সান্দ্র শব্দমালা

সান্দ্র শব্দমালা

বর্ষা নিয়ে, বৃষ্টি নিয়ে নতুন কীই বা বলার আছে। একশ বছরেরও বেশি পুরোনো প্র-প্রপিতামহ বাড়িটা, যা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি হিসেবে আজ গর্ব অপেক্ষাও বেশি মাথাব্যথার কারণ, সেই বাড়ির বিভিন্ন ফাটল দিয়ে অক্লেশে অঝোর ধারায় জল পড়ে, এজন্য বাইরে বেরোতে হয় না। বর্ষার রূপ আমি বাড়িতেই দেখিয়াছি, তাই প্রকৃতির রূপ বাইরে খুঁজিতে যাই না আর! একবার মিস্ত্রি ডেকে মোটামুটি সারানোর একটা আইডিয়া নেওয়া হয়েছিল, খরচের বহর শুনে মনে হল, এর থেকে ছাদহীন থাকাও অনেক সুখের। সব্বাই এখান থেকে চলে গেছে, পরিস্থিতির প্যাঁচে পড়ে একমাত্র রয়ে গেছে যে এই মায়াবিবরে, দায় কি তার একারই! আরে বাবা সেই দায় বহনের ক্ষমতা আছে কি না দেখতে হবে না? ফলে বর্ষা আসে, যাতনা বাড়িয়ে তোলে, জলীয় যাপন শুধু ভাবায়, কবে শেষ হবে এই যন্ত্রণাপর্ব! উত্তরপুরুষদের কোন কীর্তির ফলে এ তল্লাটের নামের সঙ্গে  এ বাড়ির একদা বাসিন্দাদের পদবী জুড়ে গেছে, সে ইতিহাস জানা নেই। ইতিহাস যেন আজ একটি আস্ত প্রহসন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তালপুকুরে ঘটিও ডোবে না। তবে সংস্কারহীন খালের নোংরা জলে ডুবে যায় গোটা তল্লাট। কালো দুর্গন্ধযুক্ত সেই জলে কয়েকদিন এ অঞ্চলের মানুষেরা রীতিমত নরকযন্ত্রণা ভোগ করে নির্বিকার। এড়িয়ে যেতে পারে না। নিজেদের মত করে কোনও বিকল্প ব্যবস্থা করে নেয়। যেমন নির্মীয়মাণ বাড়িটি থেকে তাজা কমলা রঙের ইটগুলো চারটে করে পেতে ডট ডট লাইন তৈরী হয়েছে। তার ওপর দিয়েই পারাপার চলেছে। ইটের মালিক স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে নালিশ করেছিল। তাকে বলা হল, “এইরকম পরিস্থিতিতে এটুকু অ্যাডজাস্ট করতে না পারলে এ পাড়ায় থাকবেন কীভাবে? এই লোকগুলোই তো রাতবিরেতে আপনার বিপদেআপদে পাশে এসে দাঁড়াবে!” 

কবে দাঁড়াবে, তারই আগাম প্রিমিয়াম দিতে থাকা মেডিক্লেম পলিসির মত! বোস বাড়ির নন্দনা বেশ সুন্দরী হয়ে উঠেছে, ওর মায়ের মতই। কলেজে যেতে শুরু করা থেকেই যেন আরও পল্লবিত হয়েছে। পরিবর্তনটা কারো নজর এড়ায় না। নটা সাতের ট্রেন ধরতে সেদিন রোজকার মতই ডটেড লাইন ধরে ছোট্ট ছোট্ট লাফে পেরিয়ে যাচ্ছিল এই পূতিগন্ধময় মহল্লা। হঠাৎ পা মচকে গিয়ে ব্যালেন্স রাখতে পারল না বলে সটান জলে পড়ল। হাল্কা গোলাপি ও উজ্জ্বল ধূসর রঙের মারকাটারি কম্বিনেশনের ডিজাইনার সালোয়ার কামিজ ময়লা হয়ে গেল। ফিরে আসতে হল বাড়িতে। বেরোতে গিয়ে বাধা পড়ে যাওয়ায় মা কোনভাবেই আর বেরোতে দিল না সেদিন। কীভাবে ও মাকে বোঝাবে, আজ শান্তনু রক্সিতে নুন শো-এর দুটো টিকিট কেটে অপেক্ষা করবে! কথা হয়ে আছে। মুভি তো যা দেখা হবে, সে জানাই আছে। মোদ্দা কথা একটা রঙিন বুদবুদ ঘনিয়ে উঠবে হলের অন্ধকারে। নন্দনা ভেবেই পাচ্ছে না, কীভাবে শান্তনুকে ফোনে জানাবে দুসংবাদটা! 

ইতিমধ্যে বিষাদের সব রঙটুকু মেখে বৃষ্টি নামল। বন্ধ জানলার কাচের ওপর দিয়ে আঁকাবাঁকা জলের রেখাগুলো যেন কান্নার মত গড়িয়ে পড়ছে। দূরে ঝাঁকড়া পেঁপে গাছের পাতায় ডালে ঘন ঝুপ্পুসে বসে আছে একটা চুপচুপে ভিজে যাওয়া পাখি। ও-ও কি কারো অপেক্ষায় আছে? অনেকক্ষণ পর নন্দনা করেই ফেলল ফোনটা। 

“স্যরি নন্দনা, শ্যামপুকুর আর রঘুনাথপুর হল্টের মাঝখানে ট্রেনটা থেমে গেল। থেমে আছে তো আছেই, আর চলল না। অনেকক্ষণ পর জানা গেল শিয়ালদা থেকে ইঞ্জিন ভ্যান এলে সারানো হবে।”

নন্দনা চুপ করে আছে। শান্তনু খেয়ালই করল না নন্দনা একটাও কথা বলেনি। ও বলেই চলেছে, “মাঝখানেই নেমে পড়লাম। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট হেঁটে গিয়ে হাইওয়ে পেলাম। একটা ট্রাককে কোনক্রমে ম্যানেজ করে বিদ্যাপুর মোড় এসে এখন হাঁটছি। এদিকে বৃষ্টি হয়েই চলেছে।” 

নন্দনা আর বলে উঠতে পারল না, ওর পা মচকে গিয়ে ব্যথা হচ্ছে। আর্নিকা টু হান্ড্রেড খেয়েছে যদিও। শান্তনুর কাছ থেকে উপশম পাওয়ার কথা মনেই এল না নন্দনার। শুধু মনে হচ্ছিল রঘুনাথপুর নামটা শুনে যতই অজগাঁ মনে হোক না কেন, ওখান থেকে কোলকাতা বাই রোড একঘন্টার মত। তবু শান্তনু এদিকে না এসে পেছনদিকে চলে গিয়েছিল কেন? কেন নন্দনা ফোন করার আগে ও একবার ফোন করে জানাতে পারল না! আজ যদি নন্দনার ঘটনাটা না ঘটত, ও তো হলের সামনে গিয়ে বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকত! এই না-বোঝা ছুঁয়ে বৃষ্টি হতে থাকে, হয়ে যেতেই থাকে। কখন যে এই ধারাপাত ছুঁয়ে ঘুমের পুরু আস্তরণ ছেয়ে আসে। মা কপালে হাতটা ছোঁওয়াতেই ঘুমটা ভেঙে যায় আচমকা। সন্ধের অন্ধকারে ও মাকে জোর করে আঁকড়ে ধরে আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে চায়। মা চুলে বিলি কেটে দিতে থাকে। শুধু এই ভালোলাগাটুকু চেটেপুটে নেওয়ার জন্য নন্দনা ঘুম থেকে অনেক দূরে চলে যেতে থাকে। কতদিন পর! ও বুঝতে পারে বৃষ্টি কিছুটা ধরে এসেছে।  

“মা, রাতে গরম গরম খিচুড়ি করবে?”

“তোর বাবার ফোন করে একবার বলা হয়ে গেছে। তোকে জিজ্ঞেস করতে বলেছে।”

নন্দনা ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বলল, “তাই?” ও বাবার নম্বরে ডায়াল করে বলল, “দ্যাখো না বাবা, ইলিশ পাওয়া যাবে কিনা।”

“যাঃ! বাড়িতে ঢুকে পড়লাম যে, আগে বলতে পারলি না?” নন্দনা বুঝতে পারল বাবা দুষ্টুমি করছে। ও হাসতে হাসতে নীচে নামতে থাকল।  মা সদ্য আনা ইলিশ মাছ ধুচ্ছে। ও চায়ের জল বসাল। বাবা হাসছে। নন্দনা হাসতে হাসতেই বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি একটুও সারপ্রাইজড হইনি।” বাবাও হাসতে হাসতে বলল, “বললেই হবে?” মা হাসতে হাসতেই বলল, “ওরে তোরা বাপ-মেয়েতে খুনসুটি পরে করবি। চায়ের জল যে শুকিয়ে এল।” তিনজনে মিলে চা খেতে খেতেই ঠিক হয়ে গেল খিচুড়ির সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজা আর বেগুনি হবে। স্পেশাল বেগুনি ভাজবে নন্দনা। নন্দনা বেগুন কেটে রেখে মাকে কিচেন ছেড়ে দিল। ওর হঠাৎ মনে হল, আজ মুভি দেখতে গেলেও কি এর চেয়ে বেশি মজা হত! ইতিমধ্যে শোনা গেল নন্দনার ফোনটায় একটা কল ঢুকছে। রিং টোন শুনে ও বুঝতে পারল কে কল করছে। ওর কেন যেন ধরতে ইচ্ছে করল না। এই অনিচ্ছে ছুঁয়ে আবার বৃষ্টি এল। আজ খিচুড়ি দারুণ জমবে। কতখানি জমবে এ তো সময় জানে। কিন্তু আমাদের আশা করে থাকার বাতিঘর থেকে যতদূর আলোর রেখা পৌঁছতে পারে, তারপর বিস্তৃত প্রান্তরের আলোআঁধারিকেও অস্তর্থক ধরে নিতে ইচ্ছে হয়। মুহূর্তের কাছে জিম্মা রাখা এ জীবনের অলঙ্কারগুলো শরীরে জড়িয়ে যত না আনন্দ, একান্তে কখনো কখনো নেড়েচেড়ে দেখে বোধহয় আনন্দ তার চেয়েও অনেক বেশি। 

বর্ষা নিয়ে, বৃষ্টি নিয়ে নতুন কীই বা বলার আছে। “যে রাধার কাছে তুমি বারবার ছুটে আসো আকুল কানাই / সেই টান আমাদের সমূহ দোহাই”…টানের রকমফের ঘটে যায় নিঃশব্দে। নিরাকারের প্রতি অব্যক্ত আর্তির মত সব নিবেদনের নৈবেদ্য সাজিয়েও তোমাকে আরাধনার উপচার জানা নেই বলে স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। এই বাঙ্ময় নৈঃশব্দ্যে নির্নিমেষ চেয়ে আছে তারার আকাশ। অন্তত ভোর হওয়া পর্যন্ত এই দৃষ্টিসুখ রয়ে যাক। নিরবচ্ছিন্ন বৃষ্টির কাছে উৎসর্গ রেখে যাওয়া আমাদের সব কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার আচ্ছন্নতা ঘিরে বেড়ে ওঠে আর্দ্র স্পন্দন। মিয়াঁমল্লারে লাগে সুর। ভাসতে থাকে আবহমণ্ডলে। সংক্রমণের আসক্তি ছুঁয়ে যে হাওয়ার ছাদে নেমে আসে বিরল মৌতাত, সে জানে বৃষ্টি তার শত্রুর মত। বহিরঙ্গে গলে যেতে থাকে এক নিবিড় প্রতিমা, এই শাশ্বতে কে যেন রেখেছে কয়েকটি ঝিনুক, সমুদ্র-সংক্রান্ত স্মৃতি ফিকে হতে হতে যতটুকু রয়ে গেছে, তার প্রযত্নে যে  নিরাসক্তি, তার কোনও নাম দেওয়া হয়ে ওঠেনি আজও….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *