ডিজিটাল দিগন্তের পথে

ডিজিটাল দিগন্তের পথে

ভার্চুয়াল রিয়ালিটিতে মহাকাশ ভ্রমণ

গুপি-বাঘার ইচ্ছে মতো পৌঁছে গেলাম টিমবাকটু থেকে টোকিও, নীল তিমিদের সঙ্গে ভিড়ে গিয়ে নির্দ্বিধায় ডুব দিলাম মারিয়ানা ট্রেঞ্চের অতল গভীরতায়। আবার দুটোই যদি না পোষায় তাহলে সময়যানের যাত্রী হয়ে নিমেষে চাক্ষুষ করলাম অতীত এবং ভবিষ্যতে আমার প্রাণের শহরের রূপরেখা। এত কিছু করলাম, অথচ সোফা কিংবা বিছানা ছেড়ে এক পা নড়ানোর ঝক্কি নিতে হল না। ভাবছেন স্বপ্ন দেখছিলাম? না, আমি দিব্যি চোখ মেলে আছি। তাহলে ডিসকভারি চ্যানেলের প্রোগ্রাম? উঁহু, টিভির স্ক্রিন যতই বড় হোক না, তাতে এমন কল্পনা এবং বাস্তবের সীমারেখা মুছে দেওয়া অভিজ্ঞতা পাওয়া যায় না। তবে? হ্যাঁ, ঠিক এইরকম প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে অগমেন্টেড এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি নামক দুই বৈপ্লবিক প্রযুক্তি। এরা কেবল আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকেই বদলে দিচ্ছে না বরং আমাদের চারপাশের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করার পদ্ধতিগুলোকেও পুনর্গঠিত করছে। প্রাচীন পাটলিপুত্রের রাস্তায় হাঁটাচলা, ভার্চুয়ালি পোশাক পরে নিজেকে কেমন দেখাচ্ছে তা আন্দাজ করা, বা একটি জটিল অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি অনুশীলন করা। যা একসময় কল্পবিজ্ঞান বলে মনে হত তা এখন বাস্তবতার অংশ হয়ে আমাদের জ্ঞান, অনুভব, এবং উপলব্ধি আরও উন্নত করতে পারছে। যেখানে অগমেন্টেড রিয়েলিটি আমাদের চারপাশের বাস্তব পরিবেশকে ডিজিটাল উপাদানের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করে তোলে, সেখানে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি একটি সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশ তৈরি করে, ব্যবহারকারীকে ডুবিয়ে দেয় পুরোপুরি এক কাল্পনিক জগতে।

গত কয়েক বছরে কম্পিউটিং ক্ষমতা, গ্রাফিক প্রসেসিং, এবং সেন্সর প্রযুক্তির অগ্রগতি এদের নিস্তরঙ্গ ধারণা থেকে মূলধারার প্রযুক্তিতে পরিণত করেছে। আজ এরা আর কেবল গেমিং বা বিনোদনের জন্য সীমাবদ্ধ নয়; বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, খুচরো ব্যবসা, এবং পর্যটন সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনছে। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা ভার্চুয়াল ল্যাবরেটরিতে প্রবেশ করে সরঞ্জামের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে আকর্ষণীয় এবং ইন্টারঅ্যাকটিভ উপায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারছে। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের সার্জেনরা জটিল অস্ত্রোপচারের পদ্ধতিগুলি ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশে অনুশীলন করতে সক্ষম হচ্ছে। এমনকি পিটিএসডি-এর মতো দুরূহ মানসিক রোগের পেশেন্টদের ট্রিটমেন্টের কার্যকারিতাও বেড়েছে এদের ব্যবহারে। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে গ্রাহক অভিজ্ঞতা উন্নততর হয়েছে খুচরোতে ভার্চুয়াল ট্রাই-অন বা রিয়েল এস্টেটে ভার্চুয়াল ট্যুরের মাধ্যমে।

এআর এবং ভিআর আসলে কী?

অগমেন্টেড রিয়েলিটি (এআর) এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) হল এমন দুটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাস্তবতার সঙ্গে যোগাযোগ করার পদ্ধতিকে আমূল বদলে দিয়েছে। এই দুই প্রযুক্তি একে অপরের থেকে আলাদা হলেও তাদের উদ্দেশ্য অভিন্ন—মানুষের অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ এবং ইন্টারঅ্যাকটিভ করা। তবে, এআর এবং ভিআর কীভাবে কাজ করে এবং তাদের মধ্যে কী পার্থক্য, তা বুঝতে হলে তাদের প্রাথমিক ধারণাগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে।

ভিআর হেডসেটের মাধ্যমে আমরা একটি কল্পিত বা সিমুলেটেড জগতে প্রবেশ করি। এই জগতটি হতে পারে একটি মহাকাশযান, একটি প্রাচীন যুদ্ধক্ষেত্র, বা এমনকি সমুদ্রের তলদেশ। হাতে ধরা কন্ট্রোলার বা শরীরের গতির মাধ্যমে সেই পরিবেশের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকট করতে পারি আমরা। আবার এআর আমাদের চারপাশের বাস্তব পরিবেশের উপরেই ভার্চুয়াল তথ্য বা বস্তু “ওভারলে” করে দেয়। এক্সাইটিং, তাই না? এদের কয়েক দশকের ধারাবাহিক উদ্ভাবনের ইতিহাসটাও কিন্তু সমান উত্তেজনাপূর্ণ।

ভিআর-এর যাত্রা আরম্ভ হয় ১৯৬০-এর দশকে। ১৯৬৮ সালে কম্পিউটার বিজ্ঞানী ইভান সাদারল্যান্ড “দ্য সোর্ড অব ডামোক্লেস” নামে প্রথম ভিআর হেডসেট তৈরি করেন যা ছিল ভার্চুয়াল গ্রাফিক্স প্রদর্শন করানোর একটি প্রাথমিক প্রোটোটাইপ। অত্যাধিক ভারী হওয়ার কারণে তখন সেটটা ছাদ থেকে ঝুলিয়ে রাখতে হত। ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে, ভিআর এবং এআর প্রযুক্তি ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে। ১৯৮৭ সালে জারন ল্যানিয়ার ‘ভার্চুয়াল রিয়েলিটি’ শব্দটি প্রথমবারের জন্যে চয়ন করেন। আবিষ্কার হয় ভিআর গগলস এবং ডেটা গ্লাভের মতো সরঞ্জাম। গেমিং ইন্ডাস্ট্রিতে, ১৯৯৫ সালে নিন্টেন্ডো তাদের ‘ভার্চুয়াল বয়’ নামক ডিভাইসটি চালু করে। যদিও এটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়নি, তবু ভিআর প্রযুক্তিকে জনপ্রিয় সংস্কৃতির অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে এর অবদান অস্বীকার করা যায় না। ২০১০ সালে পামার ফ্রিম্যান লাকি নামে এক আমেরিকান উদ্যোগপতি, ‘অকুলাস রিফট’ নামের প্রোটোটাইপ তৈরি করলে ভিআর প্রযুক্তিতে নতুন যুগের সূচনা হয়। উন্নত গ্রাফিক্স ব্যবহারকারীকে অন্য জগতে সম্পূর্ণরূপে ডুবিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা অচিরেই একে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। তুলনায় এআর-এর উত্থান সাম্প্রতিক। ২০১৬ সালে, পোকেমন গো বিশ্বজুড়ে এই প্রযুক্তির জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছিল। গেম ইউজাররা বাস্তব জগতের মধ্যেই ভার্চুয়াল চরিত্র অনুসন্ধান করত।

এআর এবং ভিআর এদের পার্থক্য

যদিও দুটোই আমাদের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করার জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে, এদের মধ্যে বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্যও রয়েছে:

১। পরিবেশ: ভিআর আমাদের একটি সম্পূর্ণ ডিজিটাল পরিবেশে নিয়ে যায়, যেখানে এআর বাস্তব পরিবেশকে সমৃদ্ধ করে।

২। সরঞ্জাম: ভিআর-এর জন্য একটি হেডসেট প্রয়োজন, অন্যদিকে, এআর সাধারণত স্মার্টফোন, ট্যাবলেট বা এআর-সক্ষম চশমাতে ব্যবহার করা হয়।

৩। ব্যবহার: ভিআর সাধারণত গেমিং, প্রশিক্ষণ এবং থেরাপিতে ব্যবহৃত হয়, সেখানে এআর ব্যবহার করা হয় রিটেল, শিক্ষা, এবং রিয়েল এস্টেটে।

এআর এবং ভিআর এদের ব্যবহারিক প্রয়োগ

শিক্ষাক্ষেত্র

স্কুলে প্রত্নতত্ত্ব শিক্ষা

ইতিমধ্যেই অগমেন্টেড রিয়েলিটি (এআর) এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) শিক্ষাক্ষেত্রে নীরব বিপ্লব ঘটাচ্ছে। প্রথাগত পদ্ধতির গণ্ডি ভেঙ্গে এই প্রযুক্তিগুলি শিক্ষাকে আরও আকর্ষণীয়, ইন্টারঅ্যাকটিভ এবং কার্যকর করে তুলছে। যেমন-

১। ভার্চুয়াল ফিল্ড ট্রিপ – শিক্ষার্থীরা ভিআর হেডসেট ব্যবহার করে বইয়ের পাতার বাইরে বেরিয়ে মিশরের পিরামিড, গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ দেখা, বা মহাকাশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারছে। জ্ঞানের ভিত তাতে নিঃসন্দেহে আরও মজবুত হচ্ছে।

২। ইন্টারঅ্যাকটিভ ল্যাব – এআর এবং ভিআর-এর সাহায্যে শিক্ষার্থীরা ঝুঁকিমুক্ত ভার্চুয়াল ল্যাবে কেমিক্যাল অ্যাকশন-রিঅ্যাকশনের পরীক্ষা চালাচ্ছে। বায়োলজিক্যাল এক্সপেরিমেন্টের জন্য ব্যবচ্ছেদ করছে ভার্চুয়াল শব।

৩। অ্যাক্সেসিবিলিটি বৃদ্ধি – বিশেষভাবে সক্ষম শিক্ষার্থীদের জন্যেও এআর এবং ভিআর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যেমন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা ভিআর হ্যাপটিক টুলের সাহায্যে অদৃশ্য বস্তুর গঠন অনুভব করার সুযোগ পাচ্ছে। উদাহরণঃ স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে কোভিড-১৯ মহামারির সময় ভিআর টেকনোলজি ব্যবহার করে ভার্চুয়াল ক্লাসরুম তৈরি করা হয়েছিল।

স্বাস্থ্যক্ষেত্র

চিকিৎসা থেকে থেরাপি এবং পুনর্বাসন পর্যন্ত, এই প্রযুক্তিগুলি চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনছে। যেমন –

ডাক্তারি প্রশিক্ষণে সহায়তা

১। সার্জিকাল প্রশিক্ষণ – ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশে বিভিন্ন জটিল অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি অনুশীলনের সুযোগ পাচ্ছেন সার্জেনরা। হার্ট বাইপাস সার্জারি বা মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচার ভিআর-এর মাধ্যমে বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়াই শেখা সম্ভব।

২। থেরাপি এবং মানসিক স্বাস্থ্য – মানসিক উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, পিটিএসডি এবং বিভিন্ন ভীতি (যেমন উচ্চতা বা ভিড়ের ভীতি) কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে ভিআর। একজন পাইলট তার ফ্লাইট-ফোবিয়া কাটাতে ভিআর ব্যবহার করে ভার্চুয়াল বিমানে সময় কাটাতে পারেন।

৩। পুনর্বাসন – স্ট্রোক বা দুর্ঘটনার শিকার রোগীদের জন্য এআর-ভিত্তিক ইন্টারঅ্যাকটিভ পদ্ধতি তাদের চলাচল বা শক্তি পুনরুদ্ধারে এবং পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণঃ জনস হপকিন্স হাসপাতালে স্পাইন সার্জারি চলাকালীন এআর ব্যবহার করে রোগীর মেরুদণ্ডের 3D মডেল সরাসরি প্রক্ষেপন করানো সম্ভব হয়েছে।

বিনোদনক্ষেত্র

বিনোদনের জগত, গেমিং থেকে লাইভ ইভেন্ট এবং সিনেমা পর্যন্ত, এআর এবং ভিআর, দর্শকদের কল্পনার দুনিয়ায় ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতাকে এক অভূতপূর্ব মাত্রা দিয়েছে। যেমন –

১। গেমিং-এর নতুন দিগন্ত – পোকেমন গো এআর প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যবহারকারীদের বাস্তব জগতের মধ্যে ভার্চুয়াল পোকেমন খোঁজার অভিজ্ঞতা দেয়। অন্যদিকে, বিট স্যাবার এর মতো ভিআর গেমগুলি ব্যবহারকারীদের সম্পূর্ণ ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ডুবিয়ে দেয়।

২। লাইভ ইভেন্ট এবং কনসার্ট – আজ আমরা ঘরে বসে ভার্চুয়াল কনসার্টে উপস্থিত হতে পারি, বা খেলার মাঠে উপস্থিতির অভিজ্ঞতা নিতে পারি। আমেরিকায় ন্যাশানাল বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশন মেটা কোয়েস্ট ডিভাইসের ভিআর ব্যবহার করে দর্শকদের জন্য কোর্টের পাশে বসে খেলা দেখার অভিজ্ঞতা প্রদান করেছে।

৩। সিনেমা এবং থিম পার্ক – ৩৬০-ডিগ্রি সিনেমার মাধ্যমে দর্শকরা এমন দুনিয়ায় চলে যাচ্ছে যেখানে তারা কাহিনির একটি অংশে পরিণত হয়। থিম পার্কে, ডিজনি এবং ইউনিভার্সাল স্টুডিওস এআর এবং ভিআর ব্যবহার করে এমন সব রাইড তৈরি করেছে, যা দর্শকদের অভিজ্ঞতাকে আরও ইন্টারঅ্যাকটিভ এবং আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

ব্যবসাক্ষেত্র

অগমেন্টেড রিয়েলিটি (এআর) এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) ব্যবসা ক্ষেত্রে নিত্যই নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। খুচরা বিক্রয় থেকে প্রশিক্ষণ এবং রিয়েল এস্টেট পর্যন্ত, এই প্রযুক্তিগুলি ব্যবসার কার্যক্রম এবং গ্রাহকের অভিজ্ঞতাকে আরও উন্নত করছে। যেমন –

১। রিটেল বিজনেস এআর এবং ভিআর – গ্রাহকেরা এআর অ্যাপ ব্যবহার করে পোশাক বা মেকআপের ভার্চুয়াল ট্রায়াল দিতে পারেন। IKEA-এর মতো ব্র্যান্ডগুলি এআর অ্যাপ চালু করেছে, যার সাহায্যে ক্রেতারা ঘরে ভার্চুয়াল আসবাবপত্র বসিয়ে দেখার সুযোগ পান। এতে সম্ভাব্য ক্রেতাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াটা সহজতর হয়।

রেস্ট্যুরন্টে রান্নার প্রণালী শিক্ষা

২। প্রশিক্ষণ এবং কাজের পরিবেশ – তেল শোধনাগার বা নির্মাণ শিল্পের কর্মীরা ভিআর সিমুলেশনের মাধ্যমে বিপজ্জনক পরিস্থিতির মোকাবিলা করা শিখছেন। অফিসকর্মীদের জন্যে ভিআর মিটিং প্ল্যাটফর্ম শারীরিকভাবে দূরে থেকেও বোর্ডরুম মিটিং এবং সহযোগিতার সুযোগ করে দিচ্ছে।

৩। রিয়েল এস্টেট – সশরীরে উপস্থিত না হয়েও ক্রেতারা ভিআর ট্যুরের মাধ্যমে বাড়ি বা অফিস স্পেস দেখে নিতে পারছেন।

পর্যটনক্ষেত্র

বিনোদনের মতো পর্যটনশিল্পও প্রযুক্তির ব্যবহারে নতুন মাত্রা পেয়েছে। যেমন –

১। ভার্চুয়াল ট্যুর – যারা শারীরিকভাবে ভ্রমণ করতে অক্ষম বা আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে ভ্রমণ করতে পারেন না, তারা ভিআর হেডসেটের মাধ্যমে অনায়াসে গ্রেট ওয়াল অফ চায়না, আইফেল টাওয়ার, বা তাজমহল ঘুরে আসতে পারেন।

২। এআর ট্রাভেল গাইড – স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট ব্যবহার করে পর্যটকরা তাদের আশেপাশের ল্যান্ডমার্ক সম্পর্কে ডিজিটাল তথ্য পেতে পারেন। কোনও ঐতিহাসিক স্থানের দিকে ফোনের ক্যামেরা তাক করলেই সেটি ওই জায়গার ইতিহাস, স্থাপত্যের বিবরণ, এবং অন্যান্য আকর্ষণীয় তথ্য জানিয়ে দেবে।

৩। হোটেল এবং রিসর্ট – ভ্রমণ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ভিআর-এর ভূমিকা বেশ অভিনব। গন্তব্য সম্পর্কে আগাম পরিষ্কার ধারণা করতে ভিআর অ্যাপে গাইডেড হাইকিং ট্রেল বা সমুদ্র সৈকতের পরিবেশ অনুভব করে নিতে পারি আমরা। উদাহরণঃ ল্যুভ মিউজিয়াম একটি এআর-ভিত্তিক অ্যাপ চালু করেছে যা ভিজিটরদের প্রদর্শনী সম্পর্কে বিশদ তথ্য প্রদান করে। একইভাবে, মালদ্বীপের রিসর্টগুলো সম্ভাব্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে ভিআর অ্যাপের সাহায্যে।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

ভবিষ্যতে এআর-সমৃদ্ধ চশমা স্মার্টফোনকে সম্পূর্ণভাবে প্রতিস্থাপন করবে। অর্থাৎ ফোন বের করার ঝামেলা থাকবে না, আমাদের চোখের সামনেই ভেসে উঠবে সকল প্রয়োজনীয় তথ্য। অচেনা রেস্তোরাঁয় ঢুকতে না ঢুকতেই জানতে পেরে যাব মেনু, রিভিউ, এমনকি কোন টেবিলটি ফাঁকা রয়েছে সেটাও। ভিআর কেবলমাত্র বিনোদন, শিক্ষা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, বা পর্যটনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আগামি দিনের নভোচারীরা এর মাধ্যমে ইন্টারস্টেলার অভিযানের প্রস্তুতি নেবে। মাধ্যাকর্ষণহীন অবস্থায় মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুর প্রতিক্রিয়া জানতে, মহাকাশযান চালাতে, বা মঙ্গল গ্রহে অবতরণের মতো জটিল পরিস্থিতি—সবই তারা ভিআর-এর মাধ্যমে পৃথিবীতে বসেই অনুভব করতে পারবে। প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের বাস্তবতার ধারণাকেই বদলে দেবে, যেখানে জীবন, কাজ, এবং বিনোদনের মধ্যেকার পার্থক্যগুলো ক্রমশ বিবর্ণ হয়ে যাবে।

এআর এবং ভিআর চ্যালেঞ্জ এবং সীমাবদ্ধতা

অগমেন্টেড রিয়েলিটি (এআর) এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) প্রযুক্তি আধুনিক বিশ্বে অগণিত সুযোগ এনে দিলেও, এদের কিছু উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। যেমন –

১। ব্যয়বাহুল্য এবং অ্যাক্সেসিবিলিটির সমস্যা – অন্যান্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মতো এআর এবং ভিআর-এরও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে একটি হল উচ্চ ব্যয়। উন্নত মানের ভিআর হেডসেট, যেমন মেটা কোয়েস্ট বা এইচটিসি ভাইভের দাম কয়েকশো থেকে হাজার ডলার পর্যন্ত হতে পারে। এর সঙ্গে প্রয়োজন উচ্চ ক্ষমতার কম্পিউটার বা স্মার্টফোন। এসবই উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলোয় সহজলভ্য নয়।

২। স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি – এআর এবং ভিআর প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন –

    • মোশন সিকনেস: ২০১৬ সালে জনপ্রিয় ভিআর গেম ইভ: ভ্যালকাইরি” খেলার সময় অনেক ব্যবহারকারী মাথা ঘোরা এবং বমি বমি ভাব অনুভব করেছিলেন। গেমটি ব্যবহারকারীদের ভার্চুয়াল স্পেসশিপ চালানোর অভিজ্ঞতা দেয়, কিন্তু দ্রুতগতির দৃশ্য এবং বাস্তবের সঙ্গে ভার্চুয়াল গতির অমিলের কারণে অনেকেই আরামদায়কভাবে খেলতে পারেননি। ডিজনি থিম পার্কে ‘আভাটার ফ্লাইট অফ প্যাসেজ’ রাইডে চড়তে গিয়ে আমারও একই অনুভূতি হয়েছিল।
    • চোখের ক্লান্তি: দীর্ঘক্ষণ ভিআর হেডসেট বা এআর স্ক্রিন দেখার ফলে চোখের চাপ বা মাথাব্যথা হতে পারে।
    • অতিরিক্ত ব্যবহার: ভার্চুয়াল পরিবেশে দীর্ঘ সময় কাটানোর ফলে বাস্তব জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কিছু ব্যবহারকারী ভার্চুয়াল অভিজ্ঞতায় এতটাই নিমগ্ন হয়ে পড়েন যে তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমিই যেমন একদিন পোকেমন গো খেলতে গিয়ে বন্ধুর চায়ের কাপ উল্টে দিয়েছিলাম।

৩। গোপনীয়তা এবং সুরক্ষা সংক্রান্ত উদ্বেগ – এআর এবং ভিআর ডিভাইসগুলি ব্যবহারকারীদের স্থান, শারীরিক গতিবিধি, এবং এমনকি বায়োমেট্রিক ডেটা সংগ্রহ করে। এই ডেটা সঠিকভাবে সুরক্ষিত না থাকলে তা হ্যাকারদের হাতে পড়তে পারে। ডেটার বাণিজ্যিক ব্যবহার বা বিক্রির মাধ্যমে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হওয়াও সম্ভব। ২০১৮ সালে ‘পোকেমন গো’-র বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে গেমটি ইউজারদের জিপিএস ডেটা এবং চলাচলের প্যাটার্ন রেকর্ড করছে।

৪। কনটেন্ট রেগুলেশন এবং নৈতিক প্রশ্ন – এআর এবং ভিআর কন্টেন্টের নিয়ন্ত্রণও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ভিআর গেমিং প্ল্যাটফর্মে ভায়োলেন্সের মাত্রা খুব বেশি হলে এবং শিশু বা কিশোরদের জন্য কনটেন্ট ফিল্টার করার ব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত না হলে তারা এমন বিষয়বস্তুর সম্মুখীন হতে পারে যা তাদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ২০২১ সালে একটি জনপ্রিয় ভিআর প্ল্যাটফর্ম ‘রেক রুম’ কনটেন্ট ফিল্টারিং এবং শিশু সুরক্ষার জন্য নীতি প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়েছিল।

৫। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা – প্রযুক্তির দ্রুত উন্নতির পরেও এখনও কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন-

    • হার্ডওয়্যার: ভিআর হেডসেটগুলো এখনও ভারী এবং দীর্ঘক্ষণ ব্যবহারের পক্ষে অস্বস্তিকর।
    • ইন্টারনেট নির্ভরতা: এআর এবং ভিআর-এর অনেক অ্যাপ্লিকেশন হাই স্পিড ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল, যা প্রত্যেকের কাছে সহজলভ্য নয়।
    • অ্যাপ্লিকেশন উন্নয়ন: সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল এআর এবং ভিআর কন্টেন্ট তৈরি করা ছোট ব্যবসা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য সম্ভবপর নয়।

যদিও চ্যালেঞ্জগুলো উল্লেখযোগ্য, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এগুলোর সমাধান পাওয়া তেমন কঠিন নয়। মাসপ্রোডাকশনের মাধ্যমে ডিভাইসগুলির দাম কমিয়ে বয়সানুপাতিক নিরাপদ কনটেন্ট বানাতে হবে। উন্নত করতে হবে ফিল্টারিং সিস্টেম। এনক্রিপশন টেকনোলজির প্রয়োগ এবং ডেটা নিরাপত্তার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন করে কমানো যাবে গোপনীয়তা সুরক্ষা সংক্রান্ত উদ্বেগ, আর তখনই ডিজিটাল এবং ফিজিক্যাল জগতের নিখুঁত সহাবস্থানে গড়ে ওঠা সংযুক্ত বিশ্বের প্রতিশ্রুতিটা বাস্তবায়িত হবে। খুলে যাবে অসীম সম্ভাবনার প্রবেশদ্বার, যা পুনর্গঠিত করবে মানুষের অভিজ্ঞতার ভিত্তিকেই।

অগমেন্টেড রিয়েলিটি এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি – এই দুই প্রযুক্তি আজ মানব অভিজ্ঞতা এবং সৃজনশীলতার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। যদিও এদের পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট সময় দিতে হবে, এরা ইতিমধ্যে তারা সেই নতুন দুনিয়ার প্রতিচ্ছবি দাখিল করছে, যেখানে আমাদের কাজ সহজ হবে, সময় বাঁচবে, আর অভিজ্ঞতাগুলি এমন হবে যে বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে কোনও সীমারেখাই থাকবে না। আমি অধীর অপেক্ষায় আছি কবে পুরো পরিবার নিয়ে ভার্চুয়াল ছুটিতে যাব। গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে স্কুবা ডাইভিং করব আমি, পাশের চেয়ারে বসে আমার স্ত্রী ঘুরে বেড়াবে প্যারিসে, আর সামনে আমার ছেলেমেয়ে ক্যাম্পিং করবে এভারেস্টের শিখরে। আপনারাও চোখ, কান খোলা এবং ওয়ালেট/পার্স ঢিলা রেখে দেখতেই পারেন কোথায় যাওয়া যায়।

—–

ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *