বাদল বেলা

বাদল বেলা

আদিকবি লিখেছিলেন, “আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্ট সানুম্। …”  ছেলেবেলায় গুরুজনদের মুখে শুনতাম পয়লা আষাঢ় নাকি বৃষ্টি হবেই, ছিঁটেফোঁটা হলেও হবে, কিন্তু সেইসব গুরুবাক্য বৃথা করে এই বছরে পয়লা আষাঢ়ও রুখা-শুখাই গেল। প্রখর রৌদ্রে গলদঘর্ম হবার দিন বুঝি আর শেষ হবার নয়! কালবোশেখীর মেঘ, মাঝে মাঝে পাগলা দাশুর মতো চেহারাটা দেখিয়েই উধাও হয়ে যাচ্ছে।

বারান্দায় রাখা জলপাত্রে জল খেতে আসে হা-ক্লান্ত কাক, শালিক, দোয়েল। আমি কেবল গৃহকোণে বসে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর নিবন্ধ পাঠ করি।

দক্ষিণবঙ্গে পয়লা আষাঢ় নির্জলা কাটলেও, সংবাদমাধ্যম সূত্রের খবর অনুযায়ী, সিকিম আর উত্তরবঙ্গ বেশ কিছুটা বৃষ্টির দাক্ষিণ্য পেয়েছে। বলা হচ্ছে, এইটুকু বৃষ্টি নাকি এই সময়ের জন্য স্বাভাবিক।

স্বাভাবিক! কী আশ্চর্য! তবে যে সংবাদপত্রে ছবি দেখি তিস্তার গ্রাসে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত! সব কিছু ওলটপালট হয়ে পড়ে আছে!

বিখ্যাত পরিবেশবিদ জয়া মিত্রের নিবন্ধে রয়েছে এর উত্তর। বর্ষার সময়ে নদীর জলস্ফীতি তো অবধারিত। নদীর খাত থেকে উপচে ওঠা জল দুকূল প্লাবিত করবে এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। তাই একটি চালু প্রবচন হল – ‘বড় নদীর কূলে চাষ আর ছোট নদীর তীরে বাস।’ বর্ষাকালে বন্যায় নদীর দুকূল প্লাবিত হয়, ফলে পার্শ্ববর্তী জমিগুলি জলবাহিত পলিমাটিতে উর্বর হয়। এতে পরের দুই এক বছর ফসল খুব ভালো হয়। এছাড়াও আশেপাশের ছোটোখাটো খানাখন্দ, গর্ত আর বিভিন্ন জলক্ষেত্রের সঞ্চিত জল ধীরে ধীরে মাটির নীচে চুঁইয়ে ভূগর্ভস্থ জলভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে। বৃষ্টিই পানীয় জলের একমাত্র আকর। এই জলসম্পদকে ব্যবহার করার বিপুল জ্ঞান আগে মানুষের ছিল।  উন্নয়নের অছিলায় নদীতীরবর্তী অঞ্চলসমূহকে কংক্রিটের চাদরে মুড়ে দেবার কথা মানুষ ভাবতেই পারত না। নিজেরা বড়ো নদী থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেই বসতি স্থাপন করত। 

এখন কি তাহলে সেই জ্ঞান আধুনিক শহুরে মানুষের নেই? বিলক্ষণ আছে। তবুও বেপরোয়া হয়ে, মানুষ বনদপ্তর, পরিবেশ দপ্তরের নির্দেশগুলিকে অমান্য করতে দুবার ভাবে না। অর্থমনস্ক, লোভী  মানুষ কাণ্ডজ্ঞানহীনতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে নদীর লাগোয়া জমিতে হোটেল, রিসর্ট, বেসরকারি কলেজ ইত্যাদি নির্মাণ করছে।  তারই ফলে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতেও দুকূলপ্লাবী বন্যা! প্রকৃতির  বিরুদ্ধে যাবার অমোঘ পরিণাম! সম্যক উপলব্ধি করেও লোভী এবং হঠকারী মানুষের টনক নড়ছে কই!

সাম্প্রতিকতম  উদাহরণ হিসেবে দেশজুড়ে  হইচই ফেলা রামমন্দির নির্মাণের কথা ধরা যায়। ‘মন্দিরনির্মাণে’ ভক্তজনের চিত্তরঞ্জন ঘটেছে – সন্দেহ নেই। তাতে আপত্তিরও কিছু নেই। কিন্তু সেইসঙ্গে পার্শ্ববর্তী নদীটিও যদি কর্তৃপক্ষের মনোযোগ আকর্ষণ করত! নদীর মধ্যস্থল পর্যন্ত মন্দির সংলগ্ন বিশাল ঘাট নির্মাণে পুণ্যার্থীরা অবশ্যই পুলকিত, কিন্তু ব্যাহতগতি প্রবাহটি যদি কখনও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে? মন্দিরের পাশাপাশি সেটিও তো সমান গুরুত্ব পাবার অধিকারী! এই হঠকারিতায় অন্যান্য রাজ্যের শহরগুলিও কিছু পিছিয়ে নেই।

যা আমরা সহজে পেয়েছি – নদীপ্রবাহ, বৃষ্টিধারা – সেই সবকিছু অবহেলায় উপেক্ষা করায় বিপদ আছে। তা আজ রাজধানী থেকে অনেক বড় শহরবাসী মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে। সামান্য বৃষ্টিতে আধুনিক শহরগুলো জলবন্দী। রাস্তাঘাট জল থইথই। পাম্প চালিয়েও নীচু জলমগ্ন এলাকাগুলিকে জলযন্ত্রণা থেকে মুক্ত করতে কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হয়। 

কী আর করা!  অবিমৃষ্যকারী মানুষ যে বৃষ্টিজল বয়ে যাবার রাস্তাটুকুর তোয়াক্কা না রেখে, সমস্ত মাঠ ঘাট বুজিয়ে, পাকা রাস্তা, ছিমছাম বহুতল আবাসন তৈরীতে মন দিয়েছে। নিকাশি খাল উধাও। তার খেসারত তো দিতেই হবে। একদিকে বন্যা, অন্যদিকে পানীয় জলের অভাব, আর সেই সঙ্গে রয়েছে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন। গ্লোবাল ওয়ার্মিংএর সব আয়োজন সম্পূর্ণ।

অথচ বর্ষাকালে বৃষ্টি পড়বে, মাটির ভিতরে তা চুঁইয়ে প্রবেশ করবে, মানুষ নিজের প্রাণরক্ষার কাজে, নিজের প্রয়োজনে,  আকাশ থেকে নেমে আসা জলধারা সঞ্চয় করে রাখতে প্রাণরক্ষক ছোট বড়ো জলাশয় তৈরি করে রাখবে – এ কথা তো সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের জানা ছিল। এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত কৃষিবিজ্ঞানী, মাসানোবু ফুকুওকার একটি মূল্যবান কথা সর্বদা প্রণিধানযোগ্য। “বৃষ্টি আকাশ থেকে পড়ে না, তা ওঠে মাটি থেকে। “

বাইশে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিরোধান দিবসে, প্রার্থনা সভায় যোগ দিতে অনেকেই শান্তিনিকেতনে যান, পরদিন বৃক্ষরোপণ উৎসবে যোগও দেন, কিন্তু ওই পর্যন্তই। উৎসবের মূল ভাবনাটি বিন্দুমাত্রও রেখাপাত করে না আধুনিক মনে। ওই দিনটি যেন শুধুই বৃক্ষরোপণের দিন হিসেবে চিহ্নিত! বিদ্বজ্জনেরা চেয়েছিলেন মানুষের চেতনাতেও উপ্ত হোক সেই বীজ। হয়নি।

এলোমেলো ভাবনায় অলস মধ্যাহ্ন কাটে। পরিবেশবিদরা বলেন, “বৃক্ষরোপণ করো।” কিন্তু কে নেবে সেই উদ্যোগ! খালি রোপণ করলেই তো হয় না, রক্ষণাবেক্ষণও জরুরি! সেই দায়িত্বই বা নেয় কে! অতএব টবের গাছে জল দিই আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি। এই মধ্য আষাঢ়েও কলকাতা মহানগরীর জন্য এখনও পর্যন্ত ছিঁটেফোঁটাই বরাদ্দ!

ঘরে এসে বইয়ের পাতা ওলটপালট করতে করতে আচমকাই চোখ চলে গেল সদ্য প্রকাশিত মননশীল পাক্ষিক পত্রিকার পৃষ্ঠায়,  চিঠিপত্র বিভাগে।

নদীয়া থেকে শ্রীসতীনাথ মুখোপাধ্যায় নামে শ্রদ্ধেয় বিদগ্ধ পণ্ডিতজনের পত্রে, রামায়ণ নিয়েএকটি  অসামান্য আলোচনায় উঠে এসেছে সম্পূর্ণ নতুন একটি তথ্য। অনেকেই হয়তো জানেন, কিন্তু আমার মতো অতি সাধারণ মানুষের তো মোটেই জানা ছিল না!

‘বাল্মীকির মনোভূমি’তে রচিত রামায়ণে শ্রীরামের উপাখ্যান আমাদের চিরপরিচিত। সেই ছেলেবেলা থেকেই পুরুষানুক্রমে আপামর জনসাধারণের ঘরে ঘরে  চর্চিত হয়ে থাকে রামকথা। তাঁর বীরগাথায় নির্মিত হয়েছে কতো চলচ্চিত্র।পরম্পরাগতভাবে এর পরিচয় আদিকাব্য হিসেবে।

বর্তমানে বুঝি বা শ্রীরামচন্দ্রকে ভারতীয়দের  আদিপুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করার একটা প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। এইখানেই লেখক, ইতিহাস-পুরাণ পরম্পরার আলোচনায় পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানিয়েছেন, রামায়ণকে আদিকাব্য বলে চিহ্নিত করা হলেও এটি কিন্তু মহাভারতের মতো ‘ইতিহাস’ নয়। এটির একটি ভিন্নতর ব্যখ্যাও আছে।

এখানে পাঠকের মনে হতেই পারে বর্ষাবাদলের খামখেয়ালিপনার আলোচনার মধ্যে ইতিহাস, পুরাণের দ্বন্দ্ব টেনে আনার প্রাসঙ্গিকতা কোথায়!

এ যেন “ছিল রুমাল হয়ে গেল বেড়াল” এর মতো ব্যাপারস্যাপার!

এখন সেই প্রসঙ্গেই আসা যাক। পত্রলেখক জানাচ্ছেন, রামায়ণের গল্প বাল্মীকির নিজস্ব নয়। দেবর্ষি নারদ বাল্মীকিকে সেটি শুনিয়েছিলেন এবং বাল্মীকি তাঁর সুললিত ছন্দে গেঁথে সেই কাহিনি মানুষের  কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

এইবার নারদের দিকে চোখ ফেরানো যাক। আলোচনায় জানতে পারি, ‘নার’ মানে জল, আর নারদ মানে ‘জলদাতা।’ ভারতবর্ষের মতো কৃষিপ্রধান দেশে জলের গুরুত্ব সেই প্রাচীন কাল থেকেই সবাই উপলব্ধি করছেন। তাহলে বাল্মীকিকে যিনি রামকাহিনী শুনিয়েছিলেন, সেই নারদ আদতে ‘জলদাতা!’ 

এবার তাহলে জেনে নেওয়া যাক রাম-সীতার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ঠিক কী।

রাম শব্দের অপর অর্থটি হলো জলদ মেঘ। সীতা শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো মাটি। এছাড়াও সীতা মানে হলকর্ষণ পদ্ধতি, আবার ভূমিলক্ষ্মীও। তার মানে মেঘদেবতা রামের সঙ্গে কৃষিদেবী সীতার মিলনকাব্যই হলো রামায়ণের মূল নির্যাস।

প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ শ্রী জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘রামায়ণের উৎস কৃষি’ পুস্তকে লিখেছেন,

“আদি শ্লোক মেঘবন্দনা, রাম মেঘদেবতা এবং সীতা কৃষিশ্রী। সুতরাং রামায়ণের মূল স্বরূপ কৃষিভিত্তিক।”

রামের গায়ের রঙ দুর্বাদলশ্যাম। মেঘদেবতা রাম, অঝোর বর্ষণে ধরিত্রী মাতা সীতাকে কর্ষণযোগ্য করে তোলেন। সীতা হলেন বসুমাতা। মেঘের আগমনে জলধারায় সিক্ত হয়ে বসুমতী কর্ষণযোগ্য হন।

লেখকের নিজস্ব ভাষায়, “নবদুর্বাদলশ্যাম মেঘদেবতার সঙ্গে ধান্যবর্ণা সীতার মিলনই হল রামায়ণের মূল উপজীব্য। রামের (অর্থাৎ মেঘের বা মৌসুমী বায়ুর) অয়ন, মানে আবর্তন। আর সীতা হলেন কৃষির প্রতিনিধি। রাজারানির কাহিনির অন্তরালে এই-ই হল রামায়ণের মূল বক্তব্য। 

রবীন্দ্রনাথও রক্তকরবীর ভূমিকায়  আরাম এবং শান্তির প্রতিভূ রামকে কৃষিসংস্কৃতির প্রতীক বলে উল্লেখ করেছিলেন।

রাম এবং সীতাকে যিনি যে রূপে চাইবেন সেই ভাবেই আরাধনা করে তৃপ্ত হতে পারেন বৈকি, সেই ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রত্যেকেরই আছে। কিন্তু অন্তরালের মূল ভাবনাটিকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসে গেছে।

আমাদের এই কৃষিপ্রধান দেশে, চাষবাসের ভাবনা মাথায় তুলে রেখে আর নদীর স্বাস্থ্য, নাব্যতা, পলিসংস্কার ইত্যাদির ভাবনা-চিন্তা-পরিকল্পনা এক কোণে ঠেলে সরিয়ে রেখে, কেবলই ‘ইহাগচ্ছ, ইহতিষ্ঠ’ মন্ত্রোচ্চারণ করে বৃক্ষনিধন, নদীনিধন যজ্ঞে আহুতি দিলে সমূহ বিপদ অনিবার্য। পত্রলেখক পরিশেষে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, সেই রামরাজত্ব থেকে স্বয়ং রাম চিরবিদায় নিয়ে হারিয়ে যাবেন না তো! 

পণ্ডিতজনের তথ্যসমৃদ্ধ, মননশীল প্রবন্ধটি এই মরসুমের ছিঁটেফোঁটা বৃষ্টিজলের মধ্য-আষাঢ়ে আমার মতো অতি সাধারণ পাঠককেও বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। আমাদের বাদল বেলা, এই মরসুমে বুঝি এইভাবেই কাটল!

বৈষ্ণবঘাটা পাটুলি টাউনশিপ, কলকাতা ৯৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *