মেসা ভারদে পার্ক – সবুজ টেবিলের দেশে

মেসা ভারদে পার্ক - সবুজ টেবিলের দেশে

উত্তর আমেরিকার দক্ষিণ পশ্চিমে ‘মেসা ভারদে’ পার্ক। এদেশের আদিম অধিবাসীর এক আশ্চর্য বসতি ছিল এই অঞ্চলে। আজ থেকে হাজার বছর আগে সাত শো বছর ধরে এখানে বসবাস ছিল প্রাচীন নেটিভ আমেরিকান দের যারা পাহাড়ের গায়ে, খাদের খাঁজ কুঁদে বানিয়ে ছিল ঘর বাড়ি। সে অবাক সৃষ্টির কিছু মহাকালের হাতে ধ্বংস হলেও অনেকটাই সংরক্ষিত। আর তাই দেখতেই এখানে আসা।
চার কোনের (Four Corners) এই প্রাচীন সংস্কৃতি আজকের ম্যাপে ইউটা, অ্যারিজোনা, নিউমেক্সিকো আর কলোরাডোর বিশেষ অংশ জুড়ে। কলোরাডোতে অবস্থিত মেসা ভারদে পার্ক তার একটি ভাগ।

 

ইউটা স্টেট এ আর্চ মনুমেন্ট দেখে পুব মুখো গেলে প্রায় দেড়শো মাইল পরে দেখা যাবে দূরে পাহাড়ের রূপ পরিবর্তন। আর একশৃঙ্গ বিশিষ্ট পর্বত নয়, সমান মাথা পাহাড়ের সারি। যেন মাদুরাইয়ের মন্দির গাত্র। গৈরিক পাহাড়ের গায়ে পরতে পরতে এক একটি যুগের ইতিহাস যেন এক একটা রঙের লিপি সাক্ষর। হলুদ, লাল, খয়ের রঙের খেলা। কোথাও সদ্যজাত তৃণের সবুজ শ্যামল সূক্ষ্ম আলিম্পন।
মেসা ভারদে পার্ক আমেরিকার তথা সারা পৃথিবীর এক বিশেষ সম্পদ – ১৯৭৮ সালে ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সম্মানে ভূষিত।
নামটি দেওয়া স্প্যানিশ নবাগত উপনিবেশিকদের। যার আক্ষরিক অর্থ ‘সবুজ টেবিল’। এমন নামকরণের কারণ দূরের পাহাড়গুলি বোধহয় সমতল টেবিলের মত লেগেছিল তাদের চোখে। যদিও আমার চোখে শুধু একটি মাত্র সবুজ রঙ কেন, কত রঙের যে খেলা!
ভূতত্ত্ববিদরা বলেন টেবিলের মত মোটেই সমান একতল বিশেষ নয় এ অঞ্চল। আসলে এর জমিতে আছে সামান্য সাত ডিগ্রির ঢাল আর তা দক্ষিণ দিক ঘেঁষ। তাতেই এনেছে সেই বিশেষত্বটি – এর রূপের জাদুকাঠি। এই একটু ঢালের জন্য বৃষ্টি আর বরফ গলা জলের কিছু নেমেছে ঝর্ণা হয়ে, কিছু হ্রদের পূর্ণ জলাশয়ে। এই জলের ধারাই ছিল এ সভ্যতার মূল জীবন স্রোত। আর আছে এর পাহাড়ের বিশেষ রূপ গুণ, পাললিক শিলা কোথাও জলের ধারা শুষে রেখেছে কোথাও রূপান্তরিত শিলা ধরে রেখেছে তাকে নিজের কোলে।
US 160 E রাস্তা বরাবর পুব মুখো যেতে যেতে চোখে পড়বে পার্কের প্রবেশ দ্বারের নির্দেশ। নাম ‘মেসা ক্লিফ প্যালেস’। ব্যাপারটা হল পাহাড়ের গায়ে কুঁদে তৈরি বসত বাটি। যেন এক রাজ প্রাসাদ। একটি পরিবারের বিশেষ একটি বাড়ি নয়, গোটা একটি ভিলেজ।
আজ পর্যন্ত মেসা ভারদে পার্কে প্রায় ৫০০০টি সাইট পাওয়া গেছে। এদের বসতি ছয় শত cliff dwelling পাহাড়ের খাঁজের মধ্যে। বার শো বছর আগে (500 AD – 1300 AD) এখানকার আদিম অধিবাসীরা সাতশ বছর ধরে বানিয়েছিল এই বাসভূমি। তার প্রথম দিকের গুলি সমতল মাটিতে হলেও পরের যুগে তা কখনো পাহাড়ের খাঁজে কখনো গভীর খাদের গা কুঁদে বানান হয়।
পাহাড়ের সর্পিল পথ দিয়ে এঁকে বেঁকে যেতে চোখে পড়বে সাইন বোর্ড — Cliff Palace, Cliff Balcony ইত্যাদি। Cliff Palace নামটা শুনেই মনে পড়ল Ansel Adams এর বিখ্যাত সাদা কালোর স্থিরচিত্রটি। — একটু পরেই আশা করি তা দেখতে পাব – ক্যামেরার লেন্সের ভিতর দিয়ে দেখে যা তিনি তুলে ধরেছেন, অমর করে রেখেছেন আমার মত অনেকের মনে। অধীর আগ্রহে চোখ কান খুলে অপেক্ষা করি।

Cliff Palace এর রাজবাড়ি ঢোকার আগে পড়বে ভিজিটর সেন্টার। সে পথে যেতে যেতে মন খারাপ হয়ে গেল। দিগন্ত বিস্তৃত বনভূমিতে পোড়া গাছের মৃতদেহ। হাজার হাজার পোড়া কাঠ খাড়া দাঁড়িয়ে। গত কয়েক বছর ধরে এখানে বনে আগুন লাগে বার বার, সে করুণ অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী ঐ দগ্ধ গাছ গুলি। সে সব পেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম ভিজিটার সেন্টারের চত্বরে।

 

ঢোকার মুখে একটা ধাতব ভাস্কর্য। এক আদিম মানুষ বহু কষ্টে পাহাড় চড়ে উঠছে যেন, পিঠে তার জ্বালানি কাঠের বান্ডিল। গিরি লঙ্ঘনের ক্লেশ ফুটে উঠেছে তার হাত পায়ে- এমনকি পায়ের বুড়ো আঙুলেও! শিল্পটির নাম- The Ancient Ones . শিল্পী – Edward J. Fraughton

চুপ করে দাঁড়াই কয়েক মুহূর্ত। দিগন্ত বিস্তৃত নীরবতার এক নিজস্ব রূপ আছে। নিজেকে সমর্পণ করলে তা সম্মোহিত করে। তখন প্রকৃতি যেন কথা কয়। বনস্পতির কান্না সুদূর শূন্যে শনশন শব্দে ঘুরে বেড়ায় আবার ফিরে আসে ক্ষণিক পরে পাতার ঝিরঝিরানি সুরে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় নব কিশলয়ের লুকোচুরি খেলা রোদের টাকরা টাকরা আলোর সাথে। ঠিক ঐ পোড়া কাঠ গাছটির পায়ের তলায়। শিশু তৃণার আকুল প্রশ্ন যেন প্রপিতামহীর কাছে। নটরাজের ডমরু ধ্বনিতে বাজে তার উত্তর – শব্দহীন শ্যামলিমায়।

হঠাৎ এ চুপ অবসর ভেঙে যায়। একদল দর্শক ঝমঝম করে এসে উপস্থিত হয়। গোটা চারেক ছেলে মেয়ে আর তাদের তাদের বাপ মা। ছেলে দুটিতে দারুণ ঝগড়া লেগেছে। “আই হেট ইযু।” বড়টি মুখ ঝটকায় ছোট ভাইটিকে, “আইল কিল ইয়ু!” আঙুল তুলে বন্দুক দেখায়, “আই টেল ইয়ু- আয়ল কিল ইয়ু ওয়ান ডে।” ছোট ভাই টি মুখ ভ্যাঙচায়। মা সেটাই দেখতে পান। তার শাসন চলে।

সরে আসি। আমার স্বামীকে বলি, “হিংস্রতা ব্যাপারটা বোধহয় বেড়ে গেছে আজকাল। আমাদের সময়ে কি,,,” তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেন — “ও কিছু না। ছোট ছেলেরা ও রকম মারপিট চিরকালই করে। আমরাও করেছি। হনুমান আর রাম-রাবণ যুদ্ধ। এরাও করেছে। আগে ছিল ইন্ডিয়ান আর পিলগ্রিম এখন নিনজা টারটেল বা স্পাইডার ম্যান।”

কথা বলতে বলতে আমরা কাঁচের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলাম।

আজ থেকে হাজার বছর আগে এখানে বাস করত যে উপজাতি তার নাম আনাসাজি। নামটির আক্ষরিক অর্থ ancient enemy – পুরনো শত্রু। শোনা যায় আনাসাজি উপজাতি সাত শো বছর বসবাস করার পর ১২০০ খৃস্টাব্দের শেষে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যায়। ১৩০০ শতকের পর তারা যে কোথায় গেল এ নিয়ে নানা মতভেদ আছে। কেউ বলে অসহ গরম ও খরা এর কারণ, কেউবা বলে অন্য শত্রুদের আক্রমণ বা অন্য কিছু। এক কথায় অমন রাজবাড়ি, অমন একটা গোটা সভ্যতা নির্মূল হয়ে যায়। কেন? এই সব প্রশ্নের উত্তর কেমন ভাবে উন্মোচিত হল আমার কাছে তাই লিখতেই চেষ্টা করব আজ।
কেউ বলেন এক সময়ে আনাসাজিরা ক্রমশ অধুনা নিউ মেক্সিকোর দিকে চলে যায়। বৈবাহিক সূত্রে তাদের রক্তের মিশ্রণ হয় অন্যজাতের সঙ্গে। বর্ণ-সংকর ধীরে ধীরে মিলে মিশে এদেরকে পালটে দেয়। এমন করেই ওরা ফুরিয়ে যায়।

ভাবতে গেলে আজকের যুগেও ঠিক তা ই হচ্ছে না কি? প্রাণের দায়ে, রুজির খোঁজে আমরা ঘর ছেড়ে চলে যাই দূরে, তারপর অবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পালটে যাই। পালটে যায় আমাদের মুখের ভাষা, আমাদের জীবন যাত্রা আমাদের রক্তের ধারা আরেক প্রজন্মের পর।

পরের যুগের আনাসাজি (নাম তাদের যাই হোক না আজ) কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা যাদের ধমনিতে বইছে সে ধারা।এই ডিরোগেটরি, অপমানকর নামকরণ – “পুরাতন শত্রু” তারা মেনে নেবে কেন? তুমি বলবে, এই না বললে তারা ইতিহাস থেকে মুছে গেছে, হারিয়ে গেছে তাদের শিকড়?

ঐতিহাসিক লিন্ডা করডেল বলেন দেখতে হবে কারা ঐ নাম দিয়েছিল ‘পুরনো শত্রু’— Narrator’s point of view বা কথকের দৃষ্টিকোণ অনুধাবন যোগ্য।। নামটি নজরে আসে এবং প্রথম ব্যবহৃত হয় সাহেব রিচার্ড ওয়েদারিলের মুখে – (Richard Wetherill)।

সেই সময়ে সাহেবরা এখানের খনিতে রতনের খোঁজ পায়। মাইনিং আর ট্রেড পোস্টিং এর কাজ চলে। মাইনার রিচার্ড ওয়েদারিল (১৮৮৮ নাগাদ) সাহেবের সাথে নাভাহোদের ভালই আঁতাত জমে। সাহেব যদিও ঐ কথাটির মানে বুঝতেন ভালই নিজেদের সুবিধার্থে আর ও নিয়ে মাথা ঘামান নি। ব্যাপারটা অনেকটা আমাদের বাঙাল-ঘটির মত সেনসিটিভ হলেও।

পরের যুগের আনাসাজি অধিবাসীরা এ অপমান সূচক নামটির পরিবর্তন দাবি করেন তাই এখন ওদের বলা হয় Ancient Puebloan.

পুরানো শত্রু বলত কারা? নাম দিয়েছিল নাভাহো প্রজাতির মানুষরা যারা ওদের সাথে বহু বছর ধরে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। তাই ইতিহাস কার মুখ থেকে শোনা তা বোঝা এত জরুরি – মনে করিয়ে দেন লিন্ডা করডেল।
“আমরা সশরীরে আর হয়ত এখানে থাকি না, কিন্তু আমাদের পূর্বসূরিদের আত্মা এখানে। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে শোন, কানে আসবে শিশুর হাসির রোল।মেয়েদের কথার আওয়াজ।হয়ত শুনবে কুকুরের ডাক কিংবা মুরগীর। দূরে ঢাকের বোল, গানের সুর। রান্নার গন্ধ। তাদের উপস্থিতি,উষ্ণতা তোমায় স্পর্শ করবে।”

(Even though we physically moved away, the spirits of my ancestors are still here. If you stop for a minute and listen, you can hear the children laughing and the women talking. You can hear the dogs barking and the turkeys gobbling. You can hear and feel the beat of the drums and the singing. You can smell the cooking fires. You can feel their presence, their warmth, their sense of community” – TJ Atsye, Laguna Pueblo)

এখন পর্যন্ত ক্লিফ প্যালেসে পাওয়া যায় ১৫০ টি ঘর আর ২৩টি কিভা (গোলাকৃতি, নিচুতল ঘর বিশেষ )যা নাকি বিশিষ্ট ছিল ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের জন্য । প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করেন এ রাজবাড়ি সামাজিক অনুষ্ঠান ও শাসন পরিচালনার জন্যই বিশেষ ভাবে ব্যবহৃত হত। এমনকি এখানে একের বেশি দলীয় গোষ্ঠী (Clan) একত্রে থাকার সম্ভাবনাও ছিল। এই থেকে সে যুগের মানিয়ে নেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাও আমরা পাই।

 

মাঝে একটি বড় টাওয়ার দেখা যায় আজ যা অনেকটাই ধ্বংস প্রাপ্ত। দরজাগুলি খাটো, তাই থেকে বলা হয় উচ্চতায় সে যুগের মানুষ ৫ফুট ৬” মাপের বেশি ছিলনা। এইখানে ১৯৪১ এ Ansel Adams এর আলোকচিত্রটি উল্লেখযোগ্য।

বাড়িগুলি মূলত বেলে পাথর (sandstone), চুন বালির মিশ্রণ ও কাঠ দিয়ে বানান হত। গাছের গুঁড়ির বলয় গুনে হিসেবে পাওয়া গেছে এ বিশেষ ক্লিফ প্যালেস তৈরি ও পরিচর্যার আনুমানিক সময় সীমা ১১৯০ থেকে ১২৬০। কাজ চলে ক্রমাগত যদিও, সবটা শেষ হতে য়ারও বছর কুড়ি বছর সময় নিয়েছিল,  ১২৬০ থেকে ১২৮০!

 

কেবলমাত্র গুহাগাত্রে বসতি স্থাপনে নয়, সে সময়ের প্রাচীন পুব্লোইনরা জমি ও জল সংরক্ষণ সম্বন্ধে যে গভীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার নিদর্শন রেখে গেছে তা আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারদের বিস্ময় উদ্রেক করে। জল সংরক্ষণ করার জন্য ওরা বানিয়েছিল চারটি জলাশয় ও বাঁধ। এই চারটি প্রাগৈতিহাসিক জলাশয় (Morefield Reservoir, Mummy Lake, Sagebrush and Box Elder ) Historic Civil Engineering Landmark (2004) হিসাবে (American Society of Civil Engineers র কাছ থেকে) স্বীকৃতি পায়।

 

ইঞ্জিনিয়র Kenneth Wright (মনে করেন এই জলাশয়ের চর্চা ও গবেষণা আমাদের অনেক কিছু শেখায়। সে যুগের মানুষের কাছে বনের আগুন যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, আগুনের দূর পাল্লার প্রভাব সময়ের ব্যবধানেও যে কী পরিমাণ ক্ষতি করতে পারে তা আজকের দিনে আমাদের শিখে নেবার সময় এসেছে। প্রাচীন পুব্লোইন মানুষ তার মোকাবিলা করেছে। জল যে জীবন এ তাদের ধর্ম, কর্ম ও শিল্পে প্রতিফলিত।

এমন মানুষ গুলো কোথায় গেল, এমন ঘর বাড়ি ছেড়ে? উত্তর মেলেনা, সহজ উত্তর।

মাটি খুঁড়ে কিছু পাবেনা হে, মৃদু হেসে হয়ত জানাবেন কোন বৃদ্ধ পুব্লোইন প্রপিতামহ। যা যাবার তাকে যেতে দিতে হয়। ধরে রাখতে নেই। এ কথা তাঁরা বিশ্বাস করতেন। ডুগডুগিতে হয়ত গেয়ে উঠবেনঃ

‘বহুদিন আগে হুই উত্তরে ছিল মোদের ঘর
বাপ ঠাকুরদার ভিটে, আমাদের বাসা।
আজ দখিনে এসে পড়েছি গো
মেঘফুলের আশায়
হেথায় বিদ্যুৎ চমকায় যে আকাশে
আর আঃ বৃষ্টির ফোঁটা….’

(একটি তেওয়া Tewa ভাষায় গানের বাংলা অনুবাদের চেষ্টা)

ঐ ঢাকের আওয়াজ এড়ানো যায়না। বুকের ভেতর থেকে বাজে যে। কাল বৈশাখী মেঘের ডাকের মত।সে ধ্বনি ঘরের দেওয়ালে, দরজায় ধাক্কা মারে।ঝলমল করে ওঠে সাদা-আগুন সূর্য। ডাক দেয় নাচের উঠোনে। দূরে মেঘেরা ছুটে আসে পাহাড়ের কোল ঘিরে। ওরা আকুল ডাকে সাড়া দেয়– মেঘ দে, পানি দে।
গুরু গুরু বোল ওঠে ঢাকে — তাম্বা ফে ! তাম্বা ফে !

আর যদি প্রশ্ন আসে — কোথা থেকে এল এরা?

উত্তর নির্ভর করবে কাকে জিগ্যেস করছ। প্রাচীন পুব্লোইন প্রপিতামহ বলবেন,

“ঐ যে দেখছ কিভার গহন গহ্বরে গর্তটি- (সিপাপু তার নাম) ঐ গর্ভ দ্বার দিয়ে এসেছিলাম আমরা। মাটি মার গর্ভে জন্ম আমার, আমাদের উৎস। তারপর হাঁটি হাঁটি পা পা করে কত পথ হাঁটা। কত ক্ষত বিক্ষত হয়েছি । চালিয়ে নিয়েছি। এক সময়ে পা হড়কে গেছে। ভুল করেছি। অন্ধ অহংকারে মাটি মায়ের বুকে লাথি মেরেছি, জ্বালিয়ে দিয়েছি কিভার মন্দির। অভিমানে,আস্ফালন করেছি, হত্যা করেছি নিজের ভাইকে খিদের জ্বালায়। হারিয়ে গেছি, পালিয়ে গেছি ঘর ছেড়ে। চরৈবেতির মন্ত্র শিখেছি। চলেছি, চলেছি, চলেছি। থামিনি। এখনও চলছি।”

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ফুটে উঠে ডিজিটাল মনিটরে – মেসা আদিবাসীদের টাইম লাইন।

তাতে দেখি খৃস্টপূর্ব ২৫০০ অর্থাৎ আজ থেকে ৫০০০ বছর আগের ছবি। যে প্রস্তর চিত্র (Archaic Pictograph) দেখি এ অঞ্চলের তাতে মনে হয় পাথরের অস্ত্র বানানর কারিগরিতে তারা বেশ রপ্ত ছিল। কিন্তু তখনো আদিম বর্শা দিয়ে তারা পশু শিকার করে খেত। এর পরেকার পরিবর্তন তীর-ধনুকের ব্যবহার।

আরও পরে আসে অবসিডিয়ান আর ফিরোজা পাথরের (turquoise) কাজ তাদের গয়নায় যার উৎস ছিল এখানেই, আবার সে সঙ্গে দেখা যায় ঝিনুক আর আবালন শেলের ব্যবহার যা নিঃসন্দেহে এসেছিল প্রশান্ত মহাসাগরের কূল থেকে। এ থেকে বোঝা যায় ব্যবসা বাণিজ্য তখন চলছিল ভালই।কিন্তু এসব অনেক পরের কথা।

এরও আগে ১০০০ খৃস্টাব্দে এ সভ্যতার সবচেয়ে বড় খবর – ভুট্টার আগমন। পুব্লোইন মানুষ বুঝল কেবল পশু শিকার না করেও ক্ষুন্নিবৃত্তি করা যায়। যাযাবর বৃত্তি ছেড়ে তারা ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে। বাড়ির উঠোনে সবজি আর মুরগি টার্কির চাষ শুরু হয়।। তিন ভগিনী বীজের (Three Sisters – corn, bean and squash) চারা বেয়ে ওঠে ঘরের চালে। বড় পশুর বদলে মুরগি আর টার্কির চল শুরু হয়।এগুলি রান্নার জন্য দরকার হয় বাসনের। মালসা ও নানান পাত্র।

মৃৎশিল্পের হাতে খড়ি থেকে দ্রুত ক্রম বিবর্তন আমাদের তাক লাগিয়ে দেয়। প্রথমে সাদা কালোর কাজ পরে লাল কালো এক এক যুগের এক এক শৈলীর জন্য বিশিষ্টতা দাবী করে। এই সময়ে পুব্লইন সভ্যতা তার শিখর চুড়ায়। পাহাড়ের খাঁজে বাড়ির স্থপতি, জলের ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে চলে প্রস্তর গাত্রে তাদের দৈনিক জীবনের ছবি আঁকা।.এমন কি ঐতিহাসিক যুদ্ধের ছবিও।

 

মেসা ভারদের Pictographic Point Trail এ দেখা যায় এমন একটি উদাহরণ- দুই দলের ভাগ ও তাদের নিজ নিজ স্থানে প্রত্যাবর্তন (The Mountain Sheep Clan and the Eagle Clan separating from other people and returning to their place of origin )
এই সময়ের প্রস্তর গাত্রে একটি বিশেষ ছবি উল্লেখযোগ্য – কোকোপেল্লি। এর সঙ্গে আবার একটা পোকারও তুলনা আছে, তার ছবিও দেখলাম।

 

কিন্তু কোকোপেল্লি একজন উপদেবতা গোছের মনে হল। তিনি যেন আমাদের ষষ্ঠী ঠাকরুন। উর্বরতার দেব (Fertility deity)। পিঠে তাঁর বোঁচকা বাঁধা, হাতে বাঁশি। ব্যাগ ভরা তাঁর শিশু, তাই সমত্ত মেয়ে দেখলেই তিনি তাঁর ঝুলি খুলে দেন। তিনি বাঁশির সুরে মেঘ কুমারীর মন জয় করে বৃষ্টি নামাতে পারেন, পারেন জমিতে ফসল ফলাতে। তিনি ভারি রসিক, চালাকিও জানেন অনেক। কোকোপেল্লি ওদের বড় আদরের।

এ সোনার যুগের শেষ ১১৩০ এর সমসময়ে। প্রচণ্ড খরা ও শুষ্ক আবহাওয়া একটি সভ্যতাকে যে শুকিয়ে হত্যা করতে পারে তার ঐতিহাসিক উদাহরণ এই Great Drought। এর প্রভাব পড়ে সমাজ ও মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কে। পুব্ল মৌখিক ইতিহাস বলে এ সময়ে এদের জাতীয় আত্মিক অবনতি এক চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছায়। মানুষ প্রকৃতির ওপর, বিধাতার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। কিভার মন্দির গাত্রে আগুনের হলকা মানুষের হাতে তার ধ্বংসের প্রমাণ দেখায়। তাদের অসহায় নৈতিক অবক্ষয়ের নিদর্শন। হিংসায় উন্মত্ত মানুষ শুধু শত্রুদমন নয় নরমাংস-ভোজী রাক্ষসে পরিণত হয়।

অনেকে পালিয়ে যায়।

 বহু বছর কেউ আর খোঁজ করেনি। ১৮৮৮ সালে রিচার্ড ওয়েদারিল সাহেব টের পান এর খবর নাভাহোদের সাহায্যে। মাইনিং এর কাজে তিনি তাদের জন মজুর খাটিয়েছিলেন।

ওয়েদারিল তা গভর্নমেন্টের কানেও তুললেন।এ আমাদের জাতীয় সম্পদ এমন ধারণার সূচনা — কিন্তু বিল পাস হয়না।

এমন সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এক নরওয়েজিয়ান সাহেব গুস্তাফ নরডেনসকিয়লড Gustaf Nordenskiöld এসে বিস্মিত হয়ে যান তখনো যা ছিল তা দেখে। তিনি এর ঐতিহাসিক মূল্য যাচাই করে বেশ কিছু জিনিস তাঁর দেশে নিয়ে যান যা ফিনল্যান্ডের মিউজিয়ামে সংরক্ষিত। এই ঘটনায় আমেরিকার টনক নড়ে । ১৯০৬ সালে থিওডর রুসভেলট বিল সই করেন এবং মেসা ভারদে পার্ক জাতীয় সম্পদ বলে স্বীকৃতি পায়। নিয়ম জারি হয় এখান থেকে কিছু নিতেও পারবে না, কিছু দিতেও পারবেনা যা এর ক্ষতি করে।

***
কানে আসে – “আমার নাম ম্যাদেলাইন নারানহো। আমি একজন ডোসেন্ট, টুর গাইড। আজ আমি তোমাদের ক্লিফ প্যালেসে নিয়ে যাব.”

সঙ্গে এক দংগল ইস্কুলের ছেলেমেয়ে আর তাদের অভিভাবক।

“ঐ বাড়ি আমার পূর্ব পুরুষের ভিটে। আমি থাকি এখন নিউ মেক্সিকোতে । আমি একজন মডার্ন পুব্লইন। আমাদের বংশ আর রক্তের পুব্লইন অস্তিত্ব স্বীকৃত।ফেডারেলি।প্রতি সামারে আমি আসি এখানে।। এ ভিটে পরিত্যক্ত নয়। আমার পৈত্রিক বাড়িতে তোমাদের নিয়ে যাব। কেবল আমার অনুরোধ তোমরা একে সম্মান দিও। কারো বাড়িতে ঢোকার আগে আমরা যেমন দিই। জিগ্যেস কর মনেমনে আমি কি আসতে পারি? ঘরে ঘরে গিয়ে শুনো শূন্য বাসার ভাষা। সে ভাষায় ভালবাসার সুর, মায়াজালে জড়ানো তার দেওয়াল। বাসার ও প্রাণ থাকে। কান পাতলে তা শুনতে পাওয়া যায়। এই ভালবাসা, আর হৃদ্যতার গান নিয়ে যেও তোমাদের নিজেদের ঘরে।”

ছেলেমেয়ের দলকে পাইড পাইপারের মত নিয়ে চলে গেল সেই মডার্ন পুব্লইন মেয়েটি।

হঠাৎ দেখি একটি ছোট ছেলে উবু হয়ে বসে কি যেন করছে। ঠিক এইখানে দেখেছিলাম দু ভাইয়ের ঝগড়া, ঢোকার মুখে।

এতক্ষণে তার মা ও এসে পড়েছেন। ছেলেটি করুণ মুখ তুলে দেখাল একটা পোকা উল্টে পড়েছে। পোকাটি অসহায় ভাবে হাতপা ছুঁড়ছে। ছেলেটি অনেক চেষ্টা করল ওকে সোজা করতে। তারপর অসহায় মুখ তুলে বলল, ‘হিইস স্টাক।’

আমরা সবাই মিলে নানান চেষ্টায় শেষমেশ দুটো কাঠি দিয়ে তাকে সোজা করে দেওয়া গেল। পোকাটা গুড়গুড়িয়ে পালিয়ে গেল। ছোট ছেলেটার এক মুখ হাসি।

কোকোপেল্লি।

জন্ম ও বড় হওয়া কলকাতায়। এখন ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা। বাঙলা ও ইংরিজি দুই ভাষাতেই লেখার চেষ্টা। বাঙলা ছোট গল্প ও উপন্যাসিকা ‘নবকল্লোল', 'শুকতারা', 'উৎসব', 'শঙ্খ'ও আরও নানা পত্রিকায় প্রকাশিত। বাঙলা বই — ‘আমার বাস কোথা যে’ (২০০৩-দেব সাহিত্য কুটির) ইংরাজী লেখা —Shadow Birds—Story of a Young Girl During the Partition of India (Published 2019 available in Amazon) Glass Bangles — awarded --Katha contest 2003, published in India Currents Magazine শখ — দেশ ভ্রমন, বাগান, শিশু-সঙ্গ, আরো অনেক কিছু। সবচেয়ে আনন্দ —আপন মনে লিখতে। লেখক জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ —পিতৃদেব শ্রী নারায়ণ সান্যালের শেষ বই রূপমঞ্জরীর শেষ অধ্যায় সম্পূর্ণ করা।

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Sakti Das , July 13, 2024 @ 6:17 pm

    চমৎকার ইতিহাস আর বর্ণনা। এই এলাকা ছুঁয়ে এসেছিলাম ৪৫ বছর আগে তাই কিছুই মনে নেই। তোমার সুন্দর লেখা সেই স্মৃতিতে জলসিঞ্চন করলো। শেষ লাইনটা খুব সুন্দর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *