অনুজ্জ্বল মানুষের উজ্জ্বল গান – বহমান বাসু চ্যাটার্জি

অনুজ্জ্বল মানুষের উজ্জ্বল গান – বহমান বাসু চ্যাটার্জি
‘Underdog’ শব্দটার মানে অভিধানে লেখে,  ‘’Someone who is expected to lose a contest’  অথবা   ‘Someone who is at a disadvantage’। 


অর্থাৎ একজন ছায়ার আড়ালে থাকা অনুজ্জ্বল মানুষ, যার জাঁক করে বলার কিছু নেই। প্রতিযোগিতায় যে জিতে আসতে পারেনা। পাদপ্রদীপের আলো যার মুখে পড়েনা। অথচ  বেঁচে থাকা, সুখদুঃখ, যাপনবিন্যাস  সব কিছু দিয়ে সে একটা মানচিত্র এঁকে যায়। তার মধ্যে ধরা থাকে সমাজের শতকরা পঁচানব্বই ভাগ গড় মানুষের জীবনবৃত্ত। হারজিতের ফয়সালাটি সেখানে ক্রমশ অস্পষ্ট, অপ্রাসঙ্গিক। বেঁচে থাকার আনন্দটিই শেষ কথা হয়ে দাঁড়ায়।

তার সঙ্গে এটাও সত্য, মানুষের সমাজে প্রতিযোগিতা থাকবেই। মানে, একটা ‘প্রতিযোগিতা’ থাকতেই হবে। সঙ্গে থাকবে প্রতিযোগিতায় সফল হবার জন্য  উচ্চাকাঙ্ক্ষা। অবশ্যই থাকবে, ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’ গোছের দর্শনটি প্রতিষ্ঠা করার সচেতন প্রয়াস। শিল্পে-সাহিত্যে বিষয়টি নিয়ে বহু চর্চা হয়েছে। ভিন্ন রুচির্হি  লোকাঃ। মহাকাব্য বা ইতিহাসে Underdogএর কোনও স্থান নেই। নেই পুরুষতান্ত্রিক কোনও ডিসকোর্সে। ক্ষমতার রাজনীতি প্রতিষ্ঠার পথ, পুরুষ ও  নারী চরিত্রের ক্ষেত্রে আলাদা। কিন্তু ‘সফল’ হবার জন্য এলেম দরকার। এলেমহীন ‘অপদার্থ’ পুরুষ বা দুয়োরানি নারীদের প্রতি সহমর্মিতার অনুভব শুরু হয়েছিলো মধ্যবিত্ত সংস্কৃতি উন্মেষের পর। মহামানবরাই শুধু ইতিহাস লেখেন না। শিল্পবিপ্লব পার করে এসে ভঙ্গুর, অনুজ্জ্বল মানুষদের দাঁড়াবার জায়গা তৈরি হওয়া শুরু হয়।

বঙ্গীয় মননবৃত্তে ‘অনুজ্জ্বল’ পুরুষ ও নারীদের প্রতি সহানুভূতি বেশি দেখা যায়। দেশের অন্যান্য প্রান্তের সামন্ততান্ত্রিক, বর্ণাশ্রমী মানসিকতার সংস্কৃতি থেকে সেটা একটু আলাদা। গত প্রায় দুশো বছর ধরে মধ্যবিত্তরাই বাঙালি জাতটার চালিকাশক্তি। আমাদের শিল্প-সাহিত্যেও তার বিস্তর প্রতিফলন ঘটেছে। বঙ্কিমের নবকুমার থেকে কবির ‘সাধারণ মেয়ে’। একটা ট্র্যাডিশন তৈরি হয়ে এসেছে ক্রমাগত। শরৎচন্দ্র তো ধুনিটি চিরকাল জ্বালিয়েই রেখেছিলেন। পরবর্তী কালে বাংলায় অন্য সব শিল্পীদের জন্যও সেটা দস্তুর হয়ে যায়।

সদ্যপ্রয়াত বিখ্যাত চিত্রপরিচালক বাসু চ্যাটার্জি হয়তো জন্মসূত্রেই এই ঐতিহ্যের অংশ ছিলেন। তাঁর সহযোগীরা অনেকেই  জন্মসূত্রে ‘বঙ্গীয়’ ছিলেন না। পরিচালকের সঙ্গে তাঁরা জড়ো হয়েছিলেন ‘অনুজ্জ্বল’ ঘরোয়া মানুষের জীবনকে নিয়ে ছবি বানাবার জন্য । তাকে প্রচলিত স্রোতের বাইরে গিয়ে শিল্পের বিষয় করে তুলতে আগ্রহী ছিলেন তাঁরা। পিছু ফিরে দেখলে বোঝা যাবে চ্যালেঞ্জটি  বেশ বড়ো ছিলো সে সময়। তাঁদের সম্মিলিত প্রয়াস থেকে দর্শকরা পেয়েছিলো ‘ত্রয়ী’ ছায়াছবি। মধ্যবিত্তের পরিচিত, জেল্লাহীন দৈনন্দিন জীবন আর স্পর্শকাতর রুচিবোধের সঙ্গে স্বচ্ছন্দ থেকেও তুমুল বাণিজ্যসফল তিনটি ছবি তাঁরা উপহার দিয়েছিলেন আমাদের। সমকালীন হিন্দি ছবির জগতে একটা নতুন ধারা  তৈরি হয়েছিলো।

একদিকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খান্না পর্দা কাঁপিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে ‘নেই হয়ে’ থাকা মরাঠি মঞ্চের এক অভিনেতা সারাদেশের জনতার সাইকির একটা বড়ো অংশ দখল করে নিলেন। ‘পাশের বাড়ির ছেলে’ হিসেবেও নিতান্ত ‘অনুজ্জ্বল’ ছিলেন তিনি। আশ্চর্য, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছিলো তাঁর ইউএসপি। তাঁর না ছিলো দৈহিক আবেদন, গ্ল্যামার বা এক্স ফ্যাক্টর। কিন্তু কাউকে বুঝতে না দিয়ে চরিত্রের ত্বকের নীচে মসৃণ ভাবে ঢুকে যেতে পারতেন তিনি। অভিনয় ব্যাপারটা জানতেন গভীরভাবে। কিন্তু ঘটনা হলো, তিনটি ছবিই শতকরা দুশো ভাগ পরিচালকের সৃষ্টি। ম্যাক্রো থেকে মাইক্রো লেভেল।

মনে আছে, উনিশ শো পঁচাত্তর সালের শেষদিকে যখন ছাত্র ছিলুম, একবার বন্ধুদের সঙ্গে বম্বে যাবার সুযোগ হয়েছিলো। বম্বে যাবো, সিনেমা দেখবো না, তা তো হয়না। তখন দুটো ছবিঘর ছিলো বম্বের এক আর দু নম্বর। পুরোনো ঐতিহ্যের ‘মেট্রো’ আর চমকানো ‘মরাঠা মন্দির’। প্রথমটায় দেখেছিলুম তারকার ভিড়ে ভরা ‘কভি কভি’ । দ্বিতীয়টায় ‘ছোটি সি বাত’। শুধু পরিচালকের প্রতি আনুগত্য থেকে কপর্দকহীন বালকেরা খাবার পয়সা বাঁচিয়ে সিনেমার টিকিট কেটেছিলো সেদিন। তারা ‘রজনীগন্ধা’ দেখেছিলো এক বছর আগে।

এই ত্রয়ী ছবি নিয়ে পণ্ডিতরা অনেক আলোচনা করেছেন অন্যত্র। পঁয়তাল্লিশ বছর পরে ছবিগুলি বিষয়ে যদি আলোচনা করতে হয়, তবে বহু চ্যুতি হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে। কাল নিরবধি। এই মুহূর্তে সে প্রসঙ্গে  যাবোনা। আমার সন্ধান, ছবি তিনটির গানের অংশগুলি নিয়ে। ‘রজনীগন্ধা’ ও ‘ছোটি সি বাত’ ছবিদুটির সঙ্গীতস্রষ্টা ছিলেন সলিল চৌধুরী। ‘চিতচোর’ ছবিটিতে সুরযোজনা করেছিলেন রবীন্দ্র জৈন। প্রথম ছবিদুটির গীতিকার ছিলেন যোগেশ এবং তৃতীয় ছবিটির গানগুলি লিখেছিলেন রবীন্দ্র জৈন স্বয়ং।  প্রথম ছবি দুটির থেকে তৃতীয় ছবিটিতে পরিচালক বাসু চ্যাটার্জি কিছু পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। সব চেয়ে বড়ো বদল ছিলো সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সলিল চৌধুরীর জায়গায় রবীন্দ্র জৈনকে নির্বাচন করা।

তিনটি ছবির মধ্যে সমতা বিচার করতে চাইলে  বেশ কয়েকটি বিন্দু পাওয়া যাবে। প্রথমত তিনটি ছবিরই কেন্দ্রবিন্দুতে আছে এক আপাত অনুজ্জ্বল নায়কের পুনর্বাসন।  ‘হিরো’ তৈরি করতে গিয়ে অপ্রচলিত ফ্যান্টাসির আশ্রয় নেওয়াটা দর্শকদের সাইকিতে নতুন স্বাদের সঞ্চার করেছিলো। Underdogদের প্রতি সমস্ত Underdogরা সহানুভূতিশীল হয়। তাদের ভালোবাসে। এই মনস্তত্ত্বটির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা প্রমাণিত হয়েছিলো বাসু চ্যাটার্জি নির্মিত ছবি তিনটিতে। প্রথম দুটি ছবির পটভূমি মহানাগরিক জীবন। তৃতীয়টি ছিলো প্রায় গ্রামীণ ভূগোলের এলাকায়। সলিল চৌধুরী যখন গ্রামীণ ভূমিতেও সুর করেন, তার মধ্যে এক ধরনের সাধিত পরিমার্জনার স্বাদ পাওয়া যায়। প্রথম দুটি ছবির পাঁচটি গান বাঁধা হয়েছিলো নাগরিক পরিস্থিতি অনুযায়ী। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘Urban sensibilities’, সঙ্গীত তৈরি করার সময় সলিল ব্যাপারটা স্মরণে রেখেছিলেন। রবীন্দ্র জৈনের বিশেষত্ব ছিলো লোকশৈলীতে রাগভিত্তিক সুর প্রয়োগের কৌশল। উল্লেখ্য, দুজনেই ছিলেন বাংলা সঙ্গীত পরম্পরার অংশ। পুরুষ কণ্ঠের শিল্পী নির্বাচন নিয়েও যথেষ্ট চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়। সলিল বেছে নিয়েছিলেন  শিল্পী মুকেশের কণ্ঠ। কারণ তাঁর গাওয়ার ঢংকে বলা হয় ‘সাধারণ’ মানুষের প্রিয় গায়নভঙ্গী। যা আপাতভাবে ‘অসাধিত’ ও ‘অপরিমার্জিত’, অথচ অবলীলায় হৃদয়ের তন্ত্রীকে স্পর্শ করতে পারে। এই ছবিগুলিতে গাইবার জন্য মান্না দে, রফিসাহেব বা কিশোরকুমারের মতো প্রখর গায়ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী শিল্পীরা হয়তো একটু বেমানান হয়ে যেতেন। সলিল ‘ছোটি সি বাত’  ছবিতে হিন্দি গান গাইবার প্রথম সুযোগ করে দিয়েছিলেন য়েসুদাসকে। তিনি পরিচালকের প্রত্যাশাকে বিপুল মাত্রায় ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ‘চিতচোর’ ছবিতে রবীন্দ্র জৈনের সুরসৃষ্টির দৌলতে হিন্দি ছবির জগতেও শীর্ষ স্থানটি অধিকার করে নেন।

সিরিজের প্রথম দুটি ছবি, অর্থাৎ ‘রজনীগন্ধা’ ও ‘ছোটি সি বাত’, গানের ব্যবহার কেমন হবে তা নিয়ে পরিচালক ও সঙ্গীত পরিচালক ভেবেছিলেন। যেমন, লতাজি ও আশাজি ছাড়া সাতের দশকের শুরুতে নারীকণ্ঠে কোনও বিকল্প ছিলোনা। এঁদের দুজনেরই ছিলো কণ্ঠ বা পরিবেশনার ক্ষেত্রে ‘মানিয়ে’ নেবার অপার ক্ষমতা। ভারতীয় প্লেব্যাক গানের ইতিহাসে যে কোনও গান, নায়িকা বা ছবির ফ্রেমের সঙ্গে একাত্ম হয়ে, পরিবেশনার বেনজির কৌশল এঁরা রপ্ত করেছিলেন।

অন্যদিকে দুটি ছবির নির্মাণই ত্রিকোণ প্রেমের গল্প কেন্দ্র করে। যেখানে নায়িকার আসনটি সবার উপরে।  চিত্রনাট্য অনুযায়ী নায়িকার চরিত্রের জেল্লা ‘নায়ক’ বা ‘সহনায়ক’দের ‘গ্ল্যামার’কে ছাপিয়ে যায়। দুটি ছবিতেই সহনায়কদের ভূমিকা সুকৌশলে নিষ্প্রভ রাখা হয়েছিলো। নায়কের ভূমিকায় তিনটি ছবিতেই ছিলেন অমোল পালেকর। তিনি ছিলেন মরাঠি মঞ্চের জনপ্রিয় অভিনেতা। ‘শান্ততা, কোর্ট চালু আহে’  নাটকে তাঁর অভিনয় দেখে বাসু তাঁকে হিন্দি ছবিতে অভিনয় করার প্রথম আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন। যদিও কয়েকটি মরাঠি ছবিতে তিনি  অভিনয় করেছিলেন ইতোপূর্বে। কিন্তু বম্বে ছবির প্রচলিত ‘নায়ক’ ভাবমূর্তির একেবারে বিপরীত কোটির অভিনেতা ছিলেন তিনি।

এমন নয় যে জেল্লাহীন চরিত্রে শীর্ষস্থানীয় ‘হিরো’দের নেওয়া হতো না। স্বয়ং অমিতাভ বচ্চন’কে সুধেন্দু রায় নিয়েছিলেন ‘সওদাগরে’ প্রান্তিক কৃষিজীবীর ভূমিকায়। আবার এই নায়ককেই ১৯৭৯ সালে স্বয়ং বাসু চ্যাটার্জি  ‘মঞ্জিলে’র মতো ছবিতে একেবারে জেল্লাহীন চরিত্রে সফলভাবে উতরে দিয়েছিলেন। এই ছবির  সঙ্গীত সৃষ্টি করেছিলেন সেকালের সব চেয়ে গ্ল্যামারাস সুরকার পঞ্চম। পরিচালক হিসেবে বাসু চ্যাটার্জি ‘রজনীগন্ধা’ ছবির আগে ১৯৭২ সালে তৈরি করেছিলেন ‘পিয়া কা ঘর’। যেখানে নায়ক ছিলেন অনিল ধওয়ন। ঐ বছরেই পরিচালক অসিত সেন অনিলকে যথার্থভাবে ব্যবহার করেছিলেন ‘অন্নদাতা’ ছবিতে। যে ছবিতে সলিল চৌধুরী রোমাঞ্চকর সঙ্গীত সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু ‘রজনীগন্ধা’র জন্য বাসু চ্যাটার্জি অনিল ধওয়নের কথা ভাবেননি। তাঁর বিখ্যাত ট্রিলজি ছবিতে টানা অভিনয় করার জন্য বেছে নিয়েছিলেন একেবারে  নতুন শিল্পী অমোলকে। কারণ এই তিনটি ছবিতেই তাঁর পরিকল্পিত প্রধান পুরুষ চরিত্রের জন্য (‘হিরো’ নয়) অমোলই ছিলেন একেবারে নির্ভুল নির্বাচন। তিনটি ছবিতে সহনায়কদের ভূমিকায় ছিলেন যথাক্রমে দীনেশ ঠাকুর, অসরানি এবং বিজয়েন্দ্র ঘাটগে। তাঁরাও ছিলেন নবাগত নবীন শিল্পী। চিত্রনাট্য অনুযায়ী তাঁদের ‘স্মার্ট’ ভূমিকাগুলিকে ‘আউটস্মার্ট’ করে জিতিয়ে দেওয়া হয়েছিলো ‘অনুজ্জ্বল’ অমোল অভিনীত ‘ক্যাবলা’ (মানে, আমরা এমনই বিশেষণ ব্যবহার করতুম সেকালে) চরিত্রগুলিকে। পরিচালক বার্তা দিতে চেয়েছিলেন বাস্তবিক ধুলোমাটির জগতে ‘ক্যাবলা’ মানুষরাই ঝলমলে নায়কদের থেকে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণীয়। মেয়েরাও তাঁদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের দৌলতে শেষ পর্যন্ত এমন পুরুষদের প্রতিই অধিক নির্ভর করেন। দর্শকরাও চোখ বুজে স্বীকার করেছিলেন পরিচালকের বার্তাটি। তিনটি ছবিই সেকালে পর পর রজত জয়ন্তী হবার সাফল্য পেয়েছিলো।

কবি যখন বলেন, আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে;  তখন মনে রাখতে হবে এই তিনটি ছবিতেই যাঁদের লক্ষ করে গান বাঁধা হয়েছিলো, সেই সব নায়িকাদের চরিত্রগুলিই ছিলো ছবির কেন্দ্রীয় ভূমিকায়। তাঁরা সবাই ছিলেন স্বয়ম্বরা ও স্বয়ংসিদ্ধা। প্রথম দুটি ছবির নায়িকা ছিলেন বিদ্যা সিনহা। তৃতীয়টিতে জারিনা ওয়াহব। চলিত অর্থে তিনটি ছবি মিলিয়ে ‘ত্রয়ী’ বলা হলেও চরিত্রগত ভাবে প্রথম দুটির সঙ্গে তৃতীয়টির মিল ছিলো অনেকটাই কম। গানের ব্যবহার থেকে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।  শুধু নারীকণ্ঠের নয়, পুরুষ কণ্ঠের গানেও নায়িকা-কেন্দ্রিকতা ছিলো বেশ স্পষ্ট।

‘রজনীগন্ধা’ ছবির গান দুটি তৈরি করার সময় বাসু চ্যাটার্জি ও সলিল চৌধুরী দুজনেই স্থির করেছিলেন সেগুলি মামুলি নায়ক-নায়িকার সংলাপের অংশ হবেনা। আরও একটি ব্যতিক্রম দেখা যায় এই ছবিটির নির্মাণে। এর টাইটল ফ্রেমগুলি শুরু হতেই প্রথম দেখা যাবে গীতিকার যোগেশের নাম। ব্যাপারটি এখনও নজিরবিহীন। বাসু এবং সলিলের চিন্তাধারাটি আমাদের ভাবায়।

ছবিটির থিম গান হলো রজনীগন্ধা ফুল তুমহারি মহকে য়ুঁহি জীবন মেঁ ‘। প্রিলিউডে প্রথমে স্প্যানিশ গিটার ও তার পর সেতারে স্থায়ীর সুরটি ধরা হয়েছে। যন্ত্রের পর লতাজির কণ্ঠে হামিং দিয়ে গানটির শুরু। নায়িকার কিছু ভালো লাগা মুহূর্তের অনুভূতি, ব্যাক গ্রাউণ্ড স্কোরিংয়ের মতো চিরকালের জনপ্রিয় এই  গানটিতে ধরা হয়েছিলো। মাঝখানে নায়িকার সামান্য সংলাপও দেওয়া হয়েছে একটি শিশুর উদ্দেশে। কথোপকথনের কন্ট্রাস্ট শব্দগুলি নায়িকার আবেগকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। আট মাত্রা এই কম্পোজিশনটিতে মূল যন্ত্র হিসেবে গিটার ও সেতারই টানা ব্যবহৃত হয়েছে। তালবাদ্য বলতে ট্রিপল কঙ্গো। শুধু ধরতাইয়ে রিদম ট্র্যানসফার করতে ট্রাম্পেটের ছোঁয়া দিয়ে ফাঁক ভরানো। সলিলের স্বভাবসিদ্ধ স্ট্যাকাটো শৈলী দিয়েও কীভাবে একটি পালকের মতো স্পর্শকাতর ভালোবাসার গানকে সাজানো যায়, তা অন্য সুরস্রষ্টাদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। এই ছবির দ্বিতীয় গানটিও, কঈ বার য়ুঁহি দেখা হ্যাঁয়, ইয়ে জো মন কি সীমারেখা হ্যাঁয়, আবহসঙ্গীতের মতোই প্রযুক্ত হয়েছিলো। নায়িকার মনের তোলপাড়, দ্বিধাদ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তোলার জন্য এই গান। এর জনপ্রিয়তাও প্রায় অর্ধ শতক পেরিয়ে এসে অম্লান। এই গানটির যন্ত্রানুষঙ্গে বেশ বিশদ কারুকাজ করেছিলেন সলিল। প্রিলিউডে মূল যন্ত্র বলতে স্যাক্সোফোন ও ট্রিপল কঙ্গো। অস্থায়ীতে সুর ধরে রাখতে কীবোর্ড ও জাইলোফোনের সঙ্গে বাঁশির ছোঁয়া। রজনীগন্ধা ফুল তুমহারি  গানে ফুটিয়ে তোলা নায়িকার আত্মনিবেদনের একেবারে মেজাজ বদলে গেলো অন্য গানটিতে।   বিপরীত মানসিক মেরুতে নায়িকার মনোজগতের ঘোর টালমাটাল ধরা হয়েছিলো কঈ বার য়ুঁ হি দেখা হ্যাঁয়‘ গানে। এই গানটির সূত্রে মুকেশ ১৯৭৪ সালের সেরা প্লেব্যাক গায়কের জাতীয় পুরস্কারটি লাভ করেছিলেন। গান দুটির  সুর ও যন্ত্রানুষঙ্গের ব্যবহার মন দিয়ে অনুসরণ করলে  সলিল চৌধুরীর প্রতিভার কিছুটা টের পাওয়া যায়।

‘ছোটি সি বাত’ ছবিটিকে ‘রজনীগন্ধা’র প্রতিচ্ছায়া বলাই যায়। মন্নু ভাণ্ডারির যে গল্পটির ভিত্তিতে বাসু চ্যাটার্জি ‘রজনীগন্ধা’র চিত্রনাট্য বানিয়েছিলেন, ‘ছোটি সে বাতে’ও মোটামুটি ভাবে একই ছাঁচ অনুসৃত হয়েছিলো। তিনি নিজেই ছিলেন কাহিনী ও চিত্রনাট্যের দায়িত্বে। বাজার-সফল সিক্যুয়েলগুলি এই  ধরনের গণিতই মেনে চলে। তবে এই ছবিতে পরিচালকের কৌশলটি ছিলো অন্তর্লীন। বাজার-চলতি ‘চোখে আঙুল দাদা’ হবার প্ররোচনা এড়িয়ে চলতেন তিনি।  অত্যন্ত প্রেডিক্টেবল রূপকথাও বলার ভঙ্গিতে শ্রোতাকে আকর্ষণ করতে পারে। বাসু চ্যাটার্জি চিরকালই এই কলায় ছিলেন পারদর্শী।

এই ছবিতেও পরিচালকের উদ্দিষ্ট মেজাজটি সঙ্গীত পরিচালক নির্ভুল ধরতে পেরেছিলেন। কাহিনীর অকুস্থল ছিলো বোম্বাই শহর। সঙ্গীতের চরিত্রেও তার ছাপটি আনার চেষ্টা করা হয়েছিলো। নাগরিক স্বভাবধর্মে বোম্বাই, দিল্লির থেকে বেশি নাটকীয়। গানের মধ্যে দিয়ে নাটকটিকে ধরতে চেয়েছিলেন সলিল। যন্ত্রানুষঙ্গে ব্যাপকভাবে স্যাক্সোফোনের সুর ব্যবহৃত হয়েছিলো। সহযোগী যন্ত্র হিসেবে স্যাক্সের পর্দাগুলি সুরের রূপরেখা খুব স্পষ্টভাবে ধরে রাখতে পারে। ধ্বনির মধ্যে কনট্রাস্ট এনে সুরের তৃতীয় মাত্রা  তৈরি করতে স্যাক্সের জুড়ি নেই। সলিল এই ছবির গানগুলিতে এই মাত্রাটি বারবার ব্যবহার করেছেন। মোট তিনটি গান তৈরি করেছিলেন তিনি। জানেমন জানেমন গানটি আশাজির সঙ্গে সমানে সমানে গেয়েছিলেন য়েসুদাস। এর যন্ত্রানুষঙ্গ ছিলো জমকালো। বোম্বাই ছবির উচ্চকিত নাটুকেপনাকে মধ্যবিত্তের সীমায়িত ফ্যান্টাসির জগতে একাত্ম করতে  যা করা দরকার, তার ব্যবস্থা ছিলো সেখানে। এই গানটির যে বাংলা সংস্করণটি শিল্পী সবিতা চৌধুরীর পরিবেশনায় আমরা শুনেছি, তার প্রস্তুতি এতোটা নাটকীয় ছিলো না।  বাকি গান দুটি, জানে ক্যিঁউ এবং দিন ক্যা আয়ে মেলোডির সেরা জাদুতে ভেজা চিরকালের প্রিয়তম গানের লিস্টিতে এসে যায়। এই তিনটি গানই ব্যক্তি বিশেষের কণ্ঠে ব্যবহার করা হয়নি। চিত্রনাট্য ও  ক্যামেরার সঙ্গে মিলেমিশে নাট্যমুহূর্ত তৈরি করতেই  চিত্রায়িত হয়েছিলো।

বাসু চ্যাটার্জির আলোচ্য ত্রয়ী ছবির মধ্যে ‘চিতচোর’ একটু আলাদা। সুবোধ ঘোষের কাহিনী অবলম্বনে ছবিটির চিত্রনাট্য  তৈরি হয়েছিলো। আগের দুটি ছবির মতো এর পটভূমি মহানাগরিক নয়। সঙ্গীত পরিচালকও বদলে গিয়েছিলো। সলিল চৌধুরীর বদলে এসেছিলেন রবীন্দ্র জৈন। এই ছবিটিতে চারটি গান রাখা হয়েছিলো। চারটি গান থাকার জন্য হিন্দি ছবিকে ‘মিউজিক্যাল’ বলা যায়না। কিন্তু এই ছবিটি স্বভাবে প্রায় ‘মিউজিক্যাল’। চারটি গানই লিখেছিলেন সুরকার রবীন্দ্র জৈন। চারটি গানই গেয়েছিলেন য়েসুদাস। ১৯৭৬ সালের সেরা পুরুষ প্লেব্যাক গায়কের জাতীয় পুরস্কারটি পেয়েছিলেন তিনি  গোরি তেরা গাঁও বড়া প্যারা  গানটির জন্য। সেরা মহিলা প্লেব্যাক গায়িকার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পেয়েছিলেন হেমলতা তু জো মেরে সুর মেঁ গানটির সূত্রে। এ ছাড়া ছিলো আরও দুটি গান, ‘আজ সে পহলে, আজসে জ্যাদা এবং জব দীপ জ্বলে আনা শেষ গানটি প্রায় প্রবাদিত খ্যাতি পেয়েছিলো।

রবীন্দ্র জৈন যখন লোকশৈলীর গড়নে রাগভিত্তিক সুরকে সাজিয়ে তোলেন, যন্ত্রানুষঙ্গে বিশেষ ঝুঁকি নেন না। বাঁশি, কীবোর্ড এবং পরিচিত স্ট্রিং অর্কেস্ট্রার উপরেই নির্ভর করেন। ‘গোরি তেরা’ তে আদিবাসী গানের তালটি নিপুণভাবে ব্যবহার করেছিলেন তিনি। এই সুরটিতে মালকোষ ও ভীমপলাশি রাগের ছোঁয়া রয়েছে। ‘আজ সে পহলে’ গানটি প্রযুক্ত হয়েছিলো হয়েছিলো চলন্ত গাড়ির প্রেক্ষাপটে। এই গানের তালে আমরা চপল মেজাজ ব্যবহার হতে দেখেছি। অন্য গান দুটি ছিলো প্রত্যক্ষ রাগভিত্তিক গান। পিলুর সুরে ‘তু জো মেরে সুর মেঁ’ দ্বৈত গানটি এখনও শুনলে রোমাঞ্চ জাগে। তবে রাগ ইমনে ‘জব দীপ জ্বলে আনা’  চিরকালীন রাগভিত্তিক হিন্দি ছবির সেরা তালিকার মধ্যে আসে। য়েসুদাস প্রতিটি গানে নিজেকে প্রয়োগ করেছিলেন  সরস্বতীর বরপুত্রের নিষ্ঠায়।  হিন্দি ছবির জগতে তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

এই গানদুটিতে চিত্রগ্রহণের সময় অভিনেতা অমোল পালেকরের হারমোনিয়মে ভুলভাল আঙুল চালানোর ব্যাপারটা হয়তো পরিচালকের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিলো। সেকালের বিচারে অবশ্য আর কোনও ‘ত্রুটি’ বিশেষ চোখে পড়েনা।

উপসংহারে হয়তো বলা প্রয়োজন, এতো সফল, চোখধাঁধানো ছবি আর মনভোলানো গানের মেলায় এই তিনটি ছবি নিয়েই কেন এই আলোচনা? খুব সংক্ষেপে নিজের ধারণাটি লিখে রাখি। ছবিগুলি বস্তুত ‘বাংলা সিনেমা’, শুধু সংলাপের ভাষা হিন্দি। তাদের পরিচালক ও সঙ্গীত পরিচালক শুধু জাতিগতভাবেই বাঙালি নন, তাঁরা মেজাজের দিক দিয়েও আদ্যন্ত বাঙালি। এতোটা ‘বাঙালি’ মেজাজের ছবি হয়েও তারা  সারা দেশে অপার লোকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো। অনুজ্জ্বল, মামুলি মানুষের প্রতি যে বিশ্বাস, ভালোবাসা থেকে শিল্পী বাসু চ্যাটার্জি এবং তাঁর সঙ্গীত পরিচালকেরা এই সফল ত্রয়ীর উপহারটি দর্শকদের নসিব করেছিলেন,  তার অন্য নজির এখনও আমরা ভারতীয়  ছবিতে পাইনি। তাঁদের এই সাফল্য বাঙালি হিসেবে আমাদেরও তৃপ্ত করে, ধন্য করে। মনে থেকে যায়।

শিবাংশু দে'র লেখনী অনায়াসে ছুঁয়ে যায় সঙ্গীত কাব্য ইতিহাস কিংবা উত্তরভারতীয় শিল্পশহরের ধুলোবালি। সূক্ষ্ম নরম অক্ষরে জাগান তুলোট কাগজে লুকিয়ে থাকা ছবি যার পরতে পরতে অপেক্ষা করে পাঠকের নবতর বিস্ময়। ব্যক্তি জীবনে শিবাংশু বিখ্যাত তাঁর সুভদ্র পাণ্ডিত্যের জন্যে। অতিব্যস্ত পেশাগত জীবনের খতিয়ান হয়তো লেখক পরিচয়ে তত প্রাসঙ্গিক নয়, যদি না তজ্জনিত আসমুদ্রহিমাচল ভ্রমণ ও বহু মানুষ দেখাজনিত অভিজ্ঞতা স্মরণ করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *