গঙ্গাজল

গঙ্গাজল

সীমানা পেরিয়ে

“গঙ্গাজল! গঙ্গাজল!”

জানালার বাইরে থেকে অস্ফূট আওয়াজটা কানে আসতেই মনো উঠে বসল। রাজির গলা না? মশারির বাইরে তখনও ছানাকাটা অন্ধকার। মনো বুঝল এখনো সূয্যি ওঠেনি। জানালার কাছ থেকে আবার ফিসফিসে গলা শোনা গেল।

“গঙ্গাজল আমি রাজি। একবার ইদিকে আয়।”

মনো একবার ঘুমন্ত সন্তান আর পিসশাশুড়িকে দেখে নিল, তারপর লঘু পায়ে গেল জানালার ধারে। জানালার নীচে তার গঙ্গাজল সই, রাজি, একমাথা ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে আছে। মনো ইশারায় রাজিকে দাঁড়াতে বলে বেরিয়ে আসে বাগানে।

“কী হইল, এত সকালে? কোনও বিপদ হইল নাকি, গঙ্গাজল?”

“আমাগো আর থাকনের উপায় নাই, সই। দত্তকত্তারা আইজ রাইতেই রওনা দিব। ওদের লগেই যামু। নইলে একা মাইয়ামানুষ ক্যামনে পার হমু বর্ডার। তরা কী করবি সেই খবর করতেই আইলাম।”

মনো বলল, “জানি না রে। তর তো সোয়ামী আছে ওহানে। আমার কেডা আছে, ক’।”

রাজি বলে, “ক্যান, তর বাপের ঘর আছে!”

“হেরা আমারে চায় না রে। বেধবা মাইয়া জম্মের বোঝা। তুই যা গঙ্গাজল। ভাসুর-দেওররা যাইতে চায় না, কয় এইডা আমাগো দ্যাশ, আমরা কোত্থাও যামু না। ভয় হয় বিপদে পইড়লে আমারে ফেলান দিয়াই তারা না পালায়। তহন মাইয়াটারে লইয়া কী করুম, গঙ্গাজল?”

রাজির মন খারাপ হয়ে যায়। দেশভাগের কথা ওঠা অবধি এখানের হিন্দুরা ভয়ে কাঠ হয়ে আছে। তারা শুনছে এদেশ নাকি মুসলমানদের হবে আর হিন্দুরা থাকবে ভারতে। রাজির শ্বশুর-শাশুড়িও এখানে নেই। রাজির স্বামী, শিবেন, নদীয়ার বীরনগরে থাকে। রেলে চাকরি করে। এবার ছুটি কাটিয়ে ফেরার সময় বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে গেছে। পনেরো দিন পরেই ফিরে আসার কথা। পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে দেখে শিবেন তাদের আর পাঠায়নি। সে চেষ্টা করছে যেভাবে হোক রাজি আর ভাই হীরেনকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার।

কাল রাতে দত্তজেঠি এসে বলল আজ সন্ধ্যারাতের পর তারা রওনা হবে। রাজি আর হীরেন তাদের সঙ্গে যেতে পারে। সন্ধ্যেরাতে রওনা দিলে ভোর ভোর বর্ডার পার হয়ে যেতে পারবে। রাজির তখন মনোর কথা মনে হয়েছিল। তার গঙ্গাজল দু’মাসের মেয়ে কোলে বিধবা হয়েছে ছ’মাস আগে। শ্বশুরবাড়ির লাথিঝাঁটা খেয়ে পড়ে রয়েছে। ওর কী হবে? মনোর বাপের বাড়ি চব্বিশ পরগণায়। যদি ওদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যেত তবে শিবেন ঠিক গঙ্গাজলকে ওর বাপের ঘরে পৌছে দিত। সেই কথা বলতেই ভোররাত্রে লুকিয়ে এসেছে।

রাজি ফিরে গেল বাড়িতে। অনেক গোছগাছ বাকি। কী নেবে, কী রেখে যাবে। সারাদিন কেটে গেল। সন্ধে নামছে। দত্তজেঠি একবার এসে দেখে গেছে কতটা সারা হল। রাজি একটা কাপড়ের টুকরোয় গয়নাগাঁটি আর টাকাপয়সা নিয়ে তলপেটে বাঁধলো। আর নিয়েছে পথে খাওয়ার কিছু খাবার আর সামান্য জামাকাপড়। বারো বছরের হীরেনের জিম্মায় দিয়েছে কুলদেবতা লক্ষ্মীনারায়ণের পিতলের মূর্তি। আর একজনও সঙ্গে আছে। তার সন্তান। দুইমাসের গর্ভবতী সে। একথা কারোকে জানানোর সুযোগ হয়নি তার। ভেবেছিল শাশুড়ি এলে বলবে। সে আর হল না। ভেবেছে একেবারে ওখানে পৌঁছেই জানাবে। আঁধার ঘন হয়েছে। দত্তপরিবার তৈরি। রাজি তুলসীতলায় প্রদীপ দিয়ে প্রণাম করল গলবস্ত্রে। দেখো মা তুলসী আবার যেন ফিরে আসতে পারি। হীরেন রাস্তায় এগিয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজি নিঃশব্দে দরজায় তালা লাগাল। দেখে অন্ধকারে এক ছায়ামূর্তি। ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসে সে। ভয়ার্ত গলায় চাপাস্বরে বলে, “কেডা, কেডা ওহানে? কথা কও!”

একটা সরু হাত তার মুখ চেপে ধরে। রাজি সবিস্ময়ে দেখে মনো। সে কিছু বলার আগেই মনো তার গলা জড়িয়ে ফিসফিস করে বলে, “আমার মাইয়াটারে লইয়া যা, গঙ্গাজল। যদি কুনোদিন ওপারে যাওন পারি তহন আমারে ফিরৎ দিস, ক্যামন। আর যদি নাই যাওন পারি তহন তুই অর মা। ওরে দ্যাখিস!”

নিঃশব্দে মনো ওর কোলে একটা কাপড়ের পুঁটলি গুজে দেয়। নীরব নিশ্চল একটা পুঁটলি। সেখানে একটা ক্ষীণ বুকের ওঠানামা ছাড়া আর কোন আলোড়ন নেই। মনো ফিসফিস করে বলে, “শাশুড়ির ঘুইমের লাইগ্যা কবিরাজমশাই যে ওষুধ দ্যান তাইর দুফোঁটা ওর দুধে মিশায়ে দেছি। ও তরে জ্বালাইব না। বর্ডার পাইর হইলে এট্টু খাওয়ায়ে দিস।”

রাজি কেঁপে ওঠে মনোর কথায়। তারপর কিছু মুহূর্ত দুই সই নীরবে কাঁদে। রাজি বলে, “মনে রাখস, তর দাদা নদীয়ার বীরনগরে রেলে চাকুরি করে। ওহানে রেলের ঘইরে খোঁজ নিস।”

অন্ধকারে মিলিয়ে যায় মনো। রাজি তলপেট থেকে গয়নার পুঁটুলি খুলে সেখানে মনোর মেয়েকে বাঁধে। তার নীচে গয়নার পুঁটুলি। মনে মনে বলে, “দুই ভাই-বইন একলগে রও, বুঝলা। পরাণ থাইকতে তোমাগো ক্ষতি হইতে দিমু না।”

শুরু হল হাঁটা। পথের আর শেষ হয় না। শরীর চলতে চায় না। পায়ে অজস্র ক্ষত নিয়ে একসময় এসে পৌছায় বর্ডারে। তখনও ভোর হয়নি।

গার্ড হাঁক দেয়, “কোঁচড়ে কি লও?”

“মা হমু চাচা। ভরা মাইস।”

“অমন হগ্গলে কয়। চেক কইরতে হইব।”

গার্ডের সন্দিগ্ধ দৃষ্টি। রাজি কোঁচড় থেকে গয়নার পুঁটুলি বার করে গার্ডের হাতে দেয়। পা জড়িয়ে বলে, “এই সম্বল আপনে ন্যান। প্যাটেরটারে ছাড়ান দ্যান চাচা।”

হীরেনের হাত ধরে বর্ডার পার হয়ে যায় রাজি। সর্বহারা রাজির সঙ্গে তখন দুই ঈশ্বর, মূর্ত এবং বিমূর্ত। সামনে নতুন সূর্য, নতুন ভোর।

———-

বিঃ দ্রঃ
রজনী চক্রবর্তী আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তাঁকে আমি দেখিনি – গল্প শুনেছি অনেক। তাঁর সই মনোরমা ভারতে আসতে পারেননি। শোনা গেছিল খানসেনাদের হাতে সম্মান খুইয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন। মনোর মেয়ে মানুষ হয়েছিল রাজির বড় মেয়ের পরিচয়ে। আমার চোখে রাজির মতো সাহসিনী কমই আছে।

———-

ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ অন্তর্জাল ক্লিপ আর্ট। 

ময়না মুখোপাধ্যায়ের জন্ম নদিয়া জেলায়। বিজ্ঞান, বাংলা সাহিত্য ও সমাজবিদ্যায় স্নাতক। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের নিয়ে ডিগ্রি অর্জন করে দীর্ঘ সময় এই ক্ষেত্রে কাজ করে চলেছেন। লেখার জগতে এসেছেন সম্প্রতি, লেখেন গল্প, কবিতা, ভ্রমণকাহিনী। প্রথমে কিছু গ্রুপের ইভেন্টে লেখালেখি, তারপর ইবুক আর বইয়ে আত্মপ্রকাশ আর অডিও স্টোরিতে আসা। লেখিকার আর একটি অন্যতম শখ ভারতবর্ষের চেনা অচেনা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো, পাহাড় থেকে সমুদ্রে।

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • CHIRANJIB ROY , July 16, 2022 @ 4:36 pm

    খুব সুন্দর লাগল।🌱🌍🌳

Leave a Reply to CHIRANJIB ROY Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *