িটি সারানও হয়েছে। এইদিন দেরি হয়ে যাবার কারণে দেখতে পেলাম না, বন্ধ হয়ে গেছে দরজা বিকাল ৫টার সময় (Pic-8, Museum Entry point)।

ছবি ৮

অবশ্য পূর্বেকার ভ্রমণের সময় আমি এখানে ঢুকেছি। ১৮৫৭র কাছাকাছি সময়ের ছবি এখানকার প্রধান দ্রষ্টব্য। এ পর্যন্ত ভিডিও ইউটিউবের এই ক্লিপে “Residency in Lucknow”, www.youtube.com/watch?v=Tr6lUynlqKs-এ দেখতে পাবেন।


(চলবে)

ড. শুভেন্দু প্রকাশ চক্রবর্তী

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।