প্রফুল্ল রায়ঃ এক কিশোরীর চেতনা গড়ার কারিগর

প্রফুল্ল রায়ঃ এক কিশোরীর চেতনা গড়ার কারিগর

“প্রফুল্ল রায়ের লেখা পড়তে বড্ড ভালোবাসি,” জানিয়েছিলেন মেয়েটির মা! কতই বা বয়স তখন সে কিশোরীর? এগারো বা বারো। বই পড়া নিয়ে কোনরকম বাধা নিষেধ ছিল না বাড়িতে – তাই যা পাওয়া যাবে হাতের সামনে তা পড়ে ফেললেই হল। একেবারে গোগ্রাসে।

তক্কে তক্কে থাকা তাই লাইব্রেরিতে কী কী বই আছে এ হেন বিখ্যাত লেখক প্রফুল্ল রায়ের – যা পড়ে মা একেবারে উচ্ছ্বাসিত। রাতে ডিনার টেবিলে সেইসব বই নিয়ে আলোচনা হয় – কিশোরীটি কিছু বোঝে কিছু বোঝে না। বাবা-মার আলোচনার সঙ্গে তাল মেলায় সাত বছরের বড় দাদা। নামগুলো কানে আসে ‘সিন্ধুপারের পাখি,’ ‘পূর্ব পার্বতী!’

কয়েকটা বই পড়ে ফেলা হল! সেকালের বেশ নামকরা বই – ‘জন্মভূমি,’ ‘রৌদ্র ঝলক!’ লেখকের পছন্দের শব্দগুলো গেঁথে গেল মেয়েটির মনে – ‘গমের মতন গায়ের রং’ বা ‘ঘুমের আরকে ডুবে গেল!’ লাইনগুলো মনে মনে আওড়ায় মেয়েটি! মেলাতে চায় চারপাশের সঙ্গে! আর একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আছে লেখকের – কোনও চরিত্র বা ঘটনা নিয়ে আলোচনা যা পরে করা হবে সেটা বলেই দেন ‘সে কথা পরে!’

মায়ের মতো কন্যাটিও পছন্দ করে ফেলল লেখককে!

ক্লাস নাইন হল মেয়েটির – এখন সে একটু আধটু বুঝতে পারে চারদিকের রাজনৈতিক অবস্থা, শ্রেণি-বৈষম্য সম্পর্কেও ধারণা গড়ে উঠছে। তবুও যত্নের বর্মে ঢাকা জীবনে প্রাচুর্য আর অভাবের তারতম্য ঠিক কী সেটা যেন পুরোটা বুঝে উঠতে পারে না! সাধারন মধ্যবিত্ত সংসার তাদের – প্রাচুর্য না থাকলেও খাওয়া পরার তো অভাব নেই! খাওয়া নিয়ে ভারী খুতখুঁতে মেয়েটি – মুখরোচক রান্না না হলে পাতে ভাত পড়ে থাকবেই! বলা বাহুল্য কপালে মায়ের বকাঝকাও জোটে নিয়মিত।

“ভাত ফেলবি না! কত মানুষ খেতে পায় না জানিস!” এ বুলি মায়ের মুখে সারাক্ষণ!

সে কথা জানে একটু আধটু মেয়েটা! বাড়িতে আসেন এক দু’জন খঞ্জনি বাজিয়ে ভিক্ষে করতে। দয়ার শরীর মেয়েটির – বাটি ভ’রে চাল ডাল আলু ঢেলে দেয় মানুষগুলির ঝোলায়! ভাবে, ‘আহারে বড্ড কষ্ট ওদের!’

এমন সময় হাতে এল প্রফুল্ল রায়ের সদ্য প্রকাশিত বই, “আকাশের নীচে মানুষ!” লাইব্রেরি থেকে নিয়ে এল দাদা!

“প্রফুল্ল রায়ের নতুন বই? আমি পড়ব আগে!” নাকি সুরে আবদার ছোটো বোনের।

ও মা! কী সদয় দাদাটি!

“পড়বি? আচ্ছা পড়! একটু আলাদা গোত্রের বই কিন্তু এটা! তুই পড়ে জানাবি আমাকে বইটা কেমন লেগেছে – তারপর আমি পড়ে দেখব তুই ঠিকঠাক বুঝতে পেরেছিস কিনা!”

রবিবার সকালে এল বইটি – শুরু হল পড়া।

অক্ষরে অক্ষরে থমকায় মেয়েটি – ভাবে এ কোন জায়গা আর জগতের কথা লিখেছেন লেখক? আজকের দুনিয়ায় দাস প্রথা? দাসপ্রথার কথা মেয়েটি জানে না তা তো নয় – ইতিহাসে পড়েছে বিশদ! পড়েছে ‘আঙ্কল টমস কেবিন,’ জেনেছে দাসেদের নির্যাতিত জীবনকাহিনি। পড়েছে প্রেমচন্দের গল্পের অনুবাদ – সেখানে ভূমিদাসেদের কথাও জেনেছে! কিন্তু এই ১৯৮০ সালেও তা আছে? আর কিনা বাড়ির পাশেই বিহার জেলায় ছোটনাগপুর মালভূমিতে? স্বাধীন ভারতবর্ষের বুকে এত এত মানুষ এমনি দাসত্ব ভোগ করছে – ভেবে ভেবে দিশাহারা হয়ে যায় মেয়েটি। বাবাকে জিজ্ঞেস করে এসব সত্যি কিনা। বাবার মুখের পেশিগুলো শক্ত হয়ে ওঠে, নীরবে ঘাড় নাড়েন।  

বিশ্বাস হয় না মেয়েটার! বুকের মধ্যে আকুলি বিকুলি করে। একটানা পড়ে চলে আর ভাবে – কী হবে ধর্মা আর কুশীর? জুটবে কি তাদের মুক্তি? ধর্মার যে অত সাহস নেই গণার মতো পালিয়ে যাবার! আর যাবেই বা কী করে! দুটো পরিবারের এতগুলো মানুষকে নিয়ে কি পালানো সম্ভব? তাই ধর্মা প্রাণপণে পয়সা জমিয়ে চলে। পাখি মেরে বেচে আসে শহরে – কাজের ফাঁকে সময় পেলেই বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় কিছু না কিছু ধান্দায়। ধর্মার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটিও যেন চলে – সেও যেন বন বাদাড় পেরিয়ে দেখে রাখে ধর্মাকে! আশঙ্কায় ভোগে কিছু হয়ে গেল না তো!

ভোটের রাজনীতি কী সেটা বুঝতে শিখেছে মেয়েটি – জানে যে ভোটের আগে প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি চলে! একটা ভোট পাওয়ার জন্য প্রার্থীরা কী না করে! তবুও জানা ছিল না এই মানুষগুলোর মর্মান্তিক কাহিনি – দুটো লাড্ডু পাবার জন্যে এই আর্তি!

এক নিঃশ্বাসে পড়ে চলে বইটা – ইসস, স্কুলে যদি নিয়ে যাওয়া যেত! স্কুলে ক্লাসের ফাঁকেও সে ভাবে কী হবে এরপর? ধর্মা কি মুক্তি পাবে?

টিরকের কাছ থেকে টাকাটা পেলেই স্বাধীন হয়ে যাবে – এই স্বপ্ন দেখে ধর্মা। রোজ পাখি বেচে এসে টাকা গোনায় ধর্মা আর কুশী – মাস্টারের কাছে। দোসাদটোলার সেই একমাত্র মাস্টারমশাই যিনি কোনদিন আশা ছাড়েন না – ভাবেন একদিন না একদিন এই অচ্ছুত দোসাদ ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তুলবেনই!

হরিণের ছানা যখন ধর্মা পেল না মনটা খারাপ হয়ে গেল মেয়েটির – তারপরই আশার আলোর ঝলকানি! চিতার ছানা এনে দিলে অনেক টাকা পাবে ধর্মা! কিন্তু চিতার ছানা আনা কি এত সোজা কাজ? ধর্মা বাঁচবে তো শেষ পর্যন্ত? ভাবে, আর দ্রুত পড়ে চলে বইটা।

জুটল চিতার বাচ্চা অনেক রক্ত আর ঘাম ঝরিয়ে! মেয়েটা ভেবেছিল যে করেই হোক টাকা তো যোগাড় করেছে এবার বুঝি মুক্তি হবে।

চিতার ছানার বদলে অভীষ্ট অর্থ পেয়েও স্বাধীনতা কি জুটল ধর্মা আর কুশীর কপালে?

সেই  তেরোবছর বয়সে মেয়েটি পৃথিবীর কালো জমাট বাঁধা অন্ধকার দিকটা চেনেনি ততটা। তাই আশা করেছিল যে জিতে যাবে ধর্মা – হয়ে যাবে স্বাধীন। হায় রে, জেতা কি এতই সোজা?

স্বাধীনতার দাম যে কতখানি প্রথম মেয়েটি বুঝতে শিখল ‘আকাশের নীচে মানুষ’ পড়ে!

‘আকাশের নীচে মানুষে’র রেশ রয়ে গেল মেয়েটির মনে অনেক অনেক দিন – মনে হয় আজীবন!

পরের বছর ঠিক গরমের ছুটির আগেই হাতে এল প্রফুল্ল রায়ের আরেকটি সদ্য প্রকাশিত নতুন বই!

‘ভাতের গন্ধ!’

অত মোটা নয় পাতলা বই – আর ছুটিও আছে। তাই পড়ে ফেলা যাবে একটানা!

প্রবল ধাক্কা আবার পেল মেয়েটি প্রথম পাতা পড়তে পড়তেই!

একমুঠো ভাতের এত দাম? শুধু ভাত খাবার জন্য দশ – বিশ – পঁচিশ দিন হেঁটে হেঁটে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় আসে মানুষ? তাও সেই ভাত কিন্তু আসা মাত্রই পাবে না! কবে ফসল উঠবে – মাঠে পড়ে থাকবে তুলে নিয়ে যাবার পর ঝরে যাওয়া ধান – সেই ধান কুড়িয়ে, খোসা ছাড়িয়ে তবে জুটবে একমুঠো ভাত!

এ কোন দুনিয়া যেখানে মানুষ শুধু ধানের গন্ধ শোঁকে আর স্বপ্ন দেখে এক থালা ভাতের! সব রকম ধানের নাম আর গোত্র মুনোয়ারপ্রসাদ জানে, জীবনে কবে একবার পায়েস খেয়ে ছিল সেই কথা আজীবন মনে রেখেছে, কোন চালে ভাতে ভাত খেতে ভালো – কবে খেয়েছে তার কথা আওড়ায়!

একটার পর একটা লাইন পড়ে, থমকায় আর ভাবে মেয়েটি!

বাড়িতে কাঁচকলা পেকে গেলে সেগুলো আর ব্যবহার করা হয় না! বন থেকে সেই বাগনর বা পাকা কাঁচকলা পাবার জন্য কত পরিকল্পনা – কত মারামারি! মেয়েটার মনে হয় ওই পাকা কাঁচকলা ফেলে দেওয়াই যেন এক বিলাসিতা! একমুঠো ভাতের যে এত দাম কোনও দিন কল্পনাও করেনি মেয়েটি! ‘ভাত ফোটার সুবাস’ এর কথা পড়ে মেয়েটা বাড়িতে যখন ভাত ফোটে সামনে গিয়ে দাঁড়ায় – অনুভব করতে চায় মানুষগুলোর অনুভূতি। অজান্তে চোখের কোন ভরে ওঠে জলে!

চরিত্রগুলো মনে ঘোরাফেরা করে – দুর্বল হাড্ডিসার শাশুড়িকে নিয়ে আসা লাখপতিয়া, মাঝবয়েসি ধানোয়ার, পঙ্গু অনাথ প্রতিবন্ধী মেয়ে ছনেরিকে পিঠে বয়ে নিয়ে আসা লছমন – যে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারাল পরসাদী বলে মেয়েটিকে বাঁচাতে গিয়ে।

বুড়ি শাশুড়ি যখন রোজ ভাতের জন্য কাঁদে বিধবা বৌমা লাখপতিয়া মায়ের মতন তাকে সান্ত্বনা দেয়, বুড়ির খিদে মেটায় যে কোনও ভাবে। তারপর যেদিন দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর গরম ভাত জোটে তখন সবটুকুই ঢেলে দেয় শাশুড়ির পাতে।

একই রকম ভাবে ধানোয়ার তার ভাতটুকু দিয়ে দেয় ছনেরিকে, তারপর দুটি পাকা কুল খেয়ে ক্ষুণিবৃত্তি করে।

দুই চরিত্র ধানোয়ার আর লাখপতি রাতে কথা বলে, আর নিজেদের এই স্বার্থত্যাগে নিজেরাই অবাক হয়ে যায়!

সর্বস্বহারা রিক্ত মানুষগুলোর মধ্যে এমন ভালোবাসা – এমন জীবনবোধের কাহিনি কিশোরী মনের মধ্যে যে কোন অজানা তরঙ্গ তোলে – সে নিজেই জানে না শুধু এক অদ্ভুত চেতনার উন্মেষ ঘটে মনে!

দিন কেটে যায়। কিশোরী থেকে যুবতী – যুবতী থেকে প্রৌঢ়া। মেয়েটির জীবন বয়ে চলে দেশ থেকে বিদেশে। প্রবাসী জীবন, প্রাচুর্য চারদিকে – তবু দু’টি চাল ছড়িয়ে গেলে বা দু’টি ভাত নষ্ট হলে মনে পড়ে এক দানা ভাতের জন্য অপেক্ষা করে মাসের পর মাস কত মানুষ!

মনে দাগ কাটা সেই লাইনগুলো ঘুরে ফিরে আসে, “গরম ভাতের সুগন্ধ নাকের ভেতর দিয়ে শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে যেতে থাকে! হে রামজি, কতকাল সে ভাত খায়নি!”

অদিতি পেশায় গণিতের অধ্যাপক। নেশা লেখালেখি। বাস আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে। আনন্দবাজার পত্রিকা, সানন্দা, বাংলা লাইভ, অপার বাংলা, বাতায়ন, শব্দের মিছিল, ও কলকাতা, ড্যাশ পত্রিকা সহ পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। আমেরিকা থেকে প্রকাশিত 'অভিব্যক্তি নিউ জার্সি' পত্রিকার সম্পাদক।

4 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Sagarika Ray , July 17, 2025 @ 1:49 am

    লেখাটি মনোমুগ্ধকর

    • অদিতি ঘোষ দস্তিদার , July 17, 2025 @ 12:41 pm

      অসংখ্য ধন্যবাদ বন্ধু!

  • Alokananda Ghosh , July 17, 2025 @ 3:14 am

    তোমার লেখা সব সময়ই টানে। বুক ফেয়ার থেকে বই কিনে তাই এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলি। কিন্তু এটা অন্য স্বাদের। তোমার আজকের ‘তুমি’ হয়ে ওঠা মাঝে মাঝেই ঝিলিক দিয়ে গেল। শুধু বই এর অঙ্কই কষোনি, জীবনের জটিল অঙ্কও সমাধান করেছে, যেদিন পড়লাম ফেবু তে ইণ্ডিয়া থেকে সজনে বীজ নিয়ে অন্য দেশের মাটিতে ফলিয়েছ সজনে ফুল, তোমার আবহমান কালের প্রেমিক কে খাওয়াবে বলে। অদ্ভুত সুন্দর মর্যাদাপূর্ণ ভালবাসার এই জীবনে আরো পল্লবিত হও, শুভেচ্ছা রইল। ❤️

    • অদিতি ঘোষ দস্তিদার , July 17, 2025 @ 12:43 pm

      এমন পাঠিকাকে আর কীই বা বলি! একটু সংশোধন, ইন্ডিয়া থেকে সজনের বীজ আনাইনি, আমাজনে কিনেছি। কারণটা অবশ্য সত্যি! এত্ত ধন্যবাদ!

Leave a Reply to Alokananda Ghosh Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *