পুরনো কিছু বাংলা বিজ্ঞাপন (১)
কয়েকদিন
আগে ইন্টারনেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ বেশ কয়েকটা
পুরনো বাংলা বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছিল। তাদের
মধ্যে কয়েকটি খুবই পুরনো - ৫০ বছর বা তারও
আগের। সবচেয়ে পুরনো যেটি, সেটি বেরিয়েছিল
মাসিক ভারতবর্ষে। বিজ্ঞাপনদাতা সেই কোম্পানিটির
নাম আমি কখনো শুনি নি। অন্যান্য কোম্পানিগুলিকে
আজকের অনেক পাঠকই চিনবেন। এদের তৈরী বিজ্ঞাপিত
জিনিসগুলোও বাজারে এখনও পাওয়া যায় - আদি-অকৃত্রিম
কম্পোজিশনে না হলেও ‘’নিউ এণ্ড ইমপ্রুভড’’
লেবেল-এ। এই বিজ্ঞাপনগুলির সঙ্গে দুয়েকটি
লাইন জুড়ে একটা কিছু খাড়া করব বলে যখন ভাবছি,
তখন ফোন এলো বন্ধুবর দীপক সেনগুপ্তের। নানান
কথার ফাঁকে লেখাটির প্রসঙ্গ তুলতেই দীপক বললেন,
ওঁর কাছে পুরনো অনেক বিজ্ঞাপন আছে। চাইতেই
কয়েকটি ইমেল-এ পাঠিয়েও দিলেন। দীপকের পাঠানো
বিজ্ঞাপনগুলি বেরিয়েছিল প্রবাসী, ভারতবর্ষ
এবং বঙ্গশ্রী পত্রিকায়। এই পত্রিকাগুলি আর
বসুমতী এক সময়ে শিক্ষিত বাঙালীদের অনেক বাড়িতেই
দেখা যেত। এদের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো পত্রিকা
প্রবাসী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯০১ সালে। প্রতিষ্ঠাতা
ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। ভারতবর্ষ শুরু
করেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। পত্রিকাটির জন্মসময়
১৯১৩ সাল। এর ২০ বছর পরে বঙ্গশ্রী-র জন্ম।
প্রথম সম্পাদক ছিলেন সজনীকান্ত দাস।
দীপকের
পাঠানো প্রথম বিজ্ঞাপনটি বেরিয়েছিল বাংলার
১৩১৫ সনে, অর্থাৎ প্রায় ১০৫ বছর আগে। তখন
বোধহয় Truth in Advertising ব্যাপারটাতে অত
জোর দেওয়া হত না ...যেমন, শ্রী মতিলাল বসু
এণ্ড কোম্পানির এই বিজ্ঞাপনে - লক্ষ্মীবিলাস
তেল-এ যাবতীয় শিরঃপীড়া ও হাত পা জ্বালা বন্ধ
হওয়া; Perfume ‘গোলাপ সার’-এর সুগন্ধে মাথা
ঠাণ্ডা হওয়া; গাছ গাছড়ায় প্রস্তুত কুইনাইন
বর্জিত 'সুধাসিন্ধু রসে' পাণ্ডু প্লীহা ও
যকৃত সংক্রান্ত জ্বর, ম্যালেরিয়া ও পুরাতন
জ্বর থেকে আরোগ্য লাভ করা, ইত্যাদি দাবি করা
হয়েছে! অবশ্য গ্যারাণ্টি দেওয়া হয় নি।
ক্যালকাটা
কেমিক্যালের নীচের তিনটি বিজ্ঞাপনের দুটি
বেরিয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৭৬ বছর আগে - বাংলার
১৩৪৪ সনে। ক্যাস্টর অয়েলের বিজ্ঞাপনের প্রকাশ-দিনটি
অজ্ঞাত।
পাশের
নিম টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনটি ৭০ বছর আগে প্রকাশিত
হয়েছিল । ক্যালকাটা কেমিক্যাল-এর একটা ফ্যাক্টারি
ছিল দক্ষিণ কলকাতার পণ্ডিতিয়ায় - সেখানে নিম
টুথপেস্ট তৈরি হত । সেটি এখন আর নেই । সেই
জায়গাতে 'ওয়েসিস' নামে একটি বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট
কমপ্লেক্স হয়েছে
প্রসঙ্গত,
ক্যালকাটা কেমিক্যাল এক সময়ে একটি বাঙালী
প্রতিষ্ঠান ছিল । সম্ভবত ১৯১৬ সালে এটি স্থাপিত
হয় । কোম্পনিটি নাম না পাল্টালেও - এর মালিকানা
বদলায় বেশ কয়েক বার। বিভিন্ন হাত ঘুরে শেষে
এই বাঙলী প্রতিষ্ঠানটি শ ওয়ালেস কোম্পনির
অন্তর্ভুক্ত হয়।
শুরু
থেকেই নিম গাছের উপকারিতা উপলব্ধি করে এই
কোম্পানি অনেক সামগ্রীতেই (মার্গো সাবান,
নিম টুথপেস্ট, রেণুকা টয়লেট পাউডার) নিমকে
উপাদান হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
বিলিতি সাবান ও টুথপেস্টের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে
এগুলি মন্দ বিক্রি হত ন। মার্গো সাবান ও নিম
টুথপেস্ট পরে এক সময়ে হেঙ্কেল ইণ্ডিয়া লিমিটেড
কিনে নেয় । সেই হেঙ্কেল ইণ্ডিয়া এখন জ্যোতি
ল্যাবোরেটরিজ লিমিটেড কোম্পানি নামে পরিচিত
।
নিম দাঁতনের সমস্ত বিজানুনাশক ও বিষহারক গুণ
থাকা সত্ত্বেও এর ভেতরে diethylene glycol-এর
উপস্থিতি (যা অ্যাণ্টি-ফ্রিজ-এ ব্যবহৃত হয়)
এবং ক্ষতিকারক বীজানু আবিষ্কৃত হওয়ায় এক সময়ে
এটি ব্যবহার করা বিপদজনক বলে বিদেশে ঘোষিত
হয়েছিল। পরে এগুলিকে হেঙ্কেল ইণ্ডিয়া লিমিটেড
অপসারণ করে এবং টুথ পেস্টটির ব্যবহার-যোগ্যতা
সম্পর্কে সংশয় দূর করে।
নিম
ব্যবহার করে টুথপেস্ট তৈরি সে সময়ে আরও দুয়েকটি
কোম্পানি (যেমন, অভয়াশ্রম) করত। তবে তাদের
বিজ্ঞাপন খুব একটা দেখা যেত না। এই ব্যবসাটি
সেই সময়ে ক্যালকাটা কেমিক্যালেরই একচেটিয়া
ছিল। ক্যাস্টর হেয়ার অয়েলও অন্য কোম্পানি
বিক্রি করত। নীচে কলকাতার ল্যাডকো কোম্পানির
বিজ্ঞাপনটি ৭৬ বছর আগের । কাদের বিক্রি বেশী
ছিল – সেটা অবশ্য জানা নেই।
৬৫
বছর আগে প্রকাশিত কুমারেশ-এর বিজ্ঞাপনটি বৃদ্ধদের
অনেকেরই মনে থাকবে। মায়েরা তাদের শিশুদের
এটি নিয়মিত খাওয়াতেন যাতে তাদের যকৃত বা লিভার
ভালো থাকে। এই টনিক এখন আর পাওয়া যায় না ।
দ্য ওরিয়েণ্ট কেমিক্যাল এণ্ড রিসার্চ ল্যাবরেটরী
লিমিটেড মনে হয় উঠে গেছে।
কুন্তলীন-এর
এই দুটি বিজ্ঞাপন ৭০ ও ৭১ বছর আগে প্রকাশিত
হয়। কুন্তলীন
তেল এবং দেলখোস পারফিউম-এর জনক হেমেন্দ্র
মোহন বোস একাধিক ব্যবসায়ে নিজের স্বাক্ষর
রেখেছিলেন - সুগন্ধি থেকে শুরু করে গ্রামাফোন
রেকর্ডিং তৈরি করা। ১৮৯৪ সালে উনি প্রথমে
সুগন্ধির ব্যবসা শুরু করেন। তারপরে চুলের
তেল, অডিকোলন ও অন্যান্য প্রসাধন দ্রব্য তৈরি
করে ব্যবসার প্রসার ঘটান। ১৯০০ সালে উনি একটি
ছাপাখানা ও প্রকাশনা সংস্থা কুন্তলীন প্রেস
চালু করেন। ওঁর উদ্যোগে ১৯০৩ সাল থেকে লেখকদের
জন্যে বিখ্যাত কুন্তলীন পুরস্কার দেওয়া শুরু
হয়। এই পুরস্কার পেতে হলে একটি নতুন গল্প
লেখকদের জমা দিতে হত আর সেই লেখায় মধ্যে কোথাও
‘কুন্তলীন তেল’-এর উল্লেখ থাকতে হত। প্রথম
কুন্তলীন পুরস্কার পান জগদীশ চন্দ্র বসু।
পরে শরৎচন্দ্রও এই পুরস্কার পান।
হেমেন্দ্র
মোহন রবীন্দ্রনাথের বন্ধু স্থানীয় ছিলেন।
তাই বলে বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের কুন্তলীনের
গুণগান নিছক বন্ধুপ্রীতির জন্য মনে করা হলে
ভুল করা হবে। বিজ্ঞাপনজগতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর
নাম অকাতরে ব্যবহার করতে দিয়েছেন। ঘি থেকে
শুরু করে স্নো-পাউডার এমন কি হারমোনিয়াম পর্যন্ত
- প্রায় শতাধিক বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের লিখিত
বাণী দেখা যায়। সেই সময় লেখার জন্য বাজারে
পাওয়া যেত সুলেখা কালি। ডট পেন, জেল পেন ইত্যাদি
তখন বাজারে আসে নি। ঝর্ণা কলম বা ফাউণ্টেন
পেন-এ এই কালি ভরে লোকে লিখত। সুলেখা কালির
বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘সুলেখা
কালি। এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।’ অল্প
কথায় এরকম আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন এখন আর চোখে
পড়ে না । বিদেশী কোম্পানি পার্কার-এর Quink
এবং শেফার্স-এর Skrip-এর সঙ্গে পাল্লা দিতে
হয়েছিল সুলেখা-কে। ফাউণ্টেন পেন-এর ভালো কালি
বানানো সহজসাধ্য ছিল না । কালি যেন শুকিয়ে
গিয়ে নিব দিয়ে কালি ঝরা বন্ধ না করে - কালির
উপাদান নির্বাচনে সেটি ছিল মস্ত বড় বিষয়।
তাছাড়া লেখা যেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে না
হয়, সহজে উৎপাদন করা যায় – সবই ছিল বিবেচ্য
বিষয়। রবীন্দ্রনাথের এই ঢালাও সুখ্যাতি সুলেখা
কালিকে বাজারে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছিল
– সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
রবীন্দ্রনাথের
আর একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন ছিল জলযোগ মিষ্টান্ন
ভাণ্ডারের জন্য। ওই বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ
লিখেছিলেন, ‘জলযোগের বানানো মিষ্টান্ন আমি
চেখে দেখেছি। এটা আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে। এর
আলাদা স্বাদ আছে।’ জলযোগ সে যুগে কেক-এর জন্যে
বিখ্যাত হলেও রবীন্দনাথের সার্টিফিকেট-এর
সুবাদে মিষ্টান্ন জগতেও প্রতিষ্ঠিত হবার সুযোগ
পেয়েছিল।
শুধু
রবীন্দ্রনাথ নন, সে যুগে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি,
যাঁদের মধ্যে দেশনায়করাও আছেন, বিজ্ঞাপনে
নিজেদের নাম যুক্ত করেছেন - এখন যেমন সিনেমার
নায়ক-নায়িকা আর খেলোয়াড়রা করেন। বিখ্যাত
ব্যক্তিদের প্রশস্তি সংগ্রহের ব্যাপারে সবচেয়ে
অগ্রণী ছিল বোধহয় শ্রীঘৃত। ওঁদের তালিকাতে
রবীন্দ্রনাথ তো ছিলেনই, সুভাষচন্দ্র ও শ্যামাপ্রসাদও
ছিলেন। কলস্টরাল বৃদ্ধির ভয়ে এখন ঘি-র ব্যবহার
হয়ত একটু কমেছে। কিন্তু খাঁটি ঘি-র ব্যাপারে
বাঙালীদের যে দুর্বলতা ছিল (এবং এখনো আছে),
শ্রীঘৃতের বিজ্ঞাপনগুলি দেখলে সেটা পরিষ্কার
বোঝা যাবে। একটি বিজ্ঞাপনে (এখানে দেখানো
হয় নি) জানানো হয়েছে -- শুধু ঘি নয় যে-টিনে
ঘি-টি ভরা হয়, সেটিও “প্রস্তুতকালে হস্তদ্বারা
স্পৃষ্ট নহে ময়লা বর্জিত – সুদৃশ্য টীন।“
অর্থাৎ বিশুদ্ধতা ও পরিছন্নতার ব্যাপারে শ্রীঘৃতের
মালিকরা সতর্ক।
নীচে
শ্রীঘৃতের প্রথম বিজ্ঞাপনটি ৭৬ বছর আগে প্রকাশিত।
শ্যামাপ্রসাদ ও সুভাষচন্দ্রের নামোল্লিখিত
বিজ্ঞাপনদুটি যথাক্রমে ৬৯ ও ৬৫ বছর আগে প্রকাশিত।
শ্রীঘৃত
বাজারে এখনো পাওয়া যায় কিন্তু রেডিয়ামের প্রসাধন
দ্রব্য এখন আর পাওয়া যায় না । রেডিয়াম ক্রিম
সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘রূপচর্চার
জন্য স্নো ও ক্রিমজাতীয় প্রসাধন যারা ব্যবহার
করেন, তারা রেডিয়াম ফ্যাক্টরির তৈরি ক্রিম
ব্যবহার করে দেখুন, বিদেশি পণ্যের সঙ্গে এর
কোনো পার্থক্য খুঁজে পাবেন না।’
প্রশ্ন, কোম্পানির নাম রেডিয়াম
না রেডিয়ম? রবীন্দ্রনাথ রেডিয়াম লেখা সত্বেও
বিজ্ঞাপনের নীচে রেডিয়ম লেখা !
সুজন
দাশগুপ্ত
(পরের অংশ)