বিবিধ প্রসঙ্গ
অগাস্ট ৩০, ২০১৬
আজাইর্যা বাজার কথন (পঞ্চম)
জয়া চৌধুরী
একটা অসম্ভব চাপ অনেকদিন ধরে আপনাকে যদি ঠেসে ধরে। প্রথমে হালকা হালকা পায়চারি, তারপর একটু ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে পিঠ ঠেকানো, তারপর বেশ খানিকটা যতি, উঠে দাঁড়াব কী দাঁড়াতে পারব না... একটু শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করা বিছানায় হাত পা এলিয়ে চিৎপাত হয়ে ... প্রথমে এক আধ ঘন্টা তারপর ক্রমশ বাড়তে থাকা সময়... দেওয়ালের ঘড়ির দিকে খুব চেয়ে থাকা নিথর কাঁটা ঘুরছে কী ঘুরছে না...বোঝা যায় না... রাতের পর্দা ভারী হয়ে আসে, বর্ষার সন্ধ্যা রাত গভীর রাতের অবসনন্ন টুপটাপ ল্যাম্পপোস্টের ঢাকনির ওপর একলা একলা ঝরতে থাকা... পারা যাবে... এই গভীর অতল খাদ থেকে ওঠা ...জানি না ...কেন... এত ভার ওফ এত অসহ্য ভার আর কতদিন ...
বিশ্বাস করুন বড্ড ডুবে ছিলাম অনেকদিন। শেষমেশ জার্নিটা শেষ করা গেল। বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল-এ ঘূর্ণি পাক আমাকে টানছিল কিন্তু পারেনি । একটু রিলিফ।
রোজ যেমন অনুবাদ চলে তেমন চালাচ্ছিলাম। সে তো খবরে কাগজো পড়ছিলাম, দাঁত ব্রাশ ও, হ্যাপি পেরেন্টস ডে থেকে অসহ্য বাংলা সিরিয়াল, মাঝেমধ্যে আলুর চপ বেগুনি মুড়ি থিয়েটার রাজনীতির বন্ধ্যা জল, ব্রিটেনের টেরেসা মে কী পারবে ইউরো গোষ্ঠী থেকে বের হবার সমস্যা সামাল দিতে , না কি দিলমা রউসেফই ভালো ছিল হয়ত, সিন্ধু রুপো জিতলেও দীপার পদক মিস অনেক বেশি কৃতিত্বের ইত্যাদি নিয়ে জেবড়ে ছিলাম একঘেয়ে বেঁচে থাকা। মধ্যিখানে ডাক পড়ল গল্পপাঠের। খুব আনন্দে কাটল সে সন্ধ্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাসভবনে। মেক্সিকোর এক লেখিকা থুক্কু লেখক লাউরা এসকিভেল। ওনার একটি অনবদ্য গল্প পাঠ করে বিমল আনন্দ পেয়ে বাড়ি ফিরছি মাথার ওপর ঝিরঝিরে বারিশ নিয়ে। চা খেতে দাঁড়িয়ে পড়লাম ত্রিকোণ পার্কে। খেতে খেতে কানে এলো ওপাশের ঝালমুড়িওয়ালার সঙ্গে এক মহিলার কথোপকথন।
- কী কী মাছ বিক্রি করো?
- সব রকম- রুই, তেলাপিয়া, মৌরলা, জ্যান্ত যা আছে।
- আপনি টাটকা মাছ বেচেন?
- নিশ্চয়ই
- নড়া না মড়া?
- মানে?
- মানে সে মাছ নড়তে থাকে না মরা মাছ আনেন?
মুড়ির দোকানে মাছ শুনেই এ শর্মা র কান খাড়া। বিষয়টা যে স্বপ্নকুমারের চেয়েও আজগুবি লাগছে। সেই যে “কোথা হইতে কী জানি হইয়া গেল দীপকের হাতে পিস্তল দেখিলাম”। দেখি দোকানদার আবেশে প্রায় চক্ষু বুজিয়া বলছে...
- আমি জ্যান্ত ছাড়া মরা মাছ বেচি না। আমার ভেটকির যা স্বাদ!
সামলাতে পারলাম না। পাশ থেকে গলা বাড়িয়ে বললাম,
- ভেটকি মাছ নড়ে? আমি এত বছর বাজারে যাচ্ছি কই জ্যান্ত ভেটকি তো চক্ষে দেখি নাই? সে তো জানি পুকুরে জলে আর বাবা জ্যাঠার গল্পে জ্যান্ত থাকে!
- না না। আমার কী আর এখানকার বরপ চাপা মাছ! আমি আনি সেই ঘটকপুকুর মালঞ্চ থেকে।
- সে মাছ বাজার পর্যন্ত এসে টাটকা থাকে?
- থাকবে না কেন? আমি সারের মাছ আনি না কি? যে জল ভর্তি হাঁড়িতে সার দেওয়া ঘেসো গন্ধওয়ালা মাছ আনব? আমি ঝুড়ি করে মাছ আনি। ভোরবেলা ৩ টে থেকে ৪ টের মধ্যে ধরা হয়। সে মাছ ৪ টের ভেতর পাইকারী বাজারে চলে আসে। সেখান থেকে কিনে ৫টায় আমি এ বাজারে আসি।
ঘাড় ঘুরিয়ে ত্রিকোণ পার্ক এর বনেদি পাড়াটায় তাকালাম। সিটি স্টাইলের বিরাট মল আর পাশাপাশি কলকাতার অবলুপ্ত প্রায় বাঙালি বনেদি বাড়িগুলির সার সার গাড়িবারান্দাওয়ালা বাড়ি। নিঝুম, শান্ত, আভিজাত্যে মোড়া জায়গাটায় মাছ কোথায় বিক্রি হয় রাতের অন্ধকারে ঠাহর হল না। আমার অবিশ্বাসী মুখ দেখে দোকানদার ‘ঐ ওখানে’ বলে এক অদৃশ্য অকুস্থল দেখিয়ে বলল-
- ওই ওই কোণটায় আমার দোকান। আমার দোকানে মাছের রঙ কী! সোনালি রঙ চোখ চকচক... দেখলে কেউ আর অন্য দোকানের মাছ কেনে না। চার পাঁচশ গ্রাম ওজনের মাছ সাড়ে তিনশ টাকা কেজি দরে বেচি।
আমি চোখ কপালে তুলে তোতলাতে তোতলাতে বললাম –
- আপনি দেখছি মুড়ি মাখা বিক্রি করছেন?- বলছি বটে আর ভাবছি আমি বাবা ওই মুড়ি কিনব না। যে লোক মাছ ঘাঁটাঘাঁটি করে দিনরাত তার মুড়ি মাখায় নিশ্চয়ই ভেটকির গন্ধ উঠে আসবে।
- সকাল দশটা থেকে রাত দশটা দোকান করি। বারো ঘন্টা।
আবার আমার মাথা গুলিয়ে গেল। ভোর পাঁচটায় বলল দোকান লাগাই আবার বলছে সকাল দশটায় আবার শুনি রাত নটা হলে বারো ঘন্টা হয়... আমি রাজার হিসেব করতে বসলাম। মাঝে একবার তাল করেছিলাম দ্রিঘাংচুকে ডাকব। কিন্তু সাহস করে নিজেই ইকড়ি মিকড়ি পাঁচ দুই বারো সিকি ইত্যাদি সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ভ্যাবলা হয়ে হাতের ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের খুড়িটায় শেষ চুমুক দিয়ে ছুঁড়ে ফেললাম টিনের বাক্সোটায়। বলতে গেলাম-
- আপনি সারাদিন দোকান করেন? বিশ্রাম কখন করেন তাহলে?
- বিশ্রাম ঐ একঘন্টা মত করে নিই।
আবার জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম লোকটার নাম কি। একবার হাঁ করেই মুখ বুজে ফেললাম। একে তো এক খাবলা মুড়িও কিনিনি, তার মধ্যে রাত্রি পৌনে নটায় যদি তার নাম ধাম মাছ ঝুড়ি বিয়ে বাচ্চা শউরবাড়ি ইত্যাদি নিয়ে জিজ্ঞেস করে জ্বালাতে থাকি সে আমায় সহ্য করবে বলে আপনার মনে হয়? এতটাও যে উত্তর দিল তাতে বর্তে গেলাম। মুখ দেখলাম, পরনের লুঙ্গিটাও দেখলাম তাকিয়ে... নাঃ নামটা জিজ্ঞেস করতে পারলাম না।
পরের দফায় টাটকা ভেটকির দোকানির পুরো জ্ঞাতি গুষ্টির কথা জেনে বলবখন। আজ গেলাম।
উফ... অনেক দিন পরে আজ একটু... ভাল লাগছে।
পাঠক ভালবাসা নেবেন।
লেখক পরিচিতি - লেখকের নিবাস কলকাতা, রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল অফ ল্যাঙ্গুয়েজ ও শিবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পানিশ ভাষা শিক্ষক , নেশা স্প্যানিশ চর্চা ও স্প্যানিশ- বাংলা অনুবাদ। পাঁচটি অনুবাদ গ্রন্থ ( উপন্যাস, গল্প সমগ্র, কাব্যগ্রন্থ, নাটক) প্রকাশিত। তার মধ্যে দুটি ভারতে অবস্থিত প্যারাগুয়ে দূতাবাস ও একটি চিলে দূতাবাস কর্তৃক প্রকাশিত। একটি মাত্র মৌলিক কবিতার বই অন্য পাঁচ কবির সঙ্গে মিলিত ভাবে প্রকাশিত। শখ অভিনয় করা ও নিজের জন্য গান গাওয়া আর সেতার বাজানো।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।