প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

জলধর সেনের “হিমালয়”-আজকের আলোকে

উপক্রমণিকা

নব কলেবরে জলধর সেনের ”হিমালয়ে”র [১] সম্পাদকীয়তে শ্রীবারিদবরণ ঘোষ লিখছেন, “কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, হিমালয়-কেন্দ্রিক বাংলা ভ্রমণসাহিত্যের সূচনা কখন থেকে-তাহলে আমরা বিগতকুণ্ঠ হয়ে বলতে পারবো-জলধর সেনের ‘হিমালয়’ থেকেই।” (পৃ-সম্পাদকীয়-৭)
বারিদবাবুর এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে কোনও তথ্য এখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে নেই। যদি কোনও সময়ে সেই তথ্য জানাও যায়, তাহলেও বলা যায় যে ‘হিমালয়’ই প্রথম হিমালয়ের পথের সুন্দর ও প্রকৃত (realistic) বর্ণনা আমাদের সামনে উপস্থিত করেছে। অবশ্য জলধর সেন মহাশয় তাঁর রচনা শেষ করেছেন এই বলে,

“এখন আমার বিদায় গ্রহণের সময়। হিমালয়ের পরম পবিত্র মহিমা আমি কীর্তন ক’রতে পারি নাই। যেটি যে ভাবে বর্ণনা ক’রলে ঠিক কথাটি বলা হ’ত, আমার দুর্বল লেখনী তা ব’লতে পারেনি। যে দৃশ্যের সম্মুখে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর সর্বপ্রধান শিল্পী নিজের দুর্বল হস্তের অযোগ্যতায় কাতর হ’য়ে তুলিকা দূরে নিক্ষেপ ক’রে সেই মহান দৃশ্যের সম্মুখে করযোড়ে দাঁড়িয়ে থেকেই কৃতার্থ হন, আমি সেই হিমালয়ের মহিমা ব’লতে গিয়েছিলুম-আমার স্পর্ধা কম নয়! আর সে রকম ক’রে দেখলে ঠিক দেখা হ’ত, আমার তা মোটেই হয়নি। আমি শ্মশানের জ্বলন্ত অগ্নিশিখা বুকে নিয়ে হিমালয়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে প’ড়েছিলুম; আমি শুধু দুই হাতে হিমালয়ের শীতল বাতাস, হিমালয়ের কঠিন বরফ বুকে চেপে ধ’রেছি; চারি দিকে যে স্বর্গের দৃশ্য জগৎপিতার অনন্তমহিমা অনুক্ষণ কীর্তন ক’রত, আমার কি সে সব দেখবার শুনবার সময় ছিল, না তেমন আমার মন ছিল? আমি তখন মাথা উঁচু ক’রে কি আকাশের দিকে, স্বর্গের দিকে চাইতে পারতুম; সে ভাবই তখন আমার ছিল না। আর হৃদয়ের মধ্যে যে কবিত্ব থাকলে মানুষ গাছের ফল, নদীর জল, ফুলের সৌন্দর্য্য, নির্ঝরিণীর কলতান, বিহঙ্গের হৃদয়মনোমোহন কূজন বর্ণনা ক’রতে পারে, আমার সে কবিত্ব কোন দিনই ছিল না, আমার কবিত্বানুভবের অবকাশ বা সুবিধা কোন দিনই হয় নাই, সুতরাং কিছুই বলা হয় নাই।” (পৃ-১৯৬)

এই ‘কিছুই বলা হয় নাই’ কথাটিতে আমার আপত্তি আছে। শুধু আমি কেন, বারিদবাবু এই বই-এর সম্পাদকীয়তে অনেকের কথা উল্লেখ করেছেন যা থেকে বোঝা যায় যে তিনি (বা যদি কিছু পরিবর্ধন করে থাকেন শ্রীদীনেন্দ্রকুমার রায় মহাশয়) যেমন বর্ণনা করেছেন তাঁর যাত্রা পথের, তা অপূর্ব। এ ছাড়া স্থানীয় মানুষ ও বাঙালির চরিত্র বিশ্লেষণ, তাও যথাযথ হয়েছে। আমার এই রচনায় আমি এই কথাই বোঝাবার চেষ্টা করবো যে আজকের আলোকেও এগুলি যথাযথ, অবশ্য কিছু পরিবর্তন হতে বাধ্য সময়ের পার্থক্যের কারণে।
রচনায় বর্তমান লেখকদের ভ্রমন-কাহিনি থেকে উদ্ধৃতির প্রয়োজন ছিল, কিন্তু আমি তার থেকে বিরত থেকেছি। কারণ গত প্রায় ২৫-৩০ বছরের মধ্যে লেখা হিমালয়ের বদরীনাথ অঞ্চলের কোনও ভ্রমণ-কাহিনি আমার নজরে আসেনি, যা এসেছে তা সবই ভ্রমণের গাইড। ভ্রমণ পত্রিকাগুলো গর্ব করে লেখে ‘বেরিয়ে পড়ার সেরা গাইড’। অগত্যা এই এলাকায় আমার ভ্রমন, আমার দেখা, আমার অভিজ্ঞতাই একমাত্র মূলধন। অবশ্য ‘হিমালয়’ থেকে প্রভূত সংখায় উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছি। অনেকে হয়তো বলতে পারেন যে পৃষ্ট সংখ্যা দিলেই তো হত। হাঁ, তা হয়তো হত, কিন্তু আমার মনে হয় তাতে আর একবার ‘হিমালয়ে’র রস গ্রহণ করা থেকে পাঠক বঞ্চিত হতেন [২]। এ ছাড়া ‘গঙ্গা জলে গঙ্গা পূজা’ করাই বিধেয়। এমন ভাবে পূজা করলেই সব থেক বেশি মূল্য পাওয়া ও পুণ্য অর্জন করা যায়।


গঙ্গা জলে গঙ্গা পূজা
যাবার পথেঃ

জলধর সেন বদরিকাশ্রম অর্থাৎ বদরীনাথের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন ১৮৯০ সালের ৬ মে ভোর বেলায়। রামের বনবাস যাত্রার কালে অযোধ্যাবাসীগন বেশ কিছুটা পথ তাঁর সহযাত্রী হন, তুলনাটা অতিরঞ্জন দোষে দুষ্ট হলেও সেই কথা মনে পড়ে যায় জলধরবাবু যাত্রা-শুরুতে তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের কিছু দূর পর্যন্ত সঙ্গ দানে। তবে এটাও তো ঠিক, যদিও আজকাল অনেক কমে গেছে, তা হলেও এখনও অনেক সময় আত্মীয়-বন্ধু-বান্ধব রেল স্টেশনে পোঁছাতে আসেন ভ্রমণে বেরোবার সময়।
হৃষীকেশের পথে এগোবার সময় খানু নামে ছোট এক গ্রামের বর্ণনা করতে গিয়ে জলধর সেন লিখছেন,

“গাছ পাতায় ঢাকা পাঁচসাত ঘর গৃহস্তের বাড়ী নিয়ে এই গ্রামখানি শাখাপত্র সমাচ্ছন্ন ক্ষুদ্র বিহঙ্গ-নীড়ের ন্যায় স্নিগ্ধ ও শান্তিপূর্ণ। এই গ্রামের পাশ দিয়ে একটা ছোট ঝর্ণা চলে যাচ্ছে।” (পৃ-৫)

কয়েকটি কথা মাত্র, কিন্তু গ্রামটির ছবি ছোখের সামনে ভেসে ওঠে। বর্ণনায় ‘গাছ পাতা ঢাকা’ আবার ‘শাখা পত্র সমাচ্ছন্ন’ একই কথা দুরকম ভাবে বলা হয়েছে। তবে আমার মতে তাতে গ্রামের ছবিটা আরও পরিষ্কার হয়েছে। অবশ্য ‘একটা ছোট ঝর্ণা চলে যাচ্ছে’ আমরা বলি না। ঝর্ণা কি এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় চলে যায়? হিমালয়ের বহু জায়গায় ছোট ছোট ঝর্ণা দেখতে পাই, যা আসলে ছোট জলধারা, পাহাড়ের উপর থেকে পাহাড়ে লাফাতে লাফাতে নামে বলে ঝর্ণার আকার নেয়। ঝর্ণা চলে যায় না, একই জায়গায় থাকে। নদী, পরস্পর ছোট ছোট ঝর্ণার আকার নিয়ে বয়ে যাচ্ছে বলাই বাঞ্ছনীয়। ঝর্ণা চলে যাওয়া কি দীনেন্দ্রবাবুর কল্পনা?

দল বেঁধে শিখ সন্ন্যাসীদের গ্রন্থসাহেব সহ হিন্দু তীর্থস্থান দর্শণে যাওয়া আজকাল দেখা যায় না, যা জলধরবাবু দেখেছেন হৃষীকেশের পথে। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শিখ দশম গুরু, গুরু গোবিন্দ সিং-এর বর্ণিত তপোস্থলী খোঁজার জন্যে শিখ সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ হিমালয়ের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতেন। আমার ধারণা হয়েছে যে সেই রকমই কোন শিখ সন্ন্যাসী দলের সঙ্গে জলধরবাবুদের সাক্ষাত হয়েছিল। ১৯৩০ সালের পরে সেই তপোস্থলী বদরীনাথের পথের কাছেই আবিষ্কৃত হয়েছে। উপযুক্ত সময়ে সেই বর্ণনার সু্যোগ আসবে, তাই এখানে এই প্রসঙ্গের আলোচনা আপাতত মুলতুবি রাখছি।
হৃষীকেশে পোঁছানোর পথে জলধরবাবুর বেশ কয়েকটি অভিজ্ঞতা মনে দাগ কাটে। প্রথমেই বলতে হয় ওখানকার গ্রামের সাধারণ মানুষের তীর্থ যাত্রীদের প্রতি ব্যবহার আর সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের এখানকার সাধারণ মানুষের ব্যবহার। আজকাল অবশ্য যোগাযোগের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ওই অঞ্চলের সাধারণ মানুষদের সঙ্গে তেমন ভাবে interact করতে হয় না, তা হলেও তাঁর অনুভব,

“নানা বিষয়ে আমরা ভারতের অন্যান্য দেশের লোক অপেক্ষা উন্নত ও সভ্য; কিন্তু পথিক বা রোগগ্রস্ত ব্যক্তি পথিপ্রান্তে প্রাণত্যাগ কল্লেও তাদের দিকে ফিরে তাকাবার আমাদের অবসর নেই; এতই আমরা কাজে ব্যস্ত।”-

আমাদের দেশে এখন তা সব সময়েই আমরা প্রত্যক্ষ করছি।
কয়েকদিন পরে দেবপ্রয়াগে এসে এক বাঙালির কুকীর্তির কথা শুনে নিজেই অত্যন্ত লজ্জিত হয়েছেন, বিশেষ করে বাঙালি বলে তাঁকেও স্থানীয় অধিবাসীরা সন্দেহের চোখে দেখছিল বলে। তার পরই অবশ্য আশার কথাও শুনিয়েছেন (পৃ-২৪),

“ কিন্তু আজকাল অনেক ভদ্রলোক পশ্চিমে গিয়ে আমাদের লুপ্ত গৌরব উদ্ধার ক’রেছেন এবং ভরসা আছে, তাঁদের মহত্ত্বে আমরা ভবিষ্যতে এ সব দেশে বাঙ্গালী ব’লে পরিচয় দেওয়া বিশেষ গর্বের কথা ম’নে ক’রবো।”

আমারও অভিজ্ঞতা হয়েছে যে পশ্চিমে বিভিন্ন জায়গায় বাঙ্গালি অধ্যাপনা ও বিশেষ করে চিকিৎসক হিসাবে প্রভূত যশ প্রাপ্ত হয়েছেন। জলধর বাবুও এর পরে শ্রীনগরে কর্মরত এক বাঙ্গালি চিকিৎসকের দেখা পেয়েছিলেন, যিনি সপরিবারে সেখানে বাস করছিলেন। তবে আমার এও অভিজ্ঞতা হয়েছে যে বেশ কিছু সংখ্যক বাঙালি পর্যটক স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেন না, নিজেদের অনেক উচ্চ স্তরের মানুষ ভাবেন। আমার স্নাতক-পূর্ব পাঠ পশ্চিমে এবং তার পর গত ২৫ বছরের বেশি ওই অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে আমি দুঃখের সঙ্গে এই কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি।
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা, ‘এক ভয়ানক দংশন-যাতনা’ তবে আমার মনে হয় এই যাতনার অভিজ্ঞতার চেয়ে সেই কষ্টের সময় সঙ্গী সন্ন্যাসীর সেবাই তাঁর জীবনের এক বড় পাওনা। তাঁর কথাতেই, (পৃ-১০)

“বিদেশে পথিপ্রান্তে এই রকম বিপন্ন অবস্থাতে একজন সন্ন্যাসীর নিকট যে মাতার স্নেহ, ও প্রিয়তমার যত্ন পাওয়া যাতে পারে, এ-কথা আমার নিতান্ত অসম্ভব ব’লে মনে হ’ত; কিন্তু এ সংসারে, গৃহহীন পথিকের জন্যেও ভগবানের প্রেম স্বর্গ হ’তে মানব হৃদয়ে নেমে আসে। কৃতজ্ঞতা ও ভক্তির উচ্ছ্বাসে আমার চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হ’লো।”

এর আগেই উনি লছমন-ঝোলার পূর্বাবস্থা এবং বর্তমান ঝোলা পুলের (১৮৯০ সালে তৈরি) কথা জানিয়েছেন। এখন অবশ্য আমদের কেদার-বদরীর পথে লছমন-ঝোলা পার হতে হয় না। আগে গঙ্গা বাঁয়ে রেখে এগিয়ে হৃষীকেশের শেষ প্রান্তে লছমন-ঝোলা পার করে তপোবন হয়ে গঙ্গা ডান দিকে রেখে উত্তর দিকে তীর্থযাত্রীরা এগোতেন। তবে বেশ কিছু বছর হরিদ্বার থেকে গঙ্গা ডান দিকে রেখে, যাকে বর্তমানে আপার রোড বলে সেই রাস্তা দিয়ে কিছুটা গিয়ে অপর পারে যাওয়া হোতো। এখন আবার বাই-পাস রোড দিয়ে প্রথম থেকেই গঙ্গা বাঁ দিকে রেখে এগোন হচ্ছে। তবে হরিদ্বারে আমরা এখন যে ধারাকে গঙ্গা বলছি তা কিন্তু মানুষের ব্যবস্থাপনার ফল। আমার ঠিক জানা নেই কবে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ভ্রমণ কাহিনি যে নিতান্ত কিছু ভ্রমণের কথাই নয়, জীবনকে জানা, জগৎকে বোঝা, তিনি অনেক বারই আমাদের তা প্রমাণ করেছেন। চটিতে জায়গা না পেয়ে নদী-সৈকতে বালির উপর কম্বল পেতে শুয়ে আমাদের বলছেন (এইখানেই সেই দংশণ-যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল), (পৃ-৯),

“আমার বোধ হ’ল, আমরা সংসারে নান রকম বিলাসিতার মধ্যে জোর ক’রে নতুন নতুন অভাবের সৃষ্টি ক’রে নিই; তাই সংসারে আমাদের এত দুঃখ, কষ্ট, পদে পদে ভগ্ন মনোরথের ক্লেশ ও নৈরাশ্যের যন্ত্রণা।”

আজকাল সর্বজ্ঞানী মানুষ ভ্রমণকাহিনিতে এমন কথা পছন্দ করবেন কি না জানি না। তবে এই রকম কথাই কাহিনিকে, সে ভ্রমণ কাহিনি হোক বা উপন্যাস হোক, কালজয়ী করে দেয়। আজকালকার ভ্রমণ-গাইড ১০ বছরের মধ্যেই ঠোঙা তৈরির কাগজে পরিনত হয়ে যায় নতুন নতুন পরিকাঠামোর উদ্ভবের দৌলতে।
লছমন ঝোলার পর অনেক গুলো চটির পর আছে ব্যাস-চটি। আজকাল এর আগের চটি গুলোর মধ্যে ‘শিভপুরি’ ছাড়া আর কোনও চটি নেই কেননা যাত্রীদের থাকার প্রয়োজন হয় না। শিভপুরিতে নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ গাড়ি দাঁড় করান না। তবে ব্যাস চটি এখনো আছে, অবশ্য চটি আর বলা হয় না, বলা হয় ‘ব্যাসি’। এখন এখানে যাত্রা পথে বাস কিছুক্ষণের জন্যে দাঁড়ায়, বিশেষ করে ফেরার পথে। বাসের যাত্রীরা এখানে ‘চায়-নাস্তা’ করেন।
ব্যাস চটিতে জলধর বাবু ময়ূরের নাচ দেখেছিলেন, অবশ্য গঙ্গার অপর পারে। আমার কয়েকবারের ‘চার-ধাম’ ভ্রমণকালে তা দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তবে এর অনেকটা কাছেই হৃষিকেশ থেকে ‘নীলকণ্ঠ’ মহাদেব মন্দিরের পথে ময়ূরের নাচ দেখবার সৌভাগ্য এক বার হয়েছিল। ব্যাসি থেকে এই মন্দির খুব একটা দূরে না হলেও সোজাসুজি রাস্তা সম্ভবত নেই, অনেকটা ঘুরেই যেতে হয়। জলধর বাবু এই নাচের সুন্দর বর্ণনা খুব সহজ কথায় করেছেন (পৃ-১৭),

“গাছগুলো বাতাসে দুলছে, আর তাদের চঞ্চল ছায়া নদীর নির্মল জলে সর্বদাই কাঁপচে। কিন্তু গাছের শোভার চেয়ে ময়ূরের শোভাই বেশী। ওপারের গাছগুলিতে ময়ূরের পাল। একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে, এখনও আকাশে বেশ মেঘ আছে। দলে দলে ময়ূর পুচ্ছ খুলে যে কি সুন্দর নৃত্য আরম্ভ ক’রেছে, তার আর কি ব’লবো? তাদের ডাকে সেই বনভূমিও নিস্তব্ধ নদীতীর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। একটা দোকানে বসে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে আমি মুগ্ধ হ’য়ে গেলুম। কবির কথা এখন আমার মনে আসতে লাগলো-
‘সেই কদম্বের মূল, যমুনার তীর,
সেই সে শিখীর নৃত্য,
এখনও হারিয়ে চিত্ত,
ফেলিছে বিরহ-ছায়া শ্রাবণ তিমির।‘
কিন্তু এ যে বৈশাখ। -তা হ’লেও বৈশাখের বৈকালে মধ্যে মধ্যে শ্রাবণের ঘনঘটা চোখে প’ড়ে যায়।”

সোমবার, ১১ মে জলধর বাবুদের এক নিদারুন বা দারুন অভিজ্ঞতা হলো। তাঁর সম্পূর্ণ পাথেয় হারিয়ে যাওয়া এবং তার পরে তা ফিরে পাওয়া। পরস্পর ঘটনা প্রবাহ এখানে বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই, তবে যে গরিব সাধারণ স্থানীয় অধিবাসী পাণ্ডা হারিয়ে যাওয়া ধন অত্যন্ত পরিশ্রম করে উদ্ধার করে আনল, তাঁর নির্লোভ আচরণ আমাদের মুগ্ধ করে। জলধর বাবু যখন তাঁকে পাঁচ টাকা পুরস্কার দিতে গেলেন, তিনি তা না নিয়ে বলেন (পৃ-২১),

“বাবাজি, ইনাম কা ওয়াস্তে ইতনা তকলিফ লেনেকো আদমী মেঁই নেহি হুঁ, আপ্‌কো ওয়াস্তে প্রাণ ব্যাকুল হুয়া থা।”

মনে রাখবেন এটা ১৮৯০ সালের কথা, তখন পাঁচ টাকায় সম্ভবত পাণ্ডাজির এক মাসের সংসার খরচ চলে যেত। এই প্রসঙ্গে আমি আমার প্রায় অনুরূপ অভিজ্ঞতার কথা জানাই। কিছু বছর আগে যখন গোমুখের পথে যাবার কোনও restriction ছিল না, চিরবাসাতেই রাত কাটিয়ে ভুজবাসাতে পথের ধারে এক খাবারের দোকানের সামনে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে একেবারে গোমুখে চলে গিয়েছিলাম। সেখানে ছবি তোলার জন্যে রুক্‌স্যাক থেকে টেলিফটো লেন্স বার করতে গিয়ে সেটি পেলাম না। সঙ্গে এক মালবাহক ছিল, সে ব্যাপারটা শুনে আমায় সান্ত্বনা দিল যে যদি আমি এখানে আসার পথে ফেলে থাকি তা হলে নিশ্চয় ফিরে পাবো। আমার মনে হতে লাগলো যে আমি নিশ্চয় ভুজবাসায় বসার সময় সেটি বের করে আর রুক্‌স্যাকে ঢোকাতে ভুলে গেছি। ফেরার পথে আমি দূর থেকেই লক্ষ করলাম সত্যই সেই জায়গায় লেন্সটা পড়ে আছে। এতে যেমন ওই পথের অন্যান্য যাত্রীদের কৃতিত্ব তেমনই ঘোড়াওয়ালা ও ওইখানকার দোকানিদেরও কৃতিত্ব। আমার মতো জলধর বাবুর ক্ষেত্রেও সেই রকমই হয়েছিল; ওটি পথেই পড়ে গিয়েছিল, তবে এক ভেকধারী সন্ন্যাসী টাকার পুঁটুলি নিয়ে চলে যাবার পথে পাণ্ডা তার কাছ থেকে ওইটি উদ্ধার করে।

গাড়ি চেপে ভ্রমণকালে দেবপ্রয়াগ বললেই, অনেক উঁচু রাস্তা থেকে ভাগীরথীর (জলধর বাবু অবশ্য গঙ্গা বলেছেন) সঙ্গে অলকানন্দার সঙ্গম স্থলের সেই অপূর্ব দৃশ্যের ছবি মনে ভেসে ওঠে। জলধর বাবুর কথায় (পৃ-২৫),

“পূর্বেই বলেছি এখানে গঙ্গা ও অলকানন্দার সঙ্গম হয়েছে। গঙ্গার মাহাত্ম বেশী, তাই লোকে বলে গঙ্গায় অলকানন্দা মিশেছে; কিন্তু ঠিক কথা বলতে গেলে বলা উচিত অলকানন্দার সঙ্গে গঙ্গা মিশেছে। ”

নিজের কথার প্রমাণ স্বরূপ এর পর তিনি লিখছেন,

“অলকানন্দা ঘোর রবে নাচতে নাচতে চলে যাচ্ছে; তার উচ্ছৃঙ্খল বেশ, তার তরঙ্গকল্লোল, আর তার উচ্চ তটভূমির বিস্তীর্ণ পাথরের উপর শ্যামল শৈবালের স্নিগ্ধ শোভা দেখে তাকে কবিতার একটা জীবন্ত প্রতিকৃতি বোলে বোধ হয়। সেই ভৈরব দৃশ্যের মধ্যে গঙ্গা কুলু কুলু রবে তার নির্মল জলরাশি ঢেলে দিচ্ছে। আমাদের বঙ্গের সমতল ক্ষেত্রে দুটো নদীর একটা সঙ্গম বড় বিশেষ ব্যাপার নয়; দৃশ্যতেও তেমন কিছু বৈচিত্র থাকে না-কেবল সঙ্গমস্থলটা খানিকটা প্রশস্ত হয় মাত্র; আর দুটো নদী যে কেমন ক’রে মিশে গেল, তার খবরও পাওয়া যায় না, স্বতন্ত্র অস্তিত্বের চিহ্ন ত দূরের কথা। কিন্তু এ দেশের পার্বত্য নদী পার্বত্য জাতির মতই তেজস্বী; সহজে আত্মবিসর্জন ক’রতে রাজী নয়, যথেষ্ট আয়োজন ক’রে তবে আত্মবিসর্জন করে।”

সঙ্গমের কথা নিয়ে বিচার করার আগে ওনার এই লেখার কিছুটা পরে আবার কি লিখছেন দেখে নেওয়া যাক (পৃ-৩৪),

“অলকানন্দার পূর্ব পার ইংরেজের অধিকার, পশ্চিম পার গাড়োয়াল রাজা বা টিহরির রাজার সীমানা। দেবপ্রয়াগে অলকানন্দা গঙ্গার সঙ্গে মিশেছে; সুতরাং গঙ্গার পূর্ব পার ইংরেজের, পশ্চিম অংশ টিহরীর রাজার।”

আপাত দৃষ্টিতে উদ্ধৃত প্রথম প্যারাগ্রাফটি পড়লে মনে হবে গঙ্গা (ভাগীরথী) অলকানন্দায় মিশছে। তাহলে পরে আবার কেন তিনি এর বিপরীত, অর্থাৎ ভৌগোলিক সঠীক কথা কি করে লিখলেন? এর সাধারণ উত্তর হয়, হয় তিনি না জেনে যা খুশি মনে এসেছে তাই লিখেছেন আর নয় তো এও দীনেন্দ্রবাবুর আর এক কীর্তি। জলধর বাবুর ডায়রি থেকে পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করতে গিয়ে, যে হেতু তাঁর হিমালয়ে ঘোরার কোনও কথা আমাদের জানা নেই এবং তাঁর ভৌগোলিক জ্ঞান কিছু ছিল কি না তাও আমাদের অজানা, তাই তিনি ২৫ পৃষ্টায় পরিবর্ধন বা পরিমার্জন করে কি লিখছেন তার মর্মার্থ বোঝেননি। যাই হোক এ সমস্ত ব্যাপার ছাড়াও এই আপাত ভুলের আর এক কারণ হতে পারে, এবং আমার মনে হয় সেটাই হয়েছে। অলকানন্দায় গঙ্গার (ভাগীরথী) তুলনায় জলরাশির আধিক্য আর তার উচ্ছলতা দেখলে যে কোনও মানুষের হঠাৎ মনে হতেই পারে যে অলকানন্দাতেই গঙ্গা এসে মিশছে। আর জলধর বাবু সেটাই বলতে চেয়েছেন কিন্তু লেখায় অপরের হস্তক্ষেপে ভাষার ত্রুটি হয়ে গেছে। না হলে পরে ঠিক কথাটা কী করে লেখা হয়। এই সুযোগে বলি, সম্পাদকীয়তে, বারিদ বাবুও ২৫পৃষ্ঠার লেখার কথাই বলেছেন, ৩৪পৃষ্ঠার লেখার কথা উল্লেখ করেননি।

পাঠকের ধারণা হতে পারে যে রচনায় ভুল হলেই আমি দীনেন্দ্রবাবুকে দোষি সাব্যস্ত করার চেষ্টা করছি। এর কারণ নিশ্চয় আছে। আশা করি পাঠক লক্ষ করেছেন যে, যে দুই বার আমি দীনেন্দ্র বাবুর দোষ হয়ে থাকতে পারে বলে সন্দেহ করেছি, সেই দুটি ক্ষেত্রেই তথ্য বা তত্ত্বগত ত্রুটি হয়েছে। জলধর বাবুর এই দুই ত্রুটিই না হবার কথা, তাঁর পাহাড়ি পথের এবং পাহাড়ের চরিত্রের অভিজ্ঞতার দৌলতে। এই অভিজ্ঞতা দীনেন্দ্রবাবুর ছিল কি না তা আমাদের জানা নেই।
জলধরবাবুর রসবোধ উচ্চস্তরের। বিভিন্ন জায়গায় সেই পরিচয় আমরা পেয়েছি। শ্রীনগরে ভগ্ন প্রাচীন রাজবাড়ির মধ্যে এক মন্দিরে (পৃ-৩৫),

“একটা জায়গায় দেখলুম শ্রীযুত গজানন মহাশয়- তিনিই দেবতাকুলে সব চেয়ে নিরীহ-হস্তচতুষ্টয়ে গদা ও তীরধনুক নিয়ে মহাতেজে অগ্রসর হচ্ছেন।–নিরীহ কেরানী দেবতাটির এই যুদ্ধসাজ বড়ই বেমানান দেখাচ্ছিল। মহাভারতের ত কোথাও গনেশের এতটা বীর-পরাক্রম প্রকাশের কারণ উল্লেখ দেখা যায় না, তবে যদি অন্য কোন পুরাণে এ সম্বন্ধে কিছু থাকে, তা হোলে একটা কথা বটে। কতকগুলি দেবতার চেহারা চক্ষে একটু নূতন ঠেকলো; তেত্রিশকোটির মধ্যে হ’তে তাঁদের চিনে নেওয়া আমার মত লোকের পক্ষে বিলক্ষন কঠিন ব্যাপার!”

ভ্রমণকাহিনির মধ্যে জীবনের তত্ত্ব বা বাঁচার উদ্দেশ্য, সেই দেশের ইতিহাস, ভুগোল ইত্যাদির আলোচনা থাকা খুবই স্বাভাবিক। তার সঙ্গে যদি সেখানকার সমাজ জীবনের খবর পাওয়া যায় তবে সেই কাহিনি ভবিষ্যতের জন্যে এক আকর গ্রন্থে পরিণত হতে পারে। জলধর বাবুর ‘হিমালয়ে’ এই সমস্ত গুণই বর্তমান।

১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর ভারতে দয়ানন্দ সরস্বতী বেদ ভিত্তিক ‘আর্য সমাজ’ নামে এক ধর্মীয় গোষ্ঠীর বা সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। দেখতে দেখতে বহু মানুষ আর্য সমাজের অনুগামী হয়ে যান। এঁদের মধ্যে অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীও শামিল ছিলেন, যেমন, মাদাম ক্যামা, বিনায়ক দামোদর সাভারকার (বীর সাভারকার), ভগৎ সিং, লালা রাজপত রাই ইত্যাদি। জলধরবাবু যখন দেরাদুনে শিক্ষকতা করছিলেন, তিনি আর্য সমাজভুক্ত মানুষদের সঙ্গে মূল হিন্দু সমাজের (যাঁদের ওখানে বলা হত ‘ধর্মসমাজ’) তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব্য প্রত্যক্ষ করতেন। শ্রীনগরে তাঁর এক ধর্মসমাজের বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয় এবং তাঁদের মধ্যে পুরানো দিনের অনেক কথাবার্তা হয়। তাতে আমরা সেই সময়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কের কথা জানতে পারি।

পদযাত্রা শুরুর ১১ দিন পরে ১৭ মে জলধরবাবুরা রুদ্রপ্রয়াগে পৌঁছান, প্রায় ১৮৭ কিমি পার করে। অবশ্য এর মধ্যে প্রত্যেক দিনই হেঁটেছিলেন তা নয়। আমরা জানতে পারি যে তখন রুদ্রপ্রয়াগ শহরের বিপরীত দিকে দিয়ে বদরীনাথের পথ ছিল। যদিও এও জানতে পারি যে শহর বলতে বিশেষ কিছুই ছিল না। এখন পথ শহরের উপর দিয়েই, এবং শহর বেশ বড়। এখন রুদ্রপ্রয়াগ ওই নামেরই জেলার সদর।
রুদ্রপ্রয়াগে এসে ওনাদের বেশ বিপদের মধ্যে পড়তে হয়, প্রথমে বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর জ্বর, তারপর তাঁর নিজের জ্বর ও উদরাময় রোগ এবং শেষে তাঁদের সঙ্গের সাহায্যকারি ছেলেটির জ্বর। বেশ কয়েকদিন রুদ্রপ্রয়াগেই পড়ে থাকতে হয়। তবে এখানে জলধরবাবুর এক গভীর উপলব্ধি হয়। তাঁর কথাতেই (পৃ-৪৭),

“সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে মনে বড় অহঙ্কার হ’য়েছিল যে যখন মায়াজাল ছিন্ন করা এত সহজ, তখন লোকে তা পারে না কেন? এই ত আমি পেরেছি; কিন্তু মৃত্যু যখন পাশে এসে দাঁড়ালো, মৃত্যুর সেই উচ্চ অনাবৃত তটপ্রান্তে দাঁড়িয়ে যখন প্রতিমূহূর্তে সেই বিস্মৃতিপূর্ণ, গভীর অতলে আমার পদস্খলন হ’বার সম্ভাবনা দেখলুম, তখন সংসারের সমস্ত মায়ামোহ এসে আচ্ছন্ন ক’ল্লে। মনে হ’লো যাদের ফেলে এসেছি, সন্ন্যাসী ব’লেই যে তাদের ছেড়ে আসতে পেরেছি তা নয়; তাদের একবার দেখার আশা আছে ব’লেই তাদের ফেলে আসতে পেরেছিলুম, বাঁধন ছিঁড়তে পারি নি।”

তারপর তাঁর প্রতি স্বামীজির মায়া লক্ষ করে (পৃ-৪৭),

“পৃথিবীর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ ক’রেও যিনি সকলের প্রতি স্নেহপরায়ণ, তাঁরই যথার্থ বৈরাগ্য, নতুবা জনমানবের সাড়া –শব্দশূন্য জঙ্গলে ব’সে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে অলীক ব’লে নাসাগ্রে দৃষ্টিবদ্ধ ক’রে কাল কাটানতে বিশেষ কিছু যে মহত্ত্ব আছে, তাহা আমার বোধ হয় না।”-

এই রকম কথাই কোন কাহিনির মূল্য নির্ধারণ করে। এই উপলব্ধিই কোন মানুষের শ্রেণী স্থির করে। এটাই মানুষের চিরন্তন বোধ।

তাঁর রুদ্রপ্রয়াগে সাময়িক বাস আমাদের আরও কিছু মনি-মূক্তো দিয়েছে। আধুনিক চিকিৎসার অনুপস্থিতিতে স্বামীজি জলধর বাবুকে জলপড়া পান করান। তাঁর সেরে ওঠা স্বাভাবিক কারণেই হয়তো হয়েছিল কিন্তু, আজকের দিনে আমাদের সামনে যা ঘটছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর বক্তব্য অতি মূল্যবান (পৃ-৪৮),

“আমাদের দেশে শুনেছি সেকালে জলপড়া খেয়ে লোকের ব্যারাম সারতো; মধ্যে ইয়ং বেঙ্গলদের আমলে কিছুদিন সারতো না, এখন সেই জলপড়া বিলাত হ’তে মেসমেরিজম নাম নিয়ে এদেশে এসেছে; এখন আবার তাতে অসুখ সারছে!”

আমি জলপড়া বা ওই ধরনের বিভিন্ন কুসংস্কারের পক্ষে বলছি না, বরং আশ্চর্য হচ্ছি, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের দেশে বিভিন্ন বিদেশি কুসংস্কার রমরমিয়ে চলছে। এমন কি তথাকথিত প্রগতিশীল ইংরাজি খবরের কাগজেও সেই ধরণের কুসংস্কারের কথা নিয়ম মাফিক প্রতিদিন উপস্থিত করছে। প্রায় ১২০ বছর আগেই জলধর বাবু একই কথা উল্লেখ করে গেছেন।
এই সমস্ত বিষয়ের আলোচনার মধ্যে তিনি ভ্রমণের মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি। প্রকৃতির কোলে মাথা রেখে, বাস্তবদৃষ্টি নিয়ে সুললিত ভাষায় লিখেছেন (পৃ-৪৮),

“চারিদিকে সরল সমুন্নত পর্বত; সম্মুখে অলকানন্দা ও মন্দাকিনীর খরপ্রবাহ পরস্পরে মিশে গিয়েছে; সূর্যকিরণোদ্ভাসিত পর্বতের কনক কিরীট নদীজলে প্রতিতফলিত হ’চ্ছে; রক্তরঞ্জিত মেঘের ছায়া ধীরে ধীরে ভেসে যাচ্ছে।”

এই প্রয়াগে আজকাল বদরীনাথ যাত্রা পথে কম যাত্রীরই সূর্যাস্তের সময় উপস্থিত হবার সুযোগ হয় বিশেষ করে যদি নিজের ভাড়া গাড়িতে ভ্রমণ করেন। তার কারণ এই সময়ের অনেক আগেই রুদ্রপ্রয়াগ যাতায়াতের পথে পার হয়ে যাওয়া হয়। আর যদি যাত্রী বাস বা সাধারণ বাসে যাতায়াত করা হয় তা হলে তো এখানে সঙ্গম দেখাই সম্ভব হয় না। নিজের গাড়িতে যাত্রা করলে আর ইচ্ছা ও সময় হলে এবং যাত্রা বিরতি করে একদিন থাকতে পারলে তবেই সূর্যাস্তের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে। যাই হোক আমার এক বার সূর্যাস্তের কয়েক মিনিট পরে সুযোগ হয়েছিল সঙ্গমের ধারে পৌঁছানোর। দুঃখের কথা যে ‘সূর্যকিরণোদ্ভাসিত’ অবস্থায় পর্বত শীর্ষ দেখা সম্ভব হয়নি। তবে জলধরবাবুর বর্ণনায় আমার মনে হয় কিছুটা ত্রুটি থেকে গেছে। দুটি নদীরিই জলের যে বেগ ও উচ্ছলতা, তাতে ‘সূর্যকিরণোদ্ভাসিত পর্বতের কনক কিরীট নদীজলে প্রতিতফলিত’ অবস্থায় পরিষ্কার দেখতে পাওয়া অসম্ভব। এক্ষেত্রে কনক কিরীটের শতধাবিভক্ত প্রতিফলনের শিহরণের কথা বললে বর্ণনাটি আরও নাটকীয়, বাস্তব ও উপভোগ্য হত।

রুদ্রপ্রয়াগের সাত মাইল দূরে রানি অহল্যাবাঈ দ্বারা নির্মিত শিবানন্দ চটিতে এলেন। রুদ্রপ্রয়াগের এত কাছে বলেই মনে হয় এখন এই চটির ব্যবস্থাদি নষ্ট হয়ে গেছে। এই চটির কথা আমি কিছুই জানি না। জলধর বাবুও এর দুরবস্থাই লক্ষ করেছিলেন। ওনাদের সঙ্গী ছেলেটি তখনও অসুস্থ তাই তাঁরা ওখানেই অপেক্ষা করার মনস্থ করলেন। এতে তাঁদের সহযাত্রী ‘বৈদান্তিক’ বিরক্ত হয়ে এতদিনের সাথীদের ছেড়ে চলে গেলেন। জলধরবাবুর বৈদান্তিকের চরিত্র বিশ্লেষন মনে রাখার মত (পৃ-৫৪),

“হায় মায়াবাদী বৈদান্তিক! তোমার এই মায়াবাদ কি স্বার্থপরতার নামান্তর মাত্র! তুমি দুঃখ-দারিদ্র পদদলিত ক’রে তীর্থস্থানে যেতে চাও, দরিদ্র প্রজার সর্বস্ব লুণ্ঠন ক’রে কাশীতে দেবালয় প্রতিষ্ঠা করতে চাও; ভগবানের অজস্র করূণা ও চিরন্তনের মঙ্গলেচ্ছাকে ত্যাগ ক’রে, বৈরাগ্যের হৃদয়হীনতাকেই সার পদার্থ ব’লে মনে কর। .... অথবা তোমারই বা দোষ কি, আমাদের দেশের অনেক সাধুপুরুষের বৈরাগ্যই তোমার মত।”

এক দিন বিশ্রাম নিয়েই ছেলেটি সুস্থ হয়ে ওঠে আর ওনারা আরও আট মাইল হেঁটে পিপল চটিতে এসে পৌঁছান। মজার কথা যে তাঁদের ছেড়ে চলে যাওয়া বৈদান্তিক এখানে আবার তাঁর পুরনো সহযাত্রীদের সঙ্গে যোগ দেন (পৃ-৫৬)।

“আমরা যথন পিপলচটির কাছাকাছি এসেছি, সেই সময় দেখি বৈদান্তিক ভায়া শিবানন্দের দিকে ফিরে যাচ্ছেন। তাঁকে দেখে আমার এমনি আনন্দ হ’লো আমি দৌড়ে গিয়ে তাঁর গলা জড়িয়ে ধোল্লাম। তিনি বল্লেন, ‘ভাই, তোমাদের ছেড়ে গিয়ে আমি কাজ ভাল করি নি...।”

অন্য কিছু বলার আগে বারিদবাবুর লেখা সম্পাদকীয় থেকে কয়েক লাইন উদ্ধৃত করি (সম্পাদকীয়, পৃ-১৩),

“দীনেন্দ্রকুমার একটি কথা যথার্থ বলেছেন-তাঁর অনভিজ্ঞ হস্তক্ষেপের ফলে বইয়ে কিছু অসঙ্গতি থেকে যায়। ... যেমন ‘বৈদান্তিক’ সঙ্গী জলধরের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেলেও পরবর্তী অধ্যায়গুলিতেও সঙ্গী হিসাবে তিনি বর্তমান আছেন, অথচ কোথাও তাঁর প্রত্যাবর্তনের কথা উল্লিখিত হয়নি।”

আমার মনে হয় মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

পিপল চটিতে মাছির উপদ্রবের কথা বলেছেন। আমার মা চল্লিশ বছর আগে ওই সমস্ত জায়গায় গিয়েছিলেন, তিনিও মাছির আধিক্যের কথা বলেছিলেন। বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে এখনও মাছির উপদ্রব হয়, তবে নিশ্চিত ভাবেই তা অনেক কমেছে। আশ্বিন-কার্তিক মাসে মাছি আজকাল প্রায় থাকেই না।
পিপল চটিতে তাঁদের থাকবার ইচ্ছা থাকলেও, মাছির তাড়ায় আবার পথে বের হলেন। কিছু দূর এগোবার পরই প্রথমে ঝড় ও পরে শিলা বৃষ্টির সম্মুখীন হলেন। ঝড়ের তাণ্ডব কেবল মাত্র প্রচণ্ড বলেই এর বর্ণনা থেকে বিরত থেকেছেন কিন্তু শিলাবৃষ্টির কিছুটা বর্ণনা করেছেন। বিশেষ করে (পৃ-৫৮),

“এই পার্বত্য দেশে যে রকম বড় বড় শিলাবর্ষণ হয়, আমাদের সমতল প্রদেশের লোকেদের তা বুঝিয়ে উঠা যায় না।”-

তা মনে হয় সব সময় নয়। কেদারনাথে প্রথম বার ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা বলি। প্রথম দিনের বিকাল বেলা কেদারনাথের রাস্তায় ঘুরে বেড়াবার সময় শিলাবৃষ্টির মধ্যে পড়ি। প্রায় ৩০ মিনিট প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টিতে চারি দিক সাদা হয়ে গেল। আমার স্ত্রী, দুই ছোট ছোট পুত্র ও কন্যা নিয়ে আমি এক বাড়ির রাস্তার তলের বারান্দায় পুরো সময়টা কাটাতে বাধ্য হলাম। রাস্তা, সামনের বাড়ির অল্প ঢালু ছাদ পুরূ শিলাস্তরে ঢেকে গেল, তবে শিলা ছোট ছোটই ছিল।
এখান থেকে জলধরবাবুরা কর্ণপ্রয়াগ পৌঁছান। এখানে একটি ছোট থানার প্রসঙ্গে লিখছেন (পৃ-৬১),

“আমাদের দেশের কনেস্টবল ও এখানকার কনেস্টবলে কিছুই তফাৎ দেখলাম না। আমাদের দেশের প্রভুদের মত এরাও শিষ্টের দমন ও দুষ্টের পালন ক’রে থাকেন, এবং দু’পয়সা লাভের আশায় একজন নিরীহ ব্যক্তির সর্বনাশ ক’রতে কিছুমাত্র আপত্তি বোধ করেন না।”

জলধরবাবুর অভিজ্ঞতা থেকে আজ ১২০ বছর পরে অবশ্য কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলতে পারা যায়, তাদের দুষ্টের ছাড়া আরও এক গোষ্ঠির পালন কর্তার ভূমিকায় প্রায়ই দেখা যায়।
কর্ণপ্রয়াগে সরকারের প্রতিষ্ঠিত একটি চিকিৎসালয় দেখতে পেলেন এবং বিকালে সেখানে গেলেন। ডাক্তরবাবুর সঙ্গে নানা কথা হওয়ার সময় থানায় পরিদর্শনে আসা পুলিশ ইন্‌স্পেক্টর আসেন চিকিৎসালয়ে। তিনি জলধর- বাবুর মত একজন শিক্ষিত, ইংরাজি-জানা যুবক এত কষ্ট সহ্য করে তাঁর কথামত কেবল মাত্র একটি মন্দির দেখতে আসবেন তা বিশ্বাস করতে রাজি হলেন না এবং সন্দেহ প্রকাশ করলেন যে নিশ্চয় কিছু রাজনৈতিক গূঢ় মতলব আছে (সন্দেহ যে কী, পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন)। এই পরিপ্রেক্ষিতে জলধর বাবু তাঁর এই কষ্ট সহ্য করার কারণ যা উল্লেখ করেছেন, সেই কথাগুলি আমার মনে হয় ‘হিমালয়ের’ সব থেকে মূল্যবান কথা (পৃ-৬৩),

“আমি কি শুধু কতকগুলি বহু পুরাতন দেবমূর্তি দেখবার জন্যে অনাহারে অনিদ্রায় কঠোর পরিশ্রম ক’রে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি?... পার্বত্য-নগ্ন-সৌন্দর্য, প্রকৃতির বিচিত্র দৃশ্য, খরতোয়া বঙ্কিম গিরিনদীর রজতপ্রবাহ ও সুশীতল সমীরণের অবারিত হিল্লোল, এরাই যে আমার জীবনের উপাস্য দেবতা, ইন্‌স্পেক্টর তা বুঝতে পাল্লেন না।”

 

তবে উনি বললেন বটে ইন্‌স্পেক্টর বুঝতে পারলেন না, কিন্তু তিনি তাঁর নাম ও ঠিকানা জলধর বাবুকে দিয়ে বলেন যে রাস্তায় যদি কোনও যাত্রীর সঙ্গে থানার কেউ অত্যাচার করে দেখতে পান, তাহলে তাঁকে জানাতে না ভোলেন।
মে ২৩ কর্ণপ্রয়াগ থেকে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বেরিয়ে পড়লেন। তবে কিছুদুর এগিয়ে ভাঙা ও পরিত্যক্ত বাগান সহ এক দোতলা বাড়ি দেখতে পেলেন। বাকি সঙ্গীরা তখনও না এসে পৌঁছানোর কারণে এই বাগানের এক বটগাছের নিচে বসে তিনি এক কল্পনা রাজ্যে চলে গেলেন। তাঁর মনে হল যেন (পৃ- ৬৬ ও ৬৭),

“বশিষ্টের আশ্রম, বিশ্বামিত্রের তপোবন, শান্তরসাস্পদ সকল জায়গার কথা ধীরে ধীরে আমার হৃদয় অধিকার ক’রলে।... মাথার উপর টুপ্‌টাপ্‌ ক’রে বৃক্ষপল্লবচ্যুত জলবিন্দু পড়াতে একটা পুরাতন গান মনে পড়ে গেল, -
‘আবার বল্‌ রে তরু প্রভাতকালে,
ধরা ভেসে যায় তোর নয়নজলে,
না জেনে লোকে বলে শিশিরপড়া জল রে!’
বাস্তবিক এ জায়গাটাতে এমন এক স্নিগ্ধ সৌম্য ভাব মনের মধ্যে জাগিয়ে দেয় যে ভগবানের করুণা ও প্রকৃতির বিশ্বব্যাপী সুশোভনত্ব স্বতঃই হৃদয় অধিকার করে।”

এই প্রকৃতি বর্ণনা আর একটি কারণে আমি উল্লেখ করলাম। সেই রুদ্রপ্রায়েগের মে ১৭-র পর একেবারে মে ২৩-এ জলধর বাবু পারিপার্শ্বিক প্রকৃতির বর্ণনা করলেন। যদিও এর মাঝে মানুষের প্রকৃতির কথা অনেকবারই বলেছেন।
যাই হোক, তিনি সেই ভাঙা বাড়ির ভিতরে গিয়ে রামায়ণ, মহাভারত ও বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনির সুন্দর সুন্দর অনেক ছবি দেখলেন। দুঃখের কথা এখন আর সে বাড়ি কোথায় আছে বা কোথায় ছিল, বুঝতেই পারা যায় না।
আমার হিমালয়ের হাঁটাপথের অভিজ্ঞতার কথা বলি। না, এ অভিজ্ঞতা বদরীনাথ বা চার ধামের পথের নয়, কেননা এখন কেউই আর হেঁটে যায় না। অবশ্য যমুনোত্রী ও কেদারনাথের পথে কিছুটা করে এখনও হাঁটতে হয়। এ হল গোবিন্দঘাট থেকে ১৩ কিমি দূরের ঘাঙরিয়ার যাবার পথ। এই পথে এমন বহু জায়গা আছে যেখানে গাছের নিচে শান্ত, নিঝুম আদিম বৃক্ষ-রাজি পরিবেষ্টিত জঙ্গলের মাঝে দু দণ্ড বসে চোখ বন্ধ করে ধ্যান করতে ইচ্ছে করে। গুরু গোবিন্দ সিং-এর তপোস্থলী এই পথেই। পরে আবার এই পথের কথা বলার সুযোগ আসবে।

পুরানো কথায় ফিরে আসি। এই দিন দুপুরের আগেই অলকানন্দা ও নন্দাকিনী নদীর সঙ্গম স্থল নন্দপ্রয়াগে এসে পৌঁছলেন। উনি অবশ্য নন্দাকিনী না বলে নদীর নাম নন্দা বলেছেন। জানিনা তখন হয়তো এই নামেই পরিচিত ছিল এই নদী। তাঁর ছোটবেলায় ভূগোল পড়ার সময় এই সমস্ত নদীর নাম শোনেননি। প্রথম যখন শোনেন এই নদীগুলির স্বর্গে অবস্থানের কথা ভেবেছিলেন। পরে চোখে অবস্থান দেখে এই স্থানকেই স্বর্গ বলে মনে হয়েছে তাঁর। (পৃ-৭২-৭৩),

“মানুষের কর্মফল যদি মৃত্যুর পর স্বর্গে যাবার কারণ হয়, তা হ’লে আমার পক্ষে তার বড় একটা সম্ভাবনা দেখছি নে। তবে আমার সান্ত্বনা এই, আমি মনে করি আমার এ জীবনেই স্বর্গবাস হয়ে গিয়েছে। এসব দেশে যা আছে, স্বর্গে তার চেয়েও আর বেশী কি থাকবে?”

জলধর বাবুর ছেলেবেলায় ভূগোলে এই সমস্ত নদীগুলির নাম না থাকার কথা খুবই স্বাভাবিক, কারণ তখন বিদেশি শাসণ। তবে এখনও স্কুল-পাঠ্য ভূগোলে গঙ্গা ও যমুনা ছাড়া উত্তরাখণ্ডের আর কোনও নদীর নাম নেই। স্কুল-পাঠ্য ভূগোলের কথাই বা বলি কেন, স্নাতক স্তরের প্রাকৃতিক ভূগোলেও হিমালয় অঞ্চলের কথা নাম মাত্র আছে। ভূবিদ্যাতে উত্তরাখণ্ডের পাতালভুবনেশ্বর নামের এক অদ্ভুত গুহার উল্লেখই নেই, তার বদলে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের এক সমগোত্রীয় অবশ্য বৃহত্তর এক গুহার কথা আছে। আমাদের ভাবনার পরিধি এমনই।
নন্দপ্রয়াগে জলধর বাবুর সঙ্গে পাঁচ-ছয় জন বাঙালি স্ত্রী-পুরুষের দেখা হল। তাঁরা আগের বছর থেকে এখানে অপেক্ষা করছেন নারায়ণ দর্শনের জন্যে। বিভিন্ন কারণে গত বার এখান থেকে আর এগোতে পারেননি। পরের বছর আর আসতে পারবেন কি না ভেবে এখানেই বাড়ি থেকে টাকা-পয়সা আনিয়ে একটি ঘর নিয়ে বছর কাটিয়েছেন। এবার মন্দিরের দরজা খোলার জন্যে পাণ্ডার দলের সঙ্গে গিয়ে নারায়ণ দর্শন করে এসেছেন। জলধর বাবুর বক্তব্য (পৃ- ৭৪),

“স্বীকার করি, তাঁদের ভক্তি স্বার্থপরতামিশ্রিত, হয়ত পরকালে অক্ষয় স্বর্গলাভের প্রলোভনেই তাঁরা এই কষ্টকর অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হ’য়েছিলেন; কিন্তু বাঞ্ছিতের প্রতি এমন অসাধরণ একনিষ্ঠা, এ শুধু প্রশংসনীয় নয়, অনুকরণীয়।”

এনাদের আগের বছর লক্ষে না পৌঁছানোর কারণ ছিল ওই অঞ্চলের দুর্ভিক্ষের প্রকোপ। সরকার থেকে যাত্রা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আমরা নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের কাছ থেকে শিখেছি যে গনতান্ত্রিক দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না, খাদ্যের মূল্য অবশ্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে যেতেও পারে। যে কোনও কারনেই হোক না কেন, সত্যই দুর্ভিক্ষ হয়েছে অধুনা আমরা কখনই বলতে পারি না। তাই এই কারণে তীর্থ ভ্রমণ বন্ধ হতে পারে না। ওইখানকার রাস্তা সাময়িক বন্ধ অনেক সময়ই হয়ে থাকে, এই বছর (২০১১) তো অনেক বার বেশ কিছু দিন ধরে তা হয়েছিল। তাই আজকাল ওই বাঙালি তীর্থযাত্রীদের মত অবস্থা আমরা কল্পনাই করতে পারি না।
পরের দিন, অর্থাৎ ২৪ মে, সকালেই এক অনির্বচনীয় দৃশ্য উপভোগ করলেন। কিছুটা পড়া যাক তাঁর লেখা থেকে (পৃ-৭৬),

“তখন সূর্য উঠছে, কিন্তু তখনো চারিদিকে মেঘ বেশ ঘন হ’য়েছিল; আর সেই মেঘের মধ্যে দিয়ে অল্প অল্প সূর্যকিরণ জলসিক্ত পার্বত্য প্রকৃতির উপর এক একবার প্রতিফলিত হ’চ্ছিল; সে এমন সুন্দর যে, সহজেই একটা কিছুর সঙ্গে তার উপমা দেবার ইচ্ছা হয়, কিন্তু যার সঙ্গে উপমা দেওয়া যেতে পারে এমন কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। আমার মনে হ’লো কোন সুন্দরীর বড় বড় জলভরা চোখের উপর মুখে যদি একটুখানি হাসি ফুটে উঠে ত সে অনেকটা এই রকম দেখায়। প্রভাত-সূর্্যেলর এই সতেজ, প্রদীপ্ত রশ্মির চেয়ে এই মেঘাবৃত প্রভাত কেমন মধুর ও সরস!”

আহা কী বর্ণনা! দৃশ্য আর দৃশ্যের তুলনার মাঝে যে সংযোগ, বর্ণনাকে আরও উচ্চ মাত্রায় নিয়ে গেছে। এই বর্ণনার তুলনা দা ভিঞ্চির মোনালিসার পিরামিড স্টাইলের সঙ্গে আমার করতে ইচ্ছে করে। বাঁ দিকের কোণে আছে সদ্য স্নাতা সূর্যালোকে প্রকৃতি, ডান দিকে ‘সুন্দরী বড় বড় জল ভরা চোখে’ স্মিত হাস্য প্রকৃতি আর শীর্ষে রয়েছে প্রকৃতি বর্ণনা। পিরামিডের শীর্ষে মন যাওয়া মানে বর্ণনা পাঠ, আর পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গেই এক বার মন যায় এক প্রকৃতিতে তার পরেই সুন্দরী প্রকৃতির উপর। এ যেন এখনকার মাল্টিমিডিয়াও বটে, লিখিত পাঠ বা text এবং তার পরেই দুই ছবি পরস্পর চোখের সামনে এসে যাচ্ছে। শেষের ছত্রের কথা, সম্পূর্ণ পরিষ্কার আকাশে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের তুলনায় কিছুটা মেঘাবৃত আকাশ অনেক সুন্দর দেখতে হয়, বিশেষ করে মেঘ যদি শরৎ কালের হয়, এ আমরা সমতলেও দেখতে অভ্যস্ত।
অনির্বচনীয় প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা ছাড়া মানুষে মানুষে ভালবাসারও সাক্ষ্য হলেন জলধর বাবুরা। এক বছর ধরে যে বাঙালি মহিলা-পুরুষের দল নন্দপ্রয়াগে থাকছিলেন তাঁরা দেশে ফিরে যাচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে স্থানীয় অধিবাসীদের বিদায় দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলেন। বর্ণনা যে কোনও মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে। (পৃ-৭৬-৭৭),

“একজন বাঙ্গালী রমণী একটি যুবতীর গলা ধ’রে চক্ষের জল ফেলছেন; তাঁর এই এক বৎসরের সঞ্চিত স্নেহ মমতা যেন চোখের জলে উথলে উঠছে। যুবতীও তার দেশগত কাঠিন্য ভুলে স্নেহশীলা বালিকার মত রোদন ক’চ্ছে। কোথায় সেই সুদূর পূর্বের শস্যশ্যামল সমতল বঙ্গের অন্তঃপুরচারিকা, আর কোথায় এই হিমালয়ের ক্রোড়স্থ পাষাণ-প্রাচীরবেষ্টিত একটি ক্ষুদ্র নগরের হিন্দুস্থানী যুবতী! পরস্পরের মধ্যে আকাশ পাতাল প্রভেদ; কিন্তু ভালবাসা এমন দুটি বিসদৃশ প্রাণীকে এই এক বৎসরের মধ্যেই কি দৃঢ়রুপে একসঙ্গে বেঁধে ফেলেছে! তাই তারা দেশকাল ভুলে পরস্পরের জন্যে অশ্রু বিসর্জন ক’চ্ছে, আমি এই দৃশ্যে একবারে মুগ্ধ হ’য়ে গেলুম; এই দৃশ্য আমার কতকাল মনে থাকবে।”

এই দেশে প্রত্যাবর্তনকারী স্ত্রী-পুরুষের দলের সঙ্গে তাঁরাও অশ্রুপূর্ণ বিদায় আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। এই গভীর আনন্দ দায়ক দৃশ্য দেখে ছ’মাইল হেঁটে একটি সাঁকো পার করে ‘লালসাঙ্গা’ চটিতে পৌঁছালেন। এটাকে চটি না বলে ছোট এক শহর বলার মতই সেখানকার অবস্থা। এই চটির গুরুত্ব অনেক। কেদারনাথ থেকে যাত্রীরা আবার দক্ষিণে রুদ্রপ্রয়াগে না নেমে অনেক কম পথ অতিক্রম করে এই জায়গায় বদরীনাথের পথে চলে আসতে পারেন। তাই এখানে যাত্রীর ভীড় বেশ বেশি।
এখানে থানা আর দাতব্য চিকিৎসালয় আছে বলেছেন, জলধর বাবু অবশ্য লেখেননি যে ১৮৮৯ সাল থেকে লালসাঙ্গা জেলার উত্তর বিভাগের ডেপুটি কলেক্টরের ন্যায়ালয়। নদীর উপর পারাপারের কাঠের সেতুর লাল রং-এর কারণে জায়গার নাম লালসাঙ্গা ছিল। এই প্রসঙ্গে জানাই যে লালসাঙ্গার বাজার অলকানন্দার পশ্চিম দিকে ছিল এবং ১৮৯৪ সালের বিরেহি নদীর প্রচণ্ড বন্যায় সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংশ হয়ে যায়। বন্যার পর লোহার সেতু তৈরি করা হয়। এই জায়গার আসল নাম চামোলি এবং পৌড়ি-গাড়োয়াল জেলার মহকুমা থেকে ১৯৬০সালে পূর্নাঙ্গ জেলায় উন্নত হয়। বদরীনাথ ও কেদারনাথ এই চামোলি জেলারই অন্তর্গত।
এখানে থাকবার সুবিধে হওয়া সত্তেও ওনারা লালসাঙ্গা থেকে আরও তিন মাইল এগিয়ে ‘ধাওলা’ চটিতে চলে গেলেন। কারণ সেদিন সকালেই এক সন্ন্যাসী চুরির দায়ে ধরা পড়েছে এবং তিনি আবার ‘পূর্বী’। ওই অঞ্চলে পূর্বী বলতে উত্তর প্রদেশের (তখন বলা হত যুক্ত প্রদেশ) পূর্বাংশ , বিহার, ওড়িশা ও বাংলার অধিবাসীদের বোঝাত। অতএব জলধর বাবুদেরও সন্দেহের চোখে দেখাই স্বাভাবিক। ধাওলা চটিতে রাতে শীতে খুব কষ্ট পেলেন, তাঁদের যাত্রাপথে এ পর্যন্ত এখানেই শীত সর্বাধিক বলে ওনাদের মনে হল।
পরের দিন ভোর বেলা যাত্রা শ্ররু করে সকাল ন’টা নাগাদ সামনে উন্মুক্ত এক রাস্তায় পৌঁছালেন এবং সেখান থেকে (পৃ-৮০),

“বিস্ময় বিস্ফারিত নেত্রে দেখলুম, আমরা এক সুবিশাল বরফের পাহাড়ের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছি; তার চারিটি সুদীর্ঘ শৃঙ্গ আগাগোড়া আচ্ছন্ন।... প্রাতঃসূর্যকিরণ সেই তুষার-ধবল আদ্র পর্বতশৃঙ্গগুলির হিল্লোলিত হওয়াতে বিভিন্ন বর্ণের সমাবেশে প্রতিক্ষণে কি যে অপূর্ব সৌন্দর্য প্রতিফলিত হচ্ছিল, বর্ণনা করে তা বুঝিয়ে দেওয়া যায় না; পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম চিত্রকরের তুলিকাতে সেই অপূর্ব দৃশ্যের অতি সামান্য প্রতিকৃতিও অঙ্কিত হতে পারে না।”

বর্ণনা এখানেই শেষ নয়। এই যদি “কিছুই বলা হয় নাই” হয় তবে কিছু বলা যে কি, কে জানে। অবশ্য এই সমস্ত দৃশ্য বর্ণনা অনুধাবন তারাই করতে পারে যাদের এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা আছে।
ক্রমে তাঁরা চমোলি বা লালসাঙ্গা থেকে ‘পিপলকোঠি’ পৌঁছালেন। ৯৯৫মি. উচ্চতার চমোলি থেকে পিপলকোঠি ১৭কিমি দূরে আর ১২৬০মি. উচ্চতায়। জলধর বাবুর বর্ণিত শৃঙ্গগুলির পরিচয় আমার জানা নেই, কারণ গাড়ি করে যাবার সময় কোনও তুষার কিরীট আমার দেখা সম্ভব হয়নি। তবে অবস্থান থেকে ধারণা হয় নন্দাদেবী শ্রেণীর শৃঙ্গগুলি ওখান থেকে দৃষ্টিগোচর হওয়া অসম্ভব নয়।
এখানে পিপল চটির মাছির উপদ্রবের কথা মনে পড়ে যায় তাঁদের, তাই প্রথমে ইতস্তত করেন এখানে থাকার জন্যে। পরে অবশ্য সেই দুঃসহ অবস্থা সহ্য করতে হয়নি তাঁদের, মাছি বিশেষ ছিল না ওখানে। তবে রাত্রিবাস এখানে না করে আরও কিছুটা এগিয়ে অন্য এক চটিতে করেন।
পিপলকোঠিতে জলধর বাবুর এক অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যে দোকানে সাময়িক বিশ্রাম গ্রহন করেছিলেন, সেই দোকানির এক ছোট ছেলের তাঁকে প্রশ্ন (পৃ-৮৩),

“’বাপ্‌জী নে বোলা কি স্বামী লোগোকি সাথ্‌ নারায়ণজী বাত্‌চিত্‌ করতা হ্যায়, তুমহারা সাথ নারায়ণজীকো কেয়া বাৎ হুয়া?’ – প্রশ্ন শুনে আমার চক্ষু স্থির। ভেবেচিন্তে বল্লুম, ‘হামারা সাথ আবিতক নারায়ণকা মুলাকাত নেই হুয়া।‘ আমার কথা শুনে বালক কিছু বিরক্ত হ’য়ে ব’ল্লে, ‘আরে, তব কাহে ঘর ছোড়কে সাধু হুয়া’?”

শেষের প্রশ্ন বোধ হয় সাধুদের প্রতি সাধারণ মানুষের চিরন্তন প্রশ্ন। অবশ্য আমরা আজকাল আনাচে কানাচে অনেক গুরু দেখে থাকি তারা সব সময়ই কোনও একজন নিজেদের পছন্দ মত দেবতারই মর্তে প্রতিরুপ বলতে অভ্যস্ত, দেবতার সঙ্গে কথা বলা তো খুবই সাধারণ ব্যাপার। এই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে জলধরবাবুর চিন্তা অনুধাবন যোগ্য (প্রর-৮৩),

“ভগবানের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, কিন্তু ধার্মিক সাধু বটে অনেক। আমি ধার্মিক নই, সাধুও নই। কেবল সাধুর দলে পড়ে এই সব নিগ্রহ ভোগ করছি। আগে জ্ঞান ছিল, কেবল অসাধুর সঙ্গে বেড়ালেই কৈফিয়তের তলে পড়তে হয়, এখন দেখছি সাধুর সহচর হলেও সকল সময় কৈফিয়ত এড়ানো যায় না।”

পরের দু দিনে বরফের এবং অতিরিক্ত চড়াইএর কারণে অল্পই এগোতে পারলেন এবং শেষে মে ২৭, বুধবার দুপুরের পর ১৯৯০মি. উচ্চের যোশীমঠ বা জ্যোতির্মঠে এসে উপস্থিত হলেন। যোশীমঠে না এসে অনেক যাত্রীই নিচে অলকানন্দার পাড়ের কাছ দিয়ে পরবর্তী চটিতে চলে যান। এতে দূরত্ব যেমন কম হয়, বেশি উচ্চেও উঠতে হয় না। অবশ্য যোশীমঠ বা জ্যোতির্মঠ হিন্দুদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তাই জলধরবাবুরা এই পথেই যাওয়া মনস্থ করলেন।
অষ্টম শতাব্দীর শেষ ভাগে ও নবম শতাব্দীর প্রথম ভাগে আদি গুরু শঙ্করাচার্য্য বৈদিক তত্ত্বানুযায়ী তখনকার বৌদ্ধধর্মের প্লাবন ভেদ করে হিন্দু ধর্ম পুনরুত্থান করেন। তার পর এই কাজ চালু রাখার জন্যে ভারতের চার কোণে চারটি মঠ স্থাপন করেন। উত্তরে এই যোশীমঠেই একটি মঠ, জ্যোতির্মঠ প্রতিষ্ঠিত করেন।

 

জলধর বাবু এই মঠ প্রতিষ্ঠা, মঠের পরের ইতিহাস ও মঠের বর্ণনা এবং আদি গুরু এখানকার এক মন্দিরে নরবলি বন্ধ করে বিগ্রহ মন্দিরমধ্যে প্রোথিত করে দেন, সেই কাহিনি বিবৃত করেছেন। বিভিন্ন বর্ণনা, বিশেষ করে মন্দিরে বিগ্রহ প্রোথিত করার কথা কতটা ইতিহাস সিদ্ধ তা বলা যায় না তবে আলোচনা প্রসঙ্গে ভারতীয় ও ইউরোপীয় জীবনধারার মধ্যে শ্লেষাত্মক তুলনা মনে রাখার মত (পৃ-৮৯),

“আমি বল্লুম, হুঁ, ইউরোপীয়গণের এ একটি ভয়ানক ত্রুটি বলে অবশ্য স্বীকার করতে হবে; কারণ তাঁরা যে কয়টা বছর বাঁচেন, তাতে তাঁদের মহাপ্রাণী একটু সুখস্বাচ্ছন্দতা, একটু আরাম ও তৃপ্তি অনুভব করবার অবসর পায়। আর তাঁরা যে কিছু কাজ করেন, তাতেও তাঁদের নামগুলিকে কিছু দীর্ঘকাল ইহলোকে স্থায়ী করবার কিঞ্চিৎ বন্দোবস্ত করা হয়। কিন্তু আমাদের ঠিক উল্‌টো ব্যবস্থা; জীবনটি পরিপূ্র্ণমাত্রায় অপব্যয় করাই আমাদের বৈরাগ্যের প্রধান লক্ষণ।”

এই দিনই বিকেল বেলাতে যোশীমঠ থেকে নেমে গিয়ে বিষ্ণুপ্রয়াগ (১৩৩২মি.) পৌঁছালেন। সমানে উৎরাই পথ, তাই বেশ তাড়াতাড়িই এই প্রায় ৮মাইল পথ নেমে গেলেন। অবশ্য উৎরাই পথে নামা বেশ কষ্টকর, খুবই সাবধানে নামতে হয়। বয়স বেশি হলে হাঁটুতে চাপ সহ্য করা কষ্টকর হয়ে যায়, আমি রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিভিন্ন সময়ে বুঝেছি। জলধরবাবুর বয়স এই যাত্রার সময় বেশ কম ছিল তা সত্ত্বেও উনি বলছেন (পৃ-৯৪),

“যদি পাহাড়ের গায়ে গাছপালা না থাকতো, তা হ’লে শঙ্করের মন্দির থেকে গা ছেড়ে দিলে তৎক্ষণাৎ বিষ্ণুপ্রয়াগে এসে একেবারে অলকানন্দায় দাখিল হওয়া যেত! যোশীমঠ হ’তে উৎরাই-টুকু নামতে আমার একটু বেশী কষ্ট হ’য়েছিল; কারণ পাহাড়ের গা এমন সোজা , আস্তে আস্তে লাঠিতে ভর দিয়ে নবাবী চা’লে চলা যায় না, নামতে বেশ একটু বেগ পেতে হয়; কে যেন উপর হ’তে অর্ধচন্দ্র নামিয়ে দিচ্ছে!”

বিষ্ণুপ্রয়াগে এসে থাকার জায়গার অভাবে পড়লেন। যোশীমঠের নিচ দিয়ে যাঁরা আগে চলে এসেছিলেন, তাঁরা সকলেই এখানেই অবস্থান করছেন আগে থেকে। জলধর বাবুর সেই সকল যাত্রীদের উপর রাগ হ’ল। তাঁদের বিভিন্ন রকম শাস্তি দেবার কথা চিন্তা করে মানুষের এবং তার সঙ্গে নিজ চরিত্র বিশ্লেষণ করে এই রাগের কারণ খুঁজলেন (পৃ-৯৬),
“বাস্তবিক কত সময় আমরা পরের স্বার্থপরতা দেখে রাগ করি; কিন্তু আমাদের সে রাগও স্বার্থপরতাপূর্ণ।”
বিষ্ণুপ্রয়াগে অলকানন্দা আর বিষ্ণুগঙ্গা বা ধৌলিগঙ্গার মিলন হচ্ছে। এই সঙ্গমের বর্ণনা করতে গিয়ে অন্য এক বর্ণনা-শৈলী ব্যবহার করেছেন। উনি লিখেছেন যে সঙ্গমস্থলের মাথার উপর এক ছোট মন্দির। শুনেছিলেন যে রানি অহল্যাবাঈ মন্দির গঠন করে গেছেন। কিন্তু সেখানে তখনো বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নর্মদাতীর হতে শিবলিঙ্গ এনে সেই বছরেই প্রতিষ্ঠিত হবে। এই তথ্য দিয়ে আরম্ভ করে উনি লিখছেন (পৃ-৯৭),

“মন্দিরটি এমন স্থানে নির্মিত যে, এখানে মহাদেব প্রতিষ্ঠা না করে যদি একজন কবিকে প্রতিষ্ঠা করা যেত, তা হ’লে ঠিক কাজ করা হ’তো; বিষ্ণুগঙ্গা ও অলকানন্দা নীচে দিয়ে আনন্দোচ্ছ্বাসের বিপুল কল্লোলে পরস্পরকে আলিঙ্গন ক’রেছে; পাশে ঈষৎ বক্র সমুন্নত বিশাল পর্বত আকাশ ভেদ করে উঠেছে এবং তারই গায়ে এই ক্ষুদ্র মন্দির, প্রকৃতির স্বহস্তনির্মিত চিত্রবৎ!”

ঠিক এই জায়গার বর্ণনা বিখ্যাত পর্বতারোহী Franck S. Smythe,তাঁর বিখ্যাত বই, The Valley of Flowers-এ [৩] করেছেন। বইটি ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয়। Smythe অবশ্য ১৯৩১ ও পরে ১৯৩৭ সালে এই অঞ্চলে, প্রথমবার কামেত শৃঙ্গ জয় করে ফেরার কালে আর দ্বিতীয় বার কেবল মাত্র নিকটবর্তী ভুইন্দর উপত্যকার সুন্দরতা উপভোগ করার জন্যে আসেন। ওনার বক্তব্য হল, “From Joshimath a steep path, a preferable alternative to the long tedious zigzags of the pilgrim route, descends 1,500 feet to Visnu Prayag, the junction of the Alakanada and Dhauli Rivers. Perched on a spur between these rivers is a hamlet and a flight of stone steps descends to the Alakananda River, here known as Vishnu Ganga, …
Above Vishnu Prayag, the pilgrim path enters a gorge with sheer precipices on either side which echo the thunder of the Alakananda River as it rages furiously over its steep rock-strewn bed.”

এবার বর্তমানের কথা বলা যাক্‌। বিষ্ণুপ্রয়াগ এখন আর চটি নেই, বেশ বড় পাহাড়ি শহর। আর একটি কারণে এই প্রয়াগ উত্তরাখণ্ডের নাগরিক সভ্যতা উন্নতির কাজে এক বিশেষ জায়গায় পরিণত হয়েছে। এখানে ৪৪৪ মেগাওয়াট বিষ্ণুগড় জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প গঠিত হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই বাঁধ দেওয়া হয়েছে, এবং মানুষের দ্বারা নদীর জল বাঁধা থাকে, প্রয়োজনে তা ছাড়া হয়। ওনাদের দেখা লোহার সেতু এখন আর নেই, তার বদলে এখন বেশ চওড়া আর কংক্রিটের সেতু নির্মিত হয়েছে। আর গাড়িতে করে পাকা ও বেশ চওড়া রাস্তা দিয়ে হু হু করে পার হয়ে যায় যাত্রী এই জায়গায়। সেই অহল্যাবাঈ নির্মিত মন্দিরে কোনও কারণে শিবলিঙ্গ এখন নেই, তার বদলে বিষ্ণুর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত। নিচে সঙ্গম পর্যন্ত সিঁড়ি এখনও আছে।
পরের দিন আবার ৮ মাইল পথ পেরিয়ে পাণ্ডুকেশ্বর পৌঁছালেন। বিষ্ণুপ্রয়াগ থেকে পাণ্ডুকেশ্বরের রাস্তা যাত্রীর মানসিক ও শারিরীক সামর্থের কঠিন পরীক্ষা নেয়। চড়াই-উৎরাই যেমন আছে তার সঙ্গে আছে খানা-খন্দ। যদি তখন চন্দ্র-পৃষ্ঠের কথা জানা থাকতো তাহলে জলধরবাবু তার সঙ্গেই এই পথের তুলনা করতেন। এই খানা-খন্দের সঙ্গে আবার যদি বৃষ্টির জল সহযোগী হয়, তা হলে তো আর কথাই নেই। আমি গত কয়েক বছরের মধ্যেই দুবার আষাঢ় মাসে ওই পথে গিয়েছি, তাই এ কথা বলতে পারছি। আমিই এখন যা দেখেছি, জলধর বাবুদের সময় তা হলে কী অবস্থা হত তা সহজেই অনুমান করা যায়। অবশ্য ওনারা ওই পথে বৃষ্টি পাবার কথা বলেননি, যদিও বৈশাখ মাসে ওই অঞ্চলে প্রায়ই বৃষ্টি হয়ে থাকে।
আমি দুবার আষাঢ় মাসে বিষ্ণুপ্রয়াগ হয়ে গিয়েছি তার কারণ হল ‘ফুলের উপত্যকা’ বা ‘ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স’ ও গুরু গোবিন্দ সিং-র তপোস্থলী, অর্থাৎ ‘হেমকুণ্ড’ যাওয়া। পাঠকের নিশ্চয় মনে আছে যে এর আগে দুবার এই তপোস্থলীর উল্লেখ করেছি আর দুবারই ঠিক সময়ে এর সম্পর্কে বিস্তারিত বলব বলেছি। এই বার সেই ঠিক সময় এসেছে, অবশ্য বেশি সময় নেব না, কেননা তাহলে মূল বিষয় থেকে অনেকটা বিচ্যুত হয়ে যেতে হবে।
জলধরবাবু বিষ্ণুপ্রয়াগ থেকে পাণ্ডুকেশ্বর, এই প্রায় ৮ মাইল পথ মাত্র ৩ ঘন্টায় পার করে খুব আনন্দিত হলেন বিশেষ করে পাহাড়িরাই এই পথ পার করতে ৪/৫ ঘন্টা নিয়ে থাকেন বলে। কেবল মাত্র রাস্তার ভীষণ চড়াই-উৎরাইএর কথা বলা ছাড়া কোনও চটি ইত্যাদির অবস্থানের কথা বলেননি। ‘হিমালয়’ প্রকাশনার পর এই পথের বর্ণনা আর কোনও উল্লেখযোগ্য প্রকাশনায় পাওয়া যায়নি। অর্ধশতাব্দীরও পরে, শ্রাবণ-১৩৬৯ বঙ্গাব্দে উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত বই ‘হিমালয়ের পথে পথে’ [৪] প্রকাশিত হল। সেখানে উনি লিখছেন,

“ঘাট-চটী ও পাণ্ডুকেশ্বরের মাঝপথে-অর্থাৎ দুদিক থেকেই এক মাইল দূরে-পথের পাশে একটি ছোট ঘর। আজ কয় বছর আসা-যাওয়ার পথে উৎসুক নয়নে দেখতে দেখতে যাই। চোখে পড়ে, কেমন করে ছোট ঘর ধীরে ধীরে বড় হয়। একতলার উপর দোতলা ওঠে; মাথার ওপর গম্বুজও তৈরী হয়।”

এর পর আবার,

“ক্রমে ক্রমে যাত্রাপথের মুখে-এই ‘গোবিন্দ-ঘাট’ গড়ে উঠল। গুরুদ্বারা জাগল-নবীন তীর্থ-পথের তোরণ হয়ে সুন্দর একটি ধর্মশালাও তৈরী হল।”

দুঃখের কথা, উমাপ্রসাদবাবু কবে এই ভ্রমণ করেছিলেন, পরিষ্কার ভাবে কোথাও উল্লেখ করেননি।
জলধরবাবু সম্ভবত খুব তাড়াতাড়ি হাঁটবার কারণে ঘাট চটি লক্ষ করেননি। যাই হক অন্তত উমাপ্রসাদ বাবুর লেখা থেকে বোঝা যায় ‘গোবিন্দঘাট’ পত্তনের কথা।
উমাপ্রসাদ বাবু যে সময়ের কথে বলেছেন, তখন বাস রাস্তা এই নতুন গঠিত গোবিন্দঘাটের উপর দিয়েই ছিল। পরবর্তী সময়ে বাস রাস্তা গোবিন্দঘাট পৌঁছবার প্রায় ৫০০মি. আগেই ডান দিকে বাঁক না নিয়ে সোজা এগিয়ে গেছে। নতুন সংস্করণে উপযুক্ত জায়গায় পাদটীকায় এই কথা উনি উল্লেখ করেছেন।

এবার আবার পাণ্ডুকেশ্বরের কথায় ফিরে আসা যাক। জলধর বাবু এখানে অনেক আগে চলে আসার কারণে সময় কাটাতে মন্দির দেখতে লাগলেন। এই মন্দিরের বিগ্রহ ‘যোগ-ধ্যান-বদরী’ নামে বিখ্যাত, যদিও জলধর বাবু এই কথা লেখেননি। আর একটি বিষয়েও উনি কিছু বলেননি। শীত কালে বদরীনাথের পূজা এই মন্দির থেকে করা হয়ে থাকে। অবশ্য একই কথা যোশীমঠের ক্ষেত্রেও বলা হয়। আমার মনে হয় দুই জায়গা থেকেই এই পূজা করা হয়। যোশীমঠের সঙ্গে আদি গুরুর নাম জড়িত বলে এখানকার করা পূজার কথাই বেশি প্রচারিত। জলধর বাবু বলেছেন যে এখানেও নাকি শীতে মানুষ-জন থাকেন না। হতে পারে ওনার সময় তাই হতো, তবে এখন এখানে শীতে অনেকেই থাকেন।

এখানে জলধর বাবুর প্রচণ্ড শরীর খারাপ হলো। বেশ কিছু পরে সঙ্গীদ্বয় এসে পৌঁছলেন, তবে (পৃ-১০৭),

“তাঁরা দুইজনে পথশ্রমে মরার মত হয়ে এসেছিলেন; কিন্তু আমার অবস্থা দেখে তাঁরা নিজের কষ্ট ভুলে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপরেই স্বামীজি ব্যস্তসমস্ত হ’য়ে আমাকে কোলে তুলে বাতাস করতে লাগলেন এবং ব্যাকুলভাবে আমাকে কত স্নেহের ভৎসনা কল্লেন! অচ্যুত ভায়া আমার সর্বশরীরে হাত বুলোতে লাগলেন। আমার মাথাটা যাতে একটু ভাল থাকে, এজন্য সহস্র চেষ্টা হ’তে লাগলো। ...”

এই উদ্ধৃতি ব্যবহারের দুটো কারণ আছে। প্রথম, এই রকম যাত্রাকালে একের বিপদ দলের অন্যজনেরও বিপদ বিবেচনা করতে হয় এবং পরস্পরকে যথাসাধ্য সাহায্য করা অবশ্য কর্তব্য, এই কথা মনে করিয়ে দেওয়া। দ্বিতীয় কারণ হল, জলধরবাবুর এই অবস্থা কেন হল সেই কারণ খোঁজা। আমার মনে হয়, অধিক উচ্চতার কারণে বাতাসে অক্সিজেনের অভাব কাজেই শ্বাস-কষ্ট, সঙ্গে মাথা-ধরা ও বমি। তবে আশ্চর্যের কথা পাণ্ডুকেশ্বরের উচ্চতা মাত্র ১৯২০মি., তা ছাড়া আগে, যোশীমঠে ১৯৯০মি. উচ্চতা অতিক্রম করেছেন এবং হেঁটে আসার করণে তাঁদের এই উচ্চতায় থাকা সহ্য (acclimation) হয়ে যাবার কথা। অবশ্য এই রকম হবার আর একটি কারণ জলধরবাবুর ক্ষেত্রে হয়েছে কিন্তু স্বামীজি ও অচ্যুতবাবুর হয়নি, কেননা তাঁরা খুবই ধীরে ধীরে এই পথ অতিক্রম করেছেন কিন্তু জলধরবাবু ভীষণ তাড়াতাড়ি করেছেন কাজেই তাঁর অত্যন্ত পরিশ্রম হয়েছে। অত্যধিক পরিশ্রম এই অবস্থাকে স্বাগত করে। আর একটি কারণে তাঁর এই অবস্থা হয়ে থাকতে পারে। জলধর বাবুর সম্ভবত migraine রোগ ছিল অথবা সেই দিনই দেখা দিল। এই রোগের symptom-এর সঙ্গে ওনার কষ্টের symptom মিলে যায়।
যাই হোক, অনেকের চেষ্টায় জলধরবাবু পরের দিন সকালেই সুস্থ হয়ে উঠলেন ও পরবর্তী গন্তব্যের দিকে এগোতে আরম্ভ করলেন।
বাঙালিদের সঙ্গে জলধর বাবু অন্যান্য রাজ্যের অধিবাসী, বিশেষ করে যাত্রীদের সঙ্গে স্বভাব-চরিত্রের তুলনা করেছিলেন, এই রচনার প্রায় প্রথম দিকে আলোচনা করেছি। পাণ্ডুকেশ্বর থেকে এগোবার কালে আর একবার সেই সম্পর্কে বলেছেন বেশ বিস্তৃতভাবে। পড়লেই বোঝা যায় স্থানীয় অধিবাসীদের তিনি কতটা ঊর্ধ্বাসনে স্থান দিয়েছেন। আমিও একটু বড় উদ্ধৃতিই করছি (পৃ-১১৪-১৫),

“যাত্রীর দল দেখে বালিকা, যুবতী এমন ক নিতান্ত শিশুর দলও ‘জয় বদরিবিশাল কি জয়!’ ব’লে আনন্দধ্বনি ক’রছে, এবং যাত্রীদের কাছে এসে কেহ বা একটা পয়সা, কেহ বা কিছু সূচ সূতা চাচ্ছে। দেখলুম এরা অনেকেই সূচ সূতার প্রার্থী। বোধ হয় এই দুইটি জিনিসের এরা বেশি ভক্ত। সকল বালক বালিকাই হৃষ্ট পুষ্ট ও বলিষ্ট; যুবতীগনের দেহ সবল ও দীর্ঘ। প্রকৃতি যেন নিজ হস্তে অতি সহজ ভাবে সমস্ত অঙ্গের পূর্ণতা সম্পাদন ক’রেছেন। বিশেষ তাদের মধ্যে একটা জীবন্ত ভাব দেখলুম, যা আমাদের ম্যালেরিয়াগ্রস্ত বঙ্গদেশের প্লীহাযকৃত-প্রপীড়িত অন্তঃপুরে কখনই দৃষ্টিগোচর হয় না! বোধ হ’ল এদেশে কোন রকম পীড়ার প্রবেশাধিকার নেই। এমন যে মলিন বস্ত্র ও ছিন্ন কম্বল পরিহিত ছেলে মেয়ের দল, তবু তাদের গোলাপী আভাযুক্ত সুন্দর মুখ দেখলে কোলে তুলে নিতে ইচ্ছে হয়। কতবার সতৃষ্ণ-নয়নে তাদের মুখের দিকে চেয়ে দেখলুম। এখানে আর একটু তফাৎ দেখলুম; দেশে থাকতে যখন আমরা রেলের গাড়িতে কি নৌকাযোগে কোথাও যেতুম, প্রায়ই দেখা যেত, পথের দু’পাশে রাখাল বালকেরা পাঁচনবাড়ী তুলে আমাদের শাসাচ্ছে, কখন বা ছোট মুষ্ঠি তুলে, কখন কখন বিকট মুখভঙ্গি ক’রে আমাদের ভয় দেখাচ্ছে, কিন্তু এ দেশে চাষার ছেলের সে রকম কোন উপসর্গ দেখা গেল না; ছেলেমেয়েগুলি সকলেই কেমন ধীর শান্ত। কেহই কালীঘাটের কাঙ্গালীর মত কাহাকেও জড়িয়ে ধরে না, কিম্বা গাড়ীর সঙ্গে সঙ্গে চৌরঙ্গীর মোড় পর্যন্ত ছুটে আসে না! কেহ একটি পয়সা চাহিতে সঙ্কোচবোধ করে; হয় ত মুখের দিকে একটি বার চেয়ে ঘাড় নীচু ক’রলে। যদি তার মনের ভাব বুঝে তার হাতে একটি পয়সা দেও ত উত্তম, না দেও দাঁড়িয়ে থেকে চলে যাবে। আমাদের বঙ্গভূমি ভিক্ষুকের আর্তনাদে ও কাতর প্রার্থনায় পরিপূর্ণ; তাতে দাতাদিগের কর্ণও বধির ক’রে ফেলে, সুতরাং আমাদের বঙ্গীয় দানশীলগন যদি এদেশে আসেন, ত এই সব বুভুক্ষ বালক-বালিকাদের নীরব প্রার্থনা প্রতিপদেই অনাদৃত হয়! কিন্তু যে সকল সাধু-সন্ন্যাসী এ পথে পদার্পণ করেন, তাঁদের মধ্যে বাঙ্গালীর সংখ্যা নিতান্ত কম, এবং তাঁরা গরীবের কাতর প্রার্থনা সূনবার আগেই যথাসাধ্য দান করেন। ... যে নিতান্ত ভিখারী, যার পয়সার অত্যন্ত প্রয়োজন, সেও একবারের বেশী দু’বার চায় না। তবু আমার দেশে দুষ্টুমি-জ্ঞাপক বিশেষণ যোগ ক’রতে হ’লেই লোকে বলে ‘পাহাড়ে মেয়ে’ ‘পাহাড়ে শয়তান’ ইত্যাদি। এই পাহাড়ের বুকের মধ্যে এসে, পাহাড়ের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে আলাপ ক’রে পাহাড়ীর প্রতি এ রকম কোপকটাক্ষ অকারন ব’লে মনে হ’লো। ”

যাত্রীদের কাছে সূচ সূতা (‘সুই-ধাগা’) চাওয়া বেশ কিছু বছর আগেও হত, আজকাল আর তা শোনা যায় না। ভিক্ষা চাওয়া মোটামুটি এখনও একইরকম আছে তবে সমতলের শহরগুলির তুলনায় নিশ্চয় কম। যাত্রীর সংখ্যা এখন এত বৃদ্ধি পেয়েছে, ‘জয় বদরীবিশাল’ জয়ধ্বনি তেমন আর শুনতে পাওয়া যায় না। দুষ্টু বা ‘দজ্জাল’ মেয়েকে ‘পাহাড়ে মেয়ে’ কখনও বলা হত কি না, জানি না, তবে ‘গেছো মেয়ে’ বলা হত শুনেছি। তবে শহরে তো নয়ই, গ্রামেও এখন মেয়েদের কেউ তা বলে না।
প্রকৃতি বর্ণনা মনুষ্যচরিত্রের বর্ণনার সঙ্গে সমানে চলেছে। পাণ্ডুকেশ্বরের পরের চটি ‘হনুমান চটির’ কাছে দেখলেন (পৃ-১১৫),

“চারিদিকে সাদা চিহ্ন ছাড়া আর কিছু দেখবার নেই; কে যেন সমস্ত প্রকৃতিকে দুগ্ধফেননিভ বস্ত্রখণ্ডে মুড়ে রেখেছে! পায়ের নিচে পুরু বরফ তেমন কঠিন নয়; তার মধ্যে কদাচিৎ দু’টো একটা জায়গায় বরফ গলাতে পাথরের কৃষ্ণ বর্ণ বেরিয়ে পড়েছে। সেইগুলি লক্ষ্য ক’রে পথ চলতে লাগলুম।”

কিছুটা পরেই লিখছেন(পৃ-১১৭),

“একটু অগ্রসর হ’য়েই সম্মুখে একটা প্রশস্ত দূরারোহ পাহাড় দেখলুম। আগাগোড়া কঠিন বরফরাশিতে আবৃত; যেন বিভুতিভুষিত যোগিশ্রেষ্ঠ; সরল, উন্নত, শুভ্রদেহ, ধৈর্য ও গাম্ভীর্যের যেন অখণ্ড আদর্শ। মস্তক আকাশ স্পর্শ ক’রছে, মধ্যাহ্নসূর্যের কিরণ তাতে প্রতিফলিত হ’য়ে কিরীটের ন্যায় শোভা পাচ্ছে। নিম্নে স্তূপে স্তূপে বরফ সঞ্চিত হ’য়ে পাদদেশ আবৃত ক’রেছে। আমরা যেন বিস্ময় ও ভক্তির পুষ্পাঞ্জলি দেবার জন্যই তাঁর পদতলে এসে দাঁড়ালুম।”

পরের পাতা

শুভেন্দু প্রকাশ চক্রবর্তী

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।