জানলা

জানলা

খুব অদ্ভুত হলেও অঞ্জন দত্তর ওই বিখ্যাত গানটা, ওই, আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়, আমি প্রথম শুনেছিলাম আমার ভাইয়ের গলায়। মাঝে মাঝে ও ‘উকুলেলে’ (চারটি তারবিশিষ্ট ছোটো হাওয়াই গিটার) নিয়ে পিড়িং পিড়িং করে গান করত। এখন আর করতে শুনি না। হয়তো অফিসের চাপ, হয়তো সময় পায় না, হয়তো কিছু জানলা একটা বয়সের পর আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে আসে। সামনে গিয়ে ঠকঠক করলে জানলা বলে ওঠে, “আবার ভিজতে এসেছিস হতভাগা?”

সেবার আমার অফিসের একটা চেম্বারটায় দুটো জানলা ছিল। দুটোই সবসময় বন্ধ থাকত। আসলে জানলা খুললেই সামনে পাশের অফিসের পুরনো নোনা ধরা দেওয়াল, এসির জল চুঁইয়ে পড়ে দাগ দাগ হয়ে গেছে। সারাদিন ঘরটা একটুও আকাশ পেত না। আকাশ দেখতে হলে আমায় তিনতলা থেকে নেমে আসতে হতো রাস্তায়। তবে একটুখানি নীলের দেখা পেতাম। সত্যি বলতে দম বন্ধ লাগত। ওই আক্ষেপ পুষিয়ে গেল, যখন আবার ট্রান্সফার হয়ে চলে আসা হলো রুবির অফিসে। আমার চেম্বারটা ছিল ন’তলায়। ডানদিকের গোটা দেওয়াল জুড়ে কাচের জানলা। সেন্ট্রাল এসি ছিল বলে জানলাটা সাধারণত বন্ধ থাকত। কিন্তু পর্দা টেনে দিলেই সামনে চোখে পড়ত দিগন্তের ভাগশেষের মতন একটুখানি ডাঙ্গা দেখা যাচ্ছে। ওটুকুর মধ্যেই ঠাসবুনোটের মতো ইএম বাইপাস, মেট্রো, বাইপাসের ওপাশে সবুজ আর সবুজ জেগে আছে। ওখানে একটা বড় জলাশয় দেখা যেত। এতো সুন্দর টলটলে জল, জানলাটা দিয়ে দেখে মনে হতো ওটা আসলে ওখানে নেই। অলীক। কাছে গেলেই দেখতে পাব প্যাচপ্যাচে কাদাভরা একটা উজাড় মাঠ। মাঠটা আমার আগমনের অভিপ্রায় বুঝে বলছে, “শখ কত!” তখন হয়তো বুঝতে পারতাম, জীবনের কিছু অনির্বচনীয়তা নির্দিষ্ট কিছু জানলার কাছে ঋণী থাকে। বাকি সব শুধু আসা যাওয়ার সালতামামি। ওই ওইটুকু ভাগশেষের মতন জমির ওপরে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকত এত্তবড় একটা আকাশ। কখনও তার নাম নীলাম্বর, কখনও সে খর শাদা কখনও আবার সজল শ্যামল কৃষ্ণঘন মেঘের মালা। সে এক অপরূপ দৃশ্য। চেয়ে চেয়ে আশ মেটে না এমন তার লীলা। ওই চেম্বারেই একটা ছবি লাগান হয়েছিল, ভ্যান গঘের ‘দ্য স্টারি নাইটস।’ ছবির ব্যাকরণ আমি বুঝি না, মুগ্ধতা বুঝি। চেয়ে থাকতে বেশ লাগত ছবিটার দিকে। নীল কালো আকাশে হলুদ ফুলের মতন তারা ফুটে আছে। সামনে টলটলে জল। দিগন্তের ওপার থেকে হলুদ আলোর ছায়া এসে পড়েছে জলে। এপাশে দুটো নৌকো লাগান, মাঝি কোথায় কে জানে। আর ছবির একদম তলার দিকের কোণে দুজন মানুষ। একজন পুরুষ, আরেকজন নারী। কেন জানি ওদের দেখে দম্পতি বলে মনে হয়। ছবিটার একটা মজার ব্যাপার ছিল। যখনই ওই দেওয়াল জোড়া জানলা দিয়ে কালো মেঘের ঘনঘটা ঘনিয়ে আসত, ছবিটার জলগুলো ছলছল করে উঠত। যেন হাত বাড়ালে আঙ্গুল ভিজে যাবে এমন। আসলে বর্ষার মধ্যে এক ভাঙচুর থাকে। কিছু জানলার মধ্যেও। আর শিল্প? উলুক ঝুলুক সুখের আস্তরণটুকু সরে গেলেই যে অলীক জলাশয়ের জল টলটল করে, শিল্পী ছাড়া কার সাধ্য তা আকণ্ঠ পান করে! পর্দা সরিয়ে দিতাম। পুরো। সবুজের ওপর, ইএম বাইপাসের ওপর, গুটকি গুটকি গাড়িগুলোর ওপর, সেই জলাশয়ের ওপর তখন নেমেছে নিঠুর মেঘের পুলকবেদনার ছায়া। ফুল যেমন ভ্রমর চেনে, মরুভূমি যেমন মেঘ চেনে, কবি যেমন বাঁশি চেনে তেমনি করেই বোধহয় বর্ষা ঠিক চিনে নিত দেওয়াল জোড়া জানলা আর স্টারি নাইটসের জল। বর্ষা এলেই তাই ওই জানলা আর ছবিটা হাত ধরে ধরে শিশুর খেলার মতন পাশাপাশি চলে আসত। আসলে জলের গতি অবাধ। কখন কোন সুড়ঙ্গপথ ধরে, কোন খোঁদলের সুঁড়িপথ ধরে ওরা কর্কট রোগের মতন অস্তিত্ব ছেয়ে ফেলে, বোঝে কার সাধ্য! বর্ষা বড় বেদনার ঋতু। 

কিছু খোঁদলে জল দিলে সেখান থেকে নতুন সবুজ আঙুলের মতন বৃক্ষনাথ জন্মায় না। খোঁদল বেড়ে চলে, বেড়েই চলে। বর্ষার মতন। প্রথমে ওই একটুখানি কোনায় দেখা গেল কালো জলদের রেখা। তারপর অকৃতজ্ঞ উটের মতন ধীরে ধীরে সে নীলাম্বরকে গ্রাস করতে থাকে। যখন গোটা আকাশ ছেয়ে গেছে নিবিড় বেদনায়, জানলা দিয়ে দেখা অলীক জলাশয়, যেটা আসলে নেই, কিন্তু আছে, ওই জানলাটা, যেদিকে তাকালেই বিশালতা আর অমর শিল্পীর আঁকা জলের ছলছল কেমন করে প্রতিবেশী হয়ে গাইতে থাকে, ‘উন্মদ পবনে যমুনা তরজিত, ঘন ঘন গর্জিত মেহ… দমকত বিদ্যুত, পথতরু লুণ্ঠিত, থরথর কম্পিত দেহ।’ বর্ষা ছাড়া শহরের বুকের ভেতর দুরুদুরু যমুনা আর কেইই বা আনতে পারে!

ওই অফিস থেকে চলে আসার পর ছবিটার জন্য, জানলাটার জন্য মনখারাপ হত। তাই এই অফিসে এসে চেম্বারে আরেকটা ছবি লাগিয়েছি। ছবিটার নাম ‘আমন্ড ব্লজম।’ শিল্পী উনিই। গোটা ছবিটা জুড়ে একটা শীতলপাটি বিছানো। প্রগাঢ় নীল আকাশ, বাদাম গাছের শাখা প্রশাখা একটু একটু করে নিজেকে মেলে ধরেছে ওই নীল চাঁদোয়ার নভোনীলে। সাদা সাদা ফুল ফুটে আছে। ঠিক ফুটে আছে বললে মিছে কথা বলা হয় যেন। প্রস্ফুটিত হয়ে আছে। গোটা ছবিটা জুড়ে এতো আলো! মজার ব্যাপার হলো, এই ঘরেও একটা জানলা আছে। পুরনো বাড়ির দেয়ালের মোটামুটি অর্ধেকটা জুড়ে জানলাখানা। তিনটে লম্বা লম্বা পর্দা টাঙান থাকে। দড়ি ধরে টানলে ওপরে উঠে যায়, নীচে নেমে আসে। বছরের একটা সময় জানলাটার তিনটে পর্দা ওঠানো থাকে। বোঝা যায়, তখন বর্ষাকাল। জানলার ওপারে আরেকটা পুরনো বাড়ির লম্বা ছাদ। তার ওপরেই ওই বিশাল আকাশটা। যেটা মাঝে মাঝে মেঘের আভরণে সেজে ওঠে। আর যখনই আকাশে ওরকম একটা অদ্ভুত ছায়া ঘনাতে থাকে, আমি দেখতে পাই বাদাম গাছের ফুলগুলোর পাশ থেকে উঁকি মারছে অস্তিত্বখিন্ন জলের ফোঁটাগুলো। আকাশে তখন মহতী হুলুস্থুল। মেঘের কোল ঘেঁষে উড়ে যাচ্ছে দিশেহারা পাখি। ওদের দেখলেই সহোদর বলে মনে হয়। বাদাম গাছের উজ্জ্বল নীল আর প্রস্ফুটিত ফুলগুলোয় তখন জলের ছায়া ঘনিয়ে আসছে। আলোকিত ছবির আড়ালে উঁকি মারছে মেঘের বিষণ্ণ আঁধার। হলুদ ফুলগুলো থেকে টুপটুপ ঝরে পড়ছে মথিত অন্ধকার। বর্ষার ভিতর বোধহয় এক নারী বাস করে। রাতের আকাশের মতন তার শরীর, আদুর, নক্ষত্রখচিত। বাদাম ফুলের হলুদ, অলীক জলাশয়ের অবগুণ্ঠনে সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। সর্বক্ষণ সেই সর্বনাশকে চোখের সামনে অসীমের অকরুণ মূর্তির মতন রাখা চলে না। বছরের একটা সময় বুঝি সে ছাড়া পায়। তখন আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বলে, “এবার আমার জলের ঋণ শোধ কর!” সবকটা জানলায় তখন এক অদ্ভুত খননকার্য চলে। বুকের ভেতর খুঁড়ে চলে খোঁদল, তার একান্ত নিভৃত যক্ষের কাছে পৌঁছবে বলে। সেখানে মাটিচাপা জল আছে। হাত লাগলেই পুড়ে যায় এমন তার স্নিগ্ধতা, চোখ পড়লেই অন্ধত্ব গ্রাস করে এমনই তার অনির্বচনীয়তা। বর্ষা বড় সর্বনাশের ঋতু। 

অনেকদিন আগে একটা ছোট্ট কবিতা লিখেছিলাম। তখন স্কুলে পড়ি মনে আছে। 

“এই শ্রাবণের বুকের ভেতর কোথাও আগুন আছে

এই আগুনের বুকের ভেতর কোথাও শ্রাবণ আছে

এসো, আমরা শ্রাবণের প্রতিটা বারিকণা   

মাটির টানে ধ্বংসের আগে অন্তত একবার

এই শ্রাবণকে আগুনের মতন ভালবাসি”

সিক্ততা কখনও বোঝা যায়, কখনও বোঝা যায় না। কখনও বুঝতে পারলেও সঠিক সময় জানলার পাল্লা বন্ধ করা যায় না। বর্ষার ভিতর এক অমোঘ সম্মোহন আছে। তার সামনে সবকটা বাঁধ, সবকটা পাল্লা কোথায় খড়কুটোর মতন উড়ে যায়। যখন রিক্ততার শাঁখ বেজে ওঠে, মনে পড়ে জলের ঋণ রয়ে গেল কোথাও। বর্ষার ভিতর সেই নারী বাস করে। যার মেঘস্পর্শে স্টারি নাইটসের জলে ঢেউ ওঠে, বাদাম ফুলের নিরীহ ছবির আড়াল থেকে উঁকি মারে বেহালার ছড়ের কান্নাফুল। আকাশে তখন চাপা দ্রিম দ্রিম। শনশন হাওয়া বইছে। সবকিছু ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য অন্তরীক্ষ শরীরের সেই নারী মেঘের ত্বকে নখের আঁচড়ে লিখে যাচ্ছে একটার পর একটা চিঠি। যার হয়তো গভীর কোনো অর্থ আছে, অথবা শুধুই প্রলাপ। আর সেই প্রলাপ আজীবন ধরে অনূদিত হতে থাকে। জলের ভাষায়। বর্ষা ভীষণ নিষ্ঠুর ঋতু। বিরহ লগ্নে বোধ করি তার জন্ম।

বছরের বাকি সময়গুলো জানলার ওই তিনটে পর্দা ফেলা থাকে। আসলে গরমকালে হলকা আসে, শীতকালে ঠান্ডা হাওয়া। পৃথিবী ধীরে ধীরে চরমভাবাপন্ন হচ্ছে। দেওয়ালে ঝোলান আলোর মতন ছবিটাও শান্ত বালকের মতন থাকে সারাটা বছর। যেমন পূর্ণিমার রাতে অনেকের বাতের ব্যথা ওঠে, তেমনি ছবিটা ক্ষেপে যায় বর্ষা এলে। আর এই ক্ষেপে যাওয়াটা ভীষণ ছোঁয়াচে একটা রোগ। বর্ষা খুব সম্ভবত সেই রোগটার নাম। যে রোগে বয়সের সাথে সাথে প্রবেশ-নিষেধ জানলার পাল্লাগুলো একটু একটু করে আলগা হয়ে আসে। গোমড়া মুখের মানুষগুলো ভুল করে হলেও একটু উদাস হয়ে যায়। রাস্তার ধারের কৃষ্ণচূড়া গাছটা হয়তো ভুল সময়ে লালে লাল হয়ে ফেটে পড়ে। রোজের জীবনের ঝক্কি সামনে তিতিবিরক্ত মানুষটার মনেও হয়তো ভেসে ওঠে অতীতের কোনো অভিসারের মহাকাব্য। পিড়িং পিড়িং করে গিটার অথবা ‘উকুলেলে’ বাজিয়ে হয়তো কেউ গান গেয়ে ওঠে, ‘আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে…’

জীবন একটু জল পায়। পাক না।।

নয়ন বসুর জন্ম কলকাতায়, পেশায় আয়কর আধিকারিক। নেশায় পাঠক, শ্রোতা, দ্রষ্টা এবং একদম শেষে লেখালিখি। বেড়াতে যেতে ভালোবাসেন এবং জানলা দিয়ে পাহাড় দেখা গেলে হোটেল থেকে বেরোতে চান না। ভূতে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু ভয় পান। ভয় পান উচ্চতা, প্রিয়জনের দূরত্ব এবং পাঁচ বছরের সন্তানের কান্না। প্রিয় খাবার বিরিয়ানি, প্রিয় মানুষ যারা বিরিয়ানি খাওয়ান। অপছন্দ মিথ্যে কথা। পছন্দ পুরোন আমলের বাড়ি, মেঘ আর ঘুম। প্রকাশিত বই একটি, নাম জামিলা। জীবনের লক্ষ্য চোখ বুজবার আগে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতাটি লিখে যাওয়া।

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Madhumita Roy , July 16, 2024 @ 2:36 pm

    Excellent 👌

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *