প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ

জুলাই ৩০, ২০১৬

 

আজাইর‍্যা বাজার কথন (চতুর্থ)

জয়া চৌধুরী

অন্যান্য অংশ - (১) (২) (৩) (৪) (৫)

 

চোখে পড়ার জন্য দিনরাত আকুলি বিকুলি। এই দ্যাখো আমি কেমন ওপরের পাটি নিচের মাড়ি ঠিক ঠাক ব্রাশ হেলিয়ে দাঁত মাজতে পারি। এই দ্যাখো আমি কেমন একশ্বাসে মান্না দে র গান গাইতে পারি। সঙ্গে অনুসঙ্গ হিসেবে হাজার খানেক বাদ্য বাজলেই বা কি? গানটা তো আমিই গাইলাম। এই দ্যাখো কী দারুণ কাচাকুচি করতে পারি। দুহাত দিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে ঊর্ধ্ব মুখী হয়ে শূন্যে কাপড় তুলি আর পাট করি সপাটে কলঘরের মেঝেতে... নাঃ লিস্টি বাড়াব না। সব বিষয়ে অন্যের চোখে পড়ার জন্য আর পারি না পারি হাততালি পাবার জন্য আমার খুব বাসনা। সেদিন একটি সর্বাধিক বিক্রীত সংবাদপত্রের নৈঋত অংশে সাড়ে তেত্রিশ অক্ষরে আমার সম্পক্কে লেখা প্রকাশ হয়েছে দেখেই উচ্ছ্বাসে পি কে ব্যানারজী হয়ে গেলাম। সে কী ভোকাল বাতেলা ! আশেপাশে যাকে দেখি সব্বাইকে ব্যাগের ভেতরে রাখা দুমড়ানো পত্রিকা নিয়ে সব্বাইকে ডেকে বলছিলাম দয়াখো আমি কী হনু! তো এইসব পার্থিব বিষয়ে মন টানার ফলে কোর্ট কাছারির মত তুশ্চু বিষয় ভুলে গেছলাম। মহতী পেশা ধারিণী আমার ফোন করে আসতে বলাতেই জামা গলিয়ে ব্যাগ নিয়ে সোজা বিচারালয়।  এত বছর ধরে ও পাড়ায় গিয়ে গিয়ে আমার নিশ্চিত ধারণা হয়েছে যে কোর্টে কেউ হাসে না। সুকুমার রায় এঁদের দেখেই সেই ছানাটির ছড়া লিখেছিলেন।  ক্লার্ক রা কাজ করেন মাথা গুঁজে। আর দুক্কুরবেলা  টিপিন টাইম এলেই ক্লিপ লাগানো বাস্কো খুলে বাড়ি থেকে আনা রুটি আলুর তরকারী কিম্বা ভাত ডাল পটলের রসা বা অন্য যে কোন অমেত্ত গপগপ সাটাতে শুরু করেন। সারাদিনে ওই একবারই তাঁদের কপালের কোঁচকানো ত্বক ভরপেটের সুখে টানটান হয়। এমনকী এট্টু নজর করলে ভাঁজের মাঝখানে হাসিও দেখতে পাওয়া যাবে। শেষ জুলাইয়ের বিস্টি বাদলা দিনে কোথায় খিচুড়ি দিয়ে পিত্তি রক্ষা করব তা নয় শুকনো মুখে কাজ সেরে কোর্ট থেকে বেরিয়ে আসতে হলো। বেরোবার মুখে একটি কাটা ফলের দোকান। শুনেই আঁতকে উঠবেন না মশাই । কাটা ফল নিয়ে পুরসভার বিজ্ঞাপনী ভাষায় ভ্যাজোর ভ্যাজোর বন্ধ করুন। দোকানটি বেশ ছিমছাম পরিচ্ছন্ন। বেশ কবছর ধরে লক্ষ্য করছি বিক্রেতা পরিপাটি করে সিঙ্গাপুরী কলার খোসা কাটে, তারপর একফালি তরমুজ, এক খন্ড পাকা পেঁপে , বা যে কোন মরশুমী ফল , আধাখানা পাকা শসা কেটেকুটে অল্প বিটনুন মশলা মাখিয়ে বসে বসে বিক্রি করে। সেদিন খদ্দের নেই দেখে বসলাম তার বেঞ্চে। বাজারু বাজার করতে ক্লান্ত হয় না আমিও তাই লেগে পড়লাম দর জানতে। দোকানদার ফলে আনারসের টুকরো দেবে কি না জিজ্ঞেস করাতে প্রবল বেগে মাথা নাড়াই। কিন্তু দর কত আনারসের? ছোট একপিস পঞ্চাশ টাকা। অন্যদিন গম্ভীর মুখে ফল বিক্রি করে গেলেও দোকানদারের শখ হল আমাকে দুটো জ্ঞান দেবেন। বললাম

  • আর সব ফলের দর কত যাচ্ছে? নিশ্চয়ই খুব বেশি। কদিন আগেই তো ঈদ গেল। দোকানদার শুনে সবেগে মাথা নাড়ল।
  • না না সে ঈদের সময় যা বেড়েছিল তা কমেছে তো।
  • ও তাহলে নিশ্চয়ই কম দাম। তা আপনি এই কটা ফলের জন্য এত দাম চাইছেন?
  • আজ্ঞে যতখানি দাম বাড়ে ততটা কি কমে? এই দেখুন না শসা তিরিশ টাকা কিলো, পেঁপে তিরিশ টাকা তরমুজ শেষ মরসুমেও চল্লিশ করে।  ভাল কলা দুটো কিনলেই দশ টাকা দিতে হবে । তারপর ছোলা আছে। ছোট দানা কাবুলি মটর আছে। দুম করতে কত দাম বেড়ে গেল। তাহলে এক প্লেট ফল বিশ টাকায় কিভাবে দিই বলুন?

মনে মনে এক দুই চুয়ান্ন ইত্যাদি গুণতে গুণতেই তড়িঘড়ি বললাম সে তো ঠিকই। তারপর একমনে খেতে লাগলাম। খাচ্ছি কিন্তু শালপাতার মাঝের শিরা ভেঙে তৈরী করা কাঠি দিয়ে।  ডাব খাবার পরে তার ভেতরের শাঁস বা লেই খাবার জন্য দোকানী ডাব টাকেই কেটে তার খোসা পাতলা করে একফালি  দইয়ের হাতার মত সাইজ বানিয়ে আপনার সামনে ধরলে কী দারুন লাগে বলুন তো ওটা দিয়ে লেই খেতে?  কিংবা আলুকাবলি ওয়ালা যখন শালপাতার শিরা থেকে কাঠি বানিয়ে মশলা মাখানো খাদ্যের ওপর শালের প্লেটে গুঁজে দেন হলফ করে বলতে পারি ক্রেতা রসিয়ে কষিয়েই সে জিনিষ গলাধঃকরণ করেন।  যে  যাই বলুন নিবু নিবু আলোয় নানাবিধ ছুরি কাঁচি হাতা বেলচা দিয়ে খাদ্য খাবার চেয়ে এই সব দুর্ধর্ষ কাটলারি দিয়ে খাবার মজা বেশিই পাওয়া যায় নয় কি? খেতে খেতে শুনলাম দোকানদার বলে যাচ্ছেন

  • এই বাজারে কোন ফল সস্তা নেই। এই তো আবার একুশে জুলাই বিক্কিরি থাকবে না। তিস সাল ধরে এখানে দুকান করছি। এইসব লেগেই থাকে।
  • আপনার দেশ কোথায়?
  • বিহার বৌদি। তা  কী দরকার ছিল এসব করার?  আরে বাবা সব জায়গায় তো দিদিমণির পার্টি। দিদিমণি তুমি তো জানোই সব তোমারই।
  • কেন? সেদিন কোর্ট বন্ধ থাকবে?
  • না না তা কেন? তাহলে খামোখা এই সব মিটিন করে কী লাভ! এই তো সেদিন ই মুখ্যমন্তিরীজি আসলেন।
  • মানে?
  • আরে নীতিশকুমার সাব আইলেন না?

মনে মনে বুঝলাম পশ্চিমবঙ্গে তিরিশ বছর ব্যবসা করে সংসার চালানোর পরেও এঁদের মুখ্যমন্ত্রী মানে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। বললাম-

  • হ্যাঁ হ্যাঁ। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নতুন সরকার শপথ গ্রহণের দিন অতিথি হয়ে এসেছিলেন বটে।
  • তাহলে?
  • তাহলে আর কি। আপনার ইচ্ছে না হলে যাবেন না। দোকান বন্ধ রাখতে কি বাধ্য করে কেউ ?
  • হাসি হাসি মুখে একহাত লম্বা জিভ বের করে বলে – আরে না না। এ তো আপনা সব। আমাদের ভালবাসার কাজ। ওসব জোর কিছু না। মিটিনে আমরা নিজেরাই যাব। এই কোর্ট এ সব দুকান বন্ধো থাকবে।
  • খুব সুস্বাদু প্লেট শেষ করে দাম মিটিয়ে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করলাম ... তা আপনার নাম কী ভাই।
  • একগাল হেসে বললেন দোকানদার- রামরতন সাউ।

পকেট থেকে টাকা বের করে মেটাতে মেটাতে ভাবতে লাগলাম এই সব ভালবাসা কীরকম ভালবাসা? ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই কমেডি নাটকের মত? স্বামী স্ত্রী ঝগড়া হচ্ছে ছুটিতে কোথায় বেড়াতে যাওয়া হবে। স্বামীর ইচ্ছে পুরী। কেননা সেটায় খরচা কম অথচ বেড়ানো হলো একথাও বলা যাবে। আর স্ত্রীর ইচ্ছে কাশ্মীর। কেননা সেটায় বেশ শাম্মী কাপুর আশা পারেখ মার্কা মাখোমাখো রোম্যান্স। বরফ আর শিকারায় স্বপ্নের দিন কাটানো। টাকা পয়সার মত সামান্য ব্যাপারে মাথা না ঘামিয়ে সেখানেই যাওয়া উচিৎ। কাশ্মীর – পুরী- কাশ্মীর – পুরী- পুরী পুরী- কাশ্মীর কাশ্মীর- পুরীইইই- কাশ্মীইইইইইইইইইইর। শেষ পর্যন্ত জয়ী হল কাশ্মীর ই। বেচারী স্বামী গলা বাজিয়ে বললেন- তুমি ভাবসো আমি পুরী যামু? কক্ষনও না। আমিও যামু ... নিজের ইচ্ছায়ই কাশ্মীর যামু ।

একটি পত্রিকা সেদিন আমার কাছে গদ্য চাইছিলেন।  অতঃপর ভরপেট ফল খেয়ে পত্রিকাটির জন্য আগামী সংখ্যায় ছাপিতব্য ভালবাসা বিষয়ক একটি প্রবন্ধ ভাবতে ভাবতে বাড়ির পথ ধরলাম।

 


লেখক পরিচিতি - লেখকের নিবাস কলকাতা, রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল অফ ল্যাঙ্গুয়েজ ও শিবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পানিশ ভাষা শিক্ষক , নেশা স্প্যানিশ চর্চা ও স্প্যানিশ- বাংলা অনুবাদ। পাঁচটি অনুবাদ গ্রন্থ ( উপন্যাস, গল্প সমগ্র, কাব্যগ্রন্থ, নাটক) প্রকাশিত। তার মধ্যে দুটি ভারতে অবস্থিত প্যারাগুয়ে দূতাবাস ও একটি চিলে দূতাবাস কর্তৃক প্রকাশিত। একটি মাত্র মৌলিক কবিতার বই অন্য পাঁচ কবির সঙ্গে মিলিত ভাবে প্রকাশিত। শখ অভিনয় করা ও নিজের জন্য গান গাওয়া আর সেতার বাজানো।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।