বিবিধ প্রসঙ্গ
জুলাই ১৫, ২০১৬
আজাইর্যা বাজার কথন (তৃতীয়)
জয়া চৌধুরী
ঘুমিয়েছিলাম চ্যাটচ্যাটে গরম সঙ্গে করে। গভীর রাতে ঝপঝপ করে জল ঢেলে স্নান করার পরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলে যা সুখ তার সঙ্গে খুব কম সুখেরই তুলনা করা যায়। ক্যালেন্ডার বলে তিরিশে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ঐ এলো দ্বারে। কিন্তু বাতাস বলে অন্য কিছু। চোখ খুলল, না কিচির মিচির পাখীর ডাকে নয়। কড়কড় করে পড়া বাজের শব্দ আর তুমুল বৃষ্টি আমায় ঘুম ভাঙাল ভোরে।
ফের আশা করেছিলেন তো পাঠক যে এখন বৃষ্টি নিয়ে কাব্যকথা কইব। সে গুড়ে পুরীর স্যান্ড। বেলা বাড়তে যায় বাজারে না গেলে এর পরে হরিমটর থাকবে কপালে। সত্যি কথা বলতে গেলে বাজার যাওয়া মানেই পুঁই পটলের দরদাম নিয়ে ভাবিত হওয়া আর সেই সঙ্গে যদি পকেটে মোবাইল ফোন থাকে তবে তো কথাই নেই। একহাতে ব্যাগ, শাড়ির কুচি ও ফোন সব সামলানোর আক্রোব্যাটিক নৈপুণ্য প্রয়োগের সুযোগ। চকচকে মসৃণ ডাঁটি গুলো দেখে মন্ত্র মুগ্ধের মত জয়দেবের কাছে এগিয়ে গেলাম। এ বাজারে পুঁইয়ের কিলো ৩০ টাকা, আলুর ২০ টাকা দরের খুব দূরে নয়। খুব খারাপ ডালও মুসুর ১২০ টাকা করে নিচ্ছে মুদী। স্রেফ ভগমান বলে সেই না দেখা লোকটা জানেন একেবারে নিম্ন আয়ের মানুষেরা এ বাজারে কী করে খেয়ে পরে বাঁচছে! ওটা বানান ভুল নয় মশাইয়েরা চাল যদি ৩৫ টাকার কমে কিনলে খাওয়ার মত না থাকে তাহলে ‘বান’ বসাবার মত ‘মান’ দিতে পারব না। সে যাকগে যা বলছিলাম নধর ঢ্যাঁড়শ গুলো দেখে খানিক আউস হলো দাম জিজ্ঞেস করবার। বিশ্বাস করবেন না লোকটা দাম বলল ৫০ টাকা কিলো! গজগজ করতে করতে সেও খানিক নিতেই হল পুত্রের ঢ্যাঁড়শ প্রীতি ভেবে। কিন্তু জিজ্ঞেস করতেই হল এত দাম কেন? এই মে জুন মাসে যদি সব্জী কিনতে এত টাকা দিতে হয় তাহলে অফ সিজনে সব্জীর কত দাম উঠবে?
- ও জয়দেব তোমার বাড়ি কোথায় বলতো? ( ব্যস শুরু হয়ে গেল তো পাঠকের সেই কিড়মিড়ানি... গরীব বলে তুমি বলে ডাকতে হবে?কেন ওদের মান নেই? – আরে নাঃ ওসব কোন ব্যাপার নয়। মেঘে মেঘে কম বেলা তো হল নাআর এদেরও বাপু বেশ কবছর ধরে দেখছি তাই এই সম্বোধন)
- সে তো জয়নগর লাইনে মানে তার একটু আগেই। বহড়ু গেরাম।
- তা এই ঢ্যাঁড়সের এত দাম চাইছ কেন? তুমি কি অন্য জায়গা থেকে আনো নাকি?
- না বৌদি। আমাদের ধরুন গে গেরামের কাচেই চাষ হয়। তা আমি অবিশ্যি চাষিদের কাছে গিয়ে কিনি না ওরা আমায় বাড়ি এসে বিক্কিরি করে যায়। এই পুঁই ঢ্যাঁড়শ কুমড় এসব আঁবনি এমনি কারো কাচে পাবেন না এরম। আসলে সবাই তো শিয়ালদা থেকে কেনে। সেকেনে পাঁচ কিলো কিনলে এক কিলো কোম দেয় ওজনে। আর আমাদের ওইখেনে কিনলে একসঙ্গে অনেকটা কিনি বলে এক কিলো বেশিই দেয় পাঁচ কিলো কিনলে। তাবাদে এর সোয়াদ আলাদা।
- কেন? তুমি বিক্রি করছো বলে?
- ( কান জোড়া হেসে বলে জয়দেব পাইক) না না একেনে চাষিরা ক্ষেতে সস্যের খোল দেয় তো। ওই সব দোকানের অসুদ না। একেবারে খোল দেয় বলে এমনি চ্যায়রা হয়।
বুঝলাম অরগানিক সব্জী বলেই তার ঢ্যাঁড়স বাকীদের চেয়ে সামান্য বেশি। মনে মনে ভাবি জয়দেব যদি জানত বিপণনের অন্ধিসন্ধি তাহলে অরগানিক ফুড নামে প্যাকেট করে ঢ্যাঁড়স ৫০ দুগুনে ১০০ টাকায় বিক্রি করত অবলীলায়। আর আমরা দাঁত ব্যাদান করে শপিং মলে গিয়ে আমেরিকান বাসি অরগানিক ঢ্যাঁড়স না কিনে কিনতাম সেগুলিই। বাঙালি চাষি কিংবা সবজী ওয়ালাদের দুর্দশা ঘুচিবে কেমনে? না কি আমাদের মত হাটুরে ক্রেতাদের জন্য এটি মঙ্গল!
আরো কিছু কিনবো বলে গিয়ে দাঁড়ালাম স্বপনের কাছে। তাই বলে স্বপ্নেও ভাবি না তিনি আমায় সস্তা য় কিচ্ছু সব্জী দেবেন। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ইলেকশন চলে গেছে কবে। পাত্র মিত্র গুছিয়ে সরকার ও শুরু হয়ে গেছে জোর কদম। এইবার স্বপনকে জিজ্ঞেস করবার ইচ্ছেটা দমন করলাম না। বলেই ফেললাম
- ও স্বপন তুমি ইলেকশান নিয়ে যা বলছিলে তা তো মিলল না?
- বুঝবে বুড়ি বেলা হলে
যা বাব্বা ...আমি জানতাম যে বয়স অনেক হলো। তাই বলে লোকজন যে এভাবে আঙুল তুলে নাকের ডগায় বয়স স্মরণ করাবে ভাবি নি তো! অলক্ষ্যে নিজের মুখটা একবার দেখতে ইচ্ছে করল। এট্টু থতমত খেয়ে বললাম
- কি বললে?
- বললাম বেলা হলেই বুড়ি বুঝবে। জানেন বৌদি আমাদের দেশ গাঁয়ে এক বুড়ি আছে, চোলাই বিক্কিরি করে।
- সে কি মেয়েমানুষ মদ বিক্রি করে?
- কেন? মেয়েমানুষ সব করতে পারে আর মদ বিক্কিরি পারবে না?
- হুম তাতো বটেই। সমানাধিকারে বিশ্বাস রাখলে এ প্রশ্নের জবাব হ্যাঁ তো দিতেই হয়। আমাদের ভালোয় যেমন সবার অধিকার তেমনি খারাপ এর সমান অধিকার । উল্টো কথা বলে মার খাই আর কি! তা কি যেন বলছিলে?
- বুড়ির দোকানে দিনরাত ভিড় লেগেই থাকে। সারারাত বিক্কিরি করে ভোরের দিকে ঝাঁপ ফেলে বুড়ি। আবার দোকান খুলতে খুলতে একটু বেলাই করে কারণ তার ব্যবসা সারারাত ধরে। এক রিস্কা ওয়ালা ওর দোকানে চোলাই মদ কেনে। রোজই তার হাজার বায়নাক্কা। খালি ঘ্যান ঘ্যান এত দাম দোবো না, আজ দাম দোবো না, একটা মাল ফিরি দাও না মাইরি... তা বুড়ির দোকানে সেদিন বেলা এগারোটা না বাজতেই হামলা করল। বলে কিনা বুড়ি আমায় মালের পাইট দাও, পরে টাকা দোব। সে বুড়িও তেমনি। রিস্কাওয়ালা যত চেঁচায় বুড়িও আরো শিরা ফোলায়। কিচুতেই সুবিধা করতে না পেরে লোকটা তেড়ে মেরে বেরিয়ে গেল । বুড়ি তো নিচ্চিন্ত। ধীরে সুস্থে দোকানদারী সামলে সেদিন রাতেও বিক্রি করল বেশ। ঘুম ভাঙ্গল বেশ বেলা করে, তাও আবার বুড়ির ছেলে বউয়ের চেঁচামেচিতে। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়েই মাথায় হাত... কে যেন বাড়ির চালে ফনফনানো লাউগাছ টা গোড়া শুদ্ধু কেটে নিয়ে গেছে। ছেলে খবর নিয়ে এসে বলল ওই রিস্কাওয়ালাটাই চোলাই না পেয়ে মতলব এঁটেছিল। সেরাতে দোকান বন্ধ করার পরেই কোন ফাঁকে এসে লাউগাছটা কুপিয়ে গেছে... তাই বলছিলাম কি- বুঝবে বুড়ি বেলা হলে...
লেখক পরিচিতি - লেখকের নিবাস কলকাতা, রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল অফ ল্যাঙ্গুয়েজ ও শিবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পানিশ ভাষা শিক্ষক , নেশা স্প্যানিশ চর্চা ও স্প্যানিশ- বাংলা অনুবাদ। পাঁচটি অনুবাদ গ্রন্থ ( উপন্যাস, গল্প সমগ্র, কাব্যগ্রন্থ, নাটক) প্রকাশিত। তার মধ্যে দুটি ভারতে অবস্থিত প্যারাগুয়ে দূতাবাস ও একটি চিলে দূতাবাস কর্তৃক প্রকাশিত। একটি মাত্র মৌলিক কবিতার বই অন্য পাঁচ কবির সঙ্গে মিলিত ভাবে প্রকাশিত। শখ অভিনয় করা ও নিজের জন্য গান গাওয়া আর সেতার বাজানো।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।