আমাদের বাবা

আমাদের বাবা

প্রফেসর ডঃ শংকর সেন (জন্ম – ১ ডিসেম্বর ১৯২৮, প্রয়াণ – ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২০), ছিলেন এক ছাত্রদরদী শিক্ষক এবং স্বনামধন্য প্রযুক্তিবিদ । ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী এবং কর্মজীবনে এক মহীরুহ ব্যক্তিত্বের অধিকারী, যিনি সততা, নিষ্ঠা, শৃঙ্খলা এবং নম্রতার সঙ্গে জীবনযাপন করেছেন । তিনি আমাদের বাবা, সকলের প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় মানুষ। তাঁর ব্যক্তিত্বের মতই বিশাল তাঁর কর্মজীবন ।

জন্ম কলকাতায়, , ফিজিক্‌সের শিক্ষক ও বঙ্গবাসী কলেজ-এর ভাইস প্রিন্সিপাল প্রফেসর প্রমোদ চন্দ্র সেন পিতা, মাতা মনোরমা দেবী, ডঃ সেন তাঁদের ষষ্ঠ সন্তান। তীর্থপতি ইন্‌স্টিটিউশন থেকে তিনি অঙ্ক, ফিজিক্‌স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি তে ডিস্টিংশন নিয়ে ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় পাশ করেন। সেই সময় ভারতবর্ষে প্রবল স্বাধীনতা সংগ্রাম আন্দোলন চলছে, কুইট ইণ্ডিয়া মুভমেণ্ট, গান্ধীজি , নেতাজি , এবং অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ডাকে বহু ছেলে-মেয়েরা সাড়া দিচ্ছে। আমাদের বাবার স্বদেশপ্রেমে সেই ডাক উপেক্ষা করা অসম্ভব ছিল । ১৪ বছর বয়সে তিনি শ্রীমতী অরুণা আসফ আলীর অজ্ঞাতবাসের সময় টিফিন ক্যরিয়ার করে কোনো গোপন জায়গা থেকে সকালের খাবার পৌঁছে দিতেন, তারপর সংগ্রামের অন্যান্য কাজে যুক্ত থাকার ফলে ধরা পড়ে জেল খেটেছিলেন। পরে তিনি গান্ধীজির সবরমতি আশ্রমে দুমাস ছিলেন, সেইসময় গান্ধীজি ছাত্রদের পড়াশোনায় ফিরে যেতে আদেশ দেন কারণ স্বাধীন ভারত গড়তে গেলে উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজন।

১৯৪৮-এ বিইকলেজ থেকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, গোল্ড মেডাল নিয়ে ইলেক্‌ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী পান । স্বাধীন ভারতবর্ষের তিনিই প্রথম ইঞ্জিনিয়ার যিনি ১৯৪৯ সালে ভারত সরকারের রিসার্চ ফেলোশিপ ইন ইঞ্জিনিয়ারিং পান এবং বিইকলেজে রিসার্চ ফেলো হিসেবে যোগদান করেন । এর পর ১৯৫২ তে তিনি ভারত সরকারের কাছ থেকে বিদেশে পিএইচ্‌ডি করার জন্য সম্পূর্ণ বৃত্তি লাভ করেন এবং বিলেতের ইম্পিরিয়াল কলেজের প্রথম সম্পূর্ণ বৃত্তিপ্রাপ্ত ভারতীয় পিএইচ্‌ডি ছাত্র হয়ে ভর্তি হন । ১৯৫৫ সনে তিনি পিএইচ্‌ডি এবং ডিআইসি ডিগ্রী লাভ করে দেশে ফিরে আসেন ।

বিইকলেজে অধ্যাপনা শুরু ১৯৫৬তে, ডিপার্টমেণ্ট হেড ১৯৬৫ সনে। তাঁর তত্ত্বাবধানে নতুন শিক্ষা পদ্ধতি ও শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং ছাত্রদের জন্য অনেক নতুন উদ্যোগের সৃষ্টি হয়, যেমন ৭০-এর দশকে প্রথম মেনফ্রেম কম্প্যুটার স্থাপন। তাঁর ছাত্ররা আজও গর্বভরে তাঁর দিকপাল ব্যাক্তিত্ব, পাণ্ডিত্য ও ছাত্রবৎসলতার স্মৃতিচারণ করেন । ১৯৮৬ সনে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য (Vice Chancellor) হিসাবে যোগদান করেন। চিরকাল তিনি তাঁর কর্মজীবনে শিক্ষকতাকে অন্য সব কাজের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন এবং নিজের কাছে তাঁর সর্বপ্রথম পরিচয় একজন শিক্ষকের, তাই উপাচার্যের সব দায়িত্ব পালন করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস পড়িয়েছেন । যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঁর নেতৃত্বে অনেক নতুন কাজের সূচনা হয়, যেমন আন্ত-শিক্ষা গবেষণা (interdisciplinary research), নতুন শিক্ষা বিভাগ যেমন School of Women’s Studies (প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন যশোধরা বাগচী), School of Oceanographic Studies, সল্ট লেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস এবং আরো অনেক উদ্যোগ । এই সময়ই তিনি আণ্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের জন্য দুটি Eletrical Machinery-র বই লিখেছেন, যুক্ত থেকেছেন IIT Kharagpur, Senate of Calcutta University এবং Indian Institute of Science, Bangalore প্রতিষ্ঠান গুলিতে বোর্ড মেম্বার, এবং Calcutta Electric Supply Corp ও West Bengal Power Development Corp. এর Director হিসাবে । তাঁর পরামর্শে সৃষ্ট দুটি সংস্থা এখনো সাফল্যের সঙ্গে নানারকম কাজ করে চলেছে জনবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে – পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, প্রতিষ্ঠা ১৯৮৬, এবং Forum of Scientists, Engineers and Technologists (FOSET), প্রতিষ্ঠা ১৯৮৭ । দুটি সংস্থাই এখন রাজ্যের বাইরে বহুল পরিচিত নাম। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চকে ভারত সরকার National Award for Best Effort in Science Popularization in India প্রদান করে ১৯৮৫ – ১৯৮৯ ।

১৯৭০/৮০ দশকে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যখন লোডশেডিং নিয়ে বিপর্যস্ত , বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ নিয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল উদবিগ্ন, সেই সময়ের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর অনুরোধে ১৯৯১ সনে তিনি বিদ্যুৎ দপ্তর এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেন । এরপর পশ্চিমবঙ্গের লোডশেডিং এক ইতিহাস। আমাদের বাবার কাছে সবসময় শুনেছি যে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিতরণ কেন্দ্রগুলিতে সব ছাত্রদের কাজে অবিরাম সহযোগিতা , অভূতপুর্ব ভালবাসা ও শ্রদ্ধার গল্প। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও তিনি দেশের আরও কয়েকটি সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন । ১৯৯০ দশকের গোড়া থেকে তিনি কলকাতা সায়েন্স সিটি তৈরির উদ্যোগে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিলেন, সেটির উদ্বোধন হয় ১৯৯৭ সালে । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের অধীনে West Bengal Renewable Energy Agency চালু হয় এবং সেখানে solar power, biogas, নানারকম গবেষণার বিষয়ে উনি উৎসাহ দিতেন ও সক্রিয় ভাবে আংশগ্রহণ করতেন। সাগরদ্বীপে প্রথম photovoltaic plant বা solar power plant বসানো হয় ১৯৯৩ সালে, এটি ছিল ভারতবর্ষের প্রথম solar power installation । তাছাড়াও সুন্দরবন এলাকার কিছু গ্রামে biogas দিয়ে চুল্লি ও প্রতি ঘরে একটি করে আলোর ব্যবস্থা করা হয়।  ১৯৯০ দশকে এটি একটি অভূতপূর্ব কাজ । ওই সময় ভারতমন্ত্রক-কে উনি পরামর্শ দেন renewable energy নিয়ে প্রবলভাবে কাজ শুরু করতে। সেই কাজ অনেক পরে শুরু হয় ,ততদিনে তিনি অবসরগ্রহণ করেছেন ।

১৯৯৭ সালের তাঁর কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসাবে Imperial College তাদের গৌরবজনক  Fellowship দিয়ে সম্মানিত করে। London এর Royal Albert Hall এ এক জমকালো অনুষ্ঠানে এই স্বীকৃতি তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়। পরের বছরগুলিতে Bengal Engineering and Science University, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে “Honoris Causa” D.Sc. প্রদান করে।

১৯৯৯ সালে তিনি মন্ত্রিত্ব থেকে অবসর নেন কিন্তু নিজের নানা কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন । সিকিম ও আসাম গভর্নমেন্ট এর উপদেষ্টা ছিলেন বহু বছর, যুক্ত ছিলেন ঊষাগ্রাম ট্রাস্ট ও আকবপুর সম্মিলনীতে স্বাক্ষরতা ও স্বনির্ভর প্রকল্প গুলিতে । ঊনি বরাবর গ্রামোন্নয়নের দিকে জোর দিয়েছেন, গ্রামের স্কুলশিক্ষকদের শিক্ষা বিজ্ঞান, জনস্বাস্থ্য সচেতনা ইত্যাদির ওপর সজাগ দৃষ্টি দিতেন । জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত উনি নানা বিষয় পড়াশোনা ও লেখা চালিয়ে গেছেন । আমাদের বাবা ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা, বহু বছর আগে থেকে আমাদের সঙ্গে কত আলোচনা করতেন, সেসব বিষয়গুলি সেইসময় একেবারে নতুন । বিশেষ করে ত্রিশ বছর আগে থেকে ঊনি পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতেন – হাইড্রোজেন অর্থনীতি, শক্তি সংরক্ষণ, অপ্রচলিত শক্তি, কার্বন নিঃসরণ, সমুদ্রের স্তর বৃদ্ধি, জলযুদ্ধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে এক এক সময়ে বলতেন এবং তাঁর জ্ঞান ও গবেষণার গভীরতায় আমরা অবাক হয়ে শুনতাম ।

আমাদের মা, বন্দনা সেন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর আদর্শ সহচর ছিলেন। ১৯৯৫ সালে তাঁর সময়ের অনেক আগে আমরা তাঁকে হারিয়েছি । বাবা তারপর পঁচিশ বছরের প্রতিটা দিন কাজে ডুবে থাকলেও মাকে হারানোর ব্যথা ভুলতে পারতেন না । তাঁদের জীবনদর্শন, মানবতাবাদ, ভালবাসা, এবং সহানুভূতি কেবল কথা দিয়ে নয়, তাঁদের জীবন্ত উদাহরণ দিয়ে আমাদের মনের মধ্যে গেঁথে দিয়ে গেছেন। আমাদের বাবা এবং মা উভয়েই সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সাম্যকে সর্বোচ্চ আসন দিয়েছিলেন । শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্ম এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় মেয়েদের যে সমান অধিকার, এই বিশ্বাস ও আত্মসম্মান নিয়ে বড় হয়েছি তাঁদেরই অনুপ্রেরণায় । জীবনে সব বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করতে, সুবিচার করে সিদ্ধান্ত নিতে, এবং নিজেদের মতামতের জন্য দায়বদ্ধ থাকতে শিখেছি তাঁদের কাছে । তাঁদের সাহচর্যে আনন্দের দিনগুলি এবং তাঁদের মানবতাবোধ আমাদের সারা জীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে।

 

 

 

প্রফেসর শঙ্কর সেনের দুই কন্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *