বিবিধ প্রসঙ্গ
এপ্রিল ১৫, ২০১৬
আজাইর্যা বাজার কথন (দ্বিতীয়)
জয়া চৌধুরী
পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থাকে যে ভারতীয় বাঙালিরা তাদের কাছে সে সব দেশের নির্বাচন –এর চেয়ে কম জরুরি নয় এই বাংলার বিধানসভা নির্বাচনের ফল জানা। মনে প্রাণে এতটাই একাত্ম তারা এ মাটির সঙ্গে। এই দ্যাখো মাটি শব্দটা ব্যবহার করে ফেললাম। ২০১১ সালের পর থেকে কে না জানে মাটি মানেই মা মানেই মমতা! কোন নিপাট অরাজনৈতিক মানুষও যদি এ শব্দ মুখে আনেন তাহলে তাঁকে ছদ্ম বা প্রকাশ্য তিনোমূলী বলে বিশেষায়িত করতে হইহই করে নেমে পড়েন বাকী প্রগতিশীল বাঙালিরা। তবে কি না আগামী পাঁচ বছর ও মাটি র ইংরিজী Soil না হয়ে Mamata ই থাকবে সম্প্রতি এমন রায়ই দিলেন এ রাজ্যের মানুষ। অতএব যা হয় চারদিকে চড়াম চড়াম না হলে ঢাক ঢোল কাঁসর এর সঙ্গীতায়োজন শুরু হয়ে গেছে। এসব কান্ডের মধ্যে ঠিক গতকালই ফল বেরোনোর দিন মাংস রান্না করেছিলাম। একটা পড়ে পাওয়া ছুটি ছুটি ভাব ছিল কি না আকাশে বাতাসে! আজ তাই বাজারে যাবার পথ নিলাম না। সারাদিন ছত্রিশ পেপারের এঁটো খেয়েই সময় কেটে গেল কোথায়। কাজের মাসি কাল আসে নি। অভিজ্ঞতায় জানি ভুটের সময় এইসব ছুটো ছুটির বায়নাক্কা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। আমরাই কি সবাই অফিস কাছারি তে গেছি? সময় পেতেই আজ তাকে ধিরে বসলাম। মালতী সরকারের বয়স আধ পঞ্চাশের মত, জয়নগর গামী ট্রেনে উঠে বহড়ু স্টেশনে নেমে ময়দা কালীবাড়ি যে গ্রামে সেখানে তার বাস। মাসি তার গ্রামের নামটিও বলতে পারে নি। ছোটখাট ছিমছাম চেহারা। দোষের মধ্যে মাসের মধ্যে ৭ দিন মিনিমাম কামাই করা অভ্যেস। তা কী আর করা যাবে! মাইনেও তো তাদের সঠিক দিতে পারি না আমরা। এবার তাকে জিজ্ঞেস করেই বসলাম।
- ও মালতিদি, তোমাদের ওখানে কে জিতল- তৃণমূল?
মাসি সবেগে মাথা নেড়ে ভুরু কুঁচকে বলল-
- না না, আমাদের তো মোমোতা জিতেছে।
বুঝলাম তৃণ স্তরে তৃণমূল দলের আসল নাম মমতা।
- ওঃ। তা যে জিতল, তার নাম কি?
- কী যেন নাম শ্যামল না কি… তা সে জন্যই তো আসি নি কাল। আমার জামাইকে টর্চ পার্টি শাসিয়ে ছিল পশশু রেতের বেলা। গণনার দিন যদি কিচু হয় তা সেজন্যি আসি নি।
- তা তোমরা মমতা কে দিলে কেন?
- আমরা তো দিতুম নি বৌদি। চিরকাল টর্চ পার্টিকেই দিয়েচি। তা বাদে আমার জামাই ভুটের সময় পাঁচ হাজার টাকা পাবার কথা, গেরামের কতজন পেয়েচে, আমিও পেয়েচি কিন্তু জামাই পায় নি। সে তো মোমোতার হয়ে কাজ কচ্চিল। কী অন্যায় বল দিকি? ওই বিধবা ভাতা না কি যেন পায়, সেকেনে ৪০ হাজার টাকা পাবার কথা আমার। পেলুম নি। তা কত দৌড়ঝাঁপ করলাম লেকালিকি সই কল্লাম, বলে দোবো দোবো কিন্তু ওই বেলা কে চেনো তো আমার জা, ও - ও পায় নি আমিও না। বাকী যারাই বেধবা হয়েছিল পেয়েছে। এই দ্যাকো না আমরা দু টাকা কেজি চাল পাই, বড় ছেলেটা সাইকিল পেয়েচে। ও তো বল খেলে, আমার দুই নাতিই বল খেলে সে ট্রাক ভত্তি করে ওদের সেবার নিমপীঠে খেলতে গেল এক বাস্কো বিরিয়ানি ভাত তাপ্পর খেলার সব বুটটুট যা কিচু সব স অ ব দেল মোমোতা। কেন আমরা তিনোমূল করব না কেন? আমার জামাইটা জানো বৌদি খুব চালাক। ও তো বল খেলে,ও টর্চ পার্টির হয়ে অনেক কাজ করেচে…।
মালতিদির কথা থেকে স্পষ্ট হল টর্চ পার্টি মানে এস ইউ সি আই দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় ঠিক কী পদ্ধতিতে নির্বাচন জিতে আসে বরাবর। এবারে যা উল্টে গেল। ফেসবুকের আর পত্রিকায় পাতায় যারা গুরু গম্ভীর ভাবে বলে যাচ্ছেন এ ভাবে মানুষ কে দু টাকা কেজি চাল দেওয়া মানে ভিক্ষে দেওয়া তারা কি এর পরিবর্ত কোন উপায়ে মানুষের পেট ভরাতে পারছেন? মালতিদি বলে চলে
-
- আমরা গরীব মানুষ, আমরা তো তাকেই দেবো বলো বৌদি। আমার জানো বৌদি এগটাই মেয়ে। সোয়ামী ভালো ছিল কিন্তু এট্টু বোকা বুজলে বৌদি? ঝা সব আমিই করাতাম। মেয়েটাকে দেশে বে দুব নি বলেছিলাম। আমার জামাই টা চালাক দেকলো আমার ছেলে নেই পুলে নেই ঝা কিচু সব সেই পাবে, তা দেকেই আমার মেয়েটাকে বে করবে বলে বেঁধে পললো। টর্চ পার্টি র লোক ধরে এনে জোর করে বে করল, তখন আমার মেয়েটার বয়স মাত্তর এগারো। কিচ্চু জানিনি গো , বে-র দিন সাজাতে বসেছে ওকে , তা বলে কি না পাইখানা যাবো…
মালতি মাসির গল্প আর বাড়াচ্ছি না। কিন্তু এ গল্প কি আমরা আগে কোথাও পড়ি নি? স্বাধীনতার ৬৭ বছর পরে টর্চ পার্টি হোক আর ঘাস ফুল পার্টি হোক মানুষের ভোট পেতে দুটো পেটে ভাতের চাহিদাই আগে এসে পড়ে। আগে এ গল্পের কুশীলব হাত পার্টি আর লাল পার্টি ছিল এখন তাদের নাম আলাদা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা যে সারা ভারতে কাজের লোক আর গণিকা সরবরাহের এক চেনা নাম সে কথা পাঠক জানেন। সেই কত বছর আগে বিবেকানন্দ খেয়ে না খেয়ে বলে গেলেন লেখাপড়া শেখার কথা। শিক্ষা শিক্ষা শিক্ষা ই হলো প্রকৃত উন্নয়নের চাবিকাঠি। আশা করব এই পাঁচ বছরে অন্ততঃ পাশের সংখ্যা না বাড়িয়ে শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়াক নতুন সরকার।
এসব কথার ফাঁকে আমার নতুন বাজনাটার কথাই বলি নি পাঠক। গতকাল নির্বাচনের ফল বেরোনোর দিন বাজারে গেলাম। সামান্য একটা জিনিষ কিনবার ছিল। চোখে পড়ল ঝুড়ি ভর্তি বেহালা নিয়ে বিক্রেতা বেহালা বাজাচ্ছেন।
- কি গো কত করে এই বাজনা টা? এটা কি? দুটো মাত্র তার?
- ষাট টাকা করে। এটা বেহালা বৌদি।
- বেহালায় তো অনেক তার... তুমি দেখো তো এই তার-টা কোন সুরে বেঁধেছ মা না পা?
মাথার ঝুড়ি নামিয়ে আলি মনসুর চমৎকার ছড় টানল তার দুটি তারের যন্ত্রে। একটা প্রচলিত লোকগীতি বাজিয়ে শোনাল। তারপর কোনটা পা আর কোন টা সা এ বেঁধেছে সেটাও বুঝিয়ে দিল। তারপর পুঁটলি থেকে এক টুকরো গঁদ দিয়ে বলল... সপ্তাহে সপ্তাহে রোদে দেবেন বৌদি। আপনি শিল্পী বলে এটা দিলাম, অন্য কাস্টমার কে শুধু বেহালা ই দিই।
মনটা স্নিগ্ধ ভালোলাগায় ছেয়ে গেল। ভোট আর তজ্জনিত কচকচির বাইরেও যে একটা জীবন আছে সে জীবনে সমস্যাও আছে সঙ্গীত ও আছে। সেখানে ধর্ম জাতি কিছুর ভেদ নেই। বেঁচে থাকাটা শুধুই কষ্টের নয় তাহলে। আজ আমার বাজার যাওয়া সার্থক...
লেখক পরিচিতি - লেখকের নিবাস কলকাতা, রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল অফ ল্যাঙ্গুয়েজ ও শিবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পানিশ ভাষা শিক্ষক , নেশা স্প্যানিশ চর্চা ও স্প্যানিশ- বাংলা অনুবাদ। পাঁচটি অনুবাদ গ্রন্থ ( উপন্যাস, গল্প সমগ্র, কাব্যগ্রন্থ, নাটক) প্রকাশিত। তার মধ্যে দুটি ভারতে অবস্থিত প্যারাগুয়ে দূতাবাস ও একটি চিলে দূতাবাস কর্তৃক প্রকাশিত। একটি মাত্র মৌলিক কবিতার বই অন্য পাঁচ কবির সঙ্গে মিলিত ভাবে প্রকাশিত। শখ অভিনয় করা ও নিজের জন্য গান গাওয়া আর সেতার বাজানো।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।