গ্রাম ছাড়াবার
পরেই ডান দিকে নদীর অপর পারে বেশ উঁচু পাহাড়। তবে নদী আর রাস্তার
মাঝে অনেকটা দূরত্ব এখনও রয়েছে, যেমন গ্রামের জায়গায় ছিল প্রায়
তেমনই। এখন রাস্তা অনেক জায়গায় খুব খারাপ হয়ে গেছে, আবার বেশ
কিছু অংশে ভালও রয়েছে। অবশ্য সারা রাস্তারই এই অবস্থা, পাহাড়ের
মধ্যে, বিশেষ করে হিমালয়ের মতো ভঙ্গুর পাহাড়ে যতই ভালো রাস্তা
মানুষ তৈরি করুক না কেন, প্রায়ই বিশেষ করে বর্ষার কারণে এর ভগ্নদশা
হতে বাধ্য। এই অঞ্চলটায় দেখতে পেলাম বেশ কিছু আখরোটের গাছ। বড়
টোপা কুলের আকারে সবুজ আখরোট হয়ে আছে, ফলের সংখ্যা অবশ্য খুব
বেশি নয়।
আমরা শুনেছিলাম
পুলেনার দূরত্ব গোবিন্দঘাট থেকে প্রায় ৩.৫কিমি। কিন্তু গ্রাম
ছাড়িয়ে যখন আমরা আখরোট গাছগুলির পার করার পরে কিছুটা ভাঙ্গা
রাস্তা দিয়ে এগোচ্ছি, রাস্তার পাশে পাথরের ফলকে লেখা রয়েছে ঘাঙরিয়া
১০কিমি। ঘড়ি সময় দেখাচ্ছে ১১:২০। ৩ ঘণ্টায় ৩কিমি পথ মাত্র আসতে
পেরেছি। ভয় হতে লাগলো। পরের দিকে রাস্তা শুনেছি এবং আগে দেখেছি
অনেক বেশি চড়াই। যদি এই গতিতেই হাঁটা হয় তবে ঘাঙরিয়া পৌঁছাতে
১৩কিমি পথ ১৩ ঘণ্টা অর্থাৎ রাত ১০:১৫ বেজে যাবে। না:, এই গতিতে
এগোলে চলবে না। আমরা কজন চেষ্টা করতে লাগলাম তাড়াতাড়ি পা চালাবার।
কিছু পরে
রাস্তার ধারে এক বিরাট পাথর রয়েছে এবং পাথরের মাথা সমতল এক ছাদের
আকার নিয়েছে। দেখি তার উপর বসে এক বছর দশেকের শিখ কিশোর একটি
লম্বা কাঠি দিয়ে ছোট পাথরের টুকরো ঝাঁট দেবার মতো সরাচ্ছে। তার
মা আর বাবা সস্নেহে তাকে নিচে নেমে আসতে বলছে। তাদের দেখে মনে
হলো শহরের বিত্তবান মানুষ, ছেলেটি এই রকম খোলা প্রকৃতির মধ্যে
এসে খুবই আনন্দ পাচ্ছে। মিনিট কয়েকের মধ্যেই দেখি পরপর দুইটি
শিশু, ভাই ও দিদি পোর্টারদের পিঠে ঝুড়ি চেপে নিচে নেমে যাচ্ছে।
আমি হ্যান্ডিক্যামে ছবি নিচ্ছি দেখে দিদি লাজুক ভাবে মুখ সরিয়ে
নেবার চেষ্টা করলো, তবে ওইটুকু জায়গায় কোথায় আর মুখ লুকাবে।
এখানে পরস্পর কয়েকটি শিশু, পিঠে ঝুড়ি করে পোর্টার নিয়ে যাচ্ছে
(এই রকম পোর্টারদের পিট্টু বলা হয়) আবার দুটি ছোট ছেলে রাস্তায়
বসে বিশ্রাম নিচ্ছে আর সঙ্গে সঙ্গে খেলাও করছে।
চিত্র-১৩,
ঝর্ণা
নদীর ওপারে
পাহাড়ের মাথায় সাদা ও ছাই-রঙ্গা মেঘের লুকোচুরি খেলার মধ্যে
একটা সুউচ্চ ঝর্ণার তীর বেগে নিচে নেমে আসা দেখা যাচ্ছিল পুলেনা
পৌঁছবার অনেক আগে থেকেই আর তা আমাদের চোখ সার্থক করছিল। এর আগে
এ ঝর্ণার কথা বলেছি, নিশ্চয় মনে পড়ছে। এই বার ঝর্ণা আরও পরিষ্কার
দেখা যেতে থাকলো (চিত্র-১৩, ঝর্ণা)। অনেক সময় সেই জলরাশির নামার
শুরুর জায়গা মেঘে ঢাকা পড়ে থাকার দৃশ্য আমাদের চলার গতি কমিয়ে
দিচ্ছিল। আর ঝর্ণার অন্তিম অংশ? খুঁজে পাওয়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে
সম্ভব হচ্ছিল না, সুগভীর বনানীর মধ্যে লুকিয়ে থাকার কারণে। বিরাট
বিরাট দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট ধাপে বেশ সুপুষ্ট ঝর্ণা দেখতে পেলাম ওই
পাহাড়ের গায়েই, যেটার নিচে নামা অনেকটা দেখা গেল। সেখানে এক
অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখলাম। প্রবল জলরাশি তীর বেগে প্রায় ৫০/৬০
মিটার সম্পূর্ণ রূপে বাধাহীন ভাবে নেমে আসছে পাথরের এক বিরাট
গহ্বরে। সেই গহ্বরের অনেকটা গভীরেও আমাদের দৃষ্টি পৌঁছচ্ছে।
আমার মনে হলো এই দৃশ্য অন্তত ৫০০মি. দূ্রের, তা হলেও সেই অত্যাশ্চর্য
ঝর্নার জলের পতনের গর্জন আমাদের কানে আসছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য
সেই গহ্বরের মধ্যে থেকে জল নিচের লক্ষণ-গঙ্গায় মিলিত হওয়া দেখা
যাচ্ছিল না। আমার হ্যান্ডিক্যামে বেশি শক্তিশালী জুম-লেন্স লাগিয়ে
সেই অংশের চলচ্চিত্র নিলাম। এই সময় আমার আর এক জায়গার প্রায়
একই রকম দৃশ্যের কথা মনে পড়ে গেল। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে দ্বিতীয়
বার অমরনাথ যাবার সময় পিসু-টপ থেকে যোজিবলের পথে এক ঝর্ণা দেখেছিলাম।
পূর্ব লিদ্দার নদীর সম্পূর্ণ ধারাটাই নিচে নেমে আসছিল ঠিক এখানকার
মতই পাথরের এক গহ্বরে। অবশ্য এই ঝর্ণা আমাদের বেশ কাছেই ছিল
আর জলধারার পতন মাত্র ২০/২৫মি. উচ্চতা থেকে। দুঃখের কথা, আমার
হ্যান্ডিক্যামের ব্যাটারির চার্য তখন না থাকার জন্যে সেই দৃশ্যের
চলচ্চিত্র নেওয়া সম্ভব হয়নি, তবে স্থির চিত্র নিয়ে ছিলাম।
এই ঝর্ণার
আর এক বিশেষত্বের কথা বলার মতো। আগেই বলেছি ঝর্ণায় জলের পরিমাণ
অনেক। সেই জল নিচে পড়ার সময় মনে হচ্ছিল যেন এক সঙ্গে পড়ছে না,
থেমে থেমে পড়ছে। যদিও থামা আর পড়ার সময়ের মধ্যে মাত্র ১মিলিসেকেণ্ডের
মতো পার্থক্য হচ্ছিল আর মনে হচ্ছিল যেন জল নয়, গুঁড়ো চুন কেউ
এক মুঠো করে নিয়ে নিচে ফেলে দিচ্ছে । এই দৃশ্যও আমাকে বদরীনাথ
ছাড়িয়ে বসুধারা ঝর্ণার কথা মনে করিয়ে দিলো। সেই ঝর্ণার জলও এই
রকম চুনের ড্যালা পড়ার মতো করে পড়ছিল। অবশ্য বসুধারার তুলনায়
এখানকার অনামি ঝর্ণা বেশ কয়েকগুণ বেশি উচ্চতা বিশিষ্ট।
ইতিমধ্যে
কয়েকটি ছোটখাটো ধস আমরা পার করে এসেছি। এইবার পরপর দুটো ধস বেশ
বড় ধরনের পেলাম। প্রথমটায় পাথর ও কাদামাটি মোটামুটি পরিষ্কার
করা হয়ে গেছে কিন্তু দ্বিতীয়টার পাথর সরানোর কাজ তখনোও চলছে।
লোক নির্মাণ বিভাগের রাজেন্দ্র সিং মহাশয় কাজের তদারকি করছেন।
দাঁড়িয়ে দেখলাম একটা বেশ বড় পাথর দু-তিন জন মিলে শাবলের চাড়ে
ধীরে ধীরে খাদের দিকে সরিয়ে নিয়ে এসে নিচে গড়িয়ে দিলো। পাথর
তীর বেগে প্রচণ্ড শব্দ সহ পাহাড়ের গায়ে আর গাছে ধাক্কা খেতে
খেতে নিচে এক জায়গায় স্থির হলো। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি ভিডিও
করতে আমি ভুলিনি।
রাজেন্দ্র
বাবুর কাছে জানতে পারলাম যে প্রায় সবকটা ধসই গত পরশু দিনের বৃষ্টির
সময় নেমেছে, তবে বেশ তাড়াতাড়িই তাঁরা পাথর ও কাদা কিছুটা সরিয়ে
যাত্রীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছিলেন। মানুষের বসতি
আছে এমন জায়গায় পথ আটকানো ওপর থেকে পড়া পাথর এমন ভাবে নিচে গড়িয়ে
দেওয়া যায় না, কারণ নিচে বাড়ি-ঘর ভাঙ্গা বা জীবন হানি হবার সম্ভাবনা
থাকে তাহলে।
দ্বিতীয়
ধস ছাড়িয়ে কয়েক মিনিট এগোতেই খাদের দিকে প্রচুর সংখ্যক রডডেনড্রন
গাছ রয়েছে। তার মধ্যে খান দুয়েক গাছে অসময়ে এক থোকা করে গাঢ়
লাল রঙের ফুল ফুটে রয়েছে। মনে হলো এপ্রিল-মে মাসে যদি এই রাস্তায়
আসা যেত, তা হলে নিশ্চয় চারিদিকে লাল হয়ে আছে দেখতে পাওয়া যেতো।
অবশ্য ওই সময়ে বরফের কারণে এই রাস্তা বন্ধ থাকে। জুন মাসের প্রথমেই
এই পথ যাত্রীসাধারণের জন্যে খোলা হয়। তবে শুনেছি, বিশেষ ব্যবস্থা
সাপেক্ষে ফুলের উপত্যকায় কিছু দর্শনার্থী এই সময়েও এসে থাকেন।
পিট্টু শিশুদের নিয়ে যাচ্ছে ইতিমধ্যে অনেক বারই দেখতে পেয়েছি।
এবার দেখলাম বাবা তার শিশুকন্যাটিকে কাঁধে নিয়ে নেমে যাচ্ছে।
প্রায় তার পর পরেই পিট্টুর ঝুড়িতে এক শিশু মুখে চাপা দিয়ে যাচ্ছে,
যাত্রীদের মধ্যে থেকে কেউ তাকে ডাকতেই মুখ ঢাকা হাত সরিয়ে আমাদের
এক স্বর্গীয় হাসি উপহার দিলো। অনেকক্ষণ পরে লক্ষণঙ্গার আবার
দেখা পাওয়া গেল, যদিও গর্জন প্রায় সব সময়েই শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল।
প্রায় দুপুর ১:২০ নাগাদ গোবিন্দঘাট ৫কিমি আর ঘাঙরিয়া ৮কিমি লেখা
পাথরের ফলক দেখতে পেলাম। তার মানে ৪ঘন্টায় ৫কিমি হেঁটেছি অর্থাৎ
হাঁটার গতির কিছুটা উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছি।
আরও মিনিট
চারেক হাঁটার পরেই রাস্তার ডান ধারে নদীর দিকে নিশানা দিয়ে বোর্ডে
লেখা “SUPER HYDROELECTRIC PVT. LTD, BHYUNDAR GANGA HYDROELECTRIC
PROJECT (24.5 MW), WEIR SITE” দেখতে পেলাম। তার মানে এখানে
এই জল-বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যে লক্ষণ গঙ্গার উপর বাঁধ নির্মাণ
হবে। এর পর থেকে রাস্তা বেশ উঁচুতে উঠে যেতে আরম্ভ করলো আর আমাদের
হাঁপানি বাড়তে থাকলো। তবে চলার একটা ছন্দের আমরা খোঁজ পেয়েছি,
তাই গতি আগের তুলনায় ভালই। মনে হয় অন্ধকার হবার আগে পোঁছতে হবে
আজকের গন্তব্যে সেটা আমাদের শরীর বুঝে গেছে এবং তাই সাহায্য
করছে সেই লক্ষে পৌঁছবার জন্যে। এর কাছেই বেশ কয়েকটা ভুঁই নাগফণী
(স্নেক-লিলি বা Arisaema প্রজাতির বাংলা নাম আমি দিলাম) ফুটে
আছে দেখতে পেলাম। এগুলোও একই প্রজাতির ফুল, যা আগেই দেখেছি।
পরিত্যক্ত ঝোলা সেতু রয়েছে নদীর ওপর। ওপারে ঘন জঙ্গল, কোনও পথের
চিহ্ন নেই। বুঝতে পারলাম না এই সেতু কোথায় যাবার জন্যে ব্যবহার
হতো। অবশ্য অনেক বছর আগে থেকেই হয়তো এই সেতু পরিত্যক্ত তাই পথের
চিহ্ন আর নেই।
এখন রাস্তার
ধারে গাছগুলো একে অন্যের আরও কাছাকাছি এসে গেছে। রাস্তাও যেন
পাহাড়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে ব্যস্ত, তাই সামনের রাস্তার অংশ
খুব অল্পই দেখা যাচ্ছে। নদী আমাদের ছেড়ে অনেক নিচ দিয়ে বইছে,
উচ্ছলতা প্রচণ্ড বেড়ে গেছে, গর্জনে তা প্রকাশ পাচ্ছে। প্রায়
এক ঘণ্টা হাঁটার পর এক গাছের ডালে দেখতে পেলাম গোটা দুয়েক বানর,
কোন জাতের বুঝতে পারলাম না, সারা শরীর সাদা বড় বড় লোমে ঢাকা,
মাথা ও মিসমিসে কালো মুখমণ্ডল ঘিরেও সাদা লোম। রাস্তায় তখন আমরা
চারজনেই হাঁটছিলাম, আমাদের তারা লক্ষ্য করে নিজেদের কাজে মন
দিলো। একটু ভয় হচ্ছিল যে যদি আমাদের উপস্থিতি তাদের বিরক্তির
কারণ হয়?
এইখান থেকেই
প্রথম আমরা দেখতে পেলাম বদরীনাথের নর পর্বতের (৫৮৩১মি.) পিছন
দিক। আগের বারের অভিজ্ঞতা থেকে এই পাহাড়ের পরিচয় নির্ধারণ করতে
পারলাম। অবশ্য পাহাড়ের পিছন দিক বলার কোনও মানে হয় না। তা হলেও
এই কথা বলার কারণ হলো এই দিকটা বদরীনাথ মন্দিরের বিপরীতে। এদিকে
পাহাড়ের গায়ে একটা অদ্ভুত রকমের দেখতে হিমবাহ আছে, সেটা এখান
থেকে সুন্দর দেখা গেল ।
বদরীনাথ
মন্দিরের দিক থেকে এই হিমবাহ দেখা যায় না। ওই দিক থেকে অবশ্য
হিমবাহ কেবলমাত্র মে মাসেই দেখা যাবার সম্ভাবনা থাকে তবে নারায়ণ
পর্বতের কিছুটা উপরে উঠলে, যেমন চরণ পাদুকা দেখতে গেলে নর পর্বতের
শীর্ষে অক্টোবর মাসেও হিমবাহ দেখা যায়। যাই হোক এখন আমরা দেখছি
সেই হিমবাহটি ত্রিকোণ বিশিষ্ট এবং নিচের দিকের কোণটি লম্বা জিভের
আকারে আরও নিচের দিকে নেমে এসেছে, ভূগোলে পড়া Glacier tongue-এর
এক হুবহু উদাহরণের মতো। অমরনাথের পথে শেষ নাগের ধারে পাহাড়ে
অবশ্য এর থেকেও ভাল Glacier tongue দেখেছি। এই চুড়াটি ঘাঁঙরিয়া
থেকেও দেখতে পাওয়া যায়, তবে সেখান থেকে হিমবাহের জিভের কম অংশই
দেখা যায় কারণ দৃষ্টিপথের মাঝে বেশ উঁচু উঁচু দেওদার গাছ আছে।
এরই মধ্যে স্ব-মহিমায় কখন যে লক্ষণগঙ্গার একদম কাছে চলে এসেছি
লক্ষ্যই করিনি। একেবারে নাগালের মধ্যে থাকার জন্যে কানে তালা
লেগে যাবার মতো তার শব্দ। মাঝে রুপা ও সুজু ঘোড়ায় চেপে আমাদের
এগিয়ে গেল। সত্যই সুজু বাই-পাস সার্জারি করা বুক নিয়ে এতটা যে
হেঁটে এসেছে তাই আশ্চর্যের কথা।
বিকেল ৩:১৭
মিনিটে আমরা ৭কিমি দূরত্ব পার করলাম। এই পথে দ্বিতীয় গ্রাম ভিউন্দর
(২৪৩৯মি.) এখানেই। গ্রাম পুলেনার মতো বর্ধিষ্ণু নয়, অবশ্য সম্ভবত
প্রাচীনতর। গ্রামের মধ্যে দিয়েই রাস্তা, পাকা ও কুঁড়ে ঘর দুইই
আছে। এখানেই এই পথের একমাত্র চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে, তাও সাময়িক,
হেমকুন্ড যাত্রার সময়। অবশ্য ঘাঁঙরিয়াতেও চিকিৎসার ব্যবস্থা
আছে। এখানে মানুষ-জনের উপস্থিতি ভালই রয়েছে, পুলেনার প্রায় সমস্ত
অধিবাসীরা এখন এখানে বাস করছে, এ কথা আগেই বলেছি। গুরদ্বারার
ব্যবস্থাপনায় ভাণ্ডারাও চলছে।
গ্রামের
মধ্যে থেকেই রাস্তা ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে। হাঁটুতে বেশ চাপ পড়ছে,
বিশেষ করে আমার বাতগ্রস্ত হাঁটু ভালই জানান দিচ্ছে। প্রায় আধ
ঘণ্টা চলার পর রাস্তা খুবই ভাঙ্গা, এবং বেশ দ্রুত উঁচুতে উঠে
যাচ্ছে। বড় বড় গাছের মধ্য দিয়েই রাস্তা। রাস্তার ধারে হঠাৎ দেখতে
পেলাম লেখা ঘাঁঙরিয়া ৬কিমি, মানে ৯কিমি হাঁটা হয়ে গেল। সময় প্রায়
বিকাল ৪টে। কি করে দুই কিলোমিটার ৪৫ মিনিটে হাঁটলাম! তবে কি
দূরত্ব লেখা দুটোর মধ্যে অন্তত একটা ভুল, না আমরা সময় দেখতে
ভুল করেছি? পরে আমার ভিডিও রেকর্ড দেখেছি, তাতে সময় যা রয়েছে,
তা থেকে সময় দেখা যে ভুল হয়নি তা বোঝা গেছে। একটা কথা অবশ্য
আমার মনে হয়েছে যে হাঁটা অনেক্ষণ হয়ে গেলে যেমন পরিশ্রান্ত হয়ে
যায় পথিক, তেমনই অনেক সময় সে যন্ত্রচালিতের মতোও হয়ে পড়ে। এই
সময় আমরা, বিশেষ করে আমি তাই হয়ে পড়েছিলাম বলেই মনে হয় হাঁটুর
ব্যথা মনের মধ্যে রেখেই বেশ দ্রুতই হেঁটেছিলাম নিশ্চয়।
মাত্র মিনিট
পাঁচেক এগোবার পর এক বোর্ডে বড় বড় হরফে হিন্দিতে লেখা, “সাবধান,
আগে গ্লেসিয়ার হ্যয়, ঘোড়ে সে উতর যাইয়ে।“ বাংলায় ‘আগে’ আর হিন্দিতে
‘আগে’-র মানে ঠিক বিপরীত। আমরা আগে বলতে বুঝি prior to, বা পূর্বে
আর হিন্দিতে after, বা পরে। আমরা না বাংলা আগে না হিন্দি আগে
গ্লেসিয়ার পেলাম। মনে হয় পুরো গ্লেসিয়ারই গলে গেছে। পরবর্তী
সময়ে আমরা লক্ষ্য করেছি যে আগে দেখা বেশ বড় গ্লেসিয়ারও গলে গেছে।
তবে ওই জায়গাটায় রাস্তা প্রচণ্ড খারাপ অর্থাৎ ভাঙ্গা পেলাম,
হাঁটতে বেশ অসুবিধে হচ্ছিল। একটু পরেই রাস্তা বেশ সমতল, এবং
আগের অবস্থা থেকে একেবারে বিপরীত অবস্থা, অর্থাৎ রাস্তা যেন
কয়েক দিন আগেই তৈরি। আবার খারাপ রাস্তা পেলাম এবং এবার অনেকক্ষণ
খারাপ রাস্তা দিয়েই হাঁটতে হলো। তার মানে গ্লেসিয়ারের কারণেই
এই রাস্তা ভেঙ্গে গেছে, তার আরও প্রমাণ রয়েছে রাস্তা ছাড়া সমস্ত
অঞ্চলটাতেই বড় বড় পাথর ছড়িয়ে আছে। সাধারণত গ্লেসিয়ারের সঙ্গে
ছোট বড় পাথর গড়িয়ে আসে। যখন গ্লেসিয়ার গ্লেসিয়ারই থাকে অর্থাৎ
বরফ থাকে তখন সেই সমস্ত পাথর বরফের নিচেই ঢাকা থাকে, তাই সেগুলো
দেখা যায় না। বরফ গলে গেলেই সেই ‘কঙ্কাল’ বেরিয়ে পড়ে। আমরা যে
এই ছোট বড় বোল্ডর দেখলাম, সেগুলো নিশ্চয় গ্লেসিয়ারের ‘কঙ্কাল।’
এখান থেকে পথ ক্রমশ: নেমে গিয়ে, নদীর তলে এসে গেছে। একেবারে
পাশাপাশি, যেন গলায় গলায় ভাব, এ ওকে জড়িয়ে ধরতে চাইছে। নদীর
জল এখানে পরস্পর ঝর্ণার আকার নিয়েছে । নদীর স্রোতের তীব্রতা
আর গর্জন, ওঃ, দাঁড়িয়ে দেখতে ও শুনতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু এখনো
‘দিল্লি অনেক দূর,’ দাঁড়ালে চলবে না, এগিয়ে চলো। যেতে যেতেই
কয়েক সেকেন্ড করে দাঁড়িয়ে ভিডিও করতে থাকলাম, ঘরে বসে দেখবো।
মনে পড়লো, গত বারে এই রাস্তা বিশেষ ভাঙা ছিল না, কিন্তু বেশ
কাদা ছিল। বাঁ দিকে পাহাড়ের গা দিয়ে জল ঝরছিল। এই জল ঝরা দেরাদুনের
সহস্রধারার স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছিল। তবে সহস্রধারায় আজকাল
বর্ষাকাল ছাড়া জল ঝরা বিশেষ দেখা যায় না। এ বার বৃষ্টির অভাব,
সেই কারণেই মনে হয় এখানেও তেমন জল ঝরা দেখা গেল না। তবে নদীতে
অনেক বেশি জল রয়েছে, সম্ভবত উপরে বরফ গলে যাচ্ছে অনেক তাড়াতাড়ি।
পরে আমার ধারণা যে ঠিক, বোঝা গেছলো।
বিকাল ৪:৫০
মিনিটে ৩কিমি বাকি ঘাঁঙরিয়া পৌঁছাতে লেখা দেখতে পেলাম, এবং এখানেই
লক্ষণ গঙ্গা নদীর উপর ঝোলা ব্রিজ পার হতে হলো। স্মাইথ দ্বিতীয়
বার ১৯৩৭ সালে এই পথেই এসেছিলেন এবং তিনিও সম্ভবত এই ব্রিজ পার
করে ছিলেন। সম্ভবত বলার কারণ এই জন্যে যে কিছুটা আগে যে গলে
যাওয়া গ্লেসিয়ারের কথা বলেছি, তার কিছু আগে নদীতে এক ঝোলা ব্রিজ
ভাঁঙা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছি। হয়ত সেই ব্রিজের ব্যবহারই তিনি
করে থাকতে পারেন। Valley of Flowers বইএ লিখেছেন যে তিনি ব্রিজ
পার করার সময় পর্যন্ত ফুলের দেখা না পাওয়ার কারণে সন্দেহ করেছিলেন
যে হয়ত পথ ভুল করেছেন। যাই হোক, নদীর পারেই বেশ কয়েকটা খাবারের
দোকান রয়েছে। তার মধ্যেই আবার এক ডেক চেয়ার পাতা সাজানো রেস্তোঁরা
হয়েছে। রেস্তোঁরার অবস্থিতি বেশ সুন্দর পরিবেশে, লক্ষ্মণ গঙ্গার
উপর এক ছোট দ্বীপের ধারে। চারিদিকে ঘন সবুজ বনানী, অবশ্য বনানী
এ পথে কোন জায়গায় নেই? তা হলেও কিছু আগে থেকেই জঙ্গলের গভীরতা
যেমন বেড়েছে তেমনই বনস্পতির প্রাচীনত্বও।
ব্রিজ পার
করেই রাস্তা বেশ উঁচু খাড়া পাহাড়ের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে বাঁ দিকে
বাঁক নিয়েছে। সেই দেয়ালের খাঁজে খাঁজে বেশ উঁচুতে বিরাট বিরাট
মৌচাক। মধুতে ভরা, কেননা নিচে মাটিতে মধু পড়ার দাগ রয়েছে দেখা
যাচ্ছিল। অনেক উঁচুতে হলেও দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল সময় সময় মৌচাকের
গায়ে ঢেউয়ের মত চলন। হ্যান্ডিক্যামে সেই অদ্ভুত দৃশ্য ধরে রাখলাম।
পরে দেখেছি সেই চলন বেশ ভালই বোঝা যাচ্ছে। এই খানে আমার একটা
কথা মনে এলো। প্রায় প্রত্যেক শিখ তীর্থ যাত্রী পথ চলতেই ব্যস্ত।
অত্যন্ত কম সংখ্যক শিখ যাত্রী দাঁড়িয়ে প্রকৃতির শোভা উপভোগ করছেন
আমার চোখে পড়েছে। এই যে আমি ভিডিও ছবি নিচ্ছি মৌচাকে এমন একটা
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, বেশ কয়েকজন শিখ যাত্রী আমাকে পার করে
গেল কিন্তু কেউ তার মধ্যে এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ঘটনা প্রত্যক্ষ
করলো না। এর কাছেই দেখতে পেলাম সাদা কাণ্ড সহ এক ভূর্জপত্র গাছ
ও তার পরেই গোলাপের ঝাড়। যদিও একটি মাত্র ফুলই ঝাড়ে ফুটে আছে
(চিত্র-১৪, গোলাপ (নাম বলতে হবে?))।
চিত্র-১৪,
গোলাপ (নাম বলতে হবে?)
বামাবর্তী
রাস্তা কিন্তু মাত্র ৪০ মিটারও না এগিয়ে আবার ডান দিকে বাঁক
নিল আর প্রায় ১০ মিটার উপরে উঠে গেল। এই যে বাঁক নেওয়া আর উপরে
ওঠা আরম্ভ হলো, তা বেশ কিছু দূর পর্যন্ত চলতে থাকলো আর আমাদের
যাকে বলে শুকনো ডাঁঙায় নাকানি-চোবানি খাওয়াতে আরম্ভ করে দিলো।
এই সময় ভাই ও দিদি, অনির্বাণ আর স্নিগ্ধা আমাদের ছেড়ে এগিয়ে
গেল। এক সর্দারজির সঙ্গে পরিচয় হলো, তিনি ও তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র
রাস্তার ধারে এক কালভার্টের উপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। মধ্য
বয়সী, এয়ার ফোর্সের স্কোর্ড্রন-লিডার, তাঁর পিতার অনুরোধে হেঁটে
হেমকুণ্ড তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়েছেন, পিতাও সঙ্গে চলেছেন অবশ্য
ঘোড়ায়।
৫:৫১ মিনিটে
২কিমি ঘাঁঙরিয়া পৌঁছাতে বাকির লেখা মার্কার দেখতে পেলাম, অর্থাৎ
১ ঘণ্টায় ১কিমি। ঠিকই, রাস্তার অবস্থা আর চড়াই যা, আরও আস্তে
হলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এখানকার রাস্তা ভাঁঙ্গা না হলেও
পাথরগুলোর মাঝে অনেকটা করে ফাঁক রাখা যেন সেই ফাঁক পরে সিমেন্ট
দিয়ে ভরা হবে। তা ছাড়া একের পর এক পাথর উপর দিকে স্বাভাবিক ভাবেই
উঠে রয়েছে কেননা চড়াই বেশ ভালই। এইবার একটু ভয় ভয় করতে থাকল।
তার কারণ যদিও এখানে সূর্য অস্ত যাবে ৭টার আগে নয়, কিন্তু আলো
এখনি অত্যন্ত কম, আকাশে মেঘ আর এই অঞ্চলে জঙ্গল ভীষণ গভীর আর
রাস্তা অনেক জায়গায় প্রায় গাছে ঢাকা বারান্দার মতো। তা ছাড়া
আগের অভিজ্ঞতায় জানা যে রাস্তা এই রকমই চড়াই। যাই হোক, ভেবে
লাভ নেই চলা বন্ধ করলে চলবে না। এই জায়গাতেই পথের পাশে নাগফণীর
একটা ফুল দেখতে পেলাম। এ পর্যন্ত যে প্রকারের ফুল থেকেছিলাম,
এটা সে রকম নয়। ফুলের গায়ে লম্বা ভাবে গাঢ় সবুজের পটি সমান্তরাল
ভাবে রয়েছে। বাড়ী ফিরে বই থেকে মিলিয়ে এর নাম পেয়েছিলাম Arisaema
propinquum।
আকাশ মেঘে
ঢাকা থাকা সত্যেও কয়েক মিটার আরও এগোবার পরেই উত্তর দিকে ঘন
নীল আকাশ এবং শরৎ কালের মতো সাদা মেঘের ভিতর দিয়ে বরফের চুড়া
দেখতে পাওয়া গেল, আমি অবশ্য সেই শৃঙ্গ চিনতে পারলাম না। এই অঞ্চলের
মানচিত্র থেকে আমার পরে মনে হয়েছে যে এর নাম হয়তো সপ্তশ্রীঙ্গ
(৫০৩৮মি.) হতে পারে। এই সময়েই আমাদের সঙ্গে এক দল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী
সঙ্গী পেলাম, যারা পাঞ্জাব থেকে এসেছে মনে হলো। তারা কেউ এগিয়ে
যাচ্ছে আবার দাঁড়িয়ে সাথীদের জন্যে অপেক্ষা করছে এমন ভাবে চলতে
থাকলো। পরস্পরের মধ্যে অনর্গল কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছে। বয়স কম
তাই বোধহয় এমন সম্ভব, আমরা নিজেদের মধ্যে একটা কথা বললেই বেশি
হাঁপিয়ে যাচ্ছি। বাকি রাস্তাটা ওরাই আমাদের সঙ্গ দিলো এবং শেষে
অবশ্য আমরাই আগে ঘাঁঙরিয়া পৌঁছেছিলাম, কারণ তাদের ঘরে পৌঁছবার
জন্যে ব্যগ্রতা ছিলনা। এই দলের মধ্যেই দেখতে পেলাম দুই বন্ধুর
কাঁধে ভর দিয়ে একটি ছেলে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে চলেছে।
প্রায় ৬:৩০
নাগাদ আমরা এক সমতল ভূমির ধারে এলাম। এই ভূমিতে ঘাঁঙরিয়ার হেলি-প্যাড
রয়েছে, কোনও হেলিকপ্টার অবশ্য প্যাডে ছিলনা। এই ভূমি রাস্তার
তল থেকে কিছুটা নিচে, তা হলেও পরস্পর বড় বড় পাথরের চৌকো চাঙড়
বসিয়ে রাস্তা থেকে প্রায় ৭৫সেমি উচ্চতা বিশিষ্ট চওড়া পাঁচিল
করা রয়েছে যা বড় বড় আগাছায় প্রায় ঢাকা পড়ে রয়েছে। সেই পাঁচিলের
উপর চোখে পড়ল কি যেন নড়ছে। আলো কম, ভাল দেখা যাচ্ছে না, দাঁড়িয়ে
কিছুক্ষণ লক্ষ্য রাখলাম। খয়েরি রঙের মাঝারি আকারের ইঁদুর বসে
আছে মনে হল। আবার এও মনে হলো যে এ মারমোট, এক ধরনের মেঠো কাঠবেড়ালি।
এর লেজ ইঁদুরের চাইতে অনেকটা ছোট। অবশ্য কাঠবেড়ালিদের মতো ঝালর
দেওয়াও নয়। মুখ কাঠবিড়ালির সঙ্গেই বেশি মেলে, ইঁদুরের মতো লম্বা
মুখ নয়। বিশেষ নড়াচড়া করছিল না, তাই বেশ কয়েক সেকেন্ড ভিডিও
ছবি নিতে পারলাম। স্টিল ক্যামেরায় ছবি তোলার কথা তখন খেয়ালই
হলো না। মারমোট দেখা এটা আমার দ্বিতীয় বার। গত ২০০৮ সালে লাদাখের
প্যাঙগং সো-এর পথে কয়েকবার দেখেছিলাম। সেগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটা
অনেক বড়ও ছিল। এত সব বলার পরেও আমার অবশ্য এ মারমোট না ইঁদুর
সন্দেহ থেকেই গেল। যাই হোক, সমভূমির পাশ দিয়ে রাস্তা এগোচ্ছে,
তা হলেও রাস্তার তল কিন্তু ক্রমশ: উঠে যাচ্ছে, অবশ্য তলের নতি
খুব একটা বেশি নয়। পাশাপাশি পাথরের ফাঁক থাকা রাস্তা এখানেও।
মাঠের শেষে বেশ কিছু টিনের গোলাকার কুঁড়ে ঘর রয়েছে। মনে হল ওগুলো
সেনা বিভাগের।
আমার ছবি
তোলার মাঝে ভারতী কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিল। লক্ষ্য করলাম যে ও দাঁড়িয়ে
গেছে। কাছাকাছি যেতে দাঁড়িয়ে যাবার কারণ বুঝতে পারলাম। সামনে
সমস্ত রাস্তা জুড়ে বেশ কিছু সংখ্যক বড় বড় গরু দাঁড়িয়ে আছে। তারা
অনেকেই পরস্পরের শরীর পরিষ্কার করে দিতে ব্যস্ত। কাজেই তাদের
মাঝে যেটুকু রাস্তা ফাঁকা রয়েছে সেখান দিয়ে এগোতে ভয় করছিল।
অল্প সময়ের মধ্যেই কয়েকজন যাত্রী ঘোড়া করে এদের পাশ দিয়ে চলে
গেল, সেই সুযোগে আমরাও এগিয়ে গেলাম। সেনা বিভাগের বাড়িগুলো পার
করার পরেই ঘাঁঙরিয়া ১কিমি লেখা পাথর দেখতে পেলাম ৬:৫৩ মিনিটে।
ভদ্রলোকের এক কথা, ১ ঘণ্টায় ১ কিমি হাঁটা। শরীর টেনে নিয়ে এগোতে
থাকলাম। কিন্তু ১০০মি. হাঁটার পরেই সামনে যেন লাফিয়ে রাস্তা
উঁচুতে উঠতে আরম্ভ করল এঁকে-বেঁকে। রাস্তা চলেছে দেড়-দু মিটার
ব্যাস বিশিষ্ট অসংখ্য দেওদারের মাঝ দিয়ে। এরা খাড়া উঠে গেছে
আকাশের থেকে মেঘ ধরার জন্যে। অনেক সময় অবশ্য মেঘ নিজেরা নেমে
এসেই বৃদ্ধদের মাথায় হাত বুলিয়ে যায়। আর তারা এত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে
আছে যে নিচে থেকে আকাশের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ব্যাগ থেকে টর্চ
বার করলাম দুজনেই। হ্যাঁ আমরা দুজনেই সব কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস
আলাদা করেই নিয়ে যাই। এই সমস্ত মহাদ্রুম কত কাল ধরে জঙ্গল পাহারা
দিচ্ছে কে জানে। এদের শরীরের উপর বটবৃক্ষের মতো ঝুরি নেমেছে,
শৈবালের। স্থানীয় লোকেদের ধারণা যে এঁরা সব মহান আত্মা, ধ্যান-রত
ও সমাধিস্থ। পথ জল-কাদা ভরা, তার উপর আবার পাথরগুলো কিছুটা গোলাকার
ও মসৃণ। খুব সাবধানে এগোতে হচ্ছে। ভাই-বোন অনির্বাণ আর স্নিগ্ধাদের
এইখানেই আবার ধরে ফেললাম। স্থান মাহাত্ম্যে ওরা এখানে বেশি তাড়াতাড়ি
হাঁটতে পারছে না।
সুখের কথা
যে আমাদের থাকবার জায়গায় পৌঁছাতে ১কিমি হাঁটতে হবে না। এখানই
ঘাঁঙরিয়ার কিছু বাড়ি-ঘর দেখা যাচ্ছে, এগুলো এই অঞ্চলের অধিবাসীদের
যাত্রাকালের সাময়িক বাসস্থান। আমার ভাই কল্যাণ, বন্ধুবর হীরামোহন
আর ভ্রাতুস্পুত্রসম অচিন্ত্য এরা হেঁটে অনেক আগে নিশ্চয় পৌঁছে
গেছে। তা ছাড়া সুজিত আর তার স্ত্রী রূপা ঘোড়ায় এসেছে। তাদের
সকলকেই কানাইহার গেস্ট হাউসের কথা বলাই ছিল, তারা আমাদের জন্যেও
ব্যবস্থা করবে। কাজেই শরীর কোনও রকমে টেনে কিন্তু মন উড়িয়ে নিয়ে
আমরা যাত্রা শুরুর প্রায় ১০ ঘণ্টা পরে ৭:১৫ মিনিটে পূর্ব নির্ধারিত
জায়গা ঘাঁঙরিয়ার কৃষ্ণা প্যালেস ট্যুরিস্ট গেস্ট হাউসে এসে উঠলাম
।
যে সকল পাঠক
পাহাড়ে ভ্রমণে অনভিজ্ঞ, তাঁরা মনে করতে পারেন যে এই ১৩কিমি দূরত্ব
হাঁটতে পাহাড়ে প্রায় এতটাই সময় লাগে। না, তা নয়, তবে আমাদের
মতো বয়সে এবং বাতগ্রস্ত হলে এই সময় লাগতেই পারে। আগেই বলেছি
আমার বন্ধুবর, হীরামোহন আমার চাইতে মাস তিনেকের বড়, তার সময়
লেগেছিলো ঘণ্টা সাতেক এই পথটা হাঁটতে। এখান থেকে লোকপাল-গেমকুণ্ড
প্রায় ৬কিমি আরও দূরে। সেখানে আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিলো ৭/৮ জন
শিখ যুবকদের সঙ্গে। তারা সেই দিন সকাল ৬টা নাগাদ গোবিন্দঘাট
থেকে বেরিয়ে প্রায় দুপুর ১:৩০ মিনিটেই হেমকুণ্ডে পৌঁছেছিলো এবং
সেই দিনই ২:৩০ নাগাদ আবার গোবিন্দঘাট ফিরে যাবার জন্যে হাঁটা
শুরু করছিলো। তার মানে ৭ ঘণ্টা ৩০ মিনিটে ১৯কিমি চড়াইয়ে এবং
তার পর নিশ্চয় ঘণ্টা পাঁচেকে ১৯কিমি নিচে নেমে যেতে পেরেছিলো!