(আগের অংশ) হাম্পিতে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা অত্যধিক। মোট পর্যটকের মধ্যে
প্রায় ৫০% হবে, তবে তাঁরা প্রধানত শীত কালেই এসে থাকেন। তাঁদের
মধ্যে অনেকেই ভাড়া করা সাইকেল বা বাইক নিয়ে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে
ঘোরেন। বিদেশিরা হাম্পিকে গ্রাম বলে থাকেন। তবে আমাদের নিরিখে
হাম্পি নিশ্চয় এক আধা-শহর। এখানকার রেল-স্টেশন হসপেট এই আধা-শহরের
পরিধির বাইরে। আগেই বলেছি, আমাদের হোটেল K.R.K. Residency রেল-স্টেশনের
প্রায় ১কিমি. দূরত্বে হাম্পির দিকে। সকাল ৮টা নাগাদ কথামত গঙ্গাধর
উপস্থিত হলো। আজও ঝির-ঝিরে বৃষ্টি। গঙ্গাধর বলল যে কোনও অসুবিধে
নেই, আজ অনেকটা দূরে যাব, হাম্পি ছাড়িয়ে বিজয়নগরের প্রাচীন অংশে,
রামায়ণে উল্লিখিত কিষ্কিন্ধায়। আশা করা যায় পরে বৃষ্টি পড়া হয়তো
থেমে যাবে।
কিষ্কিন্ধার দিকে আমরা যাত্রা শুরু করলাম সকাল ৮:৪০ মিনিটে। আজ
হাম্পির বসতি এলাকার মধ্যে দিয়ে গাড়ি চললো। কয়েকটা সরকারি দপ্তর
ও এক বি.এড. কলেজ রাস্তার পাশে দেখতে পেলাম। অত্যন্ত চওড়া ও মসৃণ
রাস্তা। গাড়ি প্রায় এক ঘণ্টার কিছু পরে এসে থামলো ‘আঞ্জাণীয়া’
পর্বতের পাদদেশে। পর্বত না বলে উঁচু টিলা বলা ভাল। বাঁকুড়া পুরুলিয়া
অঞ্চলের টিলার সঙ্গে এর তুলনা চলে, তবে প্রচুর গাছ-পালা রয়েছে,
বড় বড় বৌল্ডারের মাঝে। বেশ কিছু আতা গাছ রয়েছে দেখতে পেলাম। গাড়ি
থামার জায়গায় কয়েকটা ঠাণ্ডা পানিয়, চা, ভুট্টা ইত্যাদির দোকান।
দোকানিরা খরিদ্দারের অপেক্ষায় রয়েছে। রাস্তা সহ বেশ খানিকটা পরিষ্কার
ফাঁকা জায়গা আর রয়েছে বেশ শান্ত পরিবেশ। ভাল লাগলো। রাস্তার মাঝেই
এক সারমেয় একটা একটু বড় মতো পোকা নিয়ে খেলা করছে, সামনের থাবা
দিয়ে চেপে ধরে ছেড়ে দিয়ে যেন ভয়ে দূরে সরে গিয়ে আবার ফিরে আসছে।
কিছুক্ষণ ধরে তার খেলা চললো, চললো আমার হ্যান্ডিক্যামও তাদের তাক
করে। কয়েকজন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী বসে রয়েছেন। পর্বতে ওঠার জন্যে
সামনেই সিমেন্ট করা উঁচু উঁচু পাথরের সিঁড়ি দেখতে পেলাম। সিঁড়ির
দুপাশে বেশ মোটা পাঁচিল। সন্ন্যাসীরা আমাদের বলে দিলেন সিঁড়ি বেয়ে
ওপরে ওঠার পথে যেন হনুমানদের থেকে সাবধান থাকি। উপদেশ দিলেন হনুমানদের
তাড়াবার জন্যে আশপাশের গাছ থেকে ডাল ভেঙ্গে সঙ্গে রাখতে। আমরা
অনেকে তাই করলাম। কয়েকটা সিঁড়ি ওঠার পরই চোখে পড়ল একটা সিঁড়ির
ওপর দিয়ে এক অস্বাভাবিক বড় কেন্নো যাচ্ছে। অত বড় কেন্নো আমি এর
আগে একবারই মাত্র জলদাপাড়া জাতীয় অভয়ারণ্যের মাদারিহাট ট্যুরিস্ট
লজের সামনের বাগানে দেখেছিলাম। ক্রমশ পাহাড়ি রাস্তার সর্পিল গতি-রেখার
মত সিঁড়ি পথও ওপর দিকে উঠছে। আমরাও উঠতে লাগলাম। সকলেই প্রায় জীবনের
মধ্যাহ্নকালে এসে গেছি, তাই আমাদের হাঁটুতে চাপ আর শ্বাস-প্রশ্বাসে
গভীরতা এসে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কপি-দল আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে আসছে,
কিন্তু আমাদের অভ্যর্থনার বহর দেখে পেছিয়ে যাচ্ছে। এক জায়গায় সিঁড়ি-পথ
ছোট এক গুহার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেছে।
চিত্র-১৯, তুঙ্গভদ্রা নদী ১
চিত্র-২০, হনুমান মন্দির
চিত্র-২১, হনুমান
চিত্র-২২, হনুমান-মাতা অঞ্জনী দেবী
প্রায় শ-খানেক সিঁড়ি ওঠার পর পিছন দিকে তাকিয়ে দেখি কিষ্কিন্ধার
সমভূমির শ্যামলিমা আর সেই উপত্যকার মাঝে অর্ধচন্দ্রাকারে উপল সমৃদ্ধ
তুঙ্গভদ্রার গতি রেখা (চিত্র-১৯, তুঙ্গভদ্রা নদী ১)। এই অপরূপ
বিহঙ্গম দৃশ্য আমাদের মুগ্ধ করে দিলো। মনে পড়ে গেল শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের
বিখ্যাত বই “তুঙ্গভদ্রার তীরে” পড়া “তুঙ্গভদ্রার গিরি-বলয়িত উপকূলের...”
কথা। আজ পর্যন্ত সেই দৃশ্য কল্প-চক্ষে দেখতাম, এখন সেই উপকূল সামনে
দেখতে পাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত ৫৮৫টি সিঁড়ি ভেঙ্গে পর্বত শীর্ষে উঠে
আসলাম। বেশ কিছুটা প্রায় সমতল চাতাল। একধারে ‘হনুমান মন্দির’ (চিত্র-২০)।
মন্দির বেশ ছোটই। মন্দিরের প্রাচীনত্ব বোঝা কঠিন, কেননা প্লাস্টার
করা আর সাদা চুনের নতুন প্রলেপ। তবে পিছন দিক থেকে পাথরের কড়ি
সাজিয়ে গাঁথনি বোঝা যায়। কথিত, এ হনুমানের জন্মস্থান। মন্দিরে
হনুমানের গতানুগতিক বিগ্রহ নয়, দেয়ালে বাস-রিলিফ, আধুনিক শিল্পকলার
প্রতিরূপ। দৃষ্টিনন্দন। ছবি তোলা মানা। দূর থেকে হ্যান্ডিক্যামের
সাহায্যে ভিডিও ছবি থেকে গ্র্যাব করা, তাই কিছুটা অস্পষ্ট। এ ছাড়া
আমার কন্যা শুভমালা photoshop—এর কারসাজি করে সামনে থেকে দুই দর্শনার্থীর
ছবি মুছে দিয়েছে। অভিনব এই হনুমানের এমন ছবি দেখাচ্ছি (চিত্র-২১,
হনুমান)। সংলগ্ন হনুমান মাতা অঞ্জনীদেবীর মন্দির। অবশ্য আলাদা
মন্দির পরিসর নয়, বিখ্যাত সন্তানের মন্দিরেরই এক অংশে তাঁর স্থান।
মাতার সুন্দর মূর্তি, অপূর্ব মুখমণ্ডল (চিত্র-২২, হনুমান-মাতা
অঞ্জনী দেবী)। যেখানে রাম সেখানেই রাম ভক্ত হনুমানের উপস্থিতি
নিশ্চয় থাকে। কিন্তু এখানে ভক্তের কাছে দেবতা নিজেই উপস্থিত হয়েছেন,
ভ্রাতা ও স্ত্রী সহ। এখানে, অর্থাৎ কিষ্কিন্ধায় রামের উপস্থিতি
সম্পর্কে রামায়ণে বর্ণিত এক কাহিনি আছে, তবে এখন সে কাহিনি থাক,
পরবর্তী এর থেকে আরও এক উপযুক্ত সময়ে সেই প্রসঙ্গে আসা যাবে। অবশ্য
এ কাহিনি অনেকেরই জানা। মন্দির চত্বর থেকে “তুঙ্গভদ্রার গিরি-বলয়িত
উপকূলের” সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য আবার উপভোগ করলাম (চিত্র-২৩ তুঙ্গভদ্রা
নদী ২,। আমাদের এই পর্বত অভিযানের চলচ্চিত্র দেখুন এই ক্লিপে,
On to Anjania Parbat, Kishkindha)। হরিদ্বারের চণ্ডী পাহাড়েও
অঞ্জনীদেবীর মন্দির দেখেছি, তুলনায় সে মন্দির অনেক বড়। সেই মন্দির
পরিসর থেকে গঙ্গার গতিপথ ও পার্শ্ববর্তী তীরের বিহঙ্গম দৃশ্যও
অতুলনীয়। অঞ্জনীদেবীর মন্দির আছে কিন্তু এখানে হনুমানের জন্ম হয়েছিল
এ কথা বলা হয় না, কিন্তু অন্তত আরও একটি জায়গার কথা জানি যেখানে
অঞ্জনীমাতার মন্দির আছে ও বলা হয় হনুমান ওইখানেই জন্মেছিলেন। ঝাড়খণ্ডে
রাঁচি জেলার পাশেই গুমলা জেলা। গুমলা শহরের কাছে অঞ্জন নামে এক
গ্রাম। সেখানে এক গুহায় অঞ্জনীদেবীর মন্দির রয়েছে এবং বলা হয় সেখানেই
মহাবীর হনুমান জন্মেছিলেন।
চিত্র-২৩ তুঙ্গভদ্রা নদী ২
On to Anjania Parbat, Kishkindha
অঞ্জনিয়া পর্বত থেকে নেমে এসে অল্প দূরেই (প্রায় ১ কিমি.) পম্পা
সরোবরে এসে পৌঁছলাম। এও এক পৌরাণিক স্থান, আসলে বলা উচিত যে পুরাণে
ও রামায়ণে এর উল্লেখ আছে। ভ্রমণ কাহিনির মধ্যে আবার পৌরাণিক কাহিনি
ও রামায়ণ, অনেকেই বিরক্ত হতে পারেন। আমি তাঁদের বলি যে এই অংশ
বাদ দিয়ে এগিয়ে যান।
দণ্ডকারণ্য এখান থেকে বিরাট দূরে নয়। পুরাকালে দনু নামে এক বিরাটকায়
রাক্ষস সেই অরণ্যে বাস করতো এবং রাক্ষসদের যা স্বভাব, অরণ্যবাসী
ঋষিদের বিরক্ত করতো (এখনও তো সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলে আসছে, নয়
কি?)। কিন্তু আজকাল যা হবার সম্ভবনা প্রায় নেই বললেই চলে, এক শক্তিমান
ঋষি, নাম ছিল তাঁর স্থুলশিরা, দনুর দস্যুবৃত্তির শাস্তি প্রদান
করলেন। দনুকে এক কদাকার কবন্ধে রূপান্তরিত করে দিলেন। তারপর যা
হয়, ঋষির দয়ার শরীর, দনুর কাকুতিমিনতিতে গলে গিয়ে বললেন যে রামচন্দ্র
যেদিন তার হাত দুটি কেটে মেরে ফেলে অগ্নিতে দাহ করবেন, সে তার
পূর্বরূপ ফিরে পাবে। এর পর কবন্ধ রূপে দনু তপস্যায় ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট
করে দীর্ঘায়ু বর লাভে বলিয়ান হয়ে ইন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধে মেতে উঠল
কিন্তু পরাজিত হয়ে ইন্দ্রের আক্রমণে তার পদযুগল ও মস্তক (কবন্ধের
মস্তক?) শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে গেল। তাহলে জীবন ধারণ করবে কি
করে? অতএব দয়াপরবশ হয়ে (কেন?) দনুকে যোজন দৈর্ঘ্যের হস্ত যুগল
আর তীক্ষ্ণ দন্ত সহ মুখ উদরে স্থাপন করে দিলেন। ফলস্বরূপ দনু আরও
বলশালী রাক্ষসে পরিণত হলো। যাই হোক যখন রাম, লক্ষ্মণ সহ নাসিকের
কাছে বন থেকে বিভিন্ন জায়গায় সীতার খোঁজে দণ্ডকারণ্যে এলেন, দনু
তাঁদের আক্রমণ করলো। রাম সহজেই তার সেই দীর্ঘ হস্ত যুগল কর্তন
করে দিলেন। দনু বুঝতে পারলো এই তার সুযোগ উদ্ধার হবার। তাকে অগ্নিতে
দাহ করার অনুরোধ করলো রামের কাছে। কিন্তু তার আগে রামের ওই অরণ্যে
আসার কারণ জেনে তাঁকে কাছাকাছি কিষ্কিন্ধায় ঋষ্যমূক পর্বতে পম্পা
নদী তীরে গিয়ে বানর রাজ সুগ্রীবের সাহায্য চাইতে অনুরোধ করলো।
চিত্র-২৪,পম্পা সরোবর
চিত্র-২৫, কিছুকাল আগের পদ্ম-সহ পম্পা
সরোবর, ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া
চিত্র-২৬, পম্পা সরোবরের পাশের সরোবর
এই কাহিনির সত্যাসত্য বিচার করার কোনও প্রয়োজন নেই। যখনই বিচার
করতে চাইবেন যে এমনটি কোনও কালে সত্যই ঘটেছিল কি না, তখনই অনেক
প্রশ্ন এসে পড়বে এবং কাহিনি আনন্দের বদলে নিরানন্দ বহন করে আনবে।
আমরা কি কল্প-কাহিনি পড়ি না? তেমন ভাবেই নিন না এই কাহিনিটি।
ঋষ্যমূক পর্বতে পম্পা সরোবরের তীরে ঋষি মতঙ্গার আশ্রমে শিষ্যা
শবরী পরিচারিকার কাজ করতেন। কোনও কালে সম্ভবত এই সরোবর তুঙ্গভদ্রা
নদীর অংশ ছিল। পম্পা নামেও এই নদীর পরিচিতি আছে। শবরী রামের সাক্ষাতের
জন্যে উতলা ছিলেন। ঋষি মতঙ্গা বলেছিলেন যে তাঁর সেই ঈপ্সিত সাক্ষাৎ
হবেই। ঋষির সমাধি প্রাপ্তির পরও শবরী পম্পা সরোবর তীরে ঋষির আশ্রমে
রামের প্রতীক্ষায় কাল যাপন করতে থাকেন। শেষে তাঁর সেই প্রতীক্ষার
অবসান হলো যখন সীতার খোঁজে দুই ভাই আশ্রমে এলেন দনুর অনুরোধে।
অবশ্য স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস যে শবরীই সীতার খোঁজে বানর রাজ
সুগ্রীবের সাহায্য চাইবার কথা বলেন। যাই হোক এর পর আশা করি আর
কিছু না বললেও চলবে যে কেন এর কাছে অঞ্জাণীয়া বা ঋষ্যমূক পর্বতে
রাম অপেক্ষা করেছিলেন। এর পরে কি ঘটেছিল রামায়ণের সে কাহিনি আমাদের
জানা, নতুন করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
যাঁরা ব্রেক নিয়েছিলেন, এবার তাঁরা মূল কাহিনিতে ফিরে আসতে পারেন।
আমি এবার ভ্রমণে ফিরে এলাম। ব্রেকের আগে আমি আপনাদের বলেছিলাম
যে পম্পা সরোবরে এসে পৌঁছলাম। আসলে ঋষির আশ্রমে এসে পৌঁছলাম। আমাদের
গাড়ি অবশ্য সরোবরের তীরেই এসে থামলো। জানা ছিল এবং ছবিও দেখে ছিলাম
সরোবর পদ্ম গাছে ভরা। কিন্তু এই সরোবরে তো একটাও পদ্ম কেন কোনও
গাছই দেখতে পাচ্ছি না। তবে কি এ পম্পা সরোবর নয়। মনে হলো আশ্রমের
একজন রয়েছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম যে কিছুকাল আগে
প্রতিটি পদ্ম গাছ সমূলে উৎপাটিত করে দেওয়া হয়েছে (চিত্র-২৫, কিছুকাল
আগের পদ্ম-সহ পম্পা সরোবর, ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া)। কারণ?
কোনও উত্তর পেলাম না।
পম্পা সরোবর, পৌরাণিক পঞ্চ সরোবরের অন্যতম। পঞ্চ সরোবরের প্রধান,
অধুনা চীনের অধিকারে তিব্বতে ‘মানস।’ এ ছাড়া গুজরাটের কচ্ছ জেলায়
একেবারে পশ্চিমে ‘নারায়ণ সরোবর,’ গুজরাটেরই আমেদাবাদের কাছে সিদ্ধপুরে
‘বিন্দু সরোবর,’ আর রাজস্থানের আজমিরে ‘পুষ্কর’। এই সরোবরগুলিতে
স্নান নাকি বিরাট পুণ্যের ব্যাপার। তা ছাড়া আমার স্ত্রী ভারতী
ও ভগিনী-সমা গীতার সমুদ্র, নদী বা সরোবর দেখলেই স্নান করতে হবে।
অবশ্য দাক্ষিণাত্য তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়ে চৈতন্যদেবও এই সরোবরে স্নান
করেন। তাই তাঁরা স্নান তো করবেনই। তাঁরা দুজনে স্নানে গেলেন আর
আমি আশপাশ ঘুরে দেখতে আরম্ভ করলাম। প্রায় ৫০সেমি উঁচু ধাপ সহ চারিদিক
বাঁধানো বেশ বড় চতুষ্কোণ সরোবরে পরিষ্কার জল। আর কাউকে স্নান করতে
দেখতে পেলাম না। অবশ্য সরোবরের ধারে অনেক কাপড় শুকাতে দেওয়া রয়েছে।
সেই ধারেই কয়েকটা ঘর রয়েছে, মনে হলো ধর্মশালা। অল্প সংখ্যক মানুষ-জনও
দেখতে পেলাম। দূরে জঙ্গল রয়েছে মনে হলো। সরোবর ডান দিকে রেখে এগিয়ে
যেতে আরও একটা সরোবর দেখতে পেলাম। বাঁধানো নয়, তবে মনে হলো কোনও
কালে হয়তো দুই সরোবর একই ছিল। এই সরোবর ঘিরে রেখেছে প্রচুর গাছ-গাছালি
(চিত্র-২৬, পম্পা সরোবরের পাশের সরোবর)। আর বিপরীত পারে দেখা যাচ্ছে
বিরাট বিরাট বৌল্ডার, হাম্পির বৈশিষ্ট্যের চিহ্ন। মন ভরে দেখতে
ইচ্ছে করে। কিন্তু তার উপায় নেই, সময়ের অভাব। ফিরে এলাম দ্বিতীয়
সরোবরের ধার থেকে। বাঁদিকে বিরাট বিরাট এবং প্রধানত চতুষ্কোণ প্রস্থচ্ছেদ
যুক্ত অনেকগুলো কড়ি বেঁকে-চুরে পড়ে আছে এবং কয়েকটা ভাঙা ঘর দেখা
গেল। পড়েছিলাম এখানে নাকি লক্ষ্মীদেবীর মন্দির ছিল। মনে হলো এই
ভগ্নাবশেষই সেই প্রাচীন লক্ষ্মী মন্দির। ফিরে আসলাম ওইদিক থেকে
বাঁধানো পম্পা সরোবরের দিকে। দেখি ওনারা দুজনে তখনও স্নান করছেন।
ছবি তুলে পম্পা সরোবরের ধার থেকে বাঁদিকে উঁচু চত্বরে উঠলাম। সার
দিয়ে কয়েকটা ঘর, বোধ হয় এখানেই ছিল মতঙ্গা ঋষির আশ্রম, কিন্তু
দেখতে পেলাম দেয়ালে লেখা রয়েছে “শবরী আশ্রম, রামের পাদুকা”। ইংরাজিতে
লেখা “foot print”। বারান্দা পার করে সামনে দেখি গুহার মতো অন্ধকার
ঘর। ভিতরে আর গেলাম না। তার সামনে ছোট্ট এক ঘেরা জায়গায় পাশাপাশি
দুটি পায়ের ছাপের সঙ্গে মিলিয়ে পাথর কাটা। তার ওপর কয়েকটা পয়সা
ফেলা রয়েছে, আর রয়েছে গোটা কয়েক কলকে আর টগর ফুল। কাছাকাছি এক
গেরুয়াধারী ছিলেন, বললেন, এই হলো রামের পাদুকা। বাঃ, দারুণ। ভরত
রামের খড়ম নিয়ে যাবার পর তাহলে নিশ্চয় কোথাও এই পাদুকার ব্যবস্থা
করা হয়েছিল। পয়সাগুলোর আকারের সঙ্গে তুলনা করে নিশ্চিত হওয়া যায়
যে পাদুকা কোনও শিশুর পায়ের মাপের, কোনও যুবকের নয়। ঘেরা জায়গাটা
শিবলিঙ্গের গৌরীপট্টের আকার দেওয়া রয়েছে। বছর তিনেক আগে রামের
আর এক পদচিহ্ন দেখেছিলাম চিত্রকুটে, অনুসুয়া মাতার মন্দির বা আশ্রমের
কাছে মন্দাকিনী নদীর ধারে এক বিরাট পাললিক শিলার চাঙড়ের ওপর। পায়ের
ছাপের মতো বলে সেই দাগ সত্যই মনে হয়, অন্তত সেটা প্রাকৃতিক এবং
প্রাচীন মনে হয়েছিল। এই পাদুকা নিশ্চিতরূপেই মানুষের হাতে ছেনি-হাতুড়ি
দিয়ে কর্তিত। পম্পা সরোবরে আমাদের ভ্রমণের চলচ্চিত্রায়ন দেখুন
ইউটিউবের এই ক্লিপে, “Pampa Sarovar” -
Pampa Sarovar
পম্পা সরোবরের রামায়ণে উল্লেখের কথা ছাড়া ভূতত্ত্বের দৃষ্টিকোণে
এই অঞ্চল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয় এই অঞ্চল পৃথিবীর প্রাচীনতম
ভূস্তরের অন্যতম। স্থানীয় মানুষেরা এই কারণে বলে থাকেন যে এই ভূমি
‘ভূদেবী’, অর্থাৎ পৃথিবীর মায়ের বাড়ি। কাছাকাছি বেশ কিছু শৈলাশ্রয়
ও তার মধ্যে শৈলচিত্রণও পাওয়া গেছে শুনলাম, যদিও তার রক্ষণাবেক্ষণ
করার ব্যবস্থা ও সেগুলো ঠিক মতো দর্শনীয় করে রাখা নেই।
চিত্র-২৭, দুর্গা
চিত্র-২৮, ভক্তের মানসিক - ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া
চিত্র-২৯, নাগ-নাগিনী
ভারতের
বিভিন্ন জায়গায় অনেক দুর্গা মন্দির আছে। এই অঞ্চল, অর্থাৎ হাম্পির
কাছে ‘আনেগুন্ডি’ পর্বত তার ব্যতিক্রম নয়। পম্পা সরোবর থেকে বেরিয়ে
অল্প সময় পরেই এসে গেলাম আবার এক ছোট টিলার পাদদেশে। এখানে কিন্তু
ওপরে ওঠার জন্যে সিঁড়ি নেই। তা বলে সাধারণত টিলা বা পাহাড়ে ওঠার
জন্যে যে রকম পায়ে চলা পথ থাকে বৌল্ডার ও গাছপালার মাঝ দিয়ে, তাও
নেই। রয়েছে অল্প ক্রমোচ্চ পাহাড়ের মসৃণ গা। একটু আগেই বৃষ্টির
কারণে তখনও জলের ধারা সেই মসৃণ গা দিয়ে নিচের দিকে নেমে আসছে কিছু
জায়গা দিয়ে। যদিও জলের পরিমাণ তাতে বেশি ছিল না কিন্তু আমাদের
ভয় হতে লাগলো ওপরে উঠতে। অল্প সময় অপেক্ষা করে হাঁটা আরম্ভ করলাম।
পরের দিকে কয়েকটা নিচু চওড়া সিঁড়ি রয়েছে। কয়েক মিনিটেই পৌঁছে গেলাম
গাছপালা ঘেরা মন্দির পরিসরে। আশ্রমের পরিবেশ। সিংহবাহিনী মূর্তি
ছোট মন্দিরের গর্ভগৃহে (চিত্র-২৭, দুর্গা, 490.jpg)। শিব মন্দিরে
যেমন নন্দি বসে থাকেন, এখানে তেমনই সিংহ বসে আছেন গর্ভগৃহের বাইরে
নাটমঞ্চের মতো ঢাকা বারান্দায়। মন্দিরের সামনে এক অশ্বথগাছে রং-বেরঙ্গের
কাপড়ে বাঁধা কি যেন ঝুলছে অসংখ্য (চিত্র-২৮, ভক্তের মানসিক, ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া)। ভাল ভাবে কাছ
থেকে দেখে বুঝলাম কাপড়ে বাঁধা নারকোল, ভক্তজনের মানসিক। কিছুটা
দূরে বড় এক ঘর, সম্ভবত অনুষ্ঠানের জন্যে। পাশের আরও একটি অশ্বথ
গাছের গোড়ায় গোটা কয়েক পাথরে ‘নাগ-নাগিনী’-র রিলিফ রয়েছে, দেখতে
বেশ ভালই লাগলো (চিত্র-২৯, নাগ-নাগিনী)। এই মন্দির দর্শনের
ভিডিও দেখুন ইউটিউবের এই ক্লিপে, “Durga Temple in Anegundi near
Hampi -