জয় গোস্বামীর কবিতায় প্রেমচেতনা

জন্মান্ধ মেয়েকে আমি জ্যোস্নার ধারণা দেব ব’লে
এখনো রাত্রির এই মরুভুমি জাগিয়ে রেখেছি।
একজন কবি যে কবিতা রচনা করেন, তা নেহাত লেখালেখা খেলা নয়। কবিতা তার মাথা তোলবার, বেঁচে ওঠবার ভালবাসার অনন্য অবলম্বন। তিনি মানেন, স্বপ্নের মতো কবিতাতেও সমস্তই সম্ভব। তবু কবিতার জগৎ শুধু স্বপ্নেরই জগৎ নয়।
কবিতা কবির ব্যাপ্ত, বিশাল আত্মজীবনী। এক একটি কবিতা আত্মজীবনীর এক একটি পৃষ্ঠা।
(ব্লার্ব, কবিতাসংগ্রহ ৪, আনন্দ )
ঠিক তাই। কবি যে জীবন যাপন করেন, যে সমাজ বা রাষ্ট্রিক পরিমণ্ডলে বাস করেন, যে জীবন ফেলে আসেন, যা তাঁর স্বপ্ন-স্মৃতি, অধরা মায়া… তার সবকিছুই কবিকে আঁকড়ে ধরে, সাপটে-জাপটে নেয় অক্ষর-শব্দের মায়াজালে। কবি তাই ক্রমাগত নির্মাণ করেন নিজেকে। খনন করেন আপনাকে। তাঁর বোধে প্রকৃতি, প্রেম, অসূয়া, প্রতিহিংসা, উত্থান-পতন, সামাজিক অবয়ব, সবই রেখাপাত করে গভীর ভাবে। অর্থাৎ গোটা জীবনটাই উঠে আসে কবিতায়। কবি জয় গোস্বামী সেই কবি, যিনি কবিতায় তাঁর গোটা আত্মজীবনী রেখে গেছেন। শব্দের হাত ধরে অক্ষরের বিন্যাসে সেই আত্মউন্মোচিত জীবনে ‘প্রেম’ যেন এক পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিয়েছে। অনন্য উজ্জ্বল আলো হয়ে ফুটে উঠেছে। আর বিমগ্ন আতুর কবি সেই বহুধা বিভক্ত বর্ণচ্ছটায় পথ হেঁটেছেন। তিনি চিরকালীন প্রেমিক কবি। আজ আমাদের আলোচনা কবির সেই প্রেমচেতনা।
রবীন্দ্র-জীবনানন্দ পরবর্তীতে শক্তি-সুনীল-শঙ্খ ঘোষ পেরিয়ে কবিতার এক নিজস্ব ভুবন তৈরি করেছেন কবি জয় গোস্বামী। তাঁর পরিধিতে তিনিই সম্রাট। এক কথায় বলা যায় তাঁর কবিতা চিত্ররূপময়। ছন্দ, অলংকার, উপমা, চিত্রকল্প, প্রয়োগে ঈর্ষনীয় জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন কবি। ছন্দের ভূমিতে দাঁড়িয়ে প্রেমে-অপ্রেমে তিনি কবিতার যে নিটোল গৃহ বানিয়েছেন, সেখানে ছায়াকামিতায় অনায়াসে ক্লান্ত তপ্ত আগ্রহী পথিক পাঠক নিশ্চিত বসবাস করতে পারেন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন
এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদা
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম। (পাঁচালীঃ দম্পতি কথা)
জয় গোস্বামীর প্রেমের জগত বিচিত্র বিভায় আলোকিত। সেখানে যেমন আর্তি আকুলতা আছে, বিরহ, অভিসার, সমর্পণ, মিলন, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, আছে। আলো আছে, ভালো আছে, আবার কালো অন্ধকারও আছে। ক্ষমার সঙ্গে সহ্য যেমন, তেমনই অগ্রাহ্যের সঙ্গে আছে প্রতিবাদ। প্রাক্তন, বর্তমান, আর আগামী এই তিনস্তরের প্রেমই দেখি তাঁর রচনায়। কিশোরকাল থেকে কবি প্রেমকে দেখেছেন কখনও দূর থেকে, কখনও বা কাছ থেকে। বৈধ, অবৈধ, প্রকাশ্য, বা আড়াল সব ধরনের প্রেম তাঁর কবিচেতনাকে ঋদ্ধ করেছে। কবির প্রেমচেতনা বহুরৈখিক। সেখানে বিশ্বাস অবিশ্বাস সমান ভাবে দোলে। তবে, প্রেমের ব্যর্থতা, আশাভঙ্গ তাঁকে বেশি ব্যথাতুর করেছে।
প্রাকৃতিক নিয়মে প্রেম আসে মানবজীবনে। এই প্রেম নগর গ্রাম মানে না। স্বীকৃতি অস্বীকৃতি ভাবে না। আপন ভাবেই বিভোর। নিজের গমনে সে সমৃদ্ধ। কবি জয়ের কবিতায়ও সেই অনুরাগের ছোঁয়া স্পর্শময়।
বেণীমাধব, মোহনবাঁশি তমাল তরুমূলে
বাজিয়েছিলে, আমি তখন মালতী ইস্কুলে
ডেস্কে বসে অঙ্ক করি, ছোট্ট ক্লাসঘর
বাইরে দিদিমণির পাশে দিদিমণির বর
আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন শাড়ি
আলাপ হলো, বেণীমাধব, সুলেখাদের বাড়ি। (মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়)
এই প্রেম কখন স্তিমিত, কখনও বা গুটি গুটি ভীরু পায়ে সংকোচের সঙ্গে হাঁটে। “স্বপ্নে” কবিতায়–
ক’টা বাজলো? উঠে পড়লি তুই
সব ঘড়িকে বন্ধ করল কে?
রাগ করবি? হাতটা একটু ছুঁই?
বাড়ির দিকে এগিয়ে দিচ্ছি তোকে…
স্বপ্নে তোকে এগিয়ে দিই যদি
তোর বরের তাতে কি যায় আসে?
সত্যি বলছি, বিশ্বাস করবি না
স্বপ্নে আমার চোখেও জল আসে! (স্বপ্ন)
ভীরু আর অচরিতার্থ প্রেম এক সময় কেঁপে ওঠে। অভিশাপ ছুঁড়ে দেয় তথাকথিত সভ্য সমাজের দিকে। তার প্রতিবাদী কণ্ঠে কবি এভাবেই সোচ্চারে প্রশ্ন জুগিয়েছেনঃ
রাতে এখন ঘুমাতে যাই একতলার ঘরে
মেঝের উপর বিছানা পাতা, জ্যোৎস্না এসে পড়ে
আমার পরে যে বোন ছিলো চোরাপথের বাঁকে
মিলিয়ে গেছে, জানি না আজ কার সঙ্গে থাকে
আজ জুটেছে, কাল কী হবে? – কালের ঘরে শনি
আমি এখন এই পাড়ায় সেলাই দিদিমণি
তবু আগুন, বেণীমাধব, আগুন জ্বলে কই?
কেমন হবে, আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই? (মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়)
আবার জয়ের প্রেম বৈধতা অবৈধতা গ্রাহ্য করে না। সে জানে বন্ধুর বিশ্বাস। আর নিজের মত হাঁটা।
কলঙ্ক, আমি কাজলের ঘরে থাকি
কাজল আমাকে বলে সমস্ত কথা
কলঙ্ক, আমি চোট লেগে যাওয়া পাখি—
বুঝি না অবৈধতা।
…
কলঙ্ক, তুমি প্রদীপ দেখেছো? আর প্রদীপের বাটি?
জানো টলটল করে সে আমার বন্ধুর দুই চোখে?
আমি ও কাজল সন্তান তার, বন্ধুরা জল মাটি
ফিরেও দেখি না পথে পড়ে থাকা
বৈধ-অবৈধকে—
যে যার মতন রোদবৃষ্টিতে হাঁটি… (কলঙ্ক কাজল)
“স্নান” কবিতায় তিনি দুরন্ত বেপরোয়া প্রেম চিনিয়েছেন আমাদের। দাবি করেছেন পুরুষের অধিকার।
আজ যদি বলি, সেই মালার কঙ্কালগ্রন্থি আমি
ছিন্ন করবার জন্য অধিকার চাইতে এসেছি? যদি বলি
আমি সে-পুরুষ, দ্যাখো, যার জন্য তুমি এতকাল
অক্ষত রেখেছো ওই রোমাঞ্চিত যমুনা তোমার? (স্নান)
নারী-পুরুষের সম্পর্কের সার্থকতা তাদের প্রেমে। সে প্রেম জাগরণের মন্ত্র শেখায়। আর কবি জন্মান্ধ মেয়েকেও জ্যোৎস্নার ধারনা দিতে চান। প্রেমের স্বরূপ বোঝাতে চান।
মর্মে মর্মে রোমান্টিক কবি জয় গোস্বামী যেমন রাত্রির মরুভূমিতে জ্যোৎস্না ফোটান, তেমনই প্রেমের আবহমান যাত্রায় যে অতৃপ্তি তাকেও স্পর্শ করেন গভীর ভাবে। তাই মন খারাপের এই সন্ধ্যাফেরি আমাদের অন্য প্রেমের স্বাদ দেয়।
সে যে কী সম্পর্ক সব। কাউকে জানিয়ে না।
সে সবই লবণ স্বাদ। অশ্রুবিষে লোনা।
অশ্রু লবণাক্ত শুধু? রক্ত বুঝি নয়?
সে-প্রেমে রক্তের স্বাদ। খেলে নেশা হয়। (সন্ধ্যাফেরি)
হ্যাঁ, তাঁর প্রেম সব সময় সমাজবৈধ না। সে মাঝেমধ্যে অবৈধ পরকীয়ার পথ ধরে। নিষিদ্ধ ছায়ান্ধকারে তার চলন। আর এই চলন যখন গমনের পথ পায় না, তখন সে আত্মবিনাশের সিদ্ধান্ত নেয়।
ওই যে প্রেমিক আর ওই যে প্রেমিকা—
প্রচুর ঘুমের পিল ব্যাগে, নিয়ে ঘুপচি-মতো হোটেলে উঠেছে
ওই যে যুবক আর ওই যে যুবতী
ফলিডল শিশি নিয়ে চুপচাপ দরজা দিচ্ছে ঘরে
ওই যে ছেলেটি আর ওই যে মেয়েটি
রেললাইনের ধারে, ঝোপঝাড়ে, দাঁড়িয়ে রয়েছে সন্ধ্যেবেলা
দূরে লোকালের আলো
আজ, কাল, পরশু, তরুণ ওদের সবাইকেই
অপঘাতে মৃত রূপে খুঁজে পাওয়া যাবে…
ওরা তো মাস্টার ছাত্রী, দেওর বৌদি তো ওরা
ওরা তো সুদূর সম্পর্কে ভাইবোন
লোকচক্ষু থেকে ওরা এই পথে বাইরে চলে এল। (পরিশিষ্ট: পাতার পোশাক)
আবার এই প্রেমে আছে আস্থাহীন অবিশ্বাস। আধুনিক মানব-মানবীর অন্তঃসারশূন্য সুড়ঙ্গ-জীবন। প্রেম এখানে খুঁজে নিচ্ছে অন্য অবলম্বন।
সে রেখেছে বুকে মাথা। বন্ধ চোখ। সিঁথির উপরে
আমার চিবুক রাখা। কাঁচাপাকা দাড়ি ভর্তি গালে
ওর হাতটি থেমে গেল। আমার গলায় পড়ছে ঘন, দীর্ঘশ্বাস।
শরীরে আসেনি কাম। শুধু চোখ ভ’রে এল জলে।
সে ফুঁসে উঠেছে: ‘তুমি আর কাউকে সব দিয়ে এসেছে আগেই!’ (বিশ্বাস: বিকেলবেলায় কবিতা ও ঘাসফুলের কবি)
না, অত সহজ না জীবন। ফল্গুধারার মতো, তুষের আগুনের মতো ধিকি ধিকি জ্বলে প্রেম অবিনশ্বর।
কী ছিল সম্পর্ক আমাদের।
মেয়ে একটা হাত ধরল, তুমি ধরে রাখলে অন্য হাত—
ভিড়ের ভিতর দিয়ে পথ ক’রে দিয়েছে অন্ধের।
আগেই বলেছি জয় গোস্বামী জীবন অন্বেষক কবি। জীবনকে তিনি সাপটে জাপটে ধরেন। তাই তাঁর প্রেম-অনুভূতি এত বর্ণিল, এত স্তরবিশিষ্ট। পরতে পরতে জমে পেলবতার পলি। আর সেই পলি খনন করলে উঠে আসে জীবনদায়ী স্বচ্ছ জল। যা পান করে আমরা তৃপ্ত হই।
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঝোলভাত জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে মাংসরুটি কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নিরক্ষর জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে চার অক্ষর কাটাব জীবন।
…
পাগলী, তোমার সঙ্গে কাঁচা প্রুফ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ফুলপেজ কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে লে আউট জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে লে হালুয়া কাটাব জীবন। (পাগলি, তোমার সঙ্গে)
তবুও অনন্ত ধরে মেঘবালিকারা উঠে আসে। এক পৃথিবী লিখতে পারেন কথক কবি তাদের জন্য। সংবেদী হৃদয় আর অনুচ্চার ভালোলাগা নিয়ে কবি হেঁটে যান সময়ের পথে। প্রেমের আলপনা মাড়িয়ে স্নিগ্ধ সবুজ ঘাসে ঢাকা তাঁর শাশ্বত শ্যামশ্রী ইচ্ছার কাছে।
আমি বললাম, “তোমার জন্যে
নতুন ক’রে লিখব তবে।”
সে বলল, “সত্যি লিখবি?
বেশ তা হলে
মস্ত করে লিখতে হবে।
মনে থাকবে?
লিখেই কিন্তু আমায় দিবি।”
আমি বললাম, “তোমার জন্যে
লিখতে পারি এক পৃথিবী।” (মেঘবালিকার জন্য রূপকথা)
এইভাবে রক্ত-বিষে মিশে, অনুরাগ আর বিষাদ ছুঁয়ে, ক্লান্তি-ক্লান্তিহীনতায় ভেসে, মর্যাদা ও অপমান মেখে কবি জয় গোস্বামীর প্রেম শাশ্বত আনন্দবিভা নিয়ে এক পৃথিবী হেঁটে গেছে।
—–
ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত