বিবিধ
প্রসঙ্গ: গৃহ পরিচারিকাদের জীবনকথা (১)
(২)
গত কয়েক দশকে
মানবাধিকার আন্দোলনের প্রভাবে বিশ্বের নারীমুক্তি আন্দোলনে যে
জোয়ার এসেছে - তার অভিঘাতে আমাদের দেশের মেয়েদের জীবিকার প্রশ্নটি
সোচ্চর হয়ে উঠেছে। আমাদের মত দেশে দারিদ্রের সঙ্গে জীবিকার সম্পর্ক
ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখানকার বিশাল শ্রমবাহিনীকে ব্যবহার করার মত
কর্মসংস্থানের সুযোগ কোনও সৃষ্টি হয় নি। বলাই বাহুল্য যে এই শ্রমবাহিনীর
এক বৃহৎ অংশ হল মেয়েরা। অতীতের সংগঠিত শিল্পগুলিতে যে সব মেয়েরা
যুক্ত ছিল স্বাধীনতার তিরিশ বছরের মধ্যে সেই মেয়েরা বিতাড়িত হয়েছে
- তাদের সরে যেতে হয়েছে অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে অথবা বেকার জীবনে।
শুধু শিল্প থেকেই নয়, কৃষিকাজ থেকেও তাদের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।
১৯৮৭ সালে ছয় সদস্য বিশিষ্ট
জাতীয় কমিশন স্বনির্ভর কাজে এবং অসংগঠিত সংস্থায় যুক্ত মেয়েদের
উপর একটি সমীক্ষা করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীমতি এলা ভাটের নেতৃত্বে
যে রিপোর্টটি 'শ্রমশক্তি' নামে প্রকাশিত হয়, সেই রিপোর্টে বলা
হয়েছে যে, অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে মেয়েরা প্রধানত সবচেয়ে কঠিন, বৈচিত্র্যহীন
অধিক সময় সাপেক্ষ এবং কম- পারিশ্রমিকের কাজ পায়। নতুন প্রযুক্তি
বা যন্ত্রপাতি আমদানিতে তাদের বিশেষ কোনও লাভ হয় নি। আধুনিকীকরণের
ফলে তাদের কাজে কোনও বৈচিত্র্য আসে নি। কৃষিতে যন্ত্রপাতি আমদানির
ফলে তারা কৃষক থেকে ক্ষেতমজুরে পরিণত হয়েছে। মেয়েদের এখন একটি
মজুত শ্রমবাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা হয়, প্রয়োজনর তাদের বাইরেও
ঠেলে দেওয়া হয়। স্থায়িত্ব এবং নিরাপত্তার অভাবে তারা বাধ্য হয়
যেন তেন প্রকারের কাজে যুক্ত হতে।
মেয়েদের কাজ সম্পর্কে আমাদের
সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন এখনও হয় নি। নারীশ্রমিক
সংক্রান্ত তথ্য পরিবেশনেও এই দৃষ্টিভঙ্গী প্রতিফলিত। বাস্তবে কর্মরত
মেয়েদের যে সংখ্যা, তার প্রায় ত্রিশ শতাংশ কম হারে তথ্যে দেখানো
হয় এবং বিনা বেতনে পারিবারিক শ্রম, ব্যক্তিগত উৎপাদন এবং গৃহস্থালী
কাজে মূল্যায়ন হয় না। দরিদ্র পরিবারের উপার্জনে মেয়েদের অবদান
অর্থনৈতিক বাজারের হিসেবের একেবারে বাইরে। বর্তমান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক
পরিবেশে গৃহকাজে যুক্ত মেয়েদের উপরে ঘর ও বাইরের কাজের বোঝা অত্যন্ত
অমানবিক। গৃহস্থ বাড়িতে শ্রম দেওয়ার পর ঘরে ফিরে তাদের সেই একই
কাজ করতে হয় পরিবারের সদস্য হিসেবে। অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রের মধ্যে
রুজি-রোজগারের জন্য গৃহস্থালি কাজে যুক্ত মেয়েদের সংখ্যা সম্পর্কে
কোনও সার্বিক তথ্য পাওয়া যায় না। গৃহকর্মে মজুরির বিনিময়ে যুক্ত
মেয়েদের নিয়ে যে বিশাল শ্রমবাহিনী, তার সংখ্যাগত তথ্য জনগণনায়
বা আদমসুমারিতে নথিভুক্ত করা নেই। এই পেশায় যুক্ত মেয়েদের গৃহপরিচারিকা,
রাঁধুনি বা ঝি বলা হয়। এদের উপার্জন যেহেতু অনিয়মিত এবং হিসেবের
বাইরে, তাই জতীয় আয়ে এদের অবদানের কোনো উল্লেখই থাকে না। জাতীয়
কমিশনের রিপোর্টেই গৃহকর্মে যুক্ত মেয়েদের সম্বন্ধে কোনো তথ্য
লিপিবদ্ধ হয় নি। অথচ গৃহকর্মে যুক্ত মেয়েদের এই পেশা নতুন নয় -
অতি প্রাচীনকাল থেকেই এই পেশা প্রচলিত। গৃহপরিচারক, চাকর বা ভৃত্য
হিসেবে এক সময়ে পুরুষদের নিয়োগ করা হত। বিশেষত ধনী জমিদার শ্রেণীর
বাড়িতে পুরুষ পরিচারকদের নিয়ে অনেক কাহিনীও আছে। কিন্তু ত্রিশ
চল্লিশ দশকের সময় থেকেই গৃহকর্মে নিযুক্ত পুরুষদের সংখ্যা দ্রুতহারে
কমে গিয়েছে - বর্তমানে প্রায় নেই বললেই চলে। গৃহকর্মের পেশাটি
সম্পূর্ণভাবে মেয়েদের দখলেই চলে গেছে। দারিদ্র , শিক্ষার অভাব
ছাড়াও এর অন্যতম হল এই যে, মেয়েরা বাল্যকাল থেকেই গৃহস্থালী কাজে
যুক্ত থাকে এবং এই কাজে অভ্যস্ত ও দক্ষ হয়ে ওঠে। এর জন্য পৃথক
ভাবে কোনো প্রশিক্ষণ নিতে হয় না। পরিবারের অস্তিত্বের সঙ্গে গৃহকর্মের
শ্রম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই এই কাজের চাহিদা এবং যোগান - দুই-ই
সমান। দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী অসংখ্য পরিবার এই পেশার উপর
নির্ভরশীল। এই সব পরিবারের সিংহভাগ সাংসারিক ব্যয় মেয়েরা বহন করে।
এমন একটি প্রচলিত ও প্রয়োজনীয় পেশায় যুক্ত শ্রমজীবী মেয়েদের সংখ্যাগত
কোকো তথ্য কেন পাওয়া যায় নাম কেনই বা আদমসুমারিতে তার তথ্য থাকে
না, তা বোধগম্য হয় না। এদের শ্রম প্রচলিত অন্যান্য শ্রমিকদের শ্রমের
সঙ্গে যুক্ত করলে দেখা যাবে যে, শ্রমজীবী মেয়েদের সংখ্যা পুরুষদের
চেয়ে কিছুমাত্র কম নয় - বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি।
গৃহশ্রমে যুক্ত পরিচারিকাদের
ক্ষেত্রে আর একটি নেতিবাচক দিক হচ্ছে এই যে, তাদের শ্রমের কোনো
মর্যাদা (dignity of labour) নেই। এদের কাজকে সমাজে অত্যন্ত নিম্ন
মানের কাজ বলে মনে করা হয়। কোনো পরিবারে কন্যাসন্তান যদি লেখাপড়ায়
মন না দেয় বা কোনো সৃজনশীল কাজে অনিহা প্রকাশ করে, তাহলে তাকে
ভরৎসনা করা হয় - 'যা, ঝি-গিরি করে খা।' আবার কোনো ঝগড়া-বিবাদের
সময় বকা হয় - 'ঝি-চাকরের মতো চিল্লচ্ছিস কেন?', পোষাক-আষাক ময়লা
হলে বলা হয় - 'ঝি-চাকরের মতো পোষাকের চেহারা করেছে দেখ।' গৃহকর্মে
নিযুক্ত মেয়েদের সম্পর্কে এতটাই নিম্নমানের দৃষ্টিভঙ্গী যে প্রায়শই
বলতে শোনা যায়, 'ওরা ঝি-চাকর শ্রেণীর লোক - ওদের সঙ্গে এত কথার
কি দরকার?' এদের জন্য জামা-কাপড় কিনতে গেলে দোকানে জিজ্ঞেস করতে
দেখেছি - 'ঝি-দের জন্য শাড়ি দেখান তো?' বর্তমানে অবশ্য ঝি-দের
জন্য ভাষাটি পাল্টে 'কাজের মেয়েদের' জন্য শাড়ি দেখাতে বলা হয়।
মনিব বাড়িতে এদের উচ্চাসনে বসতে নেই, অনেক বাড়িতে এদের খাবারও
আলাদাকরে নির্দিষ্ট করা থাকে।
বাড়িতে কাজের মেয়ে বা গৃহপরিচারিকাদের
সঙ্গে আরও একটি অত্যন্ত অমানবিক আচরণ হল যে-কোনো জিনিস হারিয়ে
গেলে বা চুরি গেলে প্রথমেই এদের দায়ী করা হয়। প্রকৃত চুরির দায়ে
ধরা পড়ার ঘটনা যেমন আছে, তার চেয়েও বেশি দেখা গেছে নিছক সন্দেহের
বশে কাজের মেয়েদের চোর বদনাম দিয়ে কাজ থেকে বিতাড়ন, অত্যাচার ও
পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা। এদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে জেনেও
কর্মদাতারা ক্ষমা চাওয়া তো দূরস্থহান, অনুশোচনার চিহ্নও তাদের
মধ্যে কমই দেখা যায়।
কাজের ধরন:
পরিচারিকাদের কাজের বিভিন্ন
ধরন বা নমুনা আছে। এক শ্রেণীর কাজের মেয়েরা ঠিকে কাজ বা ঠিকে ঝি-এর
কাজে যুক্ত বলা হয়। এরা একাধিক বাড়িতে কাজ করে। সকাল ৬টা থেকে
সন্ধ্যা পর্যন্ত কোথাও দুই বেলা, কোথাও এক বেলা, কোথাও বা ঘণ্টা
হিসেবে এরা কাজ করে। এদের মধ্যে ঝি এবং রাঁধুনি - দুই-ই আছে। একাধিক
বাড়িতে রান্নার কাজ করে যারা তাদের বলা হয় ঠিকে রাঁধুনি। কোনো
বাড়িতে একবেলা, কোনো বাড়িতে দুই বেলা রান্নার কাজ করে এরা। ঠিকে
ঝি ও ঠিকে রাঁধুনির মধ্যে মজুরির পার্থক্য থাকে। রান্নার কাজে
মজুরি একটু বেশি। সর্বক্ষণের জন্য নিযুক্ত রাঁধুনিদের মজুরি ছাড়াও
খাওয়া-পরার সুযোগ থাকে। গত দু-তিন দশকে সাধারণ ভাবে কাজের লোকদের
অবস্থার ও অবস্থানের কিছু পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই, তবে সেই পরিবর্তন
আইনের পথে ঘটে নি। মালিক ও কর্মীদের মধ্যে কিছুটা সমাজ চেতনা ও
মানবিক চেতনা বৃদ্ধির ফলেই এই পরিবর্তন ঘটেছে। পরিবর্তনের ইতিবাচক
রূপটি অনেক সময়েই নির্ভর করে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কে মানবিক আচরণের
তারতম্যের উপর। সাধারণভাবে অধিকার প্রশ্নে কাজের মেয়েদের সুযোগ-সুবিধা
আদায়ের জন্য তেমন কোনও দরকষাকষির জায়গা এখনও তৈরি হয় নি - অর্থাৎ
গৃহকর্মে নিযুক্ত শ্রমজীবী মেয়েদের নিজস্ব কোনো সংস্থা না থাকায়
তারা দরাদরির ক্ষমতা অর্জন করতে পারে নি। তবে যেসব অঞ্চলে চাহিদার
তুলনায় জোগান কম, সেখানে কাজের মেয়েদের দরাদরির অধিক ক্ষমতা লক্ষ্য
করা যায়।
কাজের পরিধি, সময় এবং পরিবারের
সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী মজুরির পরিমান মাসে ১০০০ টাকা থেকে ২৫০০
টাকা। কে কতটা মজুরি সংগ্রহ করতে পারবে, তা নির্ভর করবে কে কতটা
কায়িক শ্রম ব্যয় করতে সক্ষম, তার ওপর। ঠিকে কাজ যারা করে, তাদের
এক বৃহৎ অংশ গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে কাজ করতে আসে। লোকাল ট্রেন ধরে
ভোরবেলায় তারা শহরে চলে আসে, ফিরে যায় সন্ধ্যার আগে। প্রতিদিন
ট্রেনে যাতায়াত করে যারা কলকাতায় কাজ করতে আসে, তাদের অধিকাংশই
উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বাসিন্দা। মেদিনীপুর থেকে অনেক মেয়ে
কলকাতায় বস্তি অঞ্চলে ঘর ভাড়া করে পরিচারিকার কাজ করে। যারা সর্বক্ষণের
কাজে যুক্ত, তারা মনিবের বাড়িতেই থাকে নতুবা শাহরের বস্তি অঞ্চলে
থাকে।
প্রতিদিন ট্রেনে যাতায়াত
করে কাজে আসা মেয়েদের গ্রামে নিজস্ব আস্তানা আছে। আবার উত্তর ও
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েদের অনেকেই রেল লাইনের
পাশে ছোট ছোট খুপরি বা ঝুপড়ি বেঁধে থাকে। এদের অনেকেরই দেশে সামান্য
জমিজমা ও বাস্তুভিটা আছে। সেখানে আত্মীয় বা পরিচিত বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার
উপরে ঘরবাড়ি দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে এরা কলকাতার বস্তি অঞ্চল বা
রেল লাইনের পাশে ঘর বাঁধে। মাঝে মাঝে এরা দেশের বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর
নেয়; যার সামান্য চাষবাস আছে সে ফসল সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। রেল
লাইনের ধারে ঝুপড়িবাসীদের প্রায়ই উৎখাতের নোটিশ দেওয়া হয়, আস্তানাগুলি
ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তখন এরা রেল লাইন অবরোধ করে প্রতিবাদ
জানায়। এদের জীবনযাপনের এই টানাপোড়েন সর্বদা চলতেই থাকে। বস্তি
বা রেললাইনের ধারে এদের অস্থায়ী বাসস্থানের চেহারা অতি করুণ। একটি
পরিবারের একটিই খুপরি, তার ভেতরে ইটের উপর ইট চাপিয়ে চৌকি বসায়
চৌকির নীচে সংসারের যাবতীয় জিনিসপত্র থাকে। রান্নার জন্য আলাদা
কোনও জায়গা থাকে না, ঘরের এককোণে কেরসিন-স্টোভে রান্না করা হয়।
কেউ কেউ ওরই মধ্যে বাঁশ দিয়ে মাচা তৈরি করে মাথা গোঁজার আরেকটা
বাড়তি জায়গা করে নেয়। অধিকাংশ বাসিন্দাদের বিদ্যুৎ নেই। কেউ কেউ
রাস্তার লাইন থেকে বে-আইনিভাবে বিদ্যুতের তার টেনে নেয়।
যারা গ্রাম থেকে প্রতিদিন
যাতায়াত করে তাদের অবস্থা অত্যন্ত কঠিন। অনেকটা পায়ে চলা পথ অতিক্রম
করে ভোর হতে না হতেই এদের ট্রেন ধরতে হয়, আবার সারাদিন কাজ সেরে
ঘরে ফেরার ট্রেন ধরতে হয়। দল বেঁধে কাজ করতে আসা এই মেয়েরা নিজেদের
মধ্যে সারাদিনের অভিজ্ঞতা বিনিময় করে। নতুন নতুন কাজের খোঁজ খবর
পাওয়া যায় কথোপকথনের মাধ্যমে। এরা কাজ সেরে যখন ঘরে ফেরার ট্রেনে
ওঠে, তখন মুড়ি জাতীয় খাবারের পসরা নিয়ে হকাররাও ট্রেনে ওঠে। ক্ষুধার্ত
মেয়েরা সকলেই মুড়ি খেতে খেতে সুখ-দুঃখের আলোচনা করে, মনিব-বাড়ির
কোনো বিশেষ মুখরোচক ঘটনা নিয়ে হাসাহাসি করে। বিভিন্ন সময়ে সমীক্ষার
কাজ করতে ট্রেনে যাতায়াতের এই পথদৃশ্য আমার চোখে পড়েছেড।
গৃহকর্মের
ক্ষেত্রেগুলিতে কিছু পরিবর্তন:
পরিচারকদের কাজের জগতে কিছু
পরিবর্তন ঘটেছে। শহরের বিস্তার ও উন্নয়নের সুবাদে তাদের কাজের
পরিধি অনেকটা বিস্তার লাভ করেছে। সমাজে জনসংখ্যার একাংশের হাতে
প্রচুর সম্পদ মজুত হওয়ায় শতকরা দশ-বারো ভাগ মানুষের জীবনযাত্রার
মান উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, বড় বড় বহুতলবিশিষ্ট ফ্ল্যাটবাড়ি
বা কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ চলছে ঢালাও ভাবে। তার ফলে একই জায়গায়
একজনের একাধিক কাজ পাবার সুযোগের সৃষ্ট হয়েছে। এই অবস্থায় ঠিকে
এবং সর্বক্ষণের কাজের লোকের চাহিদা বেড়েছে।
দ্বিতীয়ত, বহুতলবিশিষ্ট ফ্ল্যাটবাড়ির
মালিকদের বাড়ির কাজ অর্থাৎ গৃহকর্মের সুবিধার্থে আধুনিক ইলেকট্রনিক
যন্ত্রপাতির আমদানির ফলে কাজের মেয়েদের কায়িক পরিশ্রম কিছুটা লাঘব
হয়েছে এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রশিক্ষণও এরা রপ্ত করেছে।
তৃতীয়ত, এদের মজুরিও বৃদ্ধি
পেয়েছে এবং মনিব ও কর্মীর মধ্যে বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই এই মজুরি বৃদ্ধির
বিষয়টি সম্ভবপর হয়েছে। পরিচারিকাদের কাজের স্থায়িত্ব বা নিরাপত্তার
অভাব অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে কারণ কাজের চাহিদা এবং যোগানের মধ্যে
একটা সামঞ্জস্যের সৃষ্টি হয়েছে। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে
আসংখ্য অণু-পরিবারের। এই ছোট পরিবারের অনেক স্বামী স্ত্রী উভয়েই
চাকুরিজীবী হওয়ায় কাজের লোক অর্থাৎ গৃহপরিচারিকার চাহিদা বেড়েছে।
একই কমপ্লেক্সে একাধিক মেয়ে কাজ করার ফলে তাদের নিজেদের মধ্যে
অনেক ক্ষেত্রেই একটি অলিখিত বোঝাপড়া বা চুক্তি গড়ে উঠেছে। অনেক
সময় এরা এককভাবে বা দলবদ্ধ হয়ে মজুরি বৃদ্ধি এবং তাদের প্রতি অবিচারের
বিরুদ্ধে সোচ্চর হয়। চাকুরিজীবী পরিবারগুলি কাজের লোকেদের উপর
নির্ভরশীল হওয়ার ফলে বেতন বা মজুরি নিয়ে দর কষাকষির সুযোগও বৃদ্ধি
পেয়েছে।
গৃহপরিচারিকার কাজে যুক্ত
মেয়েদের বিষয়ে অনেক পরিবারেই মানবিক আচরণ পরিলক্ষিত হয়। কাজে কামাই
করলে বকাবকি করা হলেও সাধারণত মাইনে কাটা হয় না, জামাকাপড়ও নিম্নমানের
দেওয়া হয় না। বিপদে-আপদে অনেক মনিববাড়ি সাহায্য করে থাকে। কিন্তু
ব্যতিক্রমও আছে। বিশেষত মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারে এখনও কাজের লোকের
মজুরি কাজের পরিধি ইত্যাদি বিষয়ে কৃপণতা ও বৈষম্যমূলক আচরণ পরিলক্ষিত
হয়। যথাসম্ভব কম মজুরির বিনিময়ে অধিক কাজ আদায় করার প্রবণতা পরিবারগুলির
মধ্যে দেখা দেয়। এই ধরণের পরিবারগুলিতে একজন বেশি দিন টিকে থাকে
না, অনবরত কাজের লোক বদলে যেতে থাকে।
গত দুই-তিন দশক ধরে গৃহকর্মে
নিযুক্ত অল্পবয়সী মেয়েদের সংখ্যা বেশ খানিকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক
পরিবারই নাবালিকা নিয়োগে উৎসাহী। কারণ তাদের কম মজুরি দেওয়া যায়,
তারা কম খায় এবং তাদের হুকুম দিয়ে বা মিষ্টি কথা বলে অনেক বাড়তি
কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। এই অল্প বয়সী মেয়েদের মধ্যে মালিকের বাড়ির
মহিলাদের আচার-আচরণ ও সাজসজ্জা অনুকরণ করার প্রবণতা দেখা যায়।
এদের একটি বড় অংশই সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে নিযুক্ত হয়। আজকাল
প্রত্যেক বড়িতেই টেলিভিশন থাকার ফলে হিন্দি গান, নাচ ও বিজ্ঞাপনের
প্রলুব্ধ প্রচার এই মেয়েদের উপর প্রভাব বিস্তার করে। এরা নানা
ধরণের প্রসাধন দ্রব্য ব্যবহার করার ও চলতি ফ্যাশনের অনুরকরণ করার
চেষ্টা করে। লেখাপড়া করার ইচ্ছা এদের মধ্যে কমই থাকে এবং অধিকাংশ
মালিক বা মনিবই সেই দিকটিতে নজর দেয় না। প্রলোভনের হাতছনিতে এই
মেয়েরা নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। তাদের এই বিপর্যয়ের খবর সংবাদ-মাধ্যম
সূত্রে প্রায়ই পাওয়া যায়। আরও ভালো উপার্জন, বিয়ের প্রলোভনে পা
দিয়ে বহু নাবালিকা অন্ধকার জগরে হারিয়ে যায়।
গৃহপরিচারিকা হিসেবে নিযুক্ত
ময়েরা তাদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে ক্রমেই আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
বলা বাহুল্য, পুত্রসন্তানদেরই এই বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। অনেকে
কন্যাসন্তানদের স্কুলে ভর্তি করালেও বেশিদিন মেয়েদের ঘরে রাখে
না, ১৩ / ১৪ বছর বয়স হলেই বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ধারদেনা করে
পাত্রপক্ষের চাহিদা মিটিয়ে তাড়াতাড়ি মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয় এরা।
মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত অধিকাংশ
পরিবারই ঠিকে ঝি পছন্দ করে, কারণ এদের কম মজুরি দেওয়া যায়, অল্প
সময়ের মধ্যে মোটামুটি শ্রমসাপেক্ষ কাজগুলি করিয়ে নেওয়া যায়, খেতে-পরতে
বা আশ্রয় দিতে হয় না। ঠিকে ঝি-রাও কোনো একটি বাড়িতে সর্বক্ষণের
কর্মী হিসেবে থাকতে চায় না। কারণ একটি বাড়িতে আটক না থেকে যদি
একাধিক বাড়িতে কাজ করে, তাহলে চার-পাঁচটি বাড়ির বেতন বা মজুরি
মিলিয়ে এককালীন অনেক নগদ টাকা হাতে আসে। আবার সব বাড়ি থেকে অল্প
অল্প করে যা খাবার জোটে, তাতে তার নিজের ছাড়াও বাড়ির ছোটদের জন্য
বাড়তি খাবার হয়ে যায়। সকাল পাঁচটা থেকে বেলা এগারোটা এবং বেলা
তিনটে থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত এরা বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করে।
দুপুরুরবেলা যে দু-তিন ঘণ্টা অবসর মেলে, তখন প্রয়োজন বোধে বাড়তি
রোজগারের জন্য ঘরে বসে ঠোঙা তৈরি, ব্লাউজে হেম সেলাই ও বোতাম লাগানো,
প্লাস্টিকের পুতুলের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জোড়া লাগানো ইত্যাদি ছোটখাটো
ফুরনের কাজ করতে পারে এরা। একাধিক বড়িতে দ্রুত কাজ সারার জন্য
বিবাহিতা ও বয়স্কা মহিলারা তাদের অল্পবয়সী মেয়েদেরও সঙ্গে নিয়ে
যায় সাহায্যকারী হিসেবে এবং তাদের নয়-দশ বছর বয়স থেকেই ঠিকে ঝি-র
কাজ সর্বক্ষণের খাওয়াপরা কাজ-এ লাগিয়ে দেওয়া হয়।
বেলা
বন্দ্যোপাধ্যায়
(শেষাংশ)
লেখক পরিচিতিঃ বেলা বন্দ্যোপাধ্যায়
বহু বছর ধরে ভারতের নারী আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত
ছিলেন। ন্যাশেনাল ফেডারেশন অফ উইমেনের যুগ্ম সম্পাদক, সচেতনা-র
অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সভ্য এবং 'সংলাপ' সংস্থার প্রেসিডেন্ট বেলা
বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন অবসর-এর একজন শুভাকাঙ্খী। ২০০৮ সালে তাঁর
মৃত্যু হয়।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর
ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর
নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।