অকালবোধন এবং কুম্ভকর্ণ, রাবণ ও মেঘনাদ বধ: লোকাচারে, সাহিত্যে
ভূমিকা
নেপালে প্রাপ্ত সহস্রাধিক বৎসরের পুরোনো একটি দুর্লভ মাতৃমূর্তি সম্বন্ধে বলি: সমগ্র দেবগণের সমবেত তেজ হতে অসুর বিনাশের নিমিত্ত যে দেবীমূর্তি আবির্ভূত হন, সেই দেবী তিন বার মহিষাসুরকে বধ করেন। প্রথম বার অষ্টাদশভুজা উগ্রচণ্ডা রূপে এবং দ্বিতীয়বার ও তৃতীয়বার দশভুজা রূপে। আমরা সর্বত্র এই দশভুজা রূপই দেখতে অভ্যস্ত। এইটি দেবীর সেই দুর্লভ অষ্টাদশভুজা মুর্তি, কিন্তু উগ্রচণ্ডা নয়। এটি তাঁর ভদ্রকালী রূপ। এই সব কিংবদন্তির কথা পাওয়া যায় একাধারে দেবী ভাগবত, মার্কণ্ডেয় চণ্ডী, ও কালিকা পুরাণে।
নমঃ দক্ষযঞ্জ বিনাশিন্যে মহাঘোরায়ৈ যোগিনী কোটিপরিবৃতায়ৈ ভদ্রকাল্যৈ ভগবত্যৈ দুর্গায়ৈ নমঃ ||
আমাদের কাছে অষ্টমী ছিল পুজোর শ্রেষ্ঠতম দিন। সেরা ড্রেসটা সেই দিন পরা হত। সেই পোষাকে সজ্জিত হয়ে সেই দিনই কিছু ‘লাভ’ এর আশা করে সন্ধেবেলা ঠাকুর দেখতে বেরোতাম। সেই সময়ে সন্ধিপূজার লগ্ন রাত্রেই পড়ত। কিন্তু কেন জানি না, আজকাল দিনমানে সন্ধিপুজোর লগ্ন পড়ে।
অষ্টমীর শেষ ও নবমীর শুরুর যে মুহূর্ত সেটাই সন্ধি পুজো এবং কথিত আছে ওই লগ্নে রামচন্দ্র মা দুর্গার পুজো করে রাবণ বধের অনুমতি পেয়েছিলেন। বললাম যে, প্রায় সবসময়েই সেটা পড়ত গভীর রজনীতে। আমরা থাকতুম পূজা আয়োজনের ভলান্টিয়ার। পাড়ার সুন্দরী কন্যাগণ তাঁদের মাতা সমভিব্যাহারে সেথায় আগমন করতেন। পাকেচক্রে যদি এক দুবার তাদের তিরছি নজরের ঝলসানি পেতুম, আহা, ভলান্টিয়ারি সার্থক হয়ে যেত! কিন্তু হৃদয়হীনা মাতাদের কঠিন নজরদারিতে সে সুখ থেকে আমরা বঞ্চিত থাকতাম।
সেতুবন্ধ ও রামের সমুদ্র লঙ্ঘন
কিঞ্চিৎ গাম্ভীর্য অবলম্বন করে ফিরে যাই সেতুবন্ধ ও রামের সমুদ্র লঙ্ঘন করে শ্রীলঙ্কাভূমিতে অবতীর্ণ হবার কাহিনিতে।
মহাকবি বাল্মিকী বলছেন, ‘পাঁচদিন ধরে শত যোজন দীর্ঘ সেতু ক্ষিপ্রতার সঙ্গে নির্মিত হল। অসংখ্য প্রস্তরখণ্ড ব্যতিরেকে সেতুতে আত্মত্যাগ করল বহু বৃক্ষ। তারা হল – শাল, অশ্বকর্ণ, ধব, বংশ, কূটজ, অর্জুন, তাল, তিলক, তিনিশ, বিল্ব, ও সপ্তকর্ণ। তারপর পূজার আয়োজন, কিন্তু এই পুজোকে ঘিরে এক অসাধারণ কিংবদন্তি আছে। সেই কথা বলি।
এই কিংবদন্তিটি বাল্মিকী রামায়ণে নেই। যা প্রচলিত তা হল মা দুর্গা লঙ্কার রক্ষপুরীর রক্ষাকর্ত্রী ছিলেন। তাঁকে পূজার্চনা করে তুষ্ট না করলে লঙ্কাজয় অসম্ভব। সেই পূজার এক বিশেষ উপাদান ছিল ১০৮টি নীল পদ্মফুল, যা ছিল এই পূজার জন্য অনিবার্য। বিভিন্ন রামায়ণে যা বর্ণিত (যদিচ, মহাকবি বাল্মিকী রচিত রামায়ণকে সব রামায়ণের মধ্যে মূল এবং শ্রেষ্ঠতম বলে গণ্য করা হয়, কিন্তু ভারতে এবং ভারতের বাইরে আরও ২২টি ভাষায় রামায়ণ প্রণীত হয়েছে। এই ২২টির মধ্যে আছে চৈনিক, লাওশিয়ান, থাই, এবং তিব্বতী ভাষার রামায়ণ), সেই অসংখ্য কাহিনি সম্বলিত রামায়ণের সাহায্য নিয়ে ও সেখান থেকে আহৃত কিংবদন্তি এবং আমার নিজের কল্পনা দিয়ে সেই পূজার কাহিনি গড়ে তুললাম।
রাবন বধের কাহিনি
সেতু নির্মাণের পরবর্তী প্রভাতে রামচন্দ্র পূর্বমুখী হয়ে বেদীর উপর কুশাসনোপরি পদ্মাসনে আসীন – যেন ধ্যানমগ্ন। নিশাবসান হতে চলেছে, ক্ষীণ ঊষালোকে পূর্বাকাশ সদ্যস্ফুট পুষ্পদলের ন্যায় স্বচ্ছ হয়ে আসছে। সাগরক্রৌঞ্চের কলরব ও সমুদ্রতটে তরঙ্গোচ্ছ্বাসের শব্দে নিসর্গ মুখর। দূরে স্বর্ণলঙ্কাপুরীর উচ্চ শিখরে আগতপ্রায় প্রত্যুষের আভা।
লক্ষ্মণ এসে অগ্রজর পার্শ্ববর্তী হলেন। তিনি সদ্য স্নান করেছেন। তাঁর আর্দ্র কেশদাম থেকে দুটি কুন্তল গণ্ডদেশে আলম্বিত হয়ে তাঁর মুখশোভা বর্ধন করছে। তাঁর পরিধানে মৃগচর্ম। রামচন্দ্র মুখ তুলে ভ্রাতার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন এবং মৃগচর্মটিকে চিনতে পারলেন। পঞ্চবটী কাননে মায়ামৃগ দ্বারা প্রলোভিত হবার মাত্র দুই দিন পূর্বে রাম এই হরিণটিকে বধ করেছিলেন। রাম দেখলেন এক আপাত অজেয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে দীর্ঘ ত্রয়োদশ বৎসরাধিক কালব্যাপী কঠিন যুদ্ধের শ্রমও লক্ষ্মণের মুখমণ্ডলের ঔজ্জ্বল্য ম্লান করতে পারেনি। রামচন্দ্র গভীর স্নেহ অনুভব করলেন তাঁর এই অনুগত ভ্রাতার প্রতি, যিনি অগ্রজের অনুবর্তী হবার নিমিত্ত সুন্দরী পত্নী ঊর্মিলাকে এবং রাজপ্রাসাদের বিলাস-ব্যসন ত্যাগ করে এই দীর্ঘ চতুর্দশ বছরের বনবাসের ক্লেশ পরিগ্রহ করেছে। রামচন্দ্র একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে ভ্রাতাকে বললেন, ‘লক্ষ্মণ, পদ্মপুষ্পগুলিকে পুনর্বার গণনা কর।’
লক্ষ্মণ সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বেদির অপর প্রান্তে গমন করলেন। জাম্বুবানের নির্দেশে বানর স্থপতি নল বেদিটি নির্মাণ করেছেন। প্রস্তরখণ্ড দ্বারা বেদিটিকে উচ্চ করে তার উপর স্বর্ণময় বালুকারাশি বিছানো। তার পূর্বপ্রান্তে শ্রীরাম আসীন। অন্য প্রান্তে কদলীপত্রের উপর স্তূপীকৃত নীলোৎপল রাখা আছে। তার পার্শ্বে পূজার যজ্ঞের নিমিত্ত কাষ্ঠ-সমিধ রক্ষিত। অষ্টমী তিথি শেষ হয়ে আসছে। সূর্যোদয়ের কিয়ৎকাল পরেই আশ্বিন শুক্লা অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিস্থল উপস্থিত হবে। পূজারম্ভের প্রকৃষ্ট সময়। বিলম্ব যেন না হয়। লক্ষ্মণ পূর্বাকাশের দিকে তাকালেন। রাত্রের অসিত আকাশ দিনমণির আগমন আশ্বাসে স্বচ্ছ নীল রঙ ধারণ করেছে। দিগন্তের একাংশ অরুণিমায় উজ্জ্বল। ওখান থেকেই মার্তণ্ডদেব প্রকট হবেন। লক্ষ্মণ দ্রুত নীলপদ্মের গণনা শুরু করলেন।
বিভীষণের প্রভাবে ব্রাহ্মণ পুরোহিত আগমন করেছেন। তিনি পূজাপোচার মিলিয়ে নিচ্ছেন। বেদির মধ্যস্থলে যজ্ঞস্থান নির্মিত হয়েছে। পুরোহিত, সুগ্রীব, জাম্বুবান, সুষেণ, ও বিভীষণ নিম্নকণ্ঠে বাক্যালাপ করছেন। হনুমান পূজান্তে যে প্রসাদ বিতরিত হবে তাই আনয়ন করতে গেছেন। বেদির পশ্চিম-প্রান্ত থেকে লক্ষ্মণের অস্ফুট গণনার শব্দ ভেসে আসছে – সপ্ততি, একসপ্ততি, দ্বিসপ্ততি…।
রামচন্দ্র গাত্রোত্থান করে বেদি থেকে নেমে এলেন। সবাই নত মস্তকে করজোড়ে তাঁকে প্রণাম করলেন। রামচন্দ্র পুরোহিতকে সম্বোধন করে বললেন, ‘হে পূজ্য ব্রাহ্মণ, আপনি পূজায়োজনে প্রীত হয়েছেন তো? আপনার তালিকানুযায়ী সব উপচার পেয়েছেন তো?’ ব্রাহ্মণ আরও নত হয়ে, দুই হস্ত কচলাতে কচলাতে বললেন, ‘হ্যাঁ মহাভাগ! আয়োজন সঠিক ভাবে সম্পন্ন হয়েছে।’ রামচন্দ্র কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বাধা পেলেন লক্ষ্মণের ডাকে। ‘ভ্রাতাশ্রী’ বলে লক্ষ্মণ এক বিপর্যয়সূচিত সংকটাপন্ন মুখচ্ছবি নিয়ে অগ্রজের সামনে এসে দাঁড়ালেন। রামচন্দ্র প্রশ্নবাচক ভ্রু উত্তোলন করলেন। লক্ষ্মণ অস্ফুটে বললেন, ‘আমি, আমি গণনায় একশত সাতটি পদ্ম পেলাম।’ রাম কিছু বলবার আগে বিভীষণ তাঁর উচ্চগ্রাম পরুষকন্ঠে গর্জে উঠলেন, ‘অসম্ভব, অলীক – আমি সহস্তে ১০৮টি পদ্ম গণনা করে কদলীপত্রের উপর স্থাপন করেছি।’ লক্ষ্মণ পূর্ববৎ ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, ‘অপিচ আমার গণনায় ১০৭টি পদ্ম পেয়েছি।’ সুগ্রীব তৎক্ষণাৎ বললেন, ‘আমি যাচ্ছি, একটি নীলপদ্ম সংগ্রহ করা কঠিন হবে না।’ কিন্তু তিনি এক পদও অগ্রসর হতে পারলেন না। রামচন্দ্র তাঁর দীর্ঘ দক্ষিণভুজ উত্তোলন করে বললেন, ‘তিষ্ঠ, সুগ্রীব!’ তারপর তিনি বিভীষণকে শুধোলেন, ‘হে ধীমান, আপনার গণনায় আপনি ১০৮টি কমল প্রাপ্ত হয়েছিলেন?’ বিভীষণ সবিনয়ে জানালেন, ‘হ্যাঁ বীরশ্রেষ্ঠ।’ রাম সুগ্রীবের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করা মাত্র তিনি ইতিবাচক অভিব্যক্তি সহকারে বললেন, ‘হ্যাঁ মহাভাগ, ১০৮ই বটে!’
চিন্তাকুল মুখে রাম বেদিতে গিয়ে বসলেন, সবাইকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আমার পূজাতে বিঘ্ন সৃষ্টির নিমিত্ত একটি পদ্মফুল অদৃশ্য হয়েছে,’ বলে থামলেন। তারপর আবার বললেন, ‘এটা অপহরণ নয়, এ এক দৈবিক প্রক্রিয়া, আমাকে পরীক্ষার নিমিত্ত।’ মন্ত্রী বিভীষণ অভিশঙ্কা মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, ‘এখন কী উপায়?’ রামচন্দ্র ওষ্ঠে ঈষৎ হাস্য এনে লক্ষ্মণের দিকে ফিরলেন, ‘ভাতৃবর, তোমার কি স্মরণে আছে যে আমি স্বর্ণমৃগের পশ্চাতে ধাবিত হলে মহাদেবী বৈদেহী পঞ্চবটী বনে তোমাকে কী কী বলে ভর্ৎসনা করেছিলেন?’ লক্ষ্মণ মৃদুস্বরে জানালেন, ‘হ্যাঁ ভ্রাতাশ্রী!’ রাম বলে চললেন, ‘সেই ভর্ৎসনা দিবার কালে তিনি আমার শারীরিক বর্ণনা দিয়া কী বলেছিলেন তাও কি স্মরণে আছে?’ পূর্ববৎ লক্ষ্মণ বললেন, ‘হ্যাঁ ভ্রাতাশ্রী!’ রাম নির্দেশ দিলেন, ‘তুমি আমাদের এই বিপৎকালীন সুহৃদবর্গ মহোদয়দিগকে তা বিবৃত কর।’
লক্ষ্মণ অগ্রজর প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন। রামচন্দ্র স্মিতমুখে অনুমোদনসূচক মস্তকান্দোলন করলেন। লক্ষ্মণ বললেন, ‘আমার মাতৃসমা ভ্রাতৃবধূ পতির রূপ বর্ণনা কালে বলেছিলেন, “কথমিন্দীবরশ্যামং রামং পদ্মনিভেক্ষণম্।’” (“ইন্দীবরশ্যাম পদ্মচক্ষু রাম।” ইন্দীবর শব্দের অর্থ নীল। বাংলায় মানে হল “রামের চক্ষু নীলপদ্মের ন্যায়।” মারীচের মায়া চিৎকার শুনবার পর লক্ষ্মণ যখন সীতাকে ছেড়ে যেতে অস্বীকার করলেন তখন সীতা লক্ষ্মণকে নানা কঠিন বাক্যে বিদ্ধ করেন। উপরুক্ত বাক্যটি তিনি যে রামের রূপ ও গুণপনা ব্যাখ্যান করেন, তারই অংশ।) রামচন্দ্র বললেন, ‘শুধু সীতাদেবী নয়, আমার অনেক শুভার্থী বলেন আমার চক্ষুদ্বয় নীলপদ্মের ন্যায়। সুতরাং হে সুহৃদগণ, অনুমতি করুন, আমি আমার একটি চক্ষু উৎপাটিত করে একটি পদ্মের অভাব মোচন করি’।
রামচন্দ্রের এই বাক্য শুনে ধরণী স্তব্ধ হয়ে গেল। জলকল্লোল নিঃশব্দ হল, সমুদ্রপক্ষীগণ কোলাহল থেকে বিরত হল, প্রত্যুষের সমীরণ স্তম্ভিত হল, উদীয়মান অরুণাভা ম্রিয়মাণ হল, রামের ভ্রাতা ও সহচরগণ নীরব হলেন। রামচন্দ্র তাঁর জগৎখ্যাত বিজয়ধনুতে তীক্ষ্ণ এক বাণ যুক্ত করে তাঁর একটি চক্ষুর প্রতি লক্ষ্য স্থির করে জ্যা আকর্ষণ করলেন। মুহূর্তে সমস্ত চরাচর এক স্বর্গীয় আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। এক অপূর্ব, অনিন্দ্যসুন্দর নারী, যিনি দশভুজা, দশপ্রহরণধারিণী, যাঁর রূপ অলীকবিম্ব জ্যোতির্ময়ী, যিনি বিদ্যুৎপ্রভ স্বর্ণালঙ্কারে শোভিতা, তিনি রামচন্দ্রের সম্মুখে তাঁর সিংহ বাহন থেকে অবতরণ করে রামের দক্ষিণ বাহু ধরলেন, বললেন, ‘নিবৃত হও রামচন্দ্র! তোমার নীলপদ্ম আমিই আত্মসাৎ করেছিলাম। আমি তুষ্ট হয়েছি।’ রামচন্দ্র দেবীকে প্রণাম করে করপুটে ১০৮তম পদ্মটি গ্রহণ করলেন। দেবী রামচন্দ্রের মস্তকে হস্ত স্থাপন করে বললেন, ‘জয়ী হও!’ আশীর্বাদান্তে দেবী অন্তর্হিত হলেন।
শুরু হল মহাযুদ্ধ। দুপক্ষের অসংখ্য সৈন্য ও সেনাপতি রণভূমিতে অবতীর্ণ হলেন। রক্ষবাহিনী যখন বানর সেনার আক্রমণে প্রায় পর্যুদুস্ত, তখন রাবণ সিদ্ধান্ত নিলেন – মহাবীর কুম্ভকর্ণকে যুদ্ধে প্রেরণ করবেন। বাল্মিকী বিস্তারিত ভাবে বিশাল কুম্ভকর্ণের যুদ্ধে গমন পূর্বের সাজসজ্জার বর্ণনা দিয়েছেন। সেই বিবরণ থেকে প্রাসঙ্গিক দুটি অংশের কথা উল্লেখ করি। প্রথমতঃ অগস্ত্য মুনি শূন্যে রাম-রাবণের যুদ্ধ দেখতে এসেছিলেন। সুযোগ মত তিনি রামকে বললেন, ‘মহাবাহু, আমি তোমাকে সর্বশত্রুবিনাশন সনাতন গুহ্য আদিত্যহৃদয় স্তোত্র শিখিয়ে দিচ্ছি, এই মহাগুণসম্পন্ন স্তোত্র তিনবার জপ করলে তুমি যুদ্ধে জয়লাভ করবে।’ (মূল সংস্কৃত থেকে রাজশেখর বসুর অনুবাদ)।
রামচন্দ্র আচমন করে শুচি হয়ে তথা করলেন এবং সূর্যদেব তাঁকে বললেন, ‘তুমি দ্রুত রাবণকে বধ কর।’
দ্বিতীয়তঃ যুদ্ধে রাম যদ্যপি রাবণের কোন একটি মুণ্ডচ্ছেদ করছেন, ছেদনমাত্রই সেইখানে অপর এক নতুন মস্তক উদ্গত হচ্ছে। রামের সমস্ত ধনুর্বিদ্যা নিষ্ফল দেখে মাতলি বললেন, ‘মহাবীর, আপনি ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করুন।’
অপ্রাসঙ্গিক হলেও, এই নিদারুণ অস্ত্রের গুণপনা ব্যাখ্যান করি। ব্রহ্মাস্ত্রের পুঙ্খে (Fletching) পবন, ফলকে অগ্নি ও ভাস্কর, শরীরে আকাশ এবং ভারে মেরুমন্দর (মন্দার পর্বত) অধিষ্ঠান করেন। এই মহাস্ত্র সধূম কালাগ্নি এবং দীপ্ত আশীবিষের (সর্প) ন্যায় ভীষণ, সর্ব বাধা ভেদে সমর্থ, রুধির (রক্ত) ও মেদে লিপ্ত (আধুনিক ভাষায় – ‘মিসাইল’)। এই কৃতান্তসম মহাস্ত্র দ্বারা রামচন্দ্র রাবণকে বধ করলেন।
রাবণ বধের পূর্বে যে প্রবল একক সম্মুখ – সমর, রাম-রাবণ সংঘর্ষের বিপরীত ফলাফল ঘটাতে পারত, তা হল লঙ্কাপুরীর অভ্যন্তরের নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে সংঘটিত লক্ষ্মণের সঙ্গে ইন্দ্রজিতের মহাযুদ্ধ। এই মহারণে লক্ষ্মণ যদি ইন্দ্রজিতের হস্তে পরাজিত এবং নিহত হতেন, তাহলে রামচন্দ্রের সীতাদেবী উদ্ধারার্থে রাবণবধের পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হত তাতে কোন সন্দেহ নাই।
বিভীষণ নিকুম্ভিলা যজ্ঞস্থলে যাবার গোপন পথের সন্ধান জানতেন এবং সেই পথ ধরে তিনি লক্ষ্মণকে নিকুম্ভিলা যজ্ঞস্থলে ইন্দ্রজিৎ সমীপে নিয়ে যান। সঙ্গে ছিল শত শত বানর সেনানী। সেই ঘটনাকে অমর করে রেখেছেন মহাকবি মাইকেল তাঁর অমর কাব্যে। আসব সে প্রসঙ্গে। তার আগে বলি কুম্ভকর্ণ-কথা।
কুম্ভকর্ণ বধ
প্রথমেই বলা দরকার কুম্ভকর্ণ ৩৬৪ দিন নিদ্রিত থাকতেন এবং বাকি এক দিন জাগ্রত থেকে ওই দিন যে কোন যুদ্ধে অজেয় থাকবেন – এর উল্লেখ আমি বাল্মিকী রামায়ণে পাইনি। কিন্তু বাল্মিকী উবাচ, বিভীষণ বানর সেনাকে বলেছিলেন ‘কুম্ভকর্ণ হল একটি যন্ত্র’ (উচ্যন্তাং বানরাঃ সর্বে যন্ত্রমেতৎ সমুচ্ছ্রিতম – স্বর্গঃ ৬১; শ্লোকঃ ৩৩)। গবেষকগণ বাল্মিকীর (বিভীষণের মুখে) এই উক্তির ব্যাখ্যা করে মনে করেছেন – এখানে যন্ত্র মানে ‘বুদ্ধিহীন ও যান্ত্রিক ব্যক্তিত্ব।’
এরই পাশে বলা হয়েছে কুম্ভকর্ণের নীতিজ্ঞান প্রশংসার্হ। কুম্ভকর্ণ রাবণকে কটূ ভাষায় জানান যে পরস্ত্রী হরণ করা একটি নীতিবিরোধী, প্রজাহানিকর কর্ম। অপিচ, তিনি ভ্রাতার পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করবেন বলে স্বীকৃত হলেন। কিন্তু, লঙ্কেশ্বরের আর এক ভ্রাতা মহোদর এক চতুরতা প্রসূত প্রস্তাব দিলেন যে ছল করে সীতাকে রামের মিথ্যা মৃত্যু সংবাদ দেওয়া হোক, যাতে বৈদেহী বানর পক্ষ ত্যাগ করে লঙ্কার পক্ষে চলে আসেন। কুম্ভকর্ণ এই প্রস্তাবেও ক্ষিপ্ত হলেন এবং তাঁর ক্ষাত্র অহমিকা মর্ষিত হল। অতঃপর, কুম্ভকর্ণ সাজসজ্জা করে যুদ্ধে গমন করলেন। বাল্মিকী সেই সাজের সুন্দর স্বল্পাকার বিবরণ দিয়েছেন – অপরূপ সেই সাজ – গলায় দিব্যমাল্য, কানে কুণ্ডল, কেয়ূর, অঙ্গুরীয়ক, কণ্ঠহারে ভূষিত হয়ে কুম্ভকর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন।
মহাযুদ্ধ লেগে গেল। তার বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া অপ্রাসঙ্গিক। আমার মতে উল্লেখ্য দুটি ঘটনা হলঃ
(১) হনুমান (সেই দিনের বানর পক্ষের সেনাপতি) হঠাৎ দেখলেন কুম্ভকর্ণ সুগ্রীবকে বগলে চেপে ধরে লঙ্কার দিকে রওনা দিয়েছেন। সুগ্রীব আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও হাল ছাড়লেন না। কুম্ভকর্ণকে আঁচড়ে, কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে তুললেন। অন্যদিকে হনুমানও সুগ্রীবকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। লক্ষ্মণও হনুমানের সাথে যোগ দিলেন।
(২) যখন দুই পক্ষের দুই শ্রেষ্ঠবীর রাম ও কুম্ভকর্ণ মুখোমুখি হলেন, তখন শেষোক্তজন প্রথমোক্তের অস্ত্রনৈপুণ্যের পরিচয় পেলেন। রাম প্রথমে তাঁর অস্ত্রাঘাতে বিপক্ষের হাত থেকে সমস্ত অস্ত্র খসিয়ে দিলেন। কুম্ভকর্ণ হাতে মুগুর তুলে নিলেন। রাম বায়ব্য অস্ত্রে মুগুর সহ হাতটি কেটে ফেললেন। কুম্ভকর্ণ অপর হস্তে একটি বৃহৎ বৃক্ষ তুলে নিলেন। রাম তখন ঐন্দ্রাস্ত্র বাণে কুম্ভকর্ণের অপর হস্তটিও ছিন্ন করলেন। দুটি অমোঘ শক্তিশালী অর্ধচন্দ্র বাণে কুম্ভকর্ণের দুটি পদ কর্তিত হল। কুম্ভকর্ণ গড়িয়ে গিয়ে হিংস্র জলজন্তু পরিপূর্ণ সমুদ্রের জলে প্রবেশ করলেন। সমুদ্রের মধ্যে পতিত প্রায় অদৃশ্য কুম্ভকর্ণকে রাম অসংখ্য বাণের আঘাতে নিহত করলেন।
বিভীষণ এই কথাই বানরদিগের কাছে প্রচার করেছিলেন – কুম্ভকর্ণের আচার, ব্যবহার, যুদ্ধ প্রণালী সবই যন্ত্রানুগ। এরই ব্যতিক্রম নিয়ে বাল্মিকী লিখেছেন, লক্ষ্মণ ও অতিকায়ের যুদ্ধ উচ্চমানে সংঘটিত হল। মূলত এই যুদ্ধ অস্ত্র, প্রতিঅস্ত্র ও যুদ্ধ কৌশলে ঋদ্ধ। যুদ্ধের অন্তে অতিকায় পরাজিত হলেন। অতিকায়ের যথেষ্ট আত্মরক্ষামূলক বর্ম থাকা সত্ত্বেও লক্ষ্মণ তাঁকে ধ্বংস করলেন।
ইন্দ্রজিৎ বধ
সীতা উদ্ধারকল্পে রাম-রাবণের যুদ্ধের পর্বের একটি জনপ্রিয় নাম হল ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল।’ কিন্তু তার আগে রাবণের দুই ভ্রাতা – মহোদয় ও মহাপার্শ্ব এবং চার পুত্র –ত্রিশিরা, অতিকায়, দেবান্তক, ও নরান্তক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। বাল্মিকী লিখেছেন, ‘রাবণের চার পুত্র ও তাঁদের পিতৃব্যগণ দৃষ্টিনন্দন শৈল্পিক স্তরে তাঁদের যুদ্ধায়োজন করলেন। রাবণের ছেলেদের দেখে ইন্দ্র, কার্তিকেয়, কুবের ও বিষ্ণুর কথা স্মরণ হচ্ছিল।’
বাল্মিকী ‘শেল’ শব্দটি উল্লেখ করেননি বটে, উপরন্তু বলেননি যে শুধুমাত্র লক্ষ্মণই ওই অস্ত্রে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন অস্ত্রের ব্যবহারে হনুমান ব্যতিরেকে আর সমস্ত বানর বাহিনীর সেনাপতিকে, যার মধ্যে ছিলেন রাম ও লক্ষ্মণ, অবসন্ন ও চেতনহীন করে ফিরে গেলেন লঙ্কাপুরীতে। বানর সেনানীর চিফ মেডিক্যাল অফিসার জাম্বুবান চেতনহীনদের পরীক্ষা করে বললেন, হিমালয়ে স্বর্ণময় দুর্গম শৈলশ্রেষ্ঠ ঋষভ ও কৈলাসের শৃঙ্গে সর্বগুণসম্পন্ন ওষধি পাওয়া যায়, যা আহত রাম ও লক্ষ্মণকে সুস্থ করে তুলতে পারে। ওষধিগুলির নাম – মৃতসঞ্জীবনী, বিশল্যকরণী, সুবর্ণকরণী, ও সন্ধানকরণী।
খুবই সংক্ষেপে পরবর্তী ঘটনা বিবৃত করি। আমরা জানি যে, হনুমান নির্দিষ্ট ওষধি বৃক্ষ খুঁজে না পেয়ে গন্ধমাদন নামক পর্বতাংশ ভেঙে বহন করে নিয়ে লঙ্কায় হাজির হলেন। সেনাপতি সুগ্রীব, তাঁর আক্রমণ নীতি “মারি অরি পারি যে কৌশলে।” এ একেবারে আধুনিক যুদ্ধের কৌশল – ‘Nothing wrong in love and war।’ রাম ও লক্ষ্মণ চেতনহীন হয়েছেন এই সংবাদ প্রাপ্ত হয়ে রাক্ষসকুল মদ্যপানে বিজয় উৎসব পালন করবার সময়ে বানর সেনা তাদের আক্রমণ করল। রাক্ষস সেনা পলায়ন করল। বানর সেনা লঙ্কাপুরীতে অগ্নি সংযোগ করল। রাত্রে লঙ্কানগরীকে কুসুমিত পলাশ গাছের মত লাগছিল। বাল্মিকী কবিবরের একটি পঙক্তি হল: “রাত্রৌ সা দৃশ্যতে লঙ্কা পুষ্পতৈরিব কিংশুকৈঃ” [লঙ্কা কাণ্ডের সর্গঃ ৭৫ শ্লোকঃ ২৭]।
এই পরিস্থিতিতে রাবণের সামনে একটাই উপায় ছিল – ইন্দ্রজিৎকে পুনরায় যুদ্ধে প্রেরণ করা। যুদ্ধ গমনের পুর্বে ইন্দ্রজিৎ এক কৌশল অবলম্বন করলেন। মায়া সীতা নির্মাণ করে তাকে রথারূঢ় করে, সেই রথে নিজে সেই রথটিকে বানর সেনানীর মধ্য চালিত করলেন এবং রথোপরি উপবিষ্টা সীতাদেবীকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হল। বানর শিবিরে হাহাকার পড়ে গেল। শোকে মুহ্যমান হল রামের শিবির। ইন্দ্রজিৎ এইটুকুই চেয়েছিলেন। কিছুটা সময় নিজের প্রস্তুতির জন্য।
কিন্তু বিভীষণ এই ছলনা ধরে ফেললেন, শুধু তাই নয়, মায়া সীতা বধের কারণটিও ধরে ফেলেলেন। রামের শিবির নিকুম্ভিলা যজ্ঞস্থল আক্রমণের পরিকল্পনা করলেন। যজ্ঞ সাধিত হচ্ছিল এক ভীম দর্শন বটবৃক্ষের নীচে। সেই গোপন নিকুম্ভিলা যজ্ঞ স্থানে লক্ষ্মণকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বিভীষণ। তাই অস্ত্র-যুদ্ধের প্রারম্ভে শুরু হল ইন্দ্রজিত ও বিভীষণের মধ্যে বিপুল বাকযুদ্ধ। প্রথমে ঋষিবেশধারী ইন্দ্রজিৎকে আক্রমণ করলেন বানরসেনা।
যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষ্মণ, বিভীষণ ও তাঁদের সেনাদল ইন্দ্রজিতকে লক্ষ্য না করে তার রথ ও অশ্বগুলিকে ধ্বংস করতে লাগলেন। ইন্দ্রজিৎ পুনরায় নতুন রথ ও অশ্ব আনয়ন করলেন, কিন্তু বিভীষণ গদার আঘাতে তাদেরও ধ্বংস করলেন। ইন্দ্রজিৎ দিশেহারা হয়ে নিজের আক্রমণধারাকে হারিয়ে বসলেন এবং লক্ষ্মণ সেই সুযোগে ঐন্দ্রাস্ত্র দ্বারা ইন্দ্রজিৎকে বধ করলেন।
মাইকেলের ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ ইন্দ্রজিতের শেষ যাত্রা দর্শনের নিমিত্ত যাঁরা এসেছিলেন তার বিবরণের কিয়দাংশ নিবেদন করিঃ-
দশ শত রথী সাথে চলিলা সুরখী
অঙ্গদ সাগরমুখে। আইলা আকাশে
দেবকুল;- ঐরাবতে দেবকুলপতি,
সঙ্গে বরাঙ্গনা শচী অনন্তযৌবনা,
শিখিধ্বজে শিখিধ্বজ স্কন্দ তারকারি
সেনানী; চিত্রিত রথে চিত্ররথ রখী;
মৃগে বায়ুকুলরাজ; ভীষণ মহিষে
কৃতান্ত; পুস্পকে যক্ষ, অলকার পতি;”
