পাঠপ্রতিক্রিয়া: উপন্যাস: চতুষ্পাঠী

পাঠপ্রতিক্রিয়া : 'চতুষ্পাঠী' এবং 'জলের উপর পানি'

উপন্যাস: চতুষ্পাঠী
লেখক: স্বপ্নময় চক্রবর্তী
প্রকাশনা: দেজ পাবলিশিং
মুদ্রিত মূল্য: ১৩০/-
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৬০

 প্রথমেই লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তীকে অভিনন্দন জানাই সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার লাভের জন্য, ‘জলের ওপর পানি’ উপন্যাসটি লেখককে এই সম্মানে ভূষিত করেছে।  প্রতিভাবান লেখকের এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের মূলস্রোতকে আরো শক্তিশালী করল বললে এতটুকু অত্যুক্তি হবে না। এই উপন্যাসের সঙ্গে লেখকের পূর্ব প্রকাশিত ‘চতুষ্পাঠী’ উপন্যাসের পারস্পরিক সংযোগ রয়েছে। তাই প্রথম উপন্যাসটি আলোচনা না করলে দ্বিতীয় উপন্যাস আলোচনা  অসম্পূর্ণ থেকে যায়। 

‘চতুষ্পাঠী’ উপন্যাসের শুরুতেই লেখক এক উপনয়ন অনুষ্ঠানে ভিক্ষাব্রত গ্রহণের মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের এক মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারণা করেছেন। ‘ভিক্ষা’ শব্দটিকে এখানে ব্যঙ্গের মাধ্যমে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন লেখক। সব থেকেও সব হারানোর দলে যারা নাম লেখাল তারা তো অন্যের দেওয়া ভিক্ষার মাধ্যমে জীবনধারণ করবে। প্রথম লাইন থেকেই উদ্বাস্তুদের যন্ত্রণার তীব্রতা ধরা পড়ে লেখকের মমতাময় স্নিগ্ধ স্বাদু গদ্যে। তাঁদের দীর্ঘদিন ধরে লালন করে আসা সংস্কৃতি, বিশ্বাস তলিয়ে যেতে থাকে। বিলুর মায়ের প্রতি শিখার মায়ের অমানবিক আচরণ প্রমাণ করে সবহারাদের মধ্যেও বিভাজন আছে। আবার যখন তারা সংসার সমুদ্রের দুর্বিপাকে পড়ে দু’জনেই ডুবতে থাকে তখন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বাঁচতে চায়।

সংস্কৃত শিক্ষা এ যুগে অচল কিন্তু অনঙ্গমোহন তা আঁকড়ে ধরে রাখতে চান। তাঁর পুত্র জগদীশকে স্কুলে ভর্তি করার অপরাধে অনঙ্গমোহনের পিতা নীলকমল প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন। কিন্তু পাশাপাশি দেখা যায় নীলকমলের টোলে মুসলমান ছাত্ররাও পড়তে আসত। আসলে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়েই নব্য সংস্কৃতির জন্ম হয় তারই ইঙ্গিত হল এই সব টুকরো টুকরো ঘটনা। এর মধ্যেই দিয়েই লেখক ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকেন মুসলমানদের দূরে সরিয়ে রাখতে বর্ণহিন্দুদের বিভিন্ন প্রচেষ্টা এবং পরবর্তীকালেত তাদের বিরাগভাজনতার কারণ বোঝাতে। 

ইংরেজি শিক্ষার কাছে ক্রমেই হার মানতে থাকে অনঙ্গমোহনের সংস্কৃত শিক্ষা, চতুষ্পাঠীর ধারণা ভ্রান্ত হতে থাকে। দুই কিশোর বিলু আর রুনু কলকাতা আর তার সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে। প্রতি মুহূর্তে অনঙ্গমোহনের মানসিক দ্বন্দ্বও প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। টিমটিম করে টিকে থাকা  চতুষ্পাঠীর জন্যই কিছুটা সরকারি ভাতা পান তিনি। তাই যে কোনও উপায়ে তাকে টিকিয়ে রাখার মরিয়া প্রচেষ্টা জারি রাখতেই হয়। আখ্যান যত এগিয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে সঙ্গে অনঙ্গমোহনের অস্তিত্বসংকটও বৃদ্ধি পেয়েছে। 

দেশভাগের ক্ষত বুকে নিয়ে অনঙ্গমোহন যখন এপার বাংলায় চলে এসেছিলেন তখন এক অস্থির সময়। ষাটের দশকের কলকাতায় তখন খাদ্য আন্দোলন, ভারত-পাক যুদ্ধের ভয়াবহতা, কারখানার লকআউট, ছাত্র বিক্ষোভ, মিষ্টি নিয়ন্ত্রণ আইনের পাশাপাশি সমান্তরালভাবে চলতে থাকে উদ্বাস্তু সমস্যা আর তার পরবর্তী সময়ের কথা। কাব্যব্যাকরণতীর্থ শ্রীঅনঙ্গমোহন বেঁচে থাকার তীব্র লড়াইয়ে ডারউইনের অভিযোজন নীতি মেনে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত আভিজাত্য, ন্যায়নীতি, সাংস্কৃতিক চিন্তাভাবনাকে বিসর্জন দিতে থাকেন। বদলে যেতে থাকে তাঁর মুখের ভাষা। তবুও স্বপ্ন জেগে থাকে তাঁর মনে। ভুলতে পারেন না দেশের কথা, ছেড়ে আসা ভিটেমাটির কথা। তাই ১৯৬৫ সালে যখন কলকাতায় ব্ল্যাকআউট জারি হয় তখনও তিনি ভাবতে থাকেনঃ 

কলাইকুণ্ডায় পাকিস্তান বিমান হানা দিয়েছিল। এখানে যদি বোম পড়ে একটা, এইখানে? বোম কী শব্দ? সংস্কৃত ব্যোম শব্দটি ইংরাজিতে বোম হইয়াছে। সংস্কৃতই তো সকল ভাষার আদিজননী। অর্বাচীন ভাষাবিদরা এটা স্বীকার করে না। 

আচ্ছা, ভারতীয় সৈন্য কি পূর্ব পাকিস্তান দখল করতে পারে না? পারলেই কি আবার ফিরে পাবেন অনঙ্গমোহন গোবর নিকানো উঠান,কলাগাছের পাতার আন্দোলন, সুপারির সারি, চতুষ্পাঠী?

হারিয়ে যাওয়া ‘দ্যাশের বাড়ি’ আর ফিরে পাওয়া হয় না তাঁর। এখানে লোভ এক কালসর্প, সে ধর্ম মানে না, জাত মানে না। অনঙ্গমোহনের ফেলে আসা বাস্তুভিটা দখল করে তাঁরই প্রতিবেশী নোয়াখালির জব্বর আলি আর নগেন শীল। স্বার্থপরতার ক্ষেত্রে দু’জনেই সমান।

অনঙ্গমোহনের ট্রাঙ্ক থেকে খুঁজে পাওয়া যায় পূর্ণচন্দ্র চতুষ্পাঠীর অনুমোদন। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন তা টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু যেখানে মেকলের শিক্ষানীতি চালু হয়ে গেছে সেখানে এক বৃদ্ধের চতুষ্পাঠী কোন কাজে লাগবে? 

বিলুর মাও এক অস্থির সময়ের বলি। অনঙ্গমোহনের পুত্র জগদীশের অকালমৃত্যুতে নানা অপমান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সহ্য করে জীবনধারণের জন্য তাকেও কারখানায় চাকরি নিতে হয়। দেশের পালনকর্তাদের ক্ষমতার দম্ভের বলি হয়ে যুদ্ধের বাজারে ‘লকআউট‘ নামক বিভীষিকার ফলে কারখানার সেই চাকরিটি যখন চলে যায়, তখন বাধ্য হয়ে মালিকের বাড়িতে তাকে রান্নার কাজও করতে হয়। উপন্যাসের শেষভাগে যখন দেখতে পাই অসহায় অনঙ্গমোহন তাঁর প্রিয় দুষ্প্রাপ্য বইগুলোর পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে ঠোঙা বানাচ্ছেন তখন এক অদ্ভুত বিষাদ পাঠককে গ্রাস করে। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু দেশভাগ লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন কীভাবে তছনছ করে দেয় তা বোঝা যায়। 

এই উপন্যাস পড়তে পড়তে বাপ-ঠাকুরদার ভিটেমাটি ছেড়ে আসার কষ্ট প্রতি মুহূর্তে উপলব্ধি করতে পেরেছি। সেই অস্থির সময়ের প্রতিনিধি না হয়েও তাদের মানসিক যন্ত্রণাটা বুঝতে পেরেছি। ‘চতুষ্পাঠী’র প্রতি ছত্রে ছত্রে দেখেছি উদ্বাস্তুদের সংস্কৃত বিদ্যাচর্চার জন্য আকুলতা, টিকিয়ে রাখার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা।  

উপন্যাস: জলের ওপর পানি
লেখক: স্বপ্নময় চক্রবর্তী
প্রকাশনা: দেজ পাবলিশিং
মুদ্রিত মূল্য: ৫৫০/-
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৪৩২

‘চতুষ্পাঠী’ যেখানে শেষ হয়, ঠিক তারপর থেকেই শুরু হয় ‘জলের ওপর পানি’ র আখ্যান। অনঙ্গমোহন একটা যুগের প্রতিনিধি। তিনি ছিলেন ঐতিহ্য, সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। ‘চতুষ্পাঠী’তে যা ছিল একটা বীজের অঙ্কুরোদগম হওয়া। ‘জলের ওপর পানি’তে তাই বিস্তৃত আকারে বিবৃত হয়ে মহীরুহে পরিণত হয়েছে। জীবনযুদ্ধে নেমে অন্ন-বস্ত্রের লড়াই চালু রাখতে অনঙ্গমোহনের সংস্কৃত অধ্যাপক থেকে ঠোঙাওয়ালা, চা-ওয়ালাতে পরিণত হওয়া এক ট্রাজিক পরিণতি। কিন্তু এছাড়া আর কীই বা করার ছিল অনঙ্গমোহনের! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও বুঝতে পারছিলেন ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব। ঔপনিবেশিক শাসনের মতই ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাও ক্রমশই গিলে ফেলছে প্রাচীন ভাষাটিকে। ভেঙে দিচ্ছে এতদিন ধরে লালন করে আসা শিষ্টাচার, ভদ্রতাবোধ। মুখের ভাষা, শালীনতাও হারিয়ে ফেলতে থাকেন তিনি। যে সংস্কৃত একদিন ছিল তাঁর গর্বের জায়গা সেই সংস্কৃতকেই বলেন: 

তোমার শাস্ত্রের পায়ুমেহন করি আমি…এই বলেই দেয়ালের পাশে বইয়ের তাকে লাথি মারলেন তিনি। ছিটকে পড়ল কাব্য চন্দ্রসুধা…নৈষধ চরিত—কাদম্বরী। তক্ষুনি আবার গিয়ে তুলে নিলেন। চাদরে মুছলেন। ছিঁড়ে যাওয়া পাতাটিকে শুশ্রূষা করলেন অনঙ্গমোহন। হাত বুলোলেন। বাছা, সংস্কৃত ভাষা। তোর দোষ কী। আমারাই অধম। ভাষার সঙ্গে আচার আমারাই যুক্ত করেছি। এটা আমাদেরই বিফলতা। সংস্কৃত বইগুলির গায়ে হাত বুলান অনঙ্গমোহন।

আবার একই সঙ্গে ন্যায়নীতি সম্পূর্ণভাবে বিসর্জন না দিতে একথাও বলেন:

ভাবতেছি, কেবলমাত্র পয়সার জন্য, দক্ষিণার জন্য, কাপড়ের জন্য, চাউলের জন্য, ফলফলাদির জন্য আমি ভুল শিক্ষা দিমু? ভগবান তো ক্ষুধা-তৃষ্ণা-নিদ্রার ঊর্ধ্বে। অথচ ইহা গচ্ছ ইহা তিষ্ঠ কইরা তারে খাওয়াই। অথচ নিজেরাই ভোগ করি। দেখ আমি আহ্নিক করি। এইটা আমার জীবনাচার। বিষ্ণু পূজা নারায়ণ পূজাও করি। এইটা আমার ব্যক্তিগত অভ্যাস। কিন্তু যজমানের বাড়ি গিয়া তার মঙ্গল কামনায় বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করাটায় মন সায় দেয় না আমার। আমার কী ক্ষমতা আছে যে, মন্ত্রদ্বারা আবাহন কইরা ঘটের মধ্যে দেবতারে আনতে পারি। ফলফলাদি নৈবেদ্য দিয়া তারে তুষ্ট করি? তারপর তারে কই এইটা দাও, সেইটা দাও… 

পাঠক বুঝতে পারেন তাঁর অন্তরের জ্বালা, দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কথা।

আখ্যান যত এগিয়ে চলে তার সঙ্গে সঙ্গে মহাত্মা গান্ধী, নেহেরু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র, আলি জিন্নার প্রসঙ্গ থেকে রাজনৈতিক পালাবদল, অস্থিরতা, ডান-বাম রাজনীতি, বুর্জোয়া, ক্ষমতার লড়াই, দখল, নকশাল আন্দোলন ও তার পরিণতি, মুসলিম লীগ, কৃষক আন্দোলন, মরিচঝাঁপি, মন্বন্তর –  উদ্বাস্তুদের সংগ্রাম নিয়ে এগোতে থাকে কাহিনি। মন্বন্তরের ভয়ালঅবস্থা ফুটে ওঠে যেখানে সন্তানকে বিক্রি করে দেয় পিতামাতা। ক্ষুধার অনলে জাত, ধর্ম সব পুড়ে খাক হয়ে যায়। সময় যত এগিয়েছে উদ্বাস্তু সমস্যা, জমি বন্টন, চাকরির বাজার, অস্তিত্ব সংকট এগুলোও ততই প্রকট হয়েছে।  

বিলু এই উদ্বাস্তুদের প্রতিনিধি। অনঙ্গমোহনের দিন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। কিন্তু বিলুর জীবন সবে শুরু হতে চলেছে। অনঙ্গমোহনের মতো প্রতিনিধিরা ওপার বাংলা থেকে উৎখাত হয়ে এসে কলোনিতেই গড়ে তুলেছিল নতুন ঘরসংসার। তাঁরা এখানে বাঁচিয়ে রাখে তাদের নিজস্ব ধর্ম, সংস্কার, আচার, সংস্কৃতি। এই উপন্যাসে লেখক একই সঙ্গে যেমন দেশভাগের কারণ অনুসন্ধান ও তার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন তেমনি উদ্বাস্তুদের নানা সমস্যার কথাও বলেছেন। তারই ফলশ্রুতিতে একে একে উঠে আসে কুপার্স ক্যাম্প, ধুবুলিয়া, দণ্ডকারণ্য প্রসঙ্গ। ক্ষমতার দম্ভ রাজনৈতিক মতভেদের মধ্যে কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির চিরকালীন দ্বন্দ্বের মধ্যেই জন্ম নেয় নকশাল আন্দোলন। রাষ্ট্রীয় পুলিশের নিধনযজ্ঞে বলি হয় রুনুর মতো তরতাজা যুবকরা। বিলু কোনও রাজনীতিতে প্রবেশ করতে চায় না। লেখক এখানে বিলু আর তার দাদু অনঙ্গমোহনের চোখ দিয়ে সমকালীন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যক্ষ করতে থাকেন।

এরই মাঝে কৈলাস দেবনাথের ‘ছিন্নমূল’ মহাকাব্যের মাধ্যমে তীব্র শ্লেষ, ব্যঙ্গ পরিস্ফুট হয়। মানুষের জীবনের মতো ‘ছিন্নমূল’ও ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। কৈলাস, অনঙ্গমোহনরা দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে এপারে এসেছিলেন, বিলু রুনুরা উদ্বাস্তু পরিবারের নিত্যনৈমিত্তিক যন্ত্রণা সহ্য করে চলেছে। অভাব, দু’বেলা দুমুঠো খেতে না পাওয়ার যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তীব্রভাবে প্রকট হয় উদ্বাস্তু সমস্যা। উপন্যাসের বৃহৎ অংশ জুড়ে আছে অনঙ্গমোহন আর বিলু। অনঙ্গমোহনের দিন শেষ হয়ে আসছে, কিন্তু বিলুকে জীবনযুদ্ধে নামতে হয়। অনঙ্গমোহনের প্রিয় বিষয় ছিল সংস্কৃত আর বিলুর বিজ্ঞান, প্রাচীনত্ব আর আধুনিকীকরণের মিশেল। দাদুর আদর্শ বহন করে চলেছে বিলু। আপাতদৃষ্টিতে কিছুক্ষণের জন্য সেই আদর্শ থেকে সরে এলেও উপন্যাসের শেষ দিকে দেখা যায় দাদুর শিক্ষা ব্যর্থ হয়নি, উত্তরাধিকারসূত্রে বিলুও তা পেয়েছে। তার স্বপ্ন পড়াশোনা করে চাকরি যোগাড় করা। কিন্তু এই প্রসঙ্গেই বারবার এসেছে কংগ্রেস কমিউনিস্ট পার্টির দ্বন্দ্বের কথা, ইন্দিরা গান্ধী-প্রমোদ দাশগুপ্ত-চারু মজুমদারের প্রসঙ্গ, পরবর্তীতে অযোধ্যা বাবরি মসজিদ প্রসঙ্গ, বিজেপির উত্থান ইত্যাদি। এই উপন্যাসকে তাই সময়ের এক দলিলনামা হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। বিলু আর অনঙ্গমোহন দু’জন দুই সময়ের প্রতিনিধি হলেও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে, সমাজের ধারক-বাহক শাসকদের রোষানলে দু’জনেই ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। দীর্ঘ উপন্যাসের প্রতি পাতায় পাতায় কোথাও রয়েছে তীব্র ব্যঙ্গ, কোথাও কাব্যময়তা, কোথাও বা উপমা, ছড়া-প্রবাদের মিশেল। ভিতু উদ্বাস্তু মানুষ তত্ত্ব বোঝে না। তারা বোঝে ক্ষিধে। তাই তো এখানে মার্কস-লেনিন বিক্রি হয়ে যায় কাগজওয়ালার কাছে। 

অনঙ্গমোহনের হঠাৎ মৃত্যু কিছু প্রশ্নচিহ্ন রেখে যায়। যে আদর্শ, যে নীতি নিয়ে ‘চতুষ্পাঠী‘-র প্রথম পাতা থেকে তাঁর জীবন শুরু হয়েছিল এই উপন্যাসে তাঁর সেই সংগ্রাম শেষ হয় শহীদ হিসেবে। বিলুর এবার একলা পথ চলা শুরু। তার সংগ্রাম, প্রতিমুহূর্তে বেঁচে থাকার লড়াই জারি থাকে। ওদিকে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনঙ্গমোহনের দুই ছাত্র-ছাত্রী অসীম আর সুমিতার জীবনের গতিপথ পরিবর্তিত হয়। সুমিতাকে উপহার দেওয়া বই পাওয়া যায় ফুটপাতের ধারে। সেই বই কিনে নিয়ে যায় আরেক সুমিতা। কোথাও যেন লেখক এখানে একটা সিম্বলিক (প্রতীকী?) হিসেবে ব্যবহার করলেন সুমিতা নামটি। বলতে চাইলেন যতই রাজনীতির পাঁকে পড়ুক না কেন সংস্কার, আদর্শ, ন্যায়নীতি চিরপ্রবহমান। 

উদ্বাস্তু সমস্যার পাশাপাশি দেখা যায় ঘটি-বাঙাল দ্বন্দ্ব। লেখক যেভাবে এই দ্বন্দ্ব দেখিয়েছেন তা রীতিমতো প্রাসঙ্গিক। মাধুরী এই দ্বন্দ্বের শিকার। এর জন্য লেখক দেশভাগের পৈশাচিক ইতিহাসকেই দায়ী করেছেন। ধর্মের ভিত্তিতে, দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে যে দেশভাগ হয়েছিল তার প্রসঙ্গ, কারণ, বিশ্লেষণ, যুক্তি, পাল্টা যুক্তি বারবার এসেছে। লেখক মানুষের মনের ভিত্তিহীন ধর্মীয় ভাবাবেগকে কুঠারাঘাত করেছেন, কখনও তা সরাসরিভাবে, কখনও তীব্র শ্লেষের মাধ্যমে, কখনও বা যুক্তির মাধ্যমে। তাই বিলুর মুখ দিয়ে বলিয়ে নেন:

আপনারা তাড়িয়ে দিয়েছেন বলে আমার পূর্বপুরুষ নিজের দেশ ছেড়ে… চিন্তাটা মাথায় আসতেই বিলু নিজেকে দমায়, বলে ছিঃ বিলু, তোর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা রয়ে গেছে চুপি চুপি। তোদের ভূমিচ্যুতির জন্য নুরুদ্দিনের কোনো ভূমিকা নেই। বিলুর ভেতরে থাকা পাজি বিলুটা বলে—ছে’চল্লিশের দাঙ্গায় হয়তো এরাই বাপ-জ্যাঠা হাতে চপার নিয়ে… অন্য বিলুটা বলে — এভাবে ভাবিস কেন? হয়তো এরাই বাপ-জ্যাঠা কোনো বিপন্ন প্রতিবেশীকে ঘরে লুকিয়ে রেখেছিল।

জরুরি অবস্থার সময় গণতন্ত্রের কন্ঠরোধ করে সাধারণ মানুষের জনজীবন কার্যত ধ্বংস করে দেওয়ার যে জঘন্য চক্রান্ত হয়েছিল তাও এসেছে প্রসঙ্গক্রমে। রাজনীতির বেসাতিরা পক্ষে-বিপক্ষে শুধু দোষ দেয়। কিন্তু দেওয়ালে পিঠ থেকে গেলে দাবি আদায়ের জন্য উদ্বাস্তুরাও একসময় তাদের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য জবরদখল করে, কলোনি তৈরি করে। তাদেরসামনে রেখে আন্দোলনের আড়ালে রাজনীতির কারবারিরা ঘোলা জলে মাছ ধরতে নামে। রিফিউজিদের মধ্যেও আবার শ্রেণীবিভাগ আছে। পঞ্চাশে আসা রিফিউজি আর ৭১-এ আসা রিফিউজিদের মধ্যে শ্রেণীবিভাগের সঙ্গে চলতে থাকে এক ঠান্ডা লড়াই। স্বপ্নময়বাবুর কলমের ব্যবহার এখানে কৃতিত্বের দাবি রাখে। তিনি সব পরিস্থিতির জন্য সকলকেই দায়ী করলেও উপন্যাসটি এমনভাবে এঁকেছেন তাতে একপাক্ষিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। ধর্মকে তিনি এই উপন্যাসে এমনভাবে জুড়ে দিয়েছেন যার ফলে ধর্ম যেন নিজেই একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে। যে ধর্মের কারণে দেশত্যাগ, নতুন দেশ গঠন, সেই ধর্ম কিন্তু পিছু ছাড়ে না অনঙ্গমোহনের পরিবারকে। তার বার্তা পাওয়া যায় নারায়ণ শিলার হস্তান্তর হওয়ার মুহূর্তে।

উপন্যাসটির অকস্মাৎ গতি পরিবর্তন ঘটে বিলু চাকরি পাওয়ার পর যখন এক সেমিনারে গিয়ে তার বাপ-ঠাকুরদার ভিটেমাটির খোঁজে পৌঁছে যায় বাংলাদেশে। এ পর্যন্ত কাহিনি ছিল দেশভাগের কারণ, তার অমানুষিক যন্ত্রণা, ধর্মীয় উন্মাদনা, উদ্বাস্তু সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে। কিন্তু এখানে যুক্তি নির্মাণ আর খণ্ডনের মাধ্যমে এগোতে থাকেন লেখক। তাই নিয়ে আসেন উজমা চরিত্রটি। ‘সংখ্যালঘু’ হিন্দু-মুসলিম বিচার করে না। যে যেখানে সংখ্যালঘু সে সেখানেই প্রতিপক্ষের দিকে সুযোগ পেলেই ছুটে গেছে তীক্ষ্ণ ছুরির ফলা নিয়ে। এখানে লেখক যুক্তিসহকারে দেখিয়েছেন হিন্দু-মুসলিমের উদ্বাস্তু হওয়ার ভিন্ন ভিন্ন কারণ। ওপার বাংলা থেকে দেশভাগের সময় যেমন এপার বাংলায় প্রচুর মানুষ চলে এসেছিলেন ঠিক সেভাবেই ভারত থেকে বিহারী মুসলিমরাও পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। তাঁদের সমস্যার কথা শোনা যায় উজমার মুখে। এরই পাশাপাশি এসেছে ত্রিপুরার সমস্যার কথা, বাঙালির অত্যাচারে সেখানকার ভূমিপুত্রদের উৎখাত করার নোংরা রাজনীতির প্রসঙ্গ।   

মানুষ মুখে যতই বলুক না কেন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সম্পূর্ণ ধর্মহীন কি হতে পারে? আর এখানেই লেখকের দূরদৃষ্টি। তিনি একই সঙ্গে দেখিয়েছেন বাবরি মসজিদ বিতর্কের মধ্যেই বিলু আর উজমার বিবাহের কথা। আবার একটি বাস্তবচিত্রও প্রকাশ করেছেন যখন বিলু আর উজমার দাম্পত্য কলহের মধ্যে ধর্ম প্রবেশ করে। তবে উপন্যাসের বৃহৎ অংশ জুড়ে যতই রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রসঙ্গ আসুক না কেন, সবকিছুর ঊর্ধ্বে এই উপন্যাস একটি মানবিক আখ্যান। ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে বিলু আর উজমা দেখায় মানবতাই শেষ অস্ত্র। ধর্মীয় বেড়াজাল ভেঙে নাম-গোত্র-পরিচয়হীন একটি শিশুকে যখন তারা দত্তক নেয় তখন লেখক যেন নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে একটা সমঝোতায় আসার ইঙ্গিত দেন। কিংবা যখন দেখা যায় বিশ্বনাথ একটি মুসলিম শিশুকে ক্রয় করে নিয়ে আসে। এখানেই একটা সম্প্রীতির বার্তা দেন লেখক। আসলে যাই ঘটুক না কেন “সবার ওপরে মানুষ সত্য।”

এই উপন্যাস ইতিহাসের এক জ্বলন্ত আখ্যান। বৃহৎ উপন্যাস, বৃহৎ ক্যানভাস, বহু চরিত্রের সমাহার। যখন যে চরিত্রের কথা এসেছে সেই তখন প্রধান হয়ে উঠেছে। সমকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক ইতিহাস, জীবনযুদ্ধের ছবি ফুটে উঠেছে। তাই একবার পড়লে এই উপন্যাসের অর্থ সঠিকভাবে অনুধাবন করা যায় না। শিকড়ের অনুসন্ধান করতে হলে, নাড়ির টানকে অনুভব করতে হলে এই বই বারবার পড়তে হবে।

 
পেশায় শিক্ষিকা। নেশা বিভিন্ন ধরনের বই পড়া, বেড়ান আর সিনেমা দেখা। পছন্দের ভ্রমণ তালিকায় প্রথম স্থানে আছে পাহাড়িয়া ছোট ছোট গ্রাম। আরও শখ সময় ও সুযোগ পেলেই পাহাড়ের সহজ-সরল মানুষগুলোর আতিথেয়তা গ্রহণ করার জন্য বেরিয়ে পড়ে নির্জন প্রকৃতির মধ্যে থেকে নিজেকে নতুন করে চিনতে শেখা। বেড়িয়ে এসে মনের আনন্দে টুকটাক ভ্রমণকথা লেখার চেষ্টা। লেখা প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা, বাতিঘর অনলাইন ব্লগজিন, প্রবচন পত্রিকা, ‘পর্যটকের ডায়েরি’ নামক ভ্রমণ সংকলনে। পঙ্কজ উধাস, জগজিৎ সিং আর রশিদ খানের গান সুখ-দুঃখের সঙ্গী। সফট রোম্যান্টিক গান বিশেষ পছন্দ। ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করলেও বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাসের প্রতি প্রবল ঝোঁক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *