আলোছায়াময়
ছোটগল্প বিকল্প
লেখক নরেন্দ্রনাথ মিত্র
আমার মা বলত, মাকে ডাকার আগে আমি বাবাকে ডেকেছি। আমার বলা প্রথম শব্দই নাকি বাবা।সাত বছর আগে চলে যাওয়া বাবা আমার প্রতিদিনের জীবনে এমন ভাবে জড়িয়ে আছে, আমার মনে মনে বলা প্রতিটি কথাই আসলে বাবার সাথে বলা। বাবা আমার পায়ের নিচের জমি, মাথার ওপর ছাদ, হেলান দেবার দেওয়াল ছিলেন, আজও আছেন। শত সহস্র প্রশ্ন করেছি বাবাকে, বাবা কখনও বিরক্ত হননি। কখনও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেননি। হয়ত ভুল করেছি, তর্ক করেছি বয়সের দোষে, তাতেও বাবা সমানতালে উৎসাহ দিতেন। বাবা-মায়ের এক মেয়ে আমি, তাই অনেকেই বলত, “তুুই তো বাবার ছেলেই!” বাবা আপত্তি করেছেন, বলেছেন, “না, ও মেয়ে। কিন্তু দশটা ছেলের সমান।”
অথচ সাহিত্যে বাবার কথা ভাবতে বসে কেন জানি আমার প্রথমেই ‘বিকল্প’র কথা মনে পড়ল। ছোটগল্প, নরেন্দ্রনাথ মিত্রর লেখা। আবু সৈয়দ আয়ুব যাকে পৃথিবীর সেরা গল্পের মধ্যে একটি বলেছেন। আমার ধারণা এমন বাবার চরিত্র শুধু বাংলা সাহিত্যে কেন, বিশ্বসাহিত্যেও খুব একটা বেশি নেই। নরেন্দ্রনাথ মিত্র যে মুন্সিয়ানায় মানবিক কিন্তু আগ্রাসী, স্নেহপ্রবণ অথচ নিষ্ঠুর এক আলোছায়াময় বাবার চরিত্র তৈরি করেছেন, সাহিত্যে তা খুব বিরল। এ এক আপাত সরল, অথচ জটিল মনস্তত্ত্বের গল্প।
সুধা, তার বাবা হরগোবিন্দ, আর ভাই হাবুলকে নিয়ে ছিল ছোট্ট সংসার। ভাড়াটে বাড়িতে একটি মাত্র ঘর, কিন্তু তাতে সুখের কমতি ছিল না। গল্পের প্রথম কিছুটা পড়েই আমরা বুঝতে পারি হরগোবিন্দ মা-মরা সুধাকে আগলে রাখেন, ভীষণ ভালোবাসেন আর তাকে ভালো পাত্রে বিয়ে দিতে চান। এর জন্য তিনি সবরকম কষ্ট সহ্য করতে রাজি। লোকে তাঁকে কৃপণ বলে, কারণ পাই পয়সাটিও তিনি সঞ্চয় করেন সুধার বিয়ের কথা ভেবে। আস্তে আস্তে গয়না গড়ান। কিন্তু পাত্র পছন্দ হয় না। কারোর রূপ আছে, বিদ্যে কম। আবার কারোর উল্টো। ফলে বিয়েতে দেরি হয়। যদিও সুধাও চায় না তার বাবা, ভাইকে ফেলে যেতে। হরগোবিন্দ ছেলেমেয়েকে নিয়ে বেড়াতে যান, সিনেমায় যান,রাতে গল্প বলেন। সুধা তার আদর, যত্ন, ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখে বাবা আর ভাইকে, মায়ের অভাব টের পেতে দেয় না। মোটের ওপর তিনজনের সংসারটি ছিল সম্পূর্ণ, তাতে আর কারোর জায়গা ছিল না।
এই সংসারে চতুর্থ ব্যক্তির আগমন ঘটে, সুধার জেদে। হাবুলের পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়াতে বাবাকে বহু বুঝিয়ে রাজি করে সুধা, এক গৃহশিক্ষকের জন্য। অবশেষে আসে ইন্দুভূষণ, যে কিনা কোনও একটা হাইস্কুলে পড়ায়, আর টিউশনি করে। ইন্দুভূষণের কেউ নেই। এটা জানতে পেরে আজীবন ভালোবাসায় মোড়া সুধার দুঃখের অবধি থাকে না। বাবা,ভাইকে আপ্রাণ যত্ন-করা সুধা ভাইএর মাস্টারমশাইকেও একটু আধটু যত্ন করে। মাসে দুএকদিন ইন্দুভূষণকে একটু নেমন্তন্ন করে গুছিয়ে খাওয়াতে সুধার ভালো লাগে। গল্প তো হয়ই, মাঝেমাঝে ফুল আনেন মাস্টারমশাই। বই দেওয়া নেওয়া চলে দুজনের মধ্যে। আস্তে আস্তে একেবারে সাধারণ চেহারার নিরীহ মানুষটিকে সুধা তার হৃদয় দিয়ে বসে। দুপক্ষের জন্যই কথাটা সত্যি।
হরগোবিন্দ আস্তে আস্তে সব বুঝতে পারেন। পাড়ায় কানাঘুষো শুনতে পান। ইচ্ছে করলেই মাস্টারকে তাড়িয়ে দিতে পারেন তিনি, কিন্তু অপেক্ষা করেন আরও নির্মম শাস্তি দেবার জন্য। সুধার মত চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর শাস্তি আরও বেশি কিছু হওয়া উচিত। অবশেষে একটি সম্বন্ধ পাকা করে ফেলেন সুধার জন্য। বড় চাকুরে, ভালো পরিবার। এবার সুধা আপত্তি জানালো। তার সুধা, তার আদরের মেয়েটি যে এতে আপত্তি করতে পারে, এতটা ধারণা ছিল না হরগোবিন্দের। হাবুলের থেকে সব জেনে ইন্দুভূষণকে কয়েকটি ছেলেকে দিয়ে মারধর করে একটু শিক্ষা দিতে চান সুধার বাবা। কিন্তু শিক্ষাটা একটু বেশি হয়ে যায়, ইন্দুভূষণ মারা যায়। সুধা সব জানতে পারে। মাছ খাওয়া ছেড়ে দেওয়া, সাদা শাড়ি পরা সুধাকে দেখে বুকের ভেতর জ্বলে যায় হরগোবিন্দের। বলেন, “তুই কি বিধবা? তোদের কি বিয়ে হয়েছিল?” সুধা বলে, “মন্ত্র পড়া বিয়েটাই কি সব?”
যে শৈত্য এসেছিল মেয়ে বাবার সম্পর্কে তা এবার বরফের মত জমাট বাঁধে। হরগোবিন্দ দেখেন এক প্রাণহীন সুধা, সে নিয়মমত সব কাজ করছে কিন্তু যার মন অন্য কোথাও। এমন তো চাননি তিনি, তিনি তো মেয়েকে সুখ সমৃদ্ধি দিতে চেয়েছেন! এই যন্ত্রণা তাঁকে তিলেতিলে মারে। হরগোবিন্দ বোঝেন কতবড় ভুল তিনি করেছেন।
হরগোবিন্দের ভেতরটা পুড়ে যেতে থাকে। তিনি চান সম্পর্কটা সহজ করে আগের মত করে নিতে কিন্তু সব চেষ্টা যেন পাথরের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফেরত আসে। তিনি দেখতে পান ইন্দুভূষণের দেওয়া বইগুলি, বোঝেন শত্রু মরেও মরেনি। গুমরে গুমরে নিজেই মরতে থাকেন হরগোবিন্দ।
বাড়ির তিনজন তিনটে দ্বীপের মত বাস করে। কেউ কারোর মনের নাগাল পায় না। একটা ভালো বাড়ি ভাড়া নিয়ে আগের পাড়া থেকে চলে আসেন হরগোবিন্দ। কিন্তু অবস্থা বদলায় না। জেদ, অহঙ্কারে যে ভুল তিনি করেছেন, তার জন্য ক্ষমা চান সুধার কাছে, কিন্তু তা বরফ গলাতে পারে না।
এরকম কেন করলেন হরগোবিন্দ? এ কি ভালোবাসা না চুড়ান্ত অধিকারবোধ? আমার সন্তান আমার অংশ বলে কি আমি তার নিয়ন্ত্রক? হরগোবিন্দ তো ভালোই চেয়েছিলেন, যেমন আরও অসংখ্য বাবা মা চান। কিন্তু তার পরিণতি এমন হবে ভাবেননি ।সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত আবেগনির্ভরতা ছিল হরগোবিন্দের, তিনি কখনও চাননি সুধা স্বাধীনভাবে ও আত্মবিশ্বাসী হিসেবে বেড়ে উঠুক। এই অধিকারবোধ এত তীব্র ছিল, যে সুধার ভালো হবে ভেবে মানুষ মারতেও দ্বিধা বোধ করেননি। শুধু কি অধিকারবোধ, তার সাথে ছিল সামাজিক মর্যাদা হারাবার ভয়। কিন্তু তবুও এত নিষ্ঠুর বাবার জন্যও পাঠকের মনে সহানুভূতি তৈরি হয়। এখানেই লেখকের কলমের জোর।
গল্পটি শেষ হচ্ছে একটা অদ্ভুত কথপোকথন দিয়ে। ঘটনার বেশ কিছুদিন পর অফিসের এক কলিগ সুরেনের কাছে একটি ছেলে খুঁজছেন হরগোবিন্দবাবু। ছেলেটির জাত যাই হোক, শিক্ষাগত যোগ্যতা যেমনই হোক, কাজকর্ম যেমনই করুক – তাতে কিছু আসে যায় না। সুরেন বলে, ”বিলক্ষণ! তারপর কার জন্য হে? নিজের মেয়ের জন্য নাকি? আরে ভাই খুলেই বল না জামাই চাই একটি। আছে আমার হাতে। জামাই করতে চাও তো বল।”
হরগোবিন্দ বন্ধুর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলেন, “জামাই নয়, জামাই নয়। একজন প্রাইভেট টিউটর। ছেলের জন্য একজন প্রাইভেট টিউটর!”