(আগের অংশ) আঞ্জানিয়া
পর্বতের দুর্গা মন্দির দর্শন করতে করতে প্রায় দুপুর একটা বাজল।
তাই ওখান থেকে কোথাও দুপুরের আহার সারার জন্যে যাবার কথা বললাম
সাথীদের। কেমন জানি তাঁরা আমার কথা শুনেও শুনতে পাচ্ছেন না বলে
মনে হলো। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। জনান্তিকে শুনলাম যে এখানে
নাকি ২টো নাগাদ ভোগ বিতরণ হবে, ওনারা তারই আশায় অপেক্ষা করতে চান,
খরচ করে অন্য কোথাও অন্ন গ্রহণ করবেন না। আমি আমাদের গাড়ির চালক,
গঙ্গাধরের কাছ থেকে খবর নিয়ে জানতে পারলাম যে এখান থেকে পরবর্তী
দ্রষ্টব্যে যেতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগবে এবং মাঝে খাবার হোটেল
পাওয়া যাবে। তাই এখানে সময় না ব্যয় করে সকলকে গাড়িতে উঠতে বললাম।
অগত্যা সকলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার কথা শুনতে বাধ্য হলেন, আর গঙ্গাধর
গাড়ি স্টার্ট করে দিল ১টার পরেই।
চিত্র-৩০, হুলিগাম্বিকাদেবী মন্দিরের গোপুরম
গঙ্গাধরের কাছে জানতে পারলাম যে আমাদের আজকের অন্তিম ও দূরতম
গন্তব্য ‘তুঙ্গভদ্রা বাঁধ’ অবশ্য এখান থেকে সোজা যাবে না মাঝে
আমাদের দুপুরের আহারের ব্যবস্থা করিয়ে আর এক দুর্গা মন্দির দেখিয়ে
তারপর বাঁধ দেখাতে নিয়ে যাবে। হসপেট থেকে বাঁধের দূরত্ব প্রায়
১০০কিমি, আর এখান থেকে প্রায় ৫০কিমি।
বিকাল প্রায় ৩টার সময় মুনিরাবাদে হুলিগি নামে এক জায়গায় সিমেন্টের
মেঝে করা বিরাট এক পরিসরে মন্দিরের গোপুরমের কাছে গাড়ি এসে দাঁড়ালো।
চিত্র-৩১, হুলিগাম্বিকাদেবী মন্দিরের সামনে
পরিসরের বাঁ দিকে পরস্পর অনেকগুলো বিভিন্ন জিনিসের দোকান রয়েছে।
দোকানগুলোর মাথায় অনেকটা লম্বা এক হোর্ডিঙে মার্কেটের নাম লেখা
‘....হুলিগাম্বিকাদেবী।’ অর্থাৎ দুর্গা এখানে হুলিগাম্বিকাদেবী
বা হুলিগাম্মা নামে পূজিতা। তামিলনাডুর মন্দিরের শৈলীতে ঘেরা মন্দির
চত্বরের পাঁচিলের মাঝে গোপুরম (চিত্র-৩০, হুলিগাম্বিকাদেবী মন্দিরের
গোপুরম) আর পরিসরের মাঝে মন্দির (চিত্র-৩১, হুলিগাম্বিকাদেবী
মন্দিরের সামনে)। মন্দির কত প্রাচীন বা এর কি ইতিহাস
তা কোথাও থেকে জানতে পারলাম না, তবে এই মন্দির নিশ্চয় বৈশিষ্ট্যতার
দাবী রাখে। দর্শনার্থীদের মধ্যে মুসলিম ভক্তরাও রয়েছেন তা দেখতে
পেলাম ।
চিত্র-৩২, রাস্তার ওপর হুলিগাম্বিকাদেবী মন্দিরের তোরণ
হুলিগাম্বিকা মন্দিরে পৌঁছবার অল্প আগে হুলিগি অঞ্চলে ঢোকার মুখে
চৌমাথা। একদিকে মন্দির তোরণ রাস্তার ওপর (চিত্র-৩২, রাস্তার ওপর
হুলিগাম্বিকাদেবী মন্দিরের তোরণ, 494.jpg)। ইংরাজিতে কিছু লেখা
নেই, লেখা রয়েছে কন্নড় ভাষায়, তবে তোরণের ওপর দক্ষিণভারতীয় রীতিতে
যে সমস্ত মূর্তি গড়া রয়েছে, তার থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে এই তোরণ
কেন এখানে স্থাপিত। এই এলাকায় অনেক দোকান রয়েছে, তার মধ্যে বেশ
কয়েকটা রেস্তোঁরা, এরই মধ্যে যে যার পছন্দমতো জায়গায় ভাত, ইডলি
বা দোসা খাওয়া হলো।
মন্দির দেখে ভারতের আধুনিক মন্দিরের একটি উদাহরণ, “তুঙ্গভদ্রা
বাঁধ” দেখতে যাত্রা শুরু করলাম। প্রাচীন পাঠকেরা বোধ হয় মনে করতে
পারবেন যে স্বাধীনতার কিছু পরে যখন ভারতে নদী বাঁধ প্রকল্প ও তার
সঙ্গে জল-বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করার craze শুরু হয়েছিল,
প্রথম প্রধান মন্ত্রী বলেন যে এগুলই আমাদের মন্দির-মসজিদ-গির্জা-গুরদ্বারা।
আমরা এখানেই আমাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করবো এবার থেকে। যাই হোক, আমি
এত বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন স্থানে তার প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক সম্পদ
দেখে বেড়াচ্ছি, এই নতুন মন্দির ইত্যাদি দেখেছি আঙ্গুলে গোনা কয়েকটি,
তাও একটি আঙ্গুলেই তার সংখ্যা সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। যখন সুযোগ এসেছে
দেখে আসা যাক কৃষ্ণা নদীর শাখা-নদী, ভারতের এক স্বর্ণ-যুগের সাক্ষী,
তুঙ্গভদ্রা নদীর ওপর বাঁধ ও তার সঙ্গে জল-বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র।
চিত্র-৩৩, তুঙ্গভদ্রা-বাঁধ প্রকল্পের গেস্ট-হাউস
মুনিরাবাদের হুলিগির হুলিগাম্বিকা মন্দির পরিসর থেকে বেরিয়ে মিনিট
ত্রিশের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম তুঙ্গভদ্রা-বাঁধ প্রকল্পের ঘেরা জায়গার
পাদদেশে। এখান থেকে হয় প্রকল্পের বাস-এ করে আর নয় পায়ে হেঁটে প্রায়
দুই আড়াই কিমি দূরে যেতে হবে। পথ খুবই ভালো ও বেশ কিছুটা উঁচুতে
উঠতে হবে। যাতায়াত ভাড়া বাসে জন প্রতি ২০টাকা। মুনিরাবাদ থেকে
বেরোবার পর পরই বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছিল, তা এখনও চলছে। বাসের অভাবে
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর বাঁধের view point-এর কাছে এলাম। গাছপালা
ঘেরা সুন্দর বাঁধানো পায়ে চলা রাস্তা বাগানের মধ্যে দিয়ে যেতে
যেতে এই প্রকল্পের গেস্ট হাউস দেখতে পেলাম। বেশ সুন্দর আর বড় দোতলা
বাংলো (চিত্র-৩৩, তুঙ্গভদ্রা-বাঁধ প্রকল্পের গেস্ট-হাউস)।
দুই তলাই কাচের প্যানেল দিয়ে ঘেরা।
চিত্র-৩৪, ভিউ পয়েন্ট
আরও কিছুটা এগিয়ে ভিউ পয়েন্ট-এ পৌঁছলাম (চিত্র-৩৪, ভিউ পয়েন্ট)।
সামনে সমুদ্রসম বাঁধের জলরাশি। বৃষ্টির জন্যে এই জলরাশির বিহঙ্গম
দৃশ্যের সুন্দরতা মনে হলো আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যারেজের মাঝামাঝি
অনেকগুলো স্লুইস গেট খোলা। তীব্র বেগে সেগুলো থেকে জলরাশি নিচে
নেমে তুঙ্গভদ্রার ধারারূপে এগিয়ে যাচ্ছে। নিচে দেখতে পেলাম জল-বিদ্যুৎ
উৎপাদন কেন্দ্রের বাড়ি। সব মিলিয়ে মানুষ আর প্রকৃতির এই যে মিলিত
শিল্প, মনে এক অনির্বচনীয় প্রশান্তি এনে দিলো। তবে এই অপরূপ দৃশ্য
বেশিক্ষণ উপভোগ করতে পারলাম না। বৃষ্টির কারণে অন্ধকার হয়েই আসছিল।
প্রায় ১০০কিমি পথ পার করে হোটেলে ফিরতে হবে। তাই নিচে নেমে যাবার
জন্যে বাসের স্ট্যান্ডে চলে এলাম। এসে দেখলাম বাসে আর জায়গা নেই,
আগের ক্ষেপে যে সকল ভ্রমনার্থী এসেছিলো, তারা বাসের দখল নিয়ে নিয়েছে।
আমদের আসবার সময়ে কন্ডাক্টর বলে দিয়েছিলো যে আমরা যেন ১৫মিনিটের
মধ্যে স্ট্যান্ডে ফিরে আসি। তাহলে কি ওদের তা বলে দেওয়া হয়নি?
এই প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে আমাদের জন্যে জবাব হলো, “অগলি ব্স মে আপ
আইয়ে।” তা হলে তো আরও সময় আমরা ভিউ পয়েন্ট-এ থাকতে পারতাম? কি
আর করা, পরের বাসে প্রায় ৩০মিনিট পরে আমরা নিচে নামতে পারলাম।
তার পর সোজা হোটেলে ফেরা হলো রাত ৮টা নাগাদ।
চিত্র-৩৫, পম্পাপতি মন্দিরের গোপুরম
হাম্পিতে আমাদের তৃতীয় ও শেষ দিন অগাস্ট ২৯, ২০১৪ শুরু হলো সকাল
পৌনে আটটায় পম্পাপতি বা বিরূপাক্ষ মন্দির দর্শনে আসা থেকে। মন্দিরের
অবস্থান হাম্পির বাজার এলাকায়, অস্থায়ী দোকান-পাট, ঠেলা গাড়ি,
গুমটি ইত্যাদি প্রচুর রয়েছে, যার মধ্যে জল-খাবার, ফল ইত্যাদি প্রধানত
বিক্রি হচ্ছে। তবে আমার মনে হলো প্রাচীন বাজারের ভগ্নাবশেষ রয়েছে
অনেক জায়গা নিয়ে। এবং এই বাজারের নামেই এলাকা পরিচিত। এর আগে ভিঠঠল
দেবের মন্দিরের সামনে যেমন দেখেছিলাম, তার থেকে এই পরিত্যক্ত বাজারের
বিস্তার অনেক বেশি। স্থাপত্য শিল্পের বিচারে ভিঠঠল দেবের মন্দিরের
স্থান যত উচ্চেই হোক না কেন, ধার্মিক দিক থেকে এই মন্দিরের খ্যাতি
অনেক বেশি। এখানে প্রধান বিগ্রহ বা দেবতা পম্পাপতি বা বিরূপাক্ষ
নামে পরিচিত এবং হাম্পির কয়েকটি মাত্র মন্দিরের অন্যতম যেখানে
দেবতা এখনো পূজা পেয়ে থাকেন। এই মন্দির ভিঠঠল দেবের মন্দিরের থেকে
প্রাচীনতর। এর কিছু অংশ সম্ভবত দ্বিতীয় হরিহর-র রাজত্বের সময়ে
(১৩৭৭-১৪০৪ খ্রিষ্টাব্দে) নির্মিত হয়েছিল। প্রাকার বেষ্টিত পরিসরে
অনেকগুলি মন্দির আছে যা বিভিন্ন সময়ে নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে
সম্ভবত প্রাচীনতম দুটি মন্দির, ‘পার্বতী’ ও ‘ভুবনেশ্বরী,’ গঠন
শৈলী অনুসারে মনে হয় দ্বাদশ শতাব্দীতে, অর্থাৎ আরও আগে নির্মিত।
যদিও বেশ কিছু মন্দির চালুক্য এবং হোয়সালা রাজত্বকালে নির্মাণ
হয় কিন্তু বেশির ভাগ অংশই বিজয়নগর সাম্রাজ্যকালেই বিশেষ করে ১৫১০
খ্রিষ্টাব্দের আশপাশে কৃষ্ণদেবরায়ের প্রথম দিকের রাজত্বকালেই সম্পূর্ণ
নির্মিত হয়ে যায়।
চিত্র-৩৬, গোপুরমের ভাস্কর্য ১
গাড়ি থেকে বাজার এলাকায় প্রবেশ করার মুখেই নেমে পড়ে বৃষ্টির কারণে
কর্দমাক্ত কিন্তু প্রশস্ত রাস্তা ধরে প্রায় ৫২মিটার উচ্চ বিরাট
পূর্ব প্রবেশদ্বার বা গোপুরমের সামনে এসে গেলাম (চিত্র-৩৫, পম্পাপতি
মন্দিরের গোপুরম) সকাল ৮টার পরেই। নিচের দুই তলা গ্রানাইটের
আর তার ওপরের গঠন ইঁটের, ভিঠঠল দেব মন্দিরের গোপুরমের মতোই। এই
গোপুরমের নির্মাণকাল ধারণা করা হয় দ্বিতীয় দেবরায়ের রাজত্বকালে
(খ্রিষ্টাব্দ ১৪২২-৪৬), যদিও নির্মাণকারী হিসাবে ওনার এক কর্মচারী
(সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী) প্রলুগান্তি টিপ্পার নাম করা হয়। সকাল
থেকেই বৃষ্টি ঝির-ঝির করে পড়েই যাচ্ছিল, আমরা গোপুরমের কাছে পৌঁছবার
সঙ্গে সঙ্গেই মুষলধারে এসে আমাদের স্বাগত জানালো। তাড়াতাড়ি করে
গোপুরমের প্রকাণ্ড দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে ছাদের তলায় দাঁড়ালাম।
আসার পথেই ভিডিও তুলেছিলাম, তার থেকেই গ্র্যাব করে কিছুটা ওপর
দিকে গোপুরমের গায়ের ভাস্কর্যের দুটি উদাহরণ (চিত্র-৩৬, গোপুরমের
ভাস্কর্য ১ ও চিত্র-৩৭,
গোপুরমের ভাস্কর্য ২) এখানে
দেখাচ্ছি।
চিত্র-৩৭, গোপুরমের ভাস্কর্য ২
ভাস্কর্যের উৎকর্ষতা প্রশ্নাতীত। তবে আমার দুঃখ হলো এগুলো এবং
সামগ্রিকভাবে সমস্ত edifice-গুলোর রক্ষণাবেক্ষণের অভাব দেখে। এর
আগেও অবশ্য আমি এ বিষয়ে কিছু কথা বলেছি। এখানকার পরিস্থিতির সঙ্গে
আবার তুলনা করতে বাধ্য হচ্ছি যে এই সমস্ত মন্দির ইত্যাদির প্রায়
৫০০ বছর পূর্বে নির্মিত খাজুরাহোর মন্দিররাজির রক্ষণাবেক্ষণের।
আমি অবশ্য বেশ কয়েকবছর আগে সেখানে গিয়েছিলাম, তবে আমি নিশ্চিত
যে এর মধ্যে যদি পরিস্থিতি পাল্টে যায়, তাহলেও এখানকার মত মানে
তা নামতে পারবে না। পম্পাপতি মন্দিরের পরিসর অপরিষ্কার হবার একটা
ওজর হয়তো দেওয়া যেতে পারে যে এই মন্দিরে এখনও পম্পাপতি অর্থাৎ
শিবের আরাধনা করা হয়ে থাকে, তাই ভক্তের সমাবেশ এখানে অনেক বেশি।
তবে সেক্ষেত্রেও বলা যায় খাজুরাহোর “চৌঁষট যোগিনী” বা “মাতঙ্গেশ্বর”
মন্দিরেও শিব এখনও পূজা পেয়ে থাকেন, অথচ মন্দির চত্বর ঝকঝকে রয়েছে।
যাই হোক অপরিষ্কার চত্বর ছাড়া মন্দিরের মধ্যে বা দেয়ালে (চিত্র-৩৮,
মন্দিরের দেয়ালে ভাস্কর্য, Virupaksha Mandir Wall Carving.jpg)
এবং গোপুরমের গায়ে ভাস্কর্যগুলোর রং শ্যাওলার পরতে কালো হয়ে গেছে,
তা কি করে মানা যেতে পারে?
চিত্র-৩৮, মন্দিরের দেয়ালে ভাস্কর্য
অনেক হলো সমালোচনা, এবার চলুন পরিসরের মধ্যে এগোই। সম্ভবত বৃষ্টির
কারণে এখানে কোনও গাইডের উপস্থিতি চোখে পড়লো না। অবশ্য তাদের কাউকে
দেখতে পেলেও তাদের গাইডেন্সের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে পারা যেত
না বৃষ্টি ও আমাদের সময়াভাবের জন্যে। গোপুরমের নিচে থেকেই দেখলাম
সামনে বিরাট পরিসরের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক সৌধ রয়েছে। বৃষ্টিকে
অভিশাপ দিতে দিতে দৌড়ে আমরা সামনের মণ্ডপে ঢুকে পড়লাম। চত্বরের
মাঝেই সোনালি রঙের সুউচ্চ এক দণ্ডের পাশ দিয়েই দৌড়ে গেলাম। হয়তো
রং নয়, সোনার পাতে মোড়াও হতে পারে। দণ্ডের শীর্ষ বিশেষ কারুকার্য
করা। সম্ভবত দীপ জ্বালাবার জন্যে ব্যবহার হয়ে থাকে। ভাষায় বর্ণনা
করে বোঝানোর চেষ্টা করছি না। গোপুরমের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতে
যে ভিডিও তুলেছিলাম, তাতে এই দণ্ড দেখিয়েছি। এই ভিডিওতে এর গঠন
বেশি ভাল বুঝতে পারবেন। প্রধান মন্দির বলে যেটা মনে হলো তার দেয়ালে
প্রচুর ভাস্কর্য রয়েছে। দৌড়ে যে মণ্ডপে ঢুকলাম, শুনলাম সেটাই মহা-মণ্ডপ
বা রঙ্গ-মণ্ডপ। বুঝতে পারলাম আমি এই মণ্ডপকেই না জেনে প্রধান মন্দির
ভেবে নিয়েছিলাম ঠিকই। এই রঙ্গ-মণ্ডপ এই মন্দিরের নবতম সংযোজন,
১৫১০ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণদেবরায় কর্তৃক নির্মিত। মণ্ডপের অলঙ্করণ
অতি সুন্দর তথা সূক্ষ্ম, বিজয়নগর গঠন শৈলীর চূড়ান্ত উদাহরণ। মণ্ডপটি
বেশ বিরাট, স্বাভাবিক ভাবে ছাদ ধরে রাখবার জন্যে অনেকগুলি স্তম্ভ
আছে। সেই সমস্ত স্তম্ভ বিভিন্ন আকারের মিশ্রণে গঠিত। ভিডিওতে তা
বেশ ভালই বোঝা যায়। মণ্ডপের সিলিং-এ দেখতে পেলাম অসংখ্য ছবি। বাইরে
বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে, তাই মণ্ডপের ভিতর খুবই অন্ধকার। ছবিগুলো
সেই অন্ধকারে মায়াবী রূপ ধারণ করেছে। অন্ধকারে এগুলো আঁকা, না
সিলিং-এ উৎকীর্ণ রিলিফ বা ডায়োরামা বোঝা যাচ্ছিল না। ভিডিও থেকে
একটা গ্র্যাব করা ছবি দেখাই (চিত্র-৩৯, মণ্ডপের সিলিং-এ, Virupaksha
Mandir Inside Carving.jpg)। গাইডের অভাব বেশ অনুভব করছিলাম। অসংখ্য
ছবির মধ্যে কোনগুলো দেখবো বুঝতে পারছিলাম না। পরে জানতে পেরেছিলাম
যে এই মণ্ডপে বিজয়নগর শৈলীর এক বিখ্যাত ছবিই দেখিনি। এই ছবিতে
কি আছে বলার আগে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের স্থাপন কালের ইতিহাস সম্পর্কে
দু-চার কথা মনে করতে হবে।
চতুর্দশ শতাব্দীতে(১৩৩৬ খ্রি.) সংগমের দুই পুত্র, প্রথম হরিহর
(হুক্কা) ও বুক্কা রায়া (বুক্কা) আদি গুরু শঙ্করাচার্যের স্থাপিত
শৃঙ্গেরী মঠের গুরু বিদ্যারণ্যের নির্দেশ ও প্রভাব মান্য করে এই
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। গুরুর প্রভাব শুধু এই দুই
ভাইএর ওপরই সম্পূর্ণরূপে প্রতিফলিত ছিল তাই নয়, প্রায় ২০০ বছর
ধরে এই সাম্রাজ্যের প্রত্যেক রাজার ওপরই বিস্তারিত ছিল। তাই ১৫১০
খ্রিষ্টাব্দেও কৃষ্ণদেবরায় এই রঙ্গ-মণ্ডপে একটি ছবিতে (সম্ভবত
ডায়োরামা) পরিব্রাজক রূপে গুরু বিদ্যারণ্যকে দেখিয়েছেন। এই ছবিটি
আমি হয়তো দেখেছি কিন্তু বুঝতে পারিনি। উল্লেখ করার মতো ব্যাপার
যে মণ্ডপের এই ছবিগুলো এখনও ভাল অবস্থাতেই আছে।