সেকালের মহিলা
সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা অন্তঃপুর
উনিশ
শতকে আমাদের সমাজে মহিলাদের অবস্থা ছিল অবর্ণনীয়। তার
অর্থ এই নয় যে, আগে অবস্থা ভাল ছিল; কিন্তু উনিশ শতক থেকেই
নারীদের উপর সামাজিক অত্যাচার ও অমানবিক ব্যবাহারের কাহিনী
কিছু কিছু লিপিবদ্ধ হয়ে আছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় মূলতঃ
ছাপাখানার দৌলতে। জন্মাবধিই দুর্ভোগের লক্ষণ সূচিত হত
মেয়েদের জীবনে। পৃথিবীতে তার আবির্ভাবে অনেক ক্ষেত্রেই
মঙ্গলানুষ্ঠানের আয়োজন হত না; সমাজে তার স্থান ছিল নিতান্তই
অপাংক্তেয়। সমান অধিকারের যে দাবি আজকাল উচ্চারিত হয় সেটা
ছিল তখন কল্পনাতীত। বাল্যবিবাহ, বৈধব্য, পরমুখাপেক্ষী
হয়ে অবহেলায় জীবন অতিবাহিত করা ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী।
এর উপর ছিল সতীদাহ প্রথা। তবে মেয়েদের প্রয়োজন ছিল বৈকি।
পুরুষের লালসা চরিতার্থ করার জন্য অবশ্যই তাদের প্রয়োজন
ছিল; তাদের ব্যবহার করা হত মানুষের মর্যাদা দিয়ে নয়, সাময়িক
প্রয়োজন মেটাতে যন্ত্র হিসাবে। ইংরাজরা আমাদের দেশে উপনিবেশ
স্থাপন করে দেশের সম্পদ আহরণ করেছিল ঠিকই, কিন্তু তারাই
বয়ে এনেছিল সভ্যতার আলোক। যুক্তিবাদী মন ও মানবিকতার দ্বারা
চালিত হয়ে একদল শিক্ষিত লোক এগিয়ে এসেছিল মেয়েদের জীবন
যাত্রায় পরিবর্তন আনতে। এদের অগ্রণী ছিলেন রামমোহন, বিদ্যাসাগর,
অক্ষয়কুমার দত্ত, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ ব্যক্তিরা। শিক্ষার
অভাবই যে মেয়েদের দুর্দশার মূলে রয়েছে এটা বুঝতে পেরে
স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনে উদ্যোগী হয়েছিলেন সে সময়ের কিছু
আলোকপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং কতিপয় ধনাঢ্য সমাজসেবী। এই প্রচেষ্টাকে
সহায়তা ও ত্বরাণ্বিত করতে অবশ্যই এগিয়ে এসেছিলেন ইংরেজ
সরকার। সমাজের সকলেই যে এই উদারপন্থী চিন্তাধারার পোষক
ছিলেন তা নয়। রক্ষণশীল মতের অনুগামী অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিও
বহু প্রবন্ধ লিখে এবং ব্যঙ্গ বিদ্রূপের মাধ্যমে এই উদারপন্থী
ও প্রগতিশীল মনোভাবের বিরোধিতায় নেমেছিলেন।
স্ত্রীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে
ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন কলকাতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় (বর্তমানে
বেথুন কলেজ) প্রতিষ্ঠা করেন। এর পরে অনেকেই এ ধরণের বিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠার কাজে এগিয়ে এসেছেন। ২৬শে মার্চ ১৮৪৯ তারিখের
‘সাধুরঞ্জন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় –
“আমরা অবগত হইলাম যে উত্তরপাড়া নিবাসী বিখ্যাত ভূম্যাধিকারী
শ্রীযুক্ত বাবু জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় মহাশয় হিন্দু বালিকাদিগের
বিদ্যানুশীলন নিমিত্ত স্বীয় ব্যয়ে উক্ত গ্রামে এক অবৈতনিক
বিদ্যালয় সংস্থাপনের মানস করিয়াছেন, তথায় ভদ্রকুল কন্যাগণ
আপাততঃ বঙ্গভাষা শিক্ষা করিবেক এবং ছবি প্রস্তুত ও শুচের
কর্ম্ম শিক্ষা বিষয়েও উপযুক্ত শিক্ষক কর্ত্তৃক বিহিত উপদেশ
প্রাপ্ত হইবেক, এই বিদ্যালয়ের নিয়মিত ব্যয় নির্ব্বাহ নিমিত্ত
তিনি গবর্ণমেন্টের হস্তে আপন ভূমি সম্পত্তির কিয়দংশ প্রদান
করিবেন, সাধারন মঙ্গলজনক কার্য্যে জয়কৃষ্ণ বাবু যেরূপ
উৎসাহী তাহা পাঠক মহাশয়েরা বিলক্ষণরূপেই জ্ঞাত আছেন।“
তবে কোন শুভ কাজের ফল ত সঙ্গে সঙ্গে ফলে না। শিক্ষার প্রচেষ্টা
কতদূর ফলপ্রসূ হবে সে সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলেছে ‘হিতসাধক’
১২৭৫-এর শ্রাবণ সংখ্যায় –
“১৬/১৭ বৎসর হইল বেথুন সাহেব সর্ব্বপ্রথমে বালিকা বিদ্যালয়
স্থাপন করেন। তাহার পর কয়েক বৎসর মধ্যে বারয়ারি পূজার
ন্যায় লেডি স্কুল করা বাই সর্ব্বত্র হইল। এক্ষণে গ্রামে
২ এবং কোন ২ স্থানে বা পাড়ায় ২ স্ত্রীবিদ্যালয় দেখিতে
পাওয়া যায়। কিন্তু এই দীর্ঘকাল মধ্যে কয়েকটি বালিকা সুপণ্ডিতা
হইয়াছেন? বোধ হয় একটিও নয়। এবং কেনই বা অথবা কেমন করেই
বা হইবে? নবম বৎসরে পাঠ সাঙ্গ, দশম বৎসরে সদা অবগুণ্ঠিত
বধু হইয়া বোবার ন্যায় শ্বশুর গৃহে বাস এবং একাদশ বা দ্বাদশে
সন্তান প্রসবিয়া মাতৃকার্য্যে নিয়ত ব্যস্ত, এরূপ অবস্থায়
কখন কি বিদ্যা উপার্জ্জন হইতে পারে?”
স্ত্রীশিক্ষার বিরুদ্ধেও কলম ধরেছিলেন কিছু লোক। ১৮৬৯
সালের ২৩শে জুন ‘সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়’ পত্রিকায় লেখা
হয়েছে –
“ছেলেরা বিদ্যাশিক্ষা
করিয়া যে পরিমাণে সভ্য হইয়া উঠিয়াছে, কালে মেয়েরাও সেইরূপ
হইলে আমাদিগের দেশ ছেড়ে পলাইতে হইবে। ... নানা কারণবশতঃ
আমাদিগের দেশের শাস্ত্রকারেরা স্ত্রীলোকদিগে অন্তঃপুরে
আবদ্ধ করিয়া রাখিবার প্রথা প্রচলিত করিয়া গিয়াছেন। সভ্যেরা
যদি স্থির চিত্তে বিবেচনা করেন, তাহা হইলেই বুঝিতে পারিবেন,
আমাদিগের মধ্যবিৎ লকের স্ত্রীলোকেরা বিদ্যাশিক্ষা করিয়া,
কি করিবে? তাহাদিগের গৃহকার্য্য সমাধা করিয়া উঠাই ভার,
তাহার মধ্যে আবার পুস্তক লইয়া কখন পড়িতে বসিবে? আমরা ভেবেচিন্তে
ইহার কিছুই স্থির সিদ্ধান্ত করিতে পারি না। সকলেই কিছু
সম্পন্ন ব্যক্তি নহেন পল্লীগ্রামের কথা দূরে থাকুক এই
সহরের অধিকাংশ লোকেই দাসদাসী রাখিতে সক্ষম নহেন। স্ত্রীলোকেরাই
সমস্ত গৃহাকার্য্য সমাধা করে। অনেকের নিশ্বাস পরিত্যাগ
করিবার অবকাশ থাকে না। রজনীতে ছেলেকে ঘুম পাড়াবে না প্রদীপ
জ্বেলে পড়িতে বসিবে। ইউরোপের দৃষ্টান্ত দর্শাইয়া কার্য্য
করিতে গেলে আমাদিগের দেশে কোনক্রমেই চলিবে না। ...”
‘অন্তঃপুর’ পত্রিকা সম্বন্ধে এ পর্যন্ত কিছুই বলা হয় নি,
তার কারণ, সমসাময়িক সামাজিক প্রেক্ষাপট ও মেয়েদের অবস্থান
না জেনে নিলে পত্রিকা প্রকাশের গুরুত্ব ও উদ্দেশ্য বোঝা
যাবে না। যাই হোক, অনেক প্রতিকূলতা ও বিরূপ সমালোচনা উপেক্ষা
করে স্ত্রীশিক্ষার কর্মসূচী এগিয়ে চলল এবং এর সুফলও মিলতে
শুরু করল। একদলের সাফল্য অন্যদের উৎসাহ ও মনোবল বাড়িয়ে
তুলল, চলার পথে প্রেরণা যোগাল। এই অবস্থার মধ্যেই কিছু
লোক এগিয়ে এলেন পত্রিকা প্রকাশ করে মেয়েদের কথা তুলে ধরতে।
মেয়েদের লেখাও প্রকাশিত হতে লাগল। এ বিষয়ে ব্রাহ্মসমাজের
ভূমিকা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। সাহিত্যক্ষেত্রে মহিলা পরিচালিত
বা মহিলা সম্পাদিত যে সব পত্রিকার প্রবেশ ঘটে; তাদের মধ্যে
রয়েছে – ‘বঙ্গমহিলা’ (এপ্রিল, ১৮৭০); ’অনাথিনী’ (জুলাই,
১৮৭৫); ‘ভারতী’ (জুন, ১৮৭৭); ‘হিন্দুললনা’ (ফেব্রুয়ারি,
১৮৭৮); ‘বালক’ (এপ্রিল, ১৮৮৫); ‘পুণ্য’ (অক্টোবর, ১৮৯৭)
প্রভৃতি। এর মধ্যে ‘বঙ্গমহিলা’ ছিল প্রথম মহিলা-সম্পাদিত
এবং ‘অনাথিনী’ প্রথম মহিলা-পরিচালিত সাময়িকপত্র। প্রথমটি
পাক্ষিক, দ্বিতীয়টি মাসিক। ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বেথুন স্কুল
প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের যে প্রবেশাধিকার
ঘটে, সমাজের নানাক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়তে শুরু করল। ‘ভারতী’,
‘বালক’, ‘পুণ্য’ সবই ‘ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা’। ঠাকুরবাড়ির
মেয়েরা ছিলেন স্বাধীনচেতা এবং সাংস্কৃতিক জগতে তাদের বিচরণ
সুবিদিত; যদিও এর সমালোচনাও কিছু কম হয় নি।
চিত্র
১ – ৫ম বর্ষ ১৩০৯ বঙ্গাব্দের আখ্যাপত্রের প্রতিলিপি।
‘পুণ্য’ পত্রিকা প্রকাশের কিছুদিন পরেই প্রকাশিত হয় ‘অন্তঃপুর’
মাসিক পত্রিকা। প্রকাশনার তারিখ ১৩০৫ বঙ্গাব্দের মাঘ মাস
(জানুয়ারি ১৮৯৮)। এতে শুধু মহিলাদের লেখাই প্রকাশিত হত;
পত্রিকা সম্পাদক ছিলেন শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া
কন্যা বনলতা দেবী। একটা কথা মনে রাখতে হবে। ঠাকুরবাড়ির
মেয়েরা ছোটবেলা থেকেই যে সাংস্কৃতিক পরিবেশে মানুষ হয়েছেন,
অন্যেরা কিন্তু সে সুযোগ পান নি। বনলতার পত্রিকা প্রকাশনা
ও সম্পাদনা সেদিক থেকে নিঃসন্দেহে একটি অসামান্য প্রচেষ্টা।
বনলতা দেবীর সংক্ষিপ্ত জীবন ও তার অনুসৃত আদর্শ অত্যন্ত
চিত্তাকর্ষক। তার সম্বন্ধে কিছুটা জেনে নেওয়া যাক –
১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে ডিসেম্বর (৬ই পৌষ ১২৮৬) নদীয়া
জেলার কৃষ্ণনগরে বনলতার জন্ম। পিতা সমাজকর্মী ও সেবাব্রতী
শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন কৃষ্ণনগর পোষ্ট অফিসের সুপারিন্টেন্ডেন্ট।
তিনিই বনলতাকে সৎকাজ ও সমাজকল্যাণমূলক কাজে উৎসাহ দিয়েছেন।
বনলতার বিয়ে হয়েছিল ‘জীবনীকোষ’ সম্পাদক শশীভূষণ বিদ্যালঙ্কারের
সঙ্গে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে মহিলাদের নিয়ে ‘সুমতি সমিতি’
নামে একটি ক্ষুদ্র দল গঠন করেন; এর কেন্দ্রস্থল ছিল পিতার
প্রতিষ্ঠিত বরাহনগর বিধবাশ্রম। অনেক মহিলা এই সমিতিতে
যোগ দিয়ে কল্যাণমূলক কাজে অংশ গ্রহণ করতেন। এ ধরণের কাজ
স্বামীরও খুব পছন্দের ছিল। ১৭ বছর বয়সে বনলতা প্রকাশ করেন
মাসিক পত্রিকা ‘অন্তঃপুর’। তিনিই ছিলেন এর সম্পাদক। কবিতা
লিখতেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। ‘অন্তঃপুর’-এর প্রতি সংখ্যার
শুরুতেই তার লেখা চার লাইনের একটি কবিতা মুদ্রিত হত। ১৩০৭
বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যায় (৪র্থ বর্ষ) লেখা হয়েছে –
“সংসার
রাজ্যের মাঝে অন্তঃপুর রাজধানী,
পরম
মহিমাময়ী রমণী তাহার রাণী।
সংসার
সুখের হয়, স্বরগেতে পরিণত,
নারী
যদি কায়মনে পালেন রমণীব্রত।“
বনলতার রচিত কবিতা গ্রন্থের
নাম ‘বনজ’। দুর্ভাগ্যবশতঃ বিয়ের এক বছর পরেই তিনি রোগাক্রান্ত
হয়ে পড়েন। রুগ্ন শরীর নিয়েই তিনি বাইরের এবং সংসারের কাজ
নিখুত ভাবে করে গিয়েছেন। পিতামাতার কথা বলতে গিয়ে তার
চোখ জলে ভরে আসত। তার শয্যায় মাথার কাছে রাখা থাকত একটা
টাকাপয়সার বাক্স, হিসাবের খাতা ও পেন্সিল। রোগশয্যায় শুয়েও
তিনি স্বামী পুত্রকে সামনে বসে খেতে বলতেন। মৃত্যুর আধ
ঘণ্টা আগেও তিনি স্বামীকে গরম জামা গায়ে দিতে বলেছেন।
১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই মার্চ (১৮ই কার্তিক ১৯০৭) রাত
সাড়ে তিনটায় পিতা মাতা স্বামী পুত্র ও আত্মীয় স্বজনকে
ছেড়ে বনলতা লোকান্তরিত হন। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর
সংখ্যায় জনৈকা সুখতারা দত্ত ‘অন্তঃপুরে’ যে লেখাটি প্রকাশ
করেছেন তার অংশ বিশেষ – “তাঁহার সন্তানকে এমন সুন্দর শিক্ষা
দিতেন যে, তিন বৎসরের শিশু কখন মাতার অবাধ্য হইতে জানিত
না। সন্তানটির সকল কার্য্য নিজে না করিলে তাঁহার মন সন্তুষ্ট
হইত না। রোগশয্যায় যখন বুঝিলেন যে, আর বাঁচিবেন না, তখন
একদিন তাঁহার পুত্রকে কাছে ডাকিয়া বলিয়াছিলেন যে, “আমার
ত এখানে রোগ সারিতেছে না সেই জন্য ঈশ্বরের কাছে যাব। সেখানে
গেলে আমার অসুখ সেরে তোমার ভাল মা হয়ে ফিরে আসিব।“ সরল
শিশু মাতার এই বাক্যে এমনই বিশ্বাস স্থাপন করিয়াছিল যে,
যখন মৃত্যুর পর তাঁহার দেহ, সৎকারের জন্য লইয়া যাওয়া হয়,
সকলে কাঁদিয়া আকুল, তখন বিশ্বাসী শিশু সুন্দর গোলাপ ফুলে
মাতাকে সাজাইয়া প্রণাম করিয়া নিশ্চিন্ত মনে বাগানে বেড়াইতে
লাগিল। আর সকলের কান্না দেখিয়া বলিতে লাগিল, “মার অসুখ
এখানে সারিতেছে না, তাই মা ঈশ্বরের নিকট ভাল হবার জন্য
যাচ্ছেন, আবার আসবেন।“
চিত্র
২ – একটি প্রারম্ভিক পত্রের প্রতিলিপি। বড় করে দেখতে
চাইলে Ctrl টিপে রেখে + টিপুন)
বনলতা ছিলেন ‘অন্তঃপুরে’র পরিচালক ও সম্পাদক। পত্রিকাতে
কেবল মহিলাদের রচনাই প্রকাশিত হত। প্রথম সংখ্যার ‘প্রস্তাবনা’
অংশে সম্পাদিকা পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন
– “আজকাল মাসিকপত্রিকার অভাব নাই, রমণীদিগের উপযুক্ত পত্রিকার
কয়েকখানা সুন্দাররূপে পরিচালিত হইয়া রমণীদিগের উন্নতির
সহায়তা করিতেছে। আমরাও আজ ক্ষুদ্রশক্তি লইয়া রমণীদিগের
ও তাহাদের সুকুমারমতি বালক বালিকাদিগের জন্য একখানি ক্ষুদ্র
পত্রিকা প্রকাশ করিতেছি। অন্যান্য খ্যাতনামা পত্রিকার
সহিত প্রতিযোগিতা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, সেরূপ দুঃসাহসও
নাই। কেবল রমণীদিগের উন্নতিকল্পে আপনাদের যৎসামান্য শক্তি
নিয়োগ করিয়া ধন্য হইব এই আশা।“
বনলতা মাত্র ১৭ বছর বয়সে পত্রিকা প্রকাশ করেছেন; সম্পাদনার
কাজে তাকে মহিলাদের লেখা সংগ্রহ করতে হয়েছে। সে যুগে কাজটা
খুব সহজ ছিল না। মহিলা লেখকদের সংখ্যাও ছিল অনেক কম, যোগাযোগের
ব্যবস্থাও ছিল অনুন্নত। দু’বছর সম্পাদনার পর অকালে মৃত্যু
ঘটে বনলতার। তার পর সম্পাদিকা হন হেমন্তকুমারী চৌধুরী।
প্রথম দুটি সংখ্যা যোগাড় করতে পারি নি। পরে যাদের লেখা
প্রকাশিত হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন – কামিনী রায়, তরুলতা
দেবী, কাদম্বিনী দেবী, নিস্তারিণী দেবী, সরোজিনী বসু,
শরৎকুমারী দেবী, গিরিবালা সেন গুপ্তা, প্রিয়ম্বদা দেবী,
লজ্জাবতী বসু, হেমলতা দেবী, অম্বুজাসুন্দরী দাস গুপ্তা,
প্রসন্নময়ী দেবী প্রমুখ মহিলাগণ। এদের মধ্যে প্রায় সবাই
লেখক হিসাবে তখন বেশ প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ‘অন্তঃপুরে’ যেহেতু
কেবল মহিলাদের লেখাই প্রকাশের জন্য বিবেচিত হত, এর লেখকসূচী
থেকেই বোঝা যায় যে শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত বিরাট সংখ্যক মহিলা
চিরাচরিত গন্ডী পেরিয়ে সাংস্কৃতিক জগতে নিজেদের জায়গা
করে নিতে পেরেছেন। পত্রিকাতে মেয়েদের কৃতিত্বের কথাও নিয়মিত
প্রকাশিত হয়েছে। ১৮৯৯-এর ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় সংবাদ পরিবেশিত
হয়েছে – “বেথুন কলেজের লেডি সুপারিন্টেন্ডেন্ট কুমারী
চন্দ্রমুখী বসু এম.এ. এবং শ্রীমতী নির্ম্মলা সোম এম.এ.
এই বৎসর এন্ট্রান্স পরীক্ষার পরীক্ষক মনোনীত হইয়াছেন।“
চিত্র
৩ – জ্যৈষ্ঠ ১৩০৮ সংখ্যায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপন।
লেখিকারা
তাদের লেখার মাধ্যমে অনেক সময়েই নারী জীবনের নানা অসুবিধা
ও দুঃখের কথা তুলে ধরেছেন। প্রমীলাসুন্দরী দেবীর এরকমই
একটি রচনা দিয়ে বর্তমান আলোচনার ইতি টানা যাক। রচনাটির
নাম ‘বিধবা’।
বিধবা
“এই বিধবা শব্দে আমারদিগের
মনে কি একটা করুণ স্মৃতি জাগাইয়া তুলে তাহা বোধ হয় সহৃদয়
সকলেই অনুভব করিয়া থাকিবেন। সুকবি সুভাবুকগণ বিধবাকে হৃদয়রাজ্যে
কল্পনার স্বর্গ সিংহাসনে বসাইয়া মূর্ত্তিমতী পবিত্রতা
স্বর্গের দেবী ভাবিয়া ভাবে ভক্তির পুষ্পাঞ্জলী প্রদান
করেন। সে আদর্শ বড় উচ্চ, বড় পবিত্র, কিন্তু হায়! কেবল
কাব্য কবিতায় বাস্তব জীবন চলে না,- বিশেষতঃ হিন্দু রমণীর।
অনেকে বলে বিধবার মুখে একাদশী দিন পবিত্র জ্যোতিঃ দেখিতে
পান। নৃশংস অত্যাচারে, অনাহারে শুষ্ক, করুণ কচি মুখে জ্যোতিঃ
কল্পনা করিয়া যাঁহারা আনন্দ উপভোগ করেন, আমার বোধ হয় ভীষন
দুর্ভিক্ষের সময় শত শত অনাহার ক্লিষ্ট মুখে জ্যোতি দর্শন
করিয়া তাঁহারা উল্লাসে নাচিতেও পারেন। আমার এই প্রবন্ধে
যুবতী ও বালিকা বিধবাদিগকেই লক্ষ্য করিতেছি, এক্ষণে এই
বালবিধবার সংখ্যা এত অধিক যে, বিধবার কথা ভাবিতেই যৌবনে
যোগিনীর এক করুণ কোমল চিত্র চোখের উপর ভাসিয়া উঠে।
কাব্য ছাড়িয়া কবির চসমা খুলিয়া এক বার হিন্দু সমাজে বিধবার
অবস্থা ভাবিয়া দেখা যাউক; এজন্য বেশী দূর যাইতে হইবে না।
কোন সময়ে আমাদের আশ্রয়ে একটি সুকুমারী বিধবা বালিকা ছিল;
তাহার পিতা ভ্রাতাও সে সময় উপস্থিত ছিলেন। একাদশীর দিন
দিবস কোন রকমে যাইত কিন্তু সন্ধ্যা হইলেই বালিকা ক্ষুধায়
এমন অবসন্ন ভাবে ছিন্ন লতিকার ন্যায় শয্যায় পড়িয়া থাকিত
যে, সে দৃশ্য দর্শনে অতি পাষাণ হৃদয়ও বিগলিত হইয়া যায়!
মুখে কথা বাহির হইত না, বোধ হইত নিশ্বাস প্রশ্বাসও যেন
অতি কষ্টে বহিতেছে। একটু দুগ্ধ, একটু জল পান করাইবার জন্য
কত চেষ্টা করিয়াছি কিন্তু হায়, ধন্য নিষ্ঠুর সমাজের পৈশাচিক
শাসন! দারুণ গ্রিষ্মের দিনে পিপাসায় প্রাণ যায় তবু কেবল
সমাজের ভয়েই মুখে জল বিন্দুও দেওয়ার উপায় নাই; ধিক সমাজ!
শত ধিক সমাজের নেতৃগণকে!!
সেই সময়েই বিধবার প্রতি বিভৎস অত্যাচার আমি যেন জ্বলন্ত
ভাবে অনুভব করিয়াছি। একাদশীর রাত্রে আশ্রু রাখিতে পারি
নাই, আমার আহার হয় নাই; কিন্তু তাহারই জ্যেষ্ঠ সহোদর পরিতৃপ্তা
ভাবে আহার করিয়া আনন্দে মনে মনে গান করিতে করিতে শয়ানার্থে
গিয়াছে – আর পার্শ্বের ঘরে ভগিনী অনাহারে অনিদ্রায় বিশুষ্ক
ব্রততীর ন্যায় পড়িয়া আছে। ভ্রাতার বোধ হয় তাহা মনেই নাই;
কি ভীষণ নিষ্ঠুর হৃদয়বিদারক দৃশ্য!!
এইরূপে বিধবাদিগের প্রতি হৃদয় হীনতার আরও শত শত দৃশ্য
আমার পরিচিত আত্মীয়গণের মধ্যেই দর্শন করিয়া প্রতিকারের
অক্ষমতায় হৃদয়ে অসীম ক্লেশ অনুভব করিতেছি।
আমার ভক্তি ভাজনীয়া সরলা সহৃদয়া একটি বিধবা আবেগে আপ্লুত
স্বরে আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “বলিতে পার বিধবার কি
অপরাধ? বিধবা হইয়া কি অপরাধ করিয়াছি?” পরে জানিতে পারিলাম
শিল্প শিখিতে ইচ্ছা প্রকাশ করায়, “বিধবার আবার সেলাই শেখার
সখ”, বলিয়া অভিভাবক বর্গের নিকিট তাঁহাকে নিষ্ঠুররূপে
লাঞ্ছিত হইতে হইয়াছে। জানি না হিন্দুর কোন শাস্ত্রে এই
সব বিধি লিখিত আছে।
বরাবর শুনিয়া আসিতেছি প্রীতি প্রেম স্নেহ দয়ায় বাঙ্গালী
আদর্শ, বাঙ্গালী হৃদয় ভালবাসার আকর; কিন্তু হায়! বাস্তব
জীবনে বাঙ্গালীর কার্য্য কলাপে তাহার ত নিদর্শন কিছুই
দেখি না। বিধবার প্রতি – রমণীর প্রতি আপন বনিতা দুহিতা
ভগ্নীর প্রতি সাধারণতঃ বাঙ্গালীর যেরূপ ব্যবহার, সেই অহৃদয়তা,
নিষ্ঠুরতা আত্যাচার, স্মরণ করিতেও বক্ষ ফাটিয়া চক্ষু হইতে
অশ্রু পড়িতে থাকে। তাহাতে মনে হয়না ভালবাসা ইত্যাদি বলিয়া
কোন দর্শনীয়া বৃত্তি ইহাদের হৃদয়ে আছে। এই নিষ্ঠুরতা দর্শনেই
প্রাণের জ্বালায় কবি গাহিয়াছেন।
“নিষ্ঠুর
অনেক ভ্রাতা নিষ্ঠুর বিমুখ ধাতা
নিষ্ঠুর
বিমুখ তিনি, পতি নাম তার।“
হায়! ইহাপেক্ষা ক্ষোভের কথা আর কি আছে? আপন ভাই ভগিনীর
মুখপানে চায় না? পিতা কন্যার প্রতি কর্ত্তব্য পালন করেন
না? পতি পত্নীকে সুখী করে না!! ইহাপেক্ষা মানব সমাজে আর
কি অবনতি অধগতি সম্ভব? যে দিকে চাই সেদিকেই পিশাচের ভীষণ
অভিনয়।
আপন গৃহে যার ব্যবস্থার “ব” নাই তাহারাই আবার ব্যবস্থাপক
সভার সভ্য হইবার জন্য লালায়িত হয়! ধিক! এই সকল জীবকে শতধিক!!
কি করিতে ইহারা বাঁচিয়া থাকে? ভারতের কলঙ্ক জগতের ভার!
হায়, হায়, ইহার কি কিছুই প্রতিকার নাই? হায় শিক্ষিত সভ্য
বঙ্গবাসীগণ! উন্নতির জন্য লালায়িত তোমরা সবই কি তোমাদের
মুখে? এখনও কি কৃত্রিমতার খোলস ছাড়িবার সময় হয় নাই? উঠ!
বস! একবার চাহিয়া দেখ, তোমাদের আশ্রিতা নির্ভরশীলা সরলা
কুমারী বিধবা-ললনার অবস্থা কিরূপ হৃদয়বিদারক!!
আমি এখানে বিধবার বিবাহের কথা তুলিতে চাহি না। বিবাহের
মধ্যে সকল সুখ শান্তি কর্ত্তব্য আবদ্ধ আছে, একথা কখনই
সম্ভব নহে। আমাদিগের মত আমাদিগের প্রার্থনা; মন্দভাগিনী
স্বামীহীনা, বালিকাদিগের প্রতি করুণ কোমল দৃষ্টিপাত করিয়া
তাহাদিগের সুশিক্ষার ব্যবস্থা করুন, যাহাতে তাহারা আপন
পবিত্র জীবনের গুরুতর দায়িত্ব বুঝিতে ও বহিতে সক্ষম হয়।“
‘অন্তঃপুর’
ছিল সচিত্র মাসিক পত্রিকা। বনলতার অকাল মৃত্যুর পর ১৩০৭
বঙ্গাব্দ থেকে পত্রিকার সম্পাদক হন হেমন্তকুমারী চৌধুরী।
এর পরে কয়েকবার সম্পাদক বদলেছে। কুমুদিনী মিত্রও কিছুদিন
সম্পাদনা করেছেন। ১৩১১-র জ্যৈষ্ঠ থেকে ভাদ্র অবধি আবার
হেমন্তকুমারী সম্পাদক হয়ে ফিরে এসেছেন। ১৩১১-র আশ্বিন
থেকে মাঘ, এই পাঁচ মাস সম্পাদনা করেছেন লীলাবতী মিত্র।
ফাল্গুন ১৩১১ থেকে বৈশাখ ১৩১২ পর্যন্ত সম্পাদক ছিলেন সুখতারা
দত্ত। এর পরেই পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।
চিত্র
৪ – জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ১৩০৯ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি ছবি।
‘অবসরে’র
পাতাতে পুরানো দিনের সাময়িক পত্রিকা থেকে নির্বাচিত রচনা
বেরোচ্ছে অনেক দিন থেকেই। ‘অন্তঃপুর’ পত্রিকা থেকে যে
লেখাগুলি রয়েছে বা থাকবে সেগুলি হল – ‘এ কাল ও একালের
মেয়ে’ (জনৈকা হিন্দু বিধবা); ‘বসন্ত
সন্ধ্যায়’ (অম্বুজাসুন্দরী দেবী); ‘গোয়ালা
বউ’ (কামিনী রায়)।
দীপক
সেনগুপ্ত