ভূতের রাজা দিল বর

ভূতের রাজা দিল বর

সত্যজিৎ রায়ের এক সিনেমায় ভূতের রাজা গুপি গাইন এবং বাঘা বাইনকে ভরসা দিয়েছিলেন: ‘সুর হবে, গান হবে, তাল হবে, লয় হবে,’ মহাবিশ্বে ভূতের রাজা আছে কি নেই তা এখনো জানা যায়নি, তবে ভূতুড়ে কণিকার (virtual particle) দল যে আছে সে ব্যাপারে কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীরা একমত। এই ভূতুড়ে কণিকার দল সারাক্ষণ নেচে চলেছে। ওরা এই মুহূর্তে আপনাকে ধাক্কা দিচ্ছে, আপনি টের পাচ্ছেন না। মহাবিশ্বে চার ধরনের মৌলিক বল আছে: মাধ্যাকর্ষণ, বিদ্যুৎ-চুম্বকীয়, দুর্বল, এবং শক্তিশালী নিউক্লিয়ার। ইদানীং পাঁচ নম্বর বলেরও আভাস পাওয়া গেছে। ভূতুড়ে কণিকাদের আদানপ্রদান এইসব বলের সৃষ্টি করে। ফুল, চিঠি, বা মুঠোফোনের টেক্সট বিনিময় থেকে কিশোর-কিশোরী প্রেমের বাঁধনে জড়িয়ে পড়ে। তেমনি ভূতুড়ে কণিকা বিনিময় করে পৃথিবী এবং চাঁদ, ইলেকট্রন এবং প্রোটন, কয়েকটি কোয়ার্ক, এক অদৃশ্য বাঁধনে জড়িয়ে পড়তে পারে। মহাবিশ্বজুড়ে বইছে কোয়ান্টাম প্রেমের খেলা:

আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম প্রিয়,
আমার কথার ফুল গো,
আমার গানের মালা গো,
কুড়িয়ে তুমি নিও।  (কাজী নজরুল ইসলাম)

একটি ইলেকট্রন ভূতুড়ে ফোটন কণাকে প্রোটনের দিকে ছুঁড়ে দেয়, প্রোটন সেটা কুড়িয়ে নিয়ে আবার ইলেকট্রনের দিকে ছোঁড়ে, এই ছোঁড়াছুঁড়ি থেকে ওদের মধ্যে আকর্ষণ জন্মায়। কোয়ার্কগুলো ভূতুড়ে গ্লুওন কণা বিনিময় করে, সেই থেকে জন্মায় শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল। দুর্বল নিউক্লিয়ার বলকে বল বলতে দ্বিধা হয়, কারণ ওর প্রভাবে একটি কণা আরেক কণায় পরিণত হয়। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বে মাধ্যাকর্ষণকে বল না বলে গর্ত বলাই ভালো। কোয়ান্টাম তত্ত্বে গ্রাভিটোন বলে এক ভূতুড়ে কণা বিনিময়ের ফলে মাধ্যাকর্ষণ বলের সৃষ্টি হয়। আজ পর্যন্ত গ্রাভিটোন কণা অবশ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এই যে আমি চেয়ারে বসে আছি। কী করে? নিউটন বলেছেন–
পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বল আমাকে পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে টান দিচ্ছে, সেই বলে বলিয়ান হয়ে আমি চেয়ারকে নিচের দিকে ঠেলছি – একে বলে অ্যাকশন। কারো উপরে বল প্রয়োগ করলে সে উল্টো দিকে সমপরিমাণ বল প্রয়োগ করবে – একে বলে রিঅ্যাকশন। চেয়ারটি সমপরিমাণ বল দিয়ে উপরের ঠিক ঠেলছে। এই অ্যাকশন-রিঅ্যাকশনের গোলকধাঁধায় পড়ে আমি স্থির হয়ে চেয়ারের উপরে বসে আছি।

কোয়ান্টাম তত্ত্বের ব্যাখ্যা বিশ্বাস করতে কষ্ট হতে পারে – অসংখ্য ভূতুড়ে ফোটন কণা আমার পশ্চাদ্দেশকে উপরের দিকে ঠেলছে, গ্রাভিটোন কণারা টানছে নিচের দিকে! চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেই এই ভূতুড়ে কণিকার দল আমার পায়ের নিচে এসে ঠেলাঠেলি, টানাটানি শুরু করবে!

এই ভূতুড়ে কণিকার কোথা থেকে আসে? এটা বোঝার জন্যে কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তা তত্ত্ব একটুখানি জানতে হবে। ধরুন হবুচন্দ্র হুকুমজারি করলো যে তার রাজত্বে জল খেতে হলে ১ গ্লাস, ২ গ্লাস, বা ৩ গ্লাস, জল খেতে হবে, কেউ দেড় গ্লাস জল খেলে তাকে শূলে চড়ানো হবে। এখানে গ্লাস হল জল খাওয়ার কোয়ান্টাম। তেমনি দুটি বস্তু যখন এনার্জি বিনিময় করে তখন এই এনার্জির পরিমাণ হয় hf, ২ hf, ৩ hf, ইত্যাদি। এখানে h হল প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম ধ্রুব, খুব ক্ষুদ্র একটি সংখ্যা, h=6.634 x 10^(-34) joule-sec (দশমিকের পরে ৩৪ টি শূন্য, তারপরে ৬৬৩৪), এবং f হল কম্পাঙ্ক। যে দুলছে তার এনার্জি আছে, কোয়ান্টাম তত্ত্বে এই এনার্জির পরিমাণ hf, এক সেকেন্ডে যতবার দোল খাচ্ছে তাকে বলে কম্পাঙ্ক। কোয়ান্টাম তত্ত্বে এনার্জি এবং সময়, অবস্থান এবং গতি, একসাথে নির্ভুল ভাবে মাপা সম্ভব নয়। সময় ভালো ভাবে মাপতে গেলে এনার্জি মাপে বেশি ভুল হবে। শ্যাম রাখি না কুল রাখি? এই অনিশ্চয়তার সুযোগ নিয়ে শূন্য থেকে এনার্জি ধার করে ভূতুড়ে কণিকা জন্মাতে পারে। ইচ্ছে করলে ভাবতে পারেন যে বেতন পাওয়ার আগেই মুদির দোকান থেকে চালডাল কিনে বসে আছেন, বেতন পেলে ধার শোধ দিবেন। কোয়ান্টাম তত্ত্বে যতদিন এই ধার শোধ না করছেন ততদিন আপনাকে ভূত হয়ে বিরাজ করতে হবে।

ভূত হলেও পদার্থবিদ্যার আইনকানুনের হাত থেকে রেহাই নেই। ওরা সব সময় জোড় বেঁধে জন্মায়, একজন কণা, আরেকজন প্রতিকণা। ক্ষণিকের অতিথি, দুজনে একসঙ্গে মিশে গিয়ে শূন্যতার কাছে এনার্জির দেনা শোধ করে দেয়। আসলে শূন্যতা বলে কিছুই নেই। যে কোনো মুহূর্তে শূন্যতার ভিতরে অসংখ্য ভূতুড়ে কণা-প্রতিকণার জোড়া খেলা করছে।

বিজ্ঞানী হেনড্রিক কাসিমির ১৯৪৮ সালে এক ভূত ধরা ফাঁদের কথা বলেন যেখানে এই ভূতুড়ে কণিকাদের কাণ্ড ধরা পড়বে। দুটি সমান্তরাল ধাতব প্লেটের (parallel plate capacitor) মাঝের দূরত্ব এক মিটারের ১০ লক্ষ ভাগের এক ভাগের চেয়েও কম হয়ে গেলে ভূতের খেলা শুরু হয়। দুই প্লেটের মাঝে যত ভূত বাস করতে পারে, তার চেয়ে বাইরে বাস করতে পারে অনেক বেশি। ঠেলাঠেলিতে বাইরের ভূত বিজয়ী হয়, প্লেটটা নিজে নিজেই নড়ে উঠে। ফাঁদে ভূতের দেখা মিলল না, কিন্তু ভূতের ধাক্কায় ফাঁদটি নড়ে উঠল!

ভূত থেকে মানুষ বানানোরও উপায় আছে। একটি প্লেটকে যদি খুব দ্রুত ঝাঁকাঝাঁকি করা হয়, তখন সেই গণ্ডগোলে অনেক ভৌতিক কণা তার দোসরকে হারিয়ে ফেলে। তখন সে বাস্তব জগতে এসে ধরা দেয়। যে ভূতুড়ে কণা তার বন্ধুকে হারিয়ে ভূতের দেশ থেকে বাস্তব জগতে চলে এলো, তাকে গড়ার এনার্জি আসবে প্লেট ঝাঁকাঝাঁকির এনার্জি থেকে। ঝাঁকাঝাঁকি মানেই ত্বরণ। এবং আইনস্টাইনের তত্ত্বে ত্বরণ মানেই মাধ্যাকর্ষণ। ত্বরণ এবং মাধ্যাকর্ষণ, এদের আলাদা করে কার সাধ্য এমন? এটাই হল আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মূল কথা। ব্ল্যাক-হোলের ইভেন্ট হরাইজোনে এভাবেই কণিকা তৈরি হয়, যা ব্ল্যাক-হোলের আকর্ষণ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। একে বলা হয় হকিং রেডিয়েশন, বিজ্ঞানী স্টিভেন হকিং প্রথম ব্ল্যাক-হোল থেকে পালানোর এমন উপায়ের কথা বলেন।

মহাবিশ্বের বয়স যতই বাড়তে থাকবে মৃত তারাদের সংখ্যা ততই বাড়বে। হাইড্রোজেন অণুর অকাল পড়বে যা দিয়ে নতুন নক্ষত্র জন্মায়। নতুন নক্ষত্র জন্মের হার কমে যাবে। চারিদিকে শুধুই মৃত তারা। এক সময় মৃত তারারা ব্ল্যাক-হোলের পেটে যাবে। কিন্তু হকিং রেডিয়েশনের কারণে ব্ল্যাক-হোলগুলোও একদিন উবে উবে মারা যাবে। মহাবিশ্বে বস্তু এবং এনার্জির মাঝে সব লেনদেন ফুরিয়ে যাবে। থাকবে শুধু অন্ধকার। তবে বনলতা সেনের দেখা মিলবে না। তাপমাত্রা শূন্য কেলভিনের (মাইনাস ২৭৩.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) একেবারে কাছে এসে যাবে। মহাশূন্য জুড়ে ভেসে বেড়াবে শুধু কণা-প্রতিকণা দম্পতি। মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি।

খন্দকার রেজাউল করিম পেশায় একজন শিক্ষক এবং গবেষক। ছাত্রজীবন কাটিয়েছেন রাজশাহী কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এবং ইউনিভার্সিটি অফ ওরিগনে। চাকরিজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করার পরে ইদানীং বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় এবং অন লাইন ম্যাগাজিনে অল্পস্বল্প লেখালেখি করেন। তাঁর ৮০টি গবেষণামূলক প্রবন্ধ আছে। এর বাইরে "কোয়ান্টাম রাজ্যে ডালিম কুমার" নামে একটি বই লিখেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *