আমার বন্ধু
লিকি (১) (২) (৩)
[আজ থেকে
প্রায় পঁয়ষট্টি বছর আগে কোলকাতায় যখন বড়ো হচ্ছি তখন এক চমত্কার
বই হাতে আসে। বইটির নাম "আমার বন্ধু লিকি", লেখক জে.বি.এস
হ্যালডেন, অনুবাদকের নাম মনে নেই। সিগনেট প্রেস তখন বাংলা বই
ছাপার জগতে ভেল্কি দেখাচ্ছেন, তাঁদেরই প্রকাশন। যেমন মজার গল্প,
তেমনি ঝরঝরে অনুবাদ আর সিগনেটের অলঙ্করণ সম্বন্ধে তো বলার কিছু
নেই। সদ্য দশ পেরোনো ভূতে-পাওয়া এক বালকের কাছে সে বইতে ছিলো
স্বর্গপুরীর খবর। তারপর এবাড়ী সেবাড়ী বদল করতে করতে অন্য সব
গেরেম্ভারী বইয়ের চাপে পড়ে সে বই কবে হারিয়ে গেছে। পরে যখন মনে
পড়েছে তখন এদিক ওদিক বইটা খুঁজেছি কিন্তু পাই নি।
বইটি ছিলো
হ্যালডেন সায়েবের ১৯৩৭ সালে লেখা বই My Friend Leaky-র বঙ্গানুবাদ।
ইন্টারনেটের কৃপায় সম্প্রতি ইংরেজী বইটিকে ডাউনলোড করা গেছে।
পড়তে পড়তে বারবার মনে পড়লো ছোটোবেলায় বইটা পড়ে কী মজা পেয়েছিলাম।
ভাবলাম আজ বৈদ্যুতিন যুগের কিশোর-কিশোরী চিন্তা ভাবনায় তখন আমরা
যা ছিলাম তার থেকে অনেক এগিয়ে এসেছে বটে, কিন্তু নিছক যাদুকরের
সহজ কল্প-গল্প কি তাদের পৃথিবী থেকে একেবারে হারিয়ে গেছে? মন
বলে বোধহয় না, তাই যাচাই করার জন্য এই অনুবাদ করে ফেললাম।
জন বার্ডন
স্যান্ডারসন হ্যালডেন, জে.বি.এস হ্যালডেন ১৮৯২ সালে অক্সফোর্ডে
জন্মেছিলেন, বাবা ছিলেন ফিজিওলজিস্ট। তাঁর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা
পেয়ে হ্যালডেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী হয়েছিলেন, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি
আর জেনেটিক্সে। যদিও তাঁকে নির্দ্বিধায় বহুবিদ্যাবিশারদ বলা
যায়। পড়িয়েছেন, গবেষণা করেছেন, জ্ঞানগর্ভ বইপত্র লিখেছেন অনেক।
সাহিত্যানুরাগী ছিলেন, সত্যের খাতিরে রূঢ়ভাষী হতে পারতেন। ব্রিটিশ
ও ফরাসীদের সুয়েজ আক্রমণের প্রতিবাদে ১৯৫৭ সালে তিনি ভারতে চলে
আসেন, এখানকার নাগরিক হন ও ইণ্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্স্টিটিউটে
পড়াতে আরম্ভ করেন। ১৯৬৪ সালে তাঁর ভারতেই মৃত্যু হয়। যদিও বিজ্ঞান,
দর্শন ইত্যাদির ওপর তাঁর অনেক বই আছে, কিশোর-কিশোরীদের জন্য
তাঁর রচনা এই একটিই।]
সুমিত
রায়
নিউ জার্সি, এপ্রিল ১৫, ২০১৪
বয়েস তো তিনকুড়ি দশ হতে চললো,
তার মধ্যে কি কম ভোজ খেলাম রে ভাই। সেই কবে থেকে তো খেয়ে আসছি,
কতোরকমের ভোজ, কতো জায়গায় ভোজ, কতো লোকের সঙ্গে মিলেমিশে খাওয়া
ভোজ, রান্নার কতো বাহারওলা ভোজ। কয়লা খনিতে খেলাম, মস্কোয় হাড়কাঁপানো
শীতে ডানহাতের ব্যবস্থা করা হোলো, তাতে গেলাম, কোটিপতি বন্ধুর
বাড়ীতে ছাদে চব্বচোষ্য খ্যাঁটনের ডাক পেয়ে গিয়ে সাঁটিয়ে এলাম।
এ সমস্ত ভোজের কথাই ফলাও করে লেখা যায়, তাতে রান্নার নানা পদের
বর্ণনা শুনে তোমাদের সবার জিভের জলে বন্যা বয়ে যাবে, কিন্তু সে
তো হবে রান্নার বই, তাতে কি আর গল্পের মজা পাওয়া যায়? তার চেয়ে
বরং অনেক বছর আগে এক সন্ধ্যায় আমার এক যাদুকর বন্ধুর সঙ্গে ডিনার
খেয়েছিলাম, তার গল্প বলি। সেখানে অনেক মজার ব্যাপার ঘটেছিলো, সেগুলোই
আসল, খাওয়াটা তেমন কিছু আহামরি নয়। তার কারণটা কী জানো? ওই যে
বললাম ওই যে আমার বন্ধু, যাঁর বাড়ীতে আমার নেমন্তন্ন ছিলো, আমার
সেই বন্ধু ছিলেন এক জাত ম্যাজিশিয়ান, যাদুকর। ইনি কিন্তু তোমাদের
ওই হাতসাফায়ের ভেল্কি-দেখানো যাদুকর নন্, ইনি একেবারে খাঁটি
ব্যাপার, সংস্কৃতে এঁদের ঐন্দ্রজালিক বলে গালভারী নামে ডাকা হয়।
আরে যাঁরা হাতসাফাই করেন, টুপি থেকে খরগোস বার করেন, রুমালকে পাখি
বানান, মানুষ কেটে ফেলে আবার বাঁচিয়ে তোলেন, তাঁদের কোনো কেরামতি
নেই, আমি কি তাই বলেছি? তবে সত্যি সত্যিই তো আর রুমাল পাখি হচ্ছে
না, মানুষও কাটা পড়ছে না, তাই এসব খেলায় পরিশ্রমটা কম, তাই এঁরা
রোজ তিনটে করে শো করতে পারেন, করেনও। এদিকে আমার বন্ধু যেমন ম্যাজিক
বানান তাতে যদি একটা ছাগলকে ধরে প্যাঁচা করে দেন তাহলে ছাগল উবে
গিয়ে ওই প্যাঁচাটাই শেষ পর্যন্ত থেকে যাবে। অবশ্য আবার যদি বদলে
না দেন। সবসময়ে সেটা আবার সম্ভব নাও হতে পারে। এই দেখো, কথার ঝোঁকে
ডিনারের খাবারটা আহামরি নয় বলে ফেলেছিলাম, সেটা কিন্তু ঠিক নয়।
গল্পটা শোনার পর সে তোমরা ঠিক কোরো'খন, আমি এখন গল্পটা শুরু করি।
আমার এই যাদুকর বন্ধুর নাম
মিস্টার কিছু-একটা লিকি। ওই কিছু-একটা নামটা আমাকে কোনোদিন তিনি
খুলে বলেননি, এমনকি ডাকনামটাও নয়। তার একটা ভারী গূঢ় কারণ আছে,
আমি পরে জানতে পেরেছিলাম, সময়মতো বলবো। তবে মিস্টার-ফিস্টার বাদ
দিয়ে শুধু লিকি বলে ডাকতে অনুমতি দিয়েছিলেন। যাইহোক এই লিকির সঙ্গে
আমার পরিচয় কিন্তু একটু অদ্ভুতভাবে। না, না ম্যাজিকের কোনো ব্যাপার
নেই তার মধ্যে। ব্যাপারটা হোলো এইরকম। অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন
লণ্ডন শহরে থেকে পড়াশুনো করি, কয়েকবছর বিদেশে থাকা হয়ে গেছে। জানুয়ারি
মাস, সেদিন সন্ধ্যে হবো হবো, দুপুর থেকে অল্পস্বল্প বরফ পড়ছে,
রাস্তাঘাট বেশ পেছল। হেমার্কেটে রাস্তা পার হবার জন্য পা বাড়িয়েছি,
হঠাত্ রাস্তা পার হবার আলোটা সবুজ থেকে লাল হয়ে গেলো। আমি একটু
টলমল করে আবার ফুটপাথেই দাঁড়িয়ে পড়েছি। এদিকে আমার পাশে যে লোকটি
আসছিলো সে বোধহয় হাঁ করে দোকানের জানলা দেখতে দেখতে আসছিলো, সে
এই ট্র্যাফিক লাইট বদলানোটা খেয়াল করেনি, হুড়মুড় করে ফুটপাথ থেকে
রাস্তায় নেমে পড়েছে। আর ঠিক তখনই ওদিক থেকে একটা দৈত্যের মতো দোতলা
বাস গাঁক গাঁক করে আসছে। আমি যদি লোকটির নড়া ধরে টান দিয়ে ঠিকসময়ে
ফুটপাথে না তুলে আনতাম তাহলে আমার লিকি সায়েবকে সত্যি সত্যি ছ্যাঁদা-(এবং-চ্যাপ্টা-)সায়েব
হয়ে ভবের ম্যাজিক খেলা শেষ করতে হোতো।
দম ফেরত্ আসার পর দেখি
যার প্রাণ বাঁচালাম সে এক বেঁটেখাটো রোগাসোগা লোক। উস্কোখুস্কো
চুল, গালে দুতিনদিনের দাড়ি। অতি সাধারণ চেহারা, চোখে পড়ার মতো
কোনো ফিচারই নেই। না ভুল বললাম, কানদুটো বেশ বড়ো বড়ো, আবার প্রতিটির
ডগায় ঝোপের মতো একগুছি করে চুল। বয়েসটা ঠিক বোঝা গেলো না, মাঝবয়েসী
হতে পারে। তার অবস্থা তখন খুবই খারাপ, ভয়ে রঙ সাদা হয়ে গেছে, কাঁপছে
ঠকঠক করে, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না। তা তাকে তো আর সেখানে ফেলে
রেখে আসতে পারিনে, সে হয়তো ওখানেই আবার রাস্তায় মূর্চ্ছা যাবে,
গিয়ে আবার গাড়ী চাপা পড়বে। যাইহোক, তার হাত ধরে আস্তে আস্তে রাস্তা
পার করে পায়ে পায়ে বাড়ীতে পৌঁছে দিলাম, বেশী দূরে যেতে হোলো না।
যেতে যেতেই নাম জানলাম লিকি, আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তার বাড়ীর
দরজায় পৌঁছে গেলাম। তারপর লিকির ধন্যবাদ দেওয়া আর শেষ হয় না, যতো
ভাবি এইবার বিদায় নেওয়া যাবে, লিকি আবার ফিরে এসে আমার হাত ধরে
উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। আমি না থাকলে যে কী হোতো তা চিন্তার বাইরে,
আমি নিশ্চয় স্বর্গের দেবদূত, সারাজীবন তিনি আমার দাস হয়ে থাকবেন,
ইত্যাদি সব নাটুকে কথা। আমি যদি এতো কাছে এসে তার বাড়ীতে পায়ের
ধুলো না দিই, যদি একটু মিষ্টিমুখ না করে যাই তাহলে তিনি কী করে
সমাজে মুখ দেখাবেন-- একেবারে নাছোড়বান্দা। আমার আবার তখন টিউশনিতে
দেরী হয়ে যাচ্ছে তাই পরের বুধবার ডিনারে আসবো বলে ছাড়ান পেলাম।
বুধবারে যথাসময়ে নেমন্তন্ন
খেতে উপস্থিত হলাম। লিকির বাড়ীটা বাইরে থেকে আশপাশের সব বাড়ীর
মতোই সাধারণ, কেবল দরজায় একটু বেশী কারুকার্য করা। টোকা দিতে আপনিই
সে দরজা খুলে গেলো। ভেতরে ঢুকে দেখি ঘরটি বড়ো মাপের আর সাধারণ
বসবার ঘর যেমন হয় তার থেকে বেশ অন্যরকম। প্রথম তো হোলো সব দেয়ালের
সামনে সুন্দর পর্দা ঝুলছে, সব পর্দায় সেলায়ের কাজ করা চমত্কার
ছবি-- গাছপালা, ফুলফল, মানুষ আর জন্তুর। যেমন একটা ছবিতে দেখাচ্ছে
দুটো লোক একটা বাড়ী তৈরী করছে, আর একটা ছবিতে বন্দুক হাতে একটা
লোক আর তার কুকুর, দেখে মনে হয় শিকারে যাচ্ছে। ছবিগুলো যে সেলায়ের
কাজ, আমি তা ধরে দেখেছি। ছবিগুলো কিন্তু থেকে থেকেই বদলে যাচ্ছে,
এটাই হোলো আশ্চর্যের কথা। যতক্ষণ আমি তাকিয়ে আছি ততক্ষণ নয়, কিন্তু
নজর ফেরালেই দেখি সিনটা একটু বদলেছে। ডিনার শেষ করে বাড়ী ফেরার
সময় দেখি সব মিলে রাজমিস্ত্রীরা বাড়ী তৈরী করে চলে গেছে আর শিকারীর
হাতে দুটো মরা পাখী, কুকুর পায়ের কাছে ঘুমোচ্ছে। আসবাবপত্তরও কেমন
একটু কিম্ভূত ধরণের। একটা কাঁচের বুককেস ভর্তি চামড়াবাঁধানো এক
থেকে দেড়ফুট মোটা বিশালকায় সব বই। দুটো টেবিল, তার একটার ওপর ইকড়ি
মিকড়ি কাটা বিরাট এক গ্লোব আর অন্যটা হোলো অন্তত দুডজন লোকের বসে
খাবার মতন মাপের ডাইনিং টেবিল, চেয়ারগুলোয় বাহারী পুরু পুরু গদি
আঁটা। ছাত থেকে নানারকমের খেলনার মতো কী সব আর অনেক টবের গাছপালা
ঝুলছে, সে সবের মধ্যে কোথা থেকে খুব নরম আলো বেরোচ্ছে। সত্যি কথা
বলতে কী আমার একটু গা ছমছম করছিলো, নেমন্তন্ন খেতে এ কোথায় এসে
পড়লাম রে বাপু!
বেশীক্ষণ নার্ভাস হয়ে থাকতে
হোলো না, কখন দেখি আমার অজান্তেই মিঃ লিকি আমার পাশে উপস্থিত।
আজ দেখি দিব্বি সাফসুতরো, কেতাদুরস্ত ইভনিং ড্রেস পরেছে, চুলটুল
সব পাট করে আঁচড়ানো। কানদুটো আরো বড়ো দেখাচ্ছে আর কানের চুলও কামায়নি।
তা সবই যে আমার মনোমতো হতে হবে তেমন তো কোনো কথা নেই।
"আরে, আসুন, আসুন। আমার
কী সৌভাগ্য যে আমার প্রাণদাতা আমার ঘরে এসে আমাকে ধন্য করলেন,"
বলে লিকি শুরু করলেন।
আমি ভাবলাম, এই মোলো রে,
নাটক শুরু হোলো আবার । আমি বললাম, "মিঃ লিকি আমি তেমন আহামরি
কিছু করিনি, যা করেছি, আপনি হলেও তাই করতেন।"
লিকি বললেন, "বুঝলেন
না, এই গাড়ীঘোড়া ভীড়ভাট্টার ব্যাপারটা আমি এতদিনেও সামলে উঠতে
পারলাম না। আমার কাজের ঝামেলা না থাকলে আমি কবে একটা নির্জন দ্বীপে
গিয়ে বাসা বাঁধতাম।"
এমন সুযোগ ছাড়া যায় না, কথা
অন্যদিকে মোড় নেবার আগেই আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "মিঃ লিকি,
আপনি কী কাজ করেন?"
লিকি বললেন, "আমি, এ,
এ, আমি হলাম এক ম্যাজিশিয়ান, খাঁটি উইজার্ড, বাংলায় মায়াবী বলতে
পারেন। আমাকে এদিক ওদিক অনেক কাজ করতে হয়, তাদের মধ্যে একটা হোলো
এখানকার এই হট্টমেলায় ছোটোখাটো পুলিশি করা। বেশী নয়, খুবই সামান্য,
এই একটু নজর রাখা যে এই চত্বরের দুষ্টু লোকদের হাতে এখানকার ভালো
মানুষগুলোকে যেন খুব একটা জেরবার না হয়। অবশ্যই আইন-টাইন বাঁচিয়ে।
সাবধানে এসব কাজ করতে হয়, আমাদের অস্তিত্ব প্রকাশ হয়ে গেলে কাজের
অসুবিধে হবে। আর আমকে মিস্টার বলতে হবে না, শুধু লিকি বললেই চলবে।
আমি জানি আপনি মানুষটি ভালো, পেটেও কথা থাকে, আমার সঙ্গে জমবে
ভালো।"
তাই বলো, এতক্ষণে ঘর আর পর্দার
রহস্য খানিকটা বোঝা গেলো। আর একজন আসল উইজার্ডের সঙ্গে বন্ধুত্ব
করা, ওরে বাবা, আমি তো হাতে চাঁদ পেলাম।
লিকি বললেন, "কী খেতে
ইচ্ছে করছে? যা মন চায় বলুন।"
মোড়ের রেস্টুরেন্ট থেকে আসবে
আর কি। কী বলি, বললাম, "যা তৈরী আছে"।
লিকি বললেন, " সুপ দিয়ে
আরম্ভ করুন।"
ঠিক আছে, দুজনেই এই খেলা
খেলতে পারে। আমি বললাম, "মুলুকদানী।" এটা দক্ষিণ ভারতীয়
সুপ, লণ্ডনে পাওয়া যেতো ঠিকই, তবে খুঁজতে হোতো।
লিকির কোনো ভাবান্তর দেখা
গেলো না, তিনি বললেন, "বেশ আমি তার ব্যবস্থা করছি।"
তারপর বললেন, "দেখুন, আমি সাধারণত যেমনভাবে খাই তেমনভাবে
আপনাকে আপ্যায়ন করলে আপত্তি নেই তো? আপনি কি চট করে ভয় পেয়ে যান?"
"নিশ্চয় করবেন। আর না,
আমি চট করে ভয় পাই না", আমি বললাম।
"তাহলে
আমার খানসামাকে ডাকি, সে সব ঠিকঠাক করুক", বলে লিকি তাঁর
কানের ওপরকার ঝুঁটি ধরে টান দিতে, চটাপট হাততালির মতো আওয়াজ হোলো,
যদিও খুব নরম। ঘরের কোণে একটা প্রমাণ সাইজের তামার জালা ছিলো,
লিকির কানতালি শুনে দেখি সেখান দিয়ে সড়াত্ করে একটা জলে-ভেজা
সাপ মুণ্ডু বার করলো। আমি আঁত্কে ওঠার আগেই দেখি আরেকটা সাপ
বেরিয়ে হুকে ঝোলা তোয়ালে নিয়ে প্রথমটার গা মুছিয়ে দিলো। তারপর
আবার একটা সাপ বেরোলো, আবার গা মুছলো, আবার একটা, আবার একটা, এভাবে
আটটা সাপ বার হবার পর একটা বিরাট ছালার মতো প্রাণীটি বার হবার
পর বোঝা গেলো ওগুলো সাপ নয় ওটা একটাই প্রাণী। ওটা একটি অক্টোপাস।
অক্টোপাসেরা খুব বড়ো হতে পারে, তা নিয়ে অনেক গল্পকথা চালু আছে,
সে তুলনায় হয়তো তেমন কিছু না, তবে আমি এতো বড়ো অক্টোপাস আগে দেখিনি,
পরেও দেখবো বলে মনে হয় না।
লিকি বললেন, "এই হোলো
অলিভার, আমার খানসামা। আটটা হাত দেখেই বুঝতে পারছেন যে মানুষ খানসামার
থেকে অলিভার অন্তত দুগুণ ভালো। প্রতিটি হাতে, বা পায়ে, বা শুঁড়ে,
যাই বলুন, জোরও বেশী আর দশটা করে শোষক, sucker, থাকার জন্য কখনো
কিছু পড়ে ভেঙে যাবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আর ওয়েটার হিসেবে
তো ওর তুলনা নেই, খাবার দেওয়া, প্লেট তুলে নেওয়া, এ সব কাজ ও ছাত
থেকে ঝুলে ঝুলে করে নিতে পারে, কাজেই ওকে আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে
ঘাড়ে ফোঁস্ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে গোঁত্তা খেয়ে আপনার কোটে ঝোল
ফেলে খাবার পরিবেশন করতে হয় না। আসলে কী জানেন, ও যখন মানুষ ছিলো
তখন ও ওয়েটারের চাকরীই করতো। ট্রেনে পা কাটা পড়ে মরতে বসেছিলো,
আমিই তখন ওকে বাঁচাই। পা জোড়া দিতে পারলাম না, কলকব্জা ঘটিত ব্যাপারে
আমার ম্যাজিক সবসময়ে খাটে না। তাই শামুক বানিয়ে পকেটে করে বাড়ী
নিয়ে এলাম, যদি কিছু করা যায়। কিন্তু মুস্কিল হোলো যে তারপর কী
করি? যাই করে দিই না কেন তাতেই তো খোঁড়া হয়ে বসে থাকবে। তখন এই
অক্টোপাস করে দিলাম, অবশ্য অলিভারই বুদ্ধিটা দিয়েছিলো। এখন বেশ
ফুর্তিতে আছে, ওকে জিজ্ঞেস করে দেখুন।
"এই দেখো, একবার বকতে
আরম্ভ করলে আর থামতে পারিনা, আপনাকে পানীয় কী দেবো? লেমনেড আছে,
কোক আছে, বিয়ার আছে, লাল-শাদা ওয়াইন আছে। যা ইচ্ছে খান, লজ্জা
করবেন না।"
(চলবে)
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর
ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর
নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।