উক্ত পাহাড়ের মাথায়
উঠে সামনের দিকে দেখলেন (পৃ-১১৮),
“এখানে এসে চেয়ে দেখলুম অপর পাশে খানিকটা নীচে কিছুদুর বিস্তৃত
একটা সমতল ক্ষেত্র। দুই পাশে দু’টি অভ্রভেদী পাহাড় ধনুকের
মত সেই সমতলভূমিকে কোলে নিয়ে রয়েছে। অলকানন্দা দূরে দূরে
আকাবাঁকা দেহে অতি ধীরগতিতে চ’লে যাচ্ছে; কোথাও সামান্য
স্রোত দেখা যাচ্ছে; অনেক স্থানেই জল দেখবার যো নেই। পাতলা
বরফগুলি ধীরে ধীরে ভেসে যাচ্ছে, তাই দেখে স্রোতের অস্তিত্ব
অনুভব করা যায়। কোথাও বা স্রোতের সম্পর্ক মাত্র নেই, আগাগোড়া
জমে গিয়েছে, কেবল নদীগর্ভের নিম্নতায় নদীর অস্তিত্ব কল্পনা
করা যাচ্ছে। সেই দুগ্ধফেননিভ বহুদূরবিস্ত্রিত তুষাররাশির
উপর অস্তোন্মুখ তপনের লাল রশ্মি প্রতিফলিত হ’য়ে এমন বিচিত্র
শোভা হ’য়েছিল যে, বোধ হ’লো সে যেন পৃথিবীর শোভা নয়, সে দৃশ্য
অলৌকিক! আমি মনে মনে কল্পনা কল্লুম, শান্তিহারা অধীর হৃদয়ে
ঘুরতে ঘুরতে আজ বুঝি বিধাতার আশীর্বাদে দুঃখকোলাহলময় পৃথিবীর
অনেক ঊর্ধ্বে বরণীয় স্বর্গরাজ্যের দ্বারে উপনীত হয়েছি। ঐ
তুষারমণ্ডিত সন্ধ্যারাগরঞ্জিত অলকানন্দার শোভাময় উপকূল,
আমার কাছে সুরনদী মন্দাকিনীর প্রবালে বাঁধানো সুরম্য তীর
বলে বোধ হ’য়েছিল।”
এই বর্ণনা পড়ে আমার মনে হয়েছে বর্তমানে যেখানে বদরীনাথের
বাস টার্মিনাস হয়েছে, সামনে সেই জায়গাটিই তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন।
সত্যই পাহাড়ের মাঝে
অমন বড় সমতল জায়গা সাধারণত দেখা যায়না। আমি প্রথম বার যখন
দেখেছিলাম, বাস টার্মিনাস থাকা সত্ত্বেও (সামনের দিকে তখন
জিএমভিএনের যাত্রীনিবাস তৈরি হয়নি) আমারও কেমন যেন আশ্চর্যের
কথা বলে মনে হয়েছিল। এখন অবশ্য অলকানন্দার গতিপথ এখান থেকে
দেখা যায় না, কারণ নদী আর টার্মিনাসের মাঝে অনেক আশ্রম,
হোটেল ইত্যাদি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তবে আমার মনে
হয়েছে, ‘দুই পাশে দু’টি অভ্রভেদী পাহাড় ধনুকের মত সেই সমতলভূমিকে
কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে’- এই বাক্যটি একটু অতিরঞ্জিত। কারণ
ডান দিকে নর পর্বতের উচ্চতা ৫৮৩১মি. ও বাম দিকে অলকানন্দার
বিপরীত পারে নারায়ণের, ৫৯৬৫মি. আর বদরীনাথধাম, শীর্ষ দুটির
অর্ধেকের বেশি উচ্চতার, ৩১৫৪মি.। পাহাড় দুটি নিশ্চয় ছোট
নয় তবে অন্তত জলধরবাবু, যিনি অনেক নিচে থেকে উঁচু পাহাড়
দেখেছেন, তাঁর এই পাহাড়গুলোকে ‘অভ্রভেদী’ বলা কেমন যান শুনতে
লাগে। ধনুকের মত ঘিরে ধরে থাকার কথাটা অবশ্য যথার্থ।
পাণ্ডারা দলের বাকি দুজনকে বাদ দিয়ে জলধর বাবুকেই তাদের
লক্ষ্য হিসাবে ধরে নিয়ে খুবই উত্ত্যক্ত করতে থাকে এবং রকমারি
এবং হাস্যাসকর গল্প শোনাতে থাকে। ওনার মনে হল মন্দিরের সামনে
এখনও আসেননি, তাতেই এই অবস্থা, মন্দিরে না জানি কি অবস্থা
হবে। যাই হোক, এক পাণ্ডার নাম তিনি পথে জানতে পেরেছিলেন,
তার নাম করতে কোনও রকমে তাদের কাছ থেকে উদ্ধার পান। পাঠক
নিশ্চয় জানেন যে কোনও একজন পাণ্ডার যজমান হলে অন্য পাণ্ডা
নিজে থেকে তাকে ‘অধিকার’ করার চেষ্টা করে না। আজকাল অবশ্য
পাণ্ডাদের অত্যাচার এখানে একেবারেই নেই।
শেষ পর্যন্ত তাঁরা মন্দিরের কাছে এসে কোনও রকম মাথা গোঁজবার
এক স্থান পেলেন। সেদিন আর মন্দিরে প্রবেশ করতে পারলেন না,
কারণ বিকালেই মন্দির-দ্বার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
যদিও দুইএর মধ্যে আপাত দৃষ্টিতে কোনও মিল নেই, তাহলেও পর্বত
আর সমুদ্রের দৃশ্যের মধ্যে তুলনা করতে ইচ্ছা হয়, এই বলে
উনি এর পর লিখছেন (পৃ-১২৬),
“একে ত হিমালয় প্রদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য ভারী গম্ভীর; এ
গাম্ভীর্যের সহিত স্বতঃই সাগরের গাম্ভীর্য তুলনা ক’রতে ইচ্ছা
হয়। কিন্তু এই দুই জিনিসের মধ্যে আশ্চর্য রকমের তফাৎ। একটি
মহা উচ্চ, অসমান, সুদীর্ঘ শ্যামল বৃক্ষশ্রেণীর চিরন্তন বাসভূমি-আর
একটি সুগভীর নীলিমায় সমাচ্ছন্ন, তবু এ দুইয়ের মধ্যে কেন
যে তুলনার কথা মনে আসে, তাহা ঠিক বলা যায় না; বোধ করি, এ
উভয়কে দেখে আর একজনকে মনে পড়ে; এই মহান সৌন্দর্যের মধ্যে
বিশ্ব-পিতার মহিমা ব্যপ্ত আছে, তাই একটি দেখে আর একটির কথে
মনে উদয় হয়।”
এর পর বদরীনাথ মন্দিরের কথা, যেমন, এর ইতিহাস, গঠণ শৈলী,
ইত্যাদির বর্ণনা করেছেন। তিনি ঠিকই লক্ষ্য করেছেন যে (পৃ-১২৯),
“মন্দিরটি জীর্ণ হ’য়েছে; কিন্তু আগে ব’লেছি বাহ্যদৃশ্যে
তেমন জীর্ণ বলে বোধ হয় না। সকলের বিশ্বাস এ মন্দির শঙ্করাচার্যের
প্রতিষ্ঠিত। এ কথা অবিশ্বাস করবার কোন কারণ নেই; ইহা বহু
প্রাচীন জনপ্রবাদ, এবং তার কতক প্রমানও নেই, এমন নয়; কিন্তু
মন্দিরটি দেখলে কেহই বিশ্বাস ক’রবেন না যে, এটি শঙ্করাচার্যের
প্রতিষ্টিত-এমন আধুনিকের মত দেখায়!”
ওনার এই শেষের বক্তব্যটির উপর নির্ভর করে মনে হয়, এই মন্দিরের
গঠণ-শৈলীর কথা বুঝিবা বলছেন। কিন্তু পরের বর্ণনা থেকে বুঝা
যায় যে উনি মন্দিরগাত্র পরিষ্কার, এই কথা বলতে চেয়েছেন।
ইতিহাস বলে যে মন্দির গাড়োয়ালের রাজা দ্বারা সম্ভবত ষোড়শ
শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে আবার আর এক
গাড়োয়াল রাজার দ্বারা মন্দির পরিবর্ধিত হয়। অনেক বারই এর
জীর্ণোদ্ধার করা হয়েছে। ১৮০৩ সালে প্রচণ্ড ভূমিকম্পের পর
মন্দির প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংশপ্রাপ্ত হবার পর জয়পুরের মহারাজা
দ্বারা মন্দিরপুনর্ণির্মিত হয়।
জলধর বাবু লিখেছেন যে বদরীনারায়ণ বা বিষ্ণুর মূর্তি তৈরি
হয়েছে নাকি ‘পরশ-পাথরে!’ অবশ্য পরশ-পাথর বলে যে কোনও বস্তু
নেই জগতে, তা তিনি জানেন। তাই এই কথার মানে কি তাও তিনি
বলেছেন। অনেকে বলেন যে এই মূর্তি শালগ্রাম শিলায় তৈরি, তাও
সম্ভবত সত্য নয়। কারণ শালগ্রাম শিলা আসলে এক প্রকার কীটের
জীবাস্ম বা ফসিল। সাধারণত এই ফসিল দৈর্ঘ্যে ১৫সেমির বেশি
পাওয়া যায় না। দৈর্ঘ্যে এক মিটার আর প্রস্থেও তার কাছাকাছি,
বসা অবস্থার এক মূর্তি গড়তে নিশ্চয় তার থেকে বড় শিলার প্রয়োজন
হবে। কে জানে পূরাকালে তেমন বিরাট শালগ্রাম শিলা হয়ত পাওয়া
যেত। মূর্তির চোখ, নাক ও মুখ, অর্থাৎ মুখমণ্ডল পরিষ্কার
নয়। জানিনা হয়ত কালের প্রকোপে বা বহুদিন অলকানন্দায় নারদ
কুণ্ডে পড়ে থাকার কারণে এইগুলি ক্ষয় প্রাপ্ত হয়েছে। প্রত্যেক
দিন শৃঙ্গারের সময় প্রধানপুরোহিত বা রাওল চন্দন দিয়ে অঙ্গগুলি
এঁকে দেন। আমার মনে হয় কষ্টিপাথরে এই বিগ্রহ তৈরি করা হয়েছে।
অবশেষে ৩০ মে, ১৮৯০, সেই বহু কাঙ্খিত দিন এলো। ভোর বেলায়
মন্দির দ্বারে উপস্থিত হয়ে শুনলেন যে সকাল ৮-টার আগে দ্বার
খোলা হবে না। এখন ভোর ৪-টায় আরতি ও দর্শন হয়। তারপর বন্ধ
হয়ে ৮-টায় আবার দ্বার খোলা হয়। আমার মনে হয়, জলধরবাবু ভোর
৪-টায় মন্দির খুলে আবার বন্ধ হয়ে যাবার পর মন্দিরে গিয়েছিলেন।
উনি দেখলেন যে মন্দির দ্বারের কাছে ছোট এক সাময়িক পোস্ট
অফিস হয়েছে। ওইখানে বসে কয়েকটি পোস্টকার্ড কিনে দেশে তাঁর
কুশল-সংবাদ পাঠালেন। ভাবলেন যে পাঁচ সাত দিনের মধ্যেই বাংলার
এক ক্ষুদ্র গ্রামে সেই কার্ড পৌঁছে যাবে। অবশ্য পাঁচ-সাত
দিনে নিশ্চয় পৌছাতে পারত না, কারণ ডাক হরকরা তো পায়ে হেঁটেই
নিচে নামতেন। এখন কেউ ভাবতে পারেন কী, যে পোস্টকার্ড পাঁচ
সাত দিনে এত দূরে পৌঁছে যাবে? পৌঁছবেই কি না সন্দেহ হয়।
তবে এখন বদরীনাথ অন্তত গ্রীষ্মে এক বিরাট আধুনিক শহরে পরিণত
হয়, তাই সেল ফোনেই এই কাজটা হয়ে যায়। এখন এখানে কয়েকটি ব্যাঙ্কের
ATM সহ শাখা, বিভিন্ন Cell Phone facility provider-এর Tower,
এবং বড় বড় হোটেল ও বিভিন্ন সামগ্রীর বিরাট বিরাট দোকান খোলা
হয় অক্ষয় তৃতীয়া থেকে কালীপূজার কিছু দিন পর পর্যন্ত।
শেষ পর্যন্ত মন্দিরে তিনজনেই প্রবেশ করলেন সকাল ৮-টার পর
(পৃ-১৩৪),
“চতুর্ভুজ নারায়ণমূর্তি দৃষ্টিগোচর হ’লো। মূর্তি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ
পাথরের প্রস্তুত; বিগ্রহের গায়ে বহুমূল্য অলঙ্কার। অলঙ্কার
নারায়ণের আপাদমস্তক ঢেকে ফেলেছে। সেই মনিমুক্তাহীরকাদিজড়িত
হেমাভরণের মধ্য হ’তে একটা উজ্ঞ্বল স্নিগ্ধ শ্যামকান্তি বিকশিত
হ’চ্ছিল, তা দেখলে মনে বাস্তবিকই বড় আনন্দের সঞ্চার হয়।”
আমিও এই ‘মনিমুক্তাহীরকাদিজড়িত’ মূর্তি দেখেছি। তবে মূর্তির
কপালে হিরে এত জ্বল জ্বল করে যে শরীরের বাকি অংশ দেখতে অসুবিধা
হয়, যদিও শরীরের প্রায় সমস্তটাই কাপড়ে ঢাকা থাকে। ভোর ৪-টার
পরে যখন বদরীনারায়ণের শৃঙ্গার হয়, তখন দেখলে ঠাকুরের শরীরের
সমস্ত অংশই দেখা যায়। আমার এতবারের দর্শনের মধ্যে ওই সময়ে
একবারও যাইনি, তবে আমার স্ত্রী অনেক বারই দেখেছেন, তাঁর
কাছে এই বর্ণনা শুনেছি।
গর্ভগৃহে ভক্তের অনেক রকম ব্যবহার দেখা যায়। জলধর বাবুর
দেখা এক বৃদ্ধার ও তাঁর পুত্রের কথা শুনলে সত্যই মন আনন্দে
ভরে ওঠে। উমাপ্রসাদ বাবুও আর এক বৃদ্ধার কাহিনি লিখেছেন।
সেই কাহিনিও মনে বেশ দাগ কাটে। জলধরবাবু, নারায়ন দর্শনের
পর সেই বৃদ্ধার বক্তব্য তুলে ধরেছেন অল্প কয়েকটি কথার পর
(পৃ-১৩৫),
“বৃদ্ধা অনেকক্ষণ নারায়ণ দর্শন ক’রে শেষে ভক্তিভরে প্রণাম
ক’রলে। তারপর পুত্রটির দিকে চেয়ে ব’ললে , “বেটা, জনম সফল
কর্লিয়া।” সেই কথা কয়টির মধ্যে যে কত আনন্দ, তা বর্ণনাতীত।
ছেলেটি মার কথায় ভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে বতজানু হ’য়ে মায়ের পদধূলি
গ্রহণ ক’ল্লে, মাও আস্তে আস্তে জীবনের অবলম্বন ছেলেটিকে
বুকের মধ্যে টেনে নিলে। সে দৃশ্য স্বর্গীয়; আমাদের সকলের
চোখে জল পড়তে লাগলো।”
মন্দিরের প্রধান পুরোহিত, যাঁকে এখানে ‘রাওয়ল’ বলা হয়, শঙ্করাচার্য
সেই অষ্টম শতাব্দীতেই নির্ধারিত করে গিয়েছিলেন যে কেরলের
নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণ গোষ্ঠি থেকে হবেন। সেই ধারা অবলম্বনে
এখন ৪৭তম রাওয়ল অধিষ্ঠিত। জলধর বাবু তখন কততম রাওয়লের সঙ্গে
দেখা করেছিলেন লেখেননি। অবশ্য উনি রাওয়ল না বলে মোহান্ত
বলেছেন। ওনার কথামত মোহান্ত মহাশয়কে শিক্ষিত বলে ধারণা করা
যায় না তা ছাড়া তিনি মোসাহেব পরিবৃত হয়ে রয়েছেন দেখেছিলেন।
৪৬তম রাওয়ল, শ্রীবদরীপ্রসাদ নাম্বুদ্রির সঙ্গে আমার আলাপ
ও মন্দির সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনে হয়েছিল, যা আমি ভিডিও
রেকর্ড করেছিলাম। উনি বেশ উচ্চশিক্ষিত, বহুভাষা জানা এক
আধুনিক ও পরিশীলিত মনের মানুষ বলে মনে হয়েছিল। তাঁর বয়স
চল্লিশের নিচেই বলে আমার মনে হয়েছিল, তা সত্ত্বেও তাঁর ব্যক্তিত্ত্ব
আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তাঁকে দক্ষিণ ভারতীয় হওয়া
সত্ত্বেও তাঁর উত্তর ভারতীয় নাম বদরীপ্রসাদ হবার কারণ জিজ্ঞাসা
করেছিলাম। উত্তর বেশ চিত্তাকর্ষক; তাঁর মাতা বদরীনাথ দর্শনে
এসে পুত্রের জন্যে প্রার্থনা করেছিলেন আর ইচ্ছা করেছিলেন
যে সেই পুত্র যেন রাওয়ল হয়। এই সুযোগে রাওয়াল পদে অধিষ্ঠানের
জন্যে কি কি গুণাবলির প্রয়োজন ও selection পদ্ধতির কথা জানতে
প্রশ্ন করায় তার উত্তর পাই। তাতেই বুঝতে পারি নাম্বুদ্রি
গোষ্ঠিভুক্তি হওয়া ছাড়াও অনেক বিষয়ে জ্ঞান আবশ্যক ও রীতিমত
কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। জানি না আগে এই রকম পরীক্ষার
ব্যবস্থা ছিল কি না। এখন এই পদ পাওয়া সহজ নয়।
এই বিষয়ে এত বেশি
বলার কারণ যে তখন নিশ্চয় এই পদ সহজলভ্য ছিল বলেই জলধর বাবু
ওইধরণের পুজারি দেখতে পেয়েছিলেন। জলধরবাবুর সময় রাওয়ল টেহরীর
রাজার কর্মচারী হিসাবে গণ্য করা হত, এখন রাওয়ল সরকারী ব্যবস্থাপনায়
‘বদরী-কেদার মন্দির কমিটির’ কর্মচারী।
পরের দিন, মে ৩০ তাঁরা ব্যাস গুহা দেখলেন। গুহা খুঁজতে বেশ
বেগ পেতে হয়েছিল। পথে যে দুএকজনের সঙ্গে দেখ হয়েছিল, তাঁরা
এই গুহার নামও কখনো শোনেননি। (পৃ-১৪৩),
“অনেক অনুসন্ধানের পর একটা উঁচু জায়গা দেখা গেল; পাহাড়ের
অনেকখানি ঘুরে বহূ কষ্টে সেই উঁচূ জায়গাটাতে উঠলুম। স্বামীজি
শুনেছিলেন, বরফাচ্ছন্ন পর্বতের মধ্যে ব্যাসগুহার সম্মুখে
কিছুমাত্র বরফ নেই, সে জায়গাটা শৈবালদলে সমাচ্ছন্ন। এই স্থানে
উপনীত হবামাত্র সেই দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ে গেল, সুতরাং আমরা
সকজেই বুঝতে পাল্লুম, এজায়গাটাই ব্যাসগুহার সম্মুখভাগ।”
বলা হয় ব্যাস দেব এই গুহায় বসে মহাভারত রচনা করেছিলেন। ওনারা
অবশ্য কাছেই স্থিত গনেশগুহার কথা লেখেননি। বলা হয় যে ব্যাসদেবের
stenographer ছিলেন গনেশ, এবং শ্রুতলিখনের কাজটা এই গনেশগুহায়
বসেই করেছিলেন। কে জানে কেন আমি যখন প্রথম বার গুহা দুটো
দেখেছিলাম, মনে হয়েছিল ব্যাসদেবের dictation, গণেশ কেমন
করে অতটা দূর থেকে শুনতে পাচ্ছিলেন! যাই হোক এখন ওই গুহার
কাছে কোনও শৈবালদলের চিহ্ন মাত্র নেই। আর বদরীনাথ থেকে মানা
পর্যন্ত সুন্দর সিমেন্টে গাঁথা পাথরের রাস্তা। সেই রাস্তা
থেকে কিছুটা সরু অথচ একই রকম রাস্তা গুহা পর্যন্ত এসেছে,
পথে নির্দেশও দেওয়া আছে। আর ওখানকার প্রত্যেকেই নির্দেশ
দিতে পারেন।
ফিরে চলাঃ
জুন ১, ১৮৯০ ভোর বেলায়
ফেরার পথ ধরলেন। জুন ৮-এ শ্রীনগরের কাছে পৌঁছবার পর থেকে
জলধরবাবু আর ডায়েরি রাখেননি। তবে এই কদিনও যা রেখেছেন সেগুলোকে
কিছু ঘটনার বিবৃতি ছাড়া প্রকৃতি, এমন কি মনুষ্য-প্রকৃতির
বিশ্লেষণও বলা যায় না। উনি জুন ৬-এ লিখছেন (পৃ-১৯২),
“আজ দুই প্রহরে যে চটিতে আশ্রয় নিয়েছিলুম তার নামটা আমার
খাতায় লেখা নেই, সে জায়গাটা ফাঁক রয়েছে; বোধ হয় সেই দুই
প্রহরে কোন নতুন চটিতে ছিলাম, তার নামটা শুনে নিতে মনে ছিল
না, বিশেষত এই প্রত্যাবর্ত্তনের সময় ডাইরীতে তেমন নিয়মমত
লেখাই হ’তো না; তার কারন হচ্ছে এই যে, নারায়ণে যাবার সময়
যেমন একটা স্ফূর্তি নিয়ে বেরিয়েছিলুম আসবার সময় তার সম্পূর্ণ
অভাব। এখন কলের পুতুলের মত যাচ্ছি।”
আগেই যেমন বলেছি, কিছু ঘটনার বিবৃতি নিশ্চয় আছে, কিন্তু
সে ঘটনাগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি, বিশেষ করে বাঙালিদের পক্ষে
মোটেই আনন্দ দায়ক নয়। সেই কারণে এই পর্বের শেষ এখানেই করলাম।
উপসংহার
স্কুলের পাঠ থেকেই জেনে এসেছি যে রচনার একটি উপসংহার থাকে।
সেই পাঠের সম্মানার্থে আমার বক্তব্য উপস্থিত করছি। আসলে
আমি উপসংহার লেখা রচনার প্রায় আরম্ভেই করে দিয়েছি, যখন আমি
‘গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজার’ কথা বলেছি। কাজেই অন্যরকম ভাবে
একই কথা আবার বলতে হবে। ‘হিমালয়’ নিশ্চিত ভাবেই এক পূর্নাঙ্গ
ভ্রমন কাহিনি। এতে আছে পথের বর্ণনা, আশপাশের প্রকৃতি বর্ণনা,
প্রধান প্রধান জায়গার কিছু ইতিহাস, কিছু পৌরাণিক কাহিনি,
আর সবথেকে বেশি, মানূষে মানুষে যোগাযোগের বর্ণনা। এর থেকে
আমরা বেশি কী আশা করতে পারি? আশা করি, আমি আমার এই সুদীর্ঘ
ও উদ্ধৃতিবহুল রচনায়, যে লক্ষ্যের কথা প্রথমেই বলেছিলাম
তা, প্রমাণ করতে পেরেছি।
তা হলে কি কিছুই deficiency বা অভাব (অসম্পূর্ণতা) নেই এই
কাহিনির? হ্যাঁ, তা অবশ্যই আছে। এতে ভৌগোলিক তথ্য বিশেষ
নেই। যখন ‘অভ্রভেদী পাহাড়’ বা ‘তুষার কিরীটের’ কথা বলেছেন,
একটারও নাম উনি জানাননি। পর্বত শীর্ষগুলির নাম এবং অবস্থান
অবশ্য মুখস্ত রাখা সাধারণ কথা নয়, এগুলো স্থানীয় মানুষদের
কাছ থেকেও পাওয়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যায় না, এখনকার দিনেও।
তাই পরেই এগুলো কাহিনিতে যোগ করতে হয়। যেহেতু জলধরবাবু তাঁর
লেখার নিজে অন্তিম রূপ দেননি, দীনেন্দ্রবাবু সেই নামগুলি
যোগ করতে পারেননি, এটা ভাবা যেতেই পারে। তবে পরে যখন ‘হিমালয়’
বই আকারে প্রকাশ পায়, নামগুলি যোগ করার সুযোগ ছিল। প্রধান-প্রধান
স্থানের উচ্চতার কথাও উনি জানাননি। বদরীনাথ ঢোকার মুখে নর
ও নারায়ণ পর্বতদ্বয় ‘অভ্রভেদী’ বলে মনে করেছিলেন অথচ বিরাট
উচ্চতা বিশিষ্ট তুষার কিরীট ‘নীলকণ্ঠের’ (৬৫৯৭মি.) উল্লেখই
তিনি করেননি। এই শীর্ষ অলকানন্দার অপর পার থেকে মন্দিরের
দিকে তাকালেই দেখা যায়। ওনাদের বদরীনাথে নিবাসের সময় আকাশে
মেঘ বা কুয়াশার কথাও বলেননি, যে এই কিরীট দেখতে পাবেন না।
যোশীমঠের বিষয়ে লেখার
সময় ওখানকার বিখ্যাত নৃসিংহদেবের মন্দির দেখতে যাবার কথা
লেখেননি। মনে হয় সময়াভাবে সেখানে যাননি। আর বদরীনারায়ণের
শীতকালের পূজা ওখান থেকে হয়, সে কথার উল্লেখও করেননি। যদিও,
পাণ্ডুকেশ্বরের ধ্যান-বদরী মন্দিরেরও সেই পূজা হয় বলা হয়ে
থাকে, এবং তিনি সে কখাও লেখেননি।
বদরীনাথের উত্তরে মানা গ্রাম বেশ প্রাচীন। উত্তরে তিব্বতের
সঙ্গে ব্যবসায়িক পথের উপর হবার কারণে এর খ্যাতি। তবে তখন
নিশ্চয় গ্রামে অত্যন্ত কম মানুষের বসবাস ছিল। এখন যদিও এই
গ্রামের লোক সংখ্য প্রচুর, তা হলেও শীত কালে সকল মানুষই
নিচে, প্রধানত যোশীমঠে, এমন কি শ্রীনগরেও চলে আসেন। বৈশাখ
মাসের অক্ষয় তৃতীয়ার আশপাশে তাঁরা আবার মানায় ফিরে আসেন।
জলধর বাবু সেই বিষয়ে কিছু উল্লেখ করেননি, যদিও ব্যাস গুহা,
মানা গ্রামেই অবস্থিত, এবং ওনারা সেই গুহায় গিয়েছিলেন। ওনারা
ব্যাস গুহার কাছে দুইএক জন মাত্র মানুষ পেয়েছিলেন। মনে হয়
সেই বছর বেশি বরফ থাকার কারণে গ্রামে তখনও কেউ ফেরেননি।
তবে জলধর বাবুর দৃষ্টিতে গ্রামের অবস্থান নজরে পড়া স্বাভাবিক
ছিল।
এই পথের দক্ষিণ দিকে, বিশেষ করে রুদ্রপ্রয়াগের কাছে বাঘের
উপদ্রব বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্তও বেশ ছিল। উনবিংশ
শতাব্দীর শেষ দশকে কি তেমন ছিল না? না হলে জলধরবাবু এই পথ
দিয়ে যাতায়াতের সময় কিছুই উল্লেখ করেননি কেন? স্থানীয় মানুষদের
সঙ্গে উনি তো ভালই মিশেছিলেন, তাঁদের কাছে এ বিষয়ে কিছু
শোনার সম্ভাবনা ছিল। যাই হোক, এই কথা যে শুনবেনই তা অবশ্য
জোর দিয়ে বলা যায় না। যদি এ বিষয়ে কিছু লেখা থাকতো, তবে
কাহিনি আরও উচ্চতর স্তরে উন্নিত হতো।
একবার ছাড়া প্রায় সব সময় জলধরবাবু বাঙালির চরিত্র নিচু চোখে
দেখেছেন। বাঙালির কর্ম-ক্ষমতা, দক্ষতা, ইচ্ছা, সব কিছুকেই
উনি কটাক্ষ করেছেন। এটা যদি সম্পূর্ণভাবে সত্য হতো, তাহলে
ওই সময়কে বাঙলার নব-জাগরণের কালেরই অংশ হিসাবে দেখা হতো
না।
কিছু দিন আগে আমার নজরে একটি লেখা এলো। এত বছর পরে আবার
সেই পুরানো কথা, ‘হিমালয়’ রচনায় দীনেন্দ্রকুমার রায়ের কৃতিত্ব
বেশি না রায়বাহাদুর জলধর সেনের, এই নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা
[৫]।
নির্দেশিকাঃ
[১] ‘হিমালয়’; জলধর
সেন, মাঘ ১৪০২, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা।
রচনায় ব্যবহৃত উদ্ধৃতিগুলি, যদি অন্য কিছু না বলা থাকে তবে
এই বই থেকে গ্রহণ করা। পৃষ্ঠ সংখ্যা নির্দেশ করা হয়েছে বন্ধনির
মধ্যে। এই বই-এ ব্যবহৃত বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে উদ্ধৃতিগুলিতে।
[২] http:://www.abasar.net/lit_himalaya_jaladhar.htm;
এই website-এ ‘হিমালয়’ net-edition পাওয়া যাচ্ছে।
[৩] ‘The Valley of Flowers’; Franck S. Smythe, Date not
printed, Natraj Publishers, Dehradun, P.-42.
[৪] ‘হিমালয়ের’ পথে পথে’; উমাপ্রসাদ মুখোপাধায়ায়, শ্রাবণ
১৩৬৯, মিত্র ও ঘোষ, কলকাতা, পৃ-৩২।
[৫] http:://www.abasar.net/lit_jaladharSen.htm