কাজল, কাজল, আমি তোমার বাবা

কাজল, কাজল, আমি তোমার বাবা

দুর্ভাগ্যবশত পুরাণে অথবা মহাকাব্যে পিতাপুত্রের সম্পর্কের খুব উঁচুদরের নিদর্শন বিশেষ পাওয়া যায় না। ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী রাজা যযাতি তাঁর পুত্র পুরুর কাঁধে নিজের অকাল বার্ধক্য চাপিয়ে তার যৌবন আয়ত্ত করেছিলেন। এটা ঠিক, পুরু নিজের যৌবন স্বেচ্ছায় দান করেছিল, এবং বহু বহু বছর পর যযাতি তা আবার পুরুকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার আগে হাজার বছর ধরে যযাতি নাকি যৌবনের নানাবিধ আনন্দ উপভোগ করেন এবং শেষ পর্যন্ত এসবের অসারতা ইত্যাদি উপলব্ধি করে যৌবন ফেরত দেন। পরবর্তী সময়ে তপস্যা করে-টরে তাঁর আবার স্বর্গলাভও হয়। সে হোক, কিন্তু তাঁর পুত্রের সাথে সম্পর্ককে কোনোভাবেই ঠিক আদর্শ হয়তো বলা চলে না। আবার ওদিকে যোদ্ধাশ্রেষ্ঠ হয়েও মহাকাব্যের সম্ভবত অসহায়তম নায়ক ভীষ্ম পিতার সুখের জন্য নিজের জীবন অশান্তিতে ভরিয়ে তুলতে দ্বিধামাত্র করেননি। পিতার প্রতি ভালোবাসা থেকে সেটা তিনি করতেই পারেন, কিন্তু দেখার মত বিষয় হল তার পরেও পিতা শান্তনু দিব্য বৃদ্ধ বয়সে তরুণী ভার্যা গ্রহণ করে ঘর সংসারে মন দিয়েছিলেন। অনুতাপ হয়ে থাকলেও বেশ গোপন রেখেছিলেন সেটা, কেউ জানতে পারেনি। এসমস্ত কাহিনি থেকে মনে হয় প্রাচীন যুগে পিতা ও সন্তানের সম্পর্কে স্নেহ, বিশ্বাস, আশ্বাস সব ছাপিয়ে প্রধান হয়ে উঠেছিল প্রশ্নহীন আনুগত্য। কালের নিয়মে বিবর্তন ঘটেছে সমাজের পরতে পরতে। বিবর্তন এসেছে পিতা আর সন্তানের সম্পর্কের মধ্যেও। প্রশ্নহীন ও অর্থহীন আনুগত্য সরে গিয়ে জায়গা করে দিয়েছে আশ্চর্য এক বন্ধুত্বকে। সম্পর্কে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা, তৈরী হয়েছে নতুন সংজ্ঞা। পিতাঠাকুর আদর মেখে বাবা হয়ে কাছে এসেছেন। 

এই বাবা শব্দটা বোধহয় বায়ুমণ্ডলের আর এক প্রতিশব্দ। আমরা সেখানে জীবন যাপন করি, নিঃশ্বাস নিই, বেঁচে থাকি, তবে তার উপস্থিতি খুব সচেতন ভাবে টের পাই না সবসময়। বাবা যেন হবে বৃষ্টিকালের ছাতার মতো। মাথার উপরের আকাশটার মতো। পুরানো ক্ষয়ে যাওয়া বাড়ির পিলারের মতো। এমনটা হলেই যেন নিশ্চিন্ত থাকা যায়, তীব্র শীতে কনকনে ঠান্ডা হয়ে আসা হাত পা রান্নাঘরের ওমে সেঁকে নেওয়ার আমেজ পাওয়া যায়। নিশ্চিন্ত আরামে বুজে আসে চোখদুটো। এতেই আমরা আজ অভ্যস্ত। 

তবে এমনটা যদি না হয়? সেই পুরাণ বা মহাকাব্যের উদাসীন বাবা অবশ্যই নয়, কিন্তু বাবা যদি হয় বোহেমিয়ান ভবঘুরে? যদি সন্তানের অস্তিত্বটাই তার বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়?

ঠিক এই কথাটাই যে বলেছিল অপু তার বন্ধু পুলুকে, “আমি এটা কিছুতেই ভুলতে পারি না, যে কাজল আছে বলে অপর্ণা নেই।” একদিকে স্ত্রী অপর্ণাকে হারিয়ে প্রায়োন্মাদ অপু, আর অন্যদিকে জন্মমুহূর্ত থেকে মাতৃহারা, মাতামহের কাছে অনাদরে বড় হয়ে ওঠা কাজল। এই দুই প্রায় অগম্য মেরুর মাঝে সেতুবন্ধনের রূপকথার নাম অপুর সংসার। সৃষ্টি যেমন করেছেন এক প্রতিভাধর মানুষ (শ্রীবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়), তেমন এই অসামান্য কাহিনী চলচ্চিত্রে রূপান্তর করেছেন আর এক জিনিয়াস (শ্রীসত্যজিৎ রায়)। এই আলোচনা মূলত চলচ্চিত্রের অপুকে নিয়েই। 

বিধাতা বোধহয় অপুর ললাটলিখন লেখার সময়ে অন্যমনস্ক হয়ে লিখে দিয়েছিলেন, সে হবে জন্মপর্যটক। তাই দিদি দুর্গা হোক বা পত্নী অপর্ণা, কোনো বন্ধনই তার জীবনে বেশিদিন টিকে থাকেনি। তাই কি মনুষ্য জীবনের যা শ্রেষ্ঠ বন্ধন বলে পরিচিত, সেই অপত্য বন্ধন থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চেয়েছিল অপু? যার জন্মের জন্য অপর্ণা হারিয়ে গেল চিরতরে এটা হয়তো সম্পূর্ণভাবে তার প্রতি বিদ্বেষ নয়। আবার নতুন করে কিছু হারানোর ভয় হয়তো চেপে ধরেছিল অপুকে।

অন্যদিকে ছোট্ট কাজলের কাছে বাবা হ’ল এমন একজন, যে কলকাতায় থাকে। কাজল তাকে কোনোদিন দেখেনি, তবে কাজলের প্রতি কেউ কোনো অন্যায় করলে সেই কলকাতায় থাকা বাবা কিন্তু এসে তার মুন্ডু ভেঙে দেবে। এই ধারণা কাজলের মনে তৈরী হওয়াটা সত্যি বড় আশ্চর্যের। তার মাতামহ তাকে এই ধারণা তৈরী করতে সাহায্য নিশ্চয়ই করেননি, কারণ তিনি অপুকে আদৌ পছন্দ করতেন না। অপুর সাথে কন্যা অপর্ণার বিবাহটাই তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাহলে হয়ত মাতৃহারা শিশু স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতেই তার অদেখা বাবাকে তার রক্ষাকর্তা, তার পরম আশ্রয় বলে মেনে নিয়েছিল। সম্ভবত গ্রামের মধ্যে তার দেখা অন্যান্য বাবাদের ছবি মিশিয়ে কাজল তার মনের মধ্যে একান্তে নিজের বাবার ছবি সৃষ্টি করে নিয়েছিল। ছায়ার প্রয়োজন তো সব শিশুরই হয়।  প্রায় অনাথ এই শিশুটির কল্পনায় তার বাবা কিন্তু কেবলমাত্র দূরস্থিত, দুষ্প্রাপ্য নয়।

এদিকে কথায় কথায় একদিন বন্ধু পুলুর কাছে কাজলের নাম শুনে অপু কিন্তু প্রথমে বুঝতেই পারে না কাজল আসলে কে। অথচ পুত্রের ভরণপোষণের জন্য কখনও কখনও সে টাকা পাঠিয়েছে। দায়িত্ববোধ আছে, একাত্মবোধ নেই।

পুলুর কাছ থেকে অপু জানতে পারে কাজল ভালো নেই। কৌতূহল, কর্তব্যবোধ অথবা চোরা কোনো অমোঘ টান অপুকে অবশেষে নিয়ে যায় কাজলের কাছে। কাজল তখন অসুস্থ, জ্বরের ঘোরে ঘুমিয়ে আছে। তার অপাপবিদ্ধ মুখ দেখে অপুর কি অপর্ণার কথা নতুন করে মনে পড়ে যায়, নাকি অপু হঠাৎ বুঝতে পারে যে অপর্ণা আসলে চিরতরে হারিয়ে যায়নি? অথবা এটাও হতে পারে, অপর্ণা এতদিনে সত্যিই হারিয়ে গেল পুরোপুরি। সেই স্থানে তার সমস্ত ন্যায্য দাবি নিয়ে এসে দাঁড়াল কাজল, আর এমন করে পুরোটা জুড়ে দাঁড়াল যে স্মৃতির দাবি ক্ষীণ হয়ে গেল তার কাছে। “কাজল, কাজল আমি তোমার বাবা” –শব্দগুলো স্বীকৃতি দেয়, না স্বীকৃতি চায়? বোধহয় দুটোই।

কাজল অবশ্য অপুকে বাবা বলে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। হয়তো ওই ভবঘুরে পাগলাটে চেহারার সাথে তার মনের মধ্যে কল্পনায় আঁকা ছবিটা একদম মেলেনি। এই লোকটা তাকে রক্ষা করতে গিয়ে কারুর মুন্ডু ভেঙে দিতে সক্ষম বলে বিশ্বাস হয়নি তার।

কিন্তু যখন মাতামহের উদ্যত লাঠির আঘাত থেকে কাজলকে রক্ষা করে অপু, ততক্ষণাৎ পিতা আর পুত্রের চিরাচরিত ভূমিকা কেমন অনায়াসে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। 

কাজল অবশ্য রাজী হয় না অপুর সঙ্গে কলকাতায় যাত্রা করতে। সেটা কি সত্যি মাতামহের তিরস্কারের ভয়ে, নাকি অপুকে বাবা বলে স্বীকার করে নিলেই তার মনের আশৈশব সযত্নলালিত বাবা নামক রূপকথাটা নষ্ট হয়ে যাবে এই ভয়ে, তা জানি না। তাই সে প্রশ্ন করে, “তুমি আমাকে বাবার কাছে নিয়ে যাবে?” 

কলকাতা তো শিশুর গন্তব্য নয়, তার গন্তব্য যে বাবা।

বাবারা তো গন্তব্যই হয়।

বাবার কাঁধে চড়ে কাজল পাড়ি দেয় সেই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। চলচ্চিত্রের শেষে দেখা যায় কাজলের মাতামহ প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সেই মায়াবী দৃশ্যের দিকে। চির পর্যটক অপুর শুরু হয় এক নতুন যাত্রা – পিতৃত্বের যাত্রা।

সব অপুর কাঁধেই নিশ্চিন্তে থাকুক তার কাজল। নির্ভার হোক সে যাত্রা।

<অবসর পিতৃদিবস ইভেন্টে পুরস্কৃত লেখা>

চিত্রঋণ: অন্তর্জাল

 

 
বুমা ব্যানার্জীর জন্ম, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র কলকাতা হলেও বর্তমানে কানাডাবাসী। শিক্ষাক্ষেত্র: পদার্থ বিজ্ঞান; প্রাক্তন কর্মক্ষেত্র: তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগ; বর্তমান কর্মক্ষেত্র: স্বনিযুক্ত পেশা; লেখালেখি শুরু ২০২১ সাল থেকে বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিনে। জয়ঢাক, একপর্ণিকা, ম্যাজিক ল্যাম্প, নিউ জার্সি থেকে প্রকাশিত অভিব্যক্তি পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। কিশোর ভারতী পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত ও পুরস্কৃত হয়েছে। কল্পবিশ্ব শারদীয়া ২০২৩ এ প্রকাশ পেয়েছে ছোটগল্প। এছাড়া বিভিন্ন সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কিছু ছোটগল্প ও অণুগল্প। ভেল অফ টেলস্ অডিও স্টোরি চ্যানেলে উপস্থাপিত হয়েছে একটি উপন্যাসিকা। সামনের লক্ষ্য: একক গ্রন্থ প্রকাশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *