ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের পল্লী ভ্রমণ – প্রথম পর্ব

ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের পল্লী ভ্রমণ – প্রথম পর্ব

মুখবন্ধ

২০০৬ বা ২০০৭-এ কর্মসূত্রে আমাকে একবার স্কটল্যান্ডের একটি ছোট্ট শহর মন্ট্রোজ-এ যেতে হয়েছিল। লন্ডনের প্যাডিংটন স্টেশন থেকে ট্রেন ধরেছিলাম। ইংল্যান্ডের পূর্ব উপকূল ধরে সাত ঘন্টার সফর। সেই প্রথম দেখেছিলাম ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের গ্রামাঞ্চলের সৌন্দর্য। বিস্তীর্ণ সবুজের সমারোহ। বেড়া ঘেরা মাঠে সাদা-কালো ডটের মতো ঘাস খাচ্ছে ভেড়ার দল। কখনো কখনো ট্রেনটা পূর্ব উপকূলে নর্থ-সি এর পাশ ঘেঁষে দৌড়চ্ছিল। সেখানে আবার সব ঘন নীল। দিগন্তে সমুদ্র আকাশের তফাৎ বোঝা দুষ্কর। ছোট ছোট শহর, স্টেশন, ছবির মত কটেজ, গির্জা, দু-দশজন লোকের ওঠানামা, স্নিগ্ধ শান্ত পরিবেশ। কিন্তু যাক সে কথা, সেই রেল সফরে আমি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে তখনই মনে মনে স্থির করেছিলাম যে ভবিষ্যতে কখনো ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের পল্লী অঞ্চল (কান্ট্রি-সাইডের বাংলা পল্লী-অঞ্চল হয় কি? অনেক ভেবেও সঠিক বাংলাটা মাথায় এলো না) দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ঘুরে বেড়াবো। এবং তখন ঘুরবো স্রেফ বেড়ানোর জন্য, কাজের জন্য নয়…
আমার সেই স্বপ্ন পূরণ করার সুযোগ এল দুহাজার চব্বিশের এপ্রিলে। এপ্রিলে ইয়োরোপে বসন্ত আসে, যদিও বাতাসে তখনো শীতের কামড় – যেটা আমরা, এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মানুষ খুব উপভোগ করি। ওদিকে দিনের দৈর্ঘ্যও বাড়তে থাকে। ছিঁচকাঁদুনে বৃষ্টির প্রকোপও কম। মে মাসে ছুটি পড়ে যায়, তাই ইয়োরোপে গাদাগাদি ভিড় হয়। আর জুন-জুলাইয়ে রীতিমত গরম পড়ে যায়। ঐ সময় ইয়োরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ওখানে গরম মোটেই সুখপ্রদ নয়। কারণ বেশিরভাগ জায়গাতেই এ.সি তো দূর অস্ত, সামান্য সিলিং ফ্যানও থাকে না। গরমে ঘুমানো বেশ কষ্টের। তাই এপ্রিল ‘বেস্টেস্ট’।

প্রথম দিন (ইংল্যান্ড)

মুম্বই থেকে ইন্ডিগোর উড়ানে ইস্তানবুল, সেখান থেকে দেড় ঘন্টা পর টার্কিশ এয়ারলাইনের উড়ানে সোজা লন্ডনের হিথ্‌রো টারমিনাল দুই।

আমার এই ভ্রমণ বৃত্তান্তে আমি সুপরিচিত স্মৃতিসৌধ বা স্থাপত্য, গির্জা, রাজপ্রাসাদের কথা বেশি লিখবো না। ওসব আজকাল গুগল করলেই পাওয়া যায়। আমি লিখবো আমার অভিজ্ঞতার কথা যা একান্তই এক্সক্লুসিভ – স্বতন্ত্র।

তাই ইন্ডিগোর উড়ানে আন্তর্জাতিক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা জানাতেই হবে। আন্তর্জাতিক বিমান সফরের বহু অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমি কখনো এত বাজে পরিষেবার উড়ানে সফর করিনি। ইস্তানবুল অবধি সাড়ে ছ ঘন্টার উড়ান, কিন্তু খাবার দিল পরোটা আর আলুর তরকারি। আর কোনো বিকল্প নেই। নেই কোনো ইনফ্লাইট বিনোদনের ব্যবস্থা। বাড়তি সিটের সারি ঢোকানোর জন্য সামনে লেগরুমের সঙ্কীর্ণ পরিসর। নিজেদের মনে হচ্ছিল আফ্রিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চল থেকে ত্রাণপ্রাপ্ত শরণার্থী। অনেক বিদেশিও ছিলেন। এরকম নিম্নমানের বিমান পরিষেবা দেখে ভারত সম্পর্কে কী ধারণা নিয়ে যাবেন তাঁরা? আজ যদি ভারত সরকার ইন্ডিগোর আন্তর্জাতিক লাইসেন্স বাতিল করে আমি খুশি হবো। টিকিট খুব শস্তা এমন কিন্তু নয়। আমরা এই রুট বেছেছিলাম যাতে লন্ডনে দুপুরবেলায় পৌঁছতে পারি, কারণ হিথ্‌রো থেকে গাড়ি নিতে হবে।

আমার দ্বিতীয় তিক্ত অভিজ্ঞতা ইস্তানবুল বিমানবন্দরে। হ্যান্ডব্যাগেজের সিকিউরিটি হবার পরেও বিমানে চড়ার আগে আর এক খেপ বিস্তারিত সার্চ। হ্যান্ডব্যাগেজ খুলে লণ্ডভণ্ড করে। সাথে আমি কেন লন্ডন যাচ্ছি তা নিয়ে রাজ্যের সব প্রশ্ন। ফেরার টিকিট খতিয়ে দেখা। এসব কাণ্ড লন্ডন ইমিগ্রেশনে হলে কথা ছিল, তা বলে ইস্তানবুলে? ইউ.কে-র ইমিগ্রেশন কি ইউ.কে-তে ঢোকার জন্য তুর্কীস্থানকে ওদের পাহারাদার বানিয়েছে? নাকি আমি ভারতীয় পাসপোর্ট ধারণ করি বলেই এই নিগ্রহ? তুর্কীর সাথে ভারতের বৈরিতা এবং পাকিস্তানি সখ্যতার কথা কে না জানে?

আমার তৃতীয় অভিজ্ঞতা গাড়ি ভাড়া নেবার সময়। ‘কার-জেট’ বলে একটা মোটরগাড়ি ভাড়ার কোম্পানির থেকে কিছু পাউন্ড অগ্রিম দিয়ে একটা ছোট ম্যানুয়াল টয়োটা ইয়ারিস বুক করেছিলাম। গিয়ে দেখলাম লন্ডনে ‘কার-জেট’ এর অস্তিত্ব নেই। ওখানে ‘গ্রিন-মোশন’ নামে একটা কোম্পানি এটা চালায়। বিদেশে গাড়ি ভাড়া নেবার অভিজ্ঞতা আমার আগেও আছে, তাই জানি ইন্সিওরেন্স সহ ভাড়া নিলেও বেশ কিছু পাউন্ড জমা রাখতে হয়। আমার ক্রেডিট কার্ড নেই, যা আছে সব ডেবিট কার্ড আর একটা আন্তর্জাতিক ফোরেক্স কার্ড যাতে আমি পাউন্ড লোড করে নিয়ে গেছিলাম। ‘গ্রিন মোশন’ জমার অঙ্ক ডেবিট বা ফোরেক্স কার্ডে নিতে অস্বীকার করলো। আর কী সব হিসেব-টিসেব করে বলল যে ডেবিট কার্ড ব্যবহার করলে আমার আরো সাড়ে তিনশো পাউন্ড অতিরিক্ত দিতে হবে। তবে তাতে আমার মাইলেজ হয়ে যাবে অবাধ। মন খচখচ করছিল, কিন্তু উপায় নেই, নিতেই হলো। পরে দেখলাম ঠিকই হয়েছে। আমার বুকিং ছিল একহাজার মাইলের (ব্রিটেনে, আমেরিকার মতো, দূরত্বের হিসেব মাইলে হয়, কিলোমিটারে নয়)। পরে দেখেছিলাম আমরা তিনহাজার মাইলের অতিরিক্ত গাড়িতে ঘুরেছি। আমার আগের কন্ট্রাক্টে হয়তো এর থেকে বেশিই খরচ হতো আমার।

পার্কিং-এ গাড়ি নেবার সময় দেখি ডেস্ক আলো করে বসে পাকিস্তানি যুবক-যুবতী। খানিক হিন্দিতে বাতচিতের পর আমাকে বলল, ‘স্যর আপনি যে ছোট গাড়ি চেয়েছেন সেটা তো নেই, তার বদলে আমি আপনাকে বড়ো গাড়ি দেব। একই পয়সায়। নিয়ে যান। স্কটল্যান্ড অবধি যাবেন, দেখবেন কি কম্ফর্ট।’ বাইরে এসে দেখি সেটা একটা বিশাল কালো রঙের সিট্রন। মিনিবাসের মতো বপু। আমি বললাম, ‘ওরে বাবা। এত বড়ো গাড়ি নিয়ে আমি কী করবো। গাদা পেট্রোল খাবে, তাছাড়া এত বড়ো গাড়ি আমি জীবনে চালাইনি।’ পাকিস্তানি সুন্দরী – আলমা – আমাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু আমরা – মানে আমি ও আমার শ্রীমতি – কিছুতেই বুঝলাম না। ইতিমধ্যে এক জাপানি দম্পতি একটা নীল রঙের ঝকঝকে প্যজোট ফেরত দিল। আলমা বলল – ঠিক আছে, ঐ প্যজোটটা নিন। অটোম্যাটিক গাড়ি। কিন্তু না-ধোয়া অবস্থায় নিতে হবে। চলবে?

ওটাও ছোটোখাটো এস.ইউ.ভি। তবে দারুণ গাড়ি। একদম ঝাঁ চকচকে, নতুন। রাজি হয়ে গেলাম। ভেতরে দেখি সবকিছু ওর ডিজিটাল প্যানেল নিয়ন্ত্রিত। বেসিক কন্ট্রোলগুলো আমার বুড়ো মগজে ঢোকাতে সময় লাগল। আলমাকে বললাম, ‘আমায় একটু শিখিয়ে টিখিয়ে দাও।’ হেসে গড়িয়ে গেল – এরকম কাস্টমার ও দেখেনি। তবে ওর সাধ্যমত দেখিয়েও দিল, দেখলাম মেয়েটাও বেশি কিছু জানেনা। তারপর ‘দুগ্‌গা’ বলে ফোনে গুগল ম্যাপ খুলে বেরিয়ে পড়লাম (প্যজোটের প্যানেলের জিপিএস ম্যাপের সাথে আমি ধাতস্থ নই)। এতকিছুর মধ্যে খেয়ালই ছিল না যা ঐ সিট্রোয়েন মিনিবাস-টার চাবি আমার শ্রীমতির হাতব্যাগেই রয়ে গেছে…

আমাদের রাতের বুকিং ছিল অনতিদূরে একটা রামাদা হোটেলে। ভালো, ছিমছাম ব্যবস্থা। ব্রেকফাস্ট বাদ দিয়ে ৫৮ পাউন্ড শুল্ক। রাতের উড়ানে ভালো ঘুম হয় না। তাই ড্রাফট বিয়ার, ওখানকার বিখ্যাত ফিস অ্যান্ড চিপস (সাথে মটরশুঁটির পেস্ট – পরে জেনেছিলাম এটা ফিস অ্যান্ড চিপসের সাথেই আসে) আর চিকেন রোস্ট অর্ডার করে একেবারে হাঁসফাঁস অবস্থা। ভারতে হলে অভুক্ত খাবার প্যাক করাতাম – ওখানে ওসব হয় কিনা জানা ছিল না। তাই শেষমেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঠেসেঠুসে গিললাম। তারপর ঘুম।

লন্ডনে আমাদের হোটেল
আমাদের ভাড়ার প্যজোট

দ্বিতীয় দিন

বছর তিনেক আগে থাইল্যান্ডের কো-সামুই বেড়াতে গিয়ে একটা পাগলামো করে ফেলেছিলাম। ‘কর্মা হলিডেজ’ নামে একটা হলিডে-প্যাকেজ সংস্থার সদস্য হয়ে গেছিলাম। ঐ মাহিন্দ্রা হলিডেজ-এর মতো। তবে এদের বেশির ভাগ রিসর্ট পৃথিবী জুড়ে। এবং কোনোটাই বড়ো শহরের মধ্যে নয়। মানে ওই রিসর্টে পৌঁছতে গেলে গাড়ি ভাড়া করা ছাড়া গতি নেই। ইংল্যান্ডে এদের রিসর্ট নরফ্লক্স কাউন্টির ওয়াটন শহরে রিচমন্ড পার্ক বলে একটা জায়গায়। সেখানে গলফ অ্যাপার্টমেন্টে আমাদের একটা কটেজ বুক করা ছিল। লন্ডন থেকে গাড়িতে ঘন্টা তিনেকের দূরত্ব।

এই প্রথম ইউ.কে-র গ্রামাঞ্চলের আস্বাদ পেলাম। হাইওয়ের দু’পাশে সবুজের সমারোহ। ঢেউ খেলানো গাঢ় সবুজ প্রান্তরে ঘাস খাচ্ছে মোটা মোটা ভেড়ার পাল। মোটা, কারণ ওদের শরীরে পশম এইসময় পূর্ণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত। আরেকটু গরম পড়লেই ওদের উল ছেঁটে ফেলা হবে। শীত আসতে আসতে ফের সেগুলো গজিয়ে যাবে। কোথাও দেখলাম মেষশাবক মায়ের দুদু খেয়ে চলেছে, ওদিকে মা নিশ্চিন্তে ঘাস চিবোচ্ছে। কখনো বা সড়কের দু’পাশে বড়ো বড়ো ওক, বিচ, চেস্টনাট আর পাইনের বনানী। রাস্তার দুপাশ থেকে ঝুঁকে পরে ছাতা ধরেছে যেন। শান্ত, নির্মল পরিবেশ। এতো গাড়ি চলেছে একটা হর্ন শোনা যাচ্ছে না। রাউন্ড-অ্যাবাউট বা ক্রসিং-এ গোলাবর্তে থাকা গাড়ির রাইট-অফ-ওয়ের নিয়ম সবাই মেনে চলছে – আমাদের মতো যে যেখান দিয়ে পারছে ঢুকিয়ে দিচ্ছে না। রাস্তার পাশে ‘শোল্ডার’-এর সাদা দাগের বাইরে দিয়ে কেউ ওভারটেক করছে না। কারো কোনো তাড়া নেই, অথবা থাকলেও সেটা আপাতভাবে দৃশ্যমান নয়।

রিচমন্ড পার্ক গলফ অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে দেখলাম কেউ নেই, শুধু গলফ ক্লাবের বারে বসে বিয়ার আর ওয়াইন পান করছে কতিপয় নরনারী। ভারত থেকে রওনা দেবার আগেই ওখানের কেয়ারটেকার – সাইমন নামে একটি ছেলের সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলাম। ফের সাইমনকে ফোন করতেই এলো তার মা – মার্গারেট নামে এক ছিপছিপে বুড়ি। কাছেপিঠেই থাকেন, কারণ পাঁচ মিনিটের মধ্যে বুড়ি হাজির। আমাদের বসতে বলে দেখতে গেলো আমাদের কটেজ তৈরি আছে কিনা। মিনিট দশেক পর সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে এসে আমাদের কটেজ ব্যবহার করার ‘ডুজ অ্যান্ড ডোন্টস’ বিস্তারিত বোঝালো। আমার ডেবিট কার্ডের নম্বর ছেপে রাখলো – কারণ শর্ত অনুযায়ী আমরা যত ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করছি তার পয়সা ওটার থেকে কাটবে।

কটেজে ঢুকে মন ভরে গেল। ছোট্ট কিন্তু আরামদায়ক। নীচতলায় লিভিং রুম আর কিচেন। ফ্রিজ, হট-প্লেট, বৈদ্যুতিক কেটল, বাসনপত্র, নানান ধরণের পানীয়র গ্লাস, তোয়ালে, বাসন ধোয়ার সাবান ইত্যাদি সবই রাখা আছে। লিভিং রুমে সোফা, সামনে বড়ো কাচের জানালা দিয়ে দৃশ্যমান বিস্তীর্ণ হরিৎ গলফ কোর্স। ছড়ানো ছেটানো ওক, বার্চ আর পাইন বৃক্ষ। আমাদের জানালার বাইরের পাইন গাছটার নীচে বসে রোদ পোয়াতে পোয়াতে দুহাত মুখের কাছে নিয়ে ওক গাছের নীচে পড়ে থাকা একর্ন খাচ্ছে কেঁদো কেঁদো কাঠবিড়ালি। ওদের অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করে ঘাস থেকে কীসব খুঁটে খাচ্ছে ওদের থেকেও বড়ো সাইজের কবুতর…

কার্পেট ঢাকা সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠলে দোতলার বেডরুম। বিছানার শিয়রে জানালা, সেটা দিয়েও দৃশ্যমান সবুজের সমারোহ। ঘুম থেকে উঠলে মনে হবে ঘাসের মধ্যে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা একে কুটিরে বাস করছি। এযাবৎ এরকম সেটআপ ইংরেজি সিনেমাতেই দেখেছি। দুপাশে ঢাল খেয়ে যাওয়া নীচু ছাদ, হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায়। রৌদ্রজ্জ্বল দিনে ঘর গরম রাখার প্রকৃষ্ট উপায়। অবশ্য এখন হিটার চলছিল।

বিকেলে ওয়াটন শহরের আশপাশটা ঘুরে ফিরে দেখলাম। ছোট ছোট দোকান, গির্জা। ফুটপাথে ডিফিব্রিলেটর মেশিন আঁটা। পথচলতি মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হলে যাতে ঐ যন্ত্র প্রয়োগ করে তাকে বাঁচানো যায় – তার ব্যবস্থা। চমৎকৃত হলাম। পরে দেখেছিলাম এই ডিফিব্রিলেটর যন্ত্র ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের ছোট বড়ো সব জায়গায় যত্র তত্র আঁটা রয়েছে। ডিফিব্রিলেটরের মতো যন্ত্রকে এরা ফার্স্ট এইডের পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে এসেছে।

একটা ছোট ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে চাল, ডাল, ডিম, শসা, টমেটো ওয়াইন আর বিয়ার কিনে নিয়ে এসে ফ্রিজ ভরালাম। শ্রীমতি দেশের থেকে কিছু মশলাপাতি নিয়ে এসেছিল। রাতে গরম ভাত ডিমসেদ্ধ আর আলুসেদ্ধ দিয়ে দারুণ লাগলো। চুপি চুপি জানিয়ে রাখি, হোয়াইট ওয়াইনের সঙ্গে এই মেনুটা দারুণ জমে…

রিচমন্ড পার্কে আমাদের কটেজ
আমাদের জানালা থেকে সবুজের সমারোহ
কুলুকুলু বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদীর উপর পুরোনো সাঁকো – রিচমন্ড পার্ক
ডিফিব্রিলেটর এখানে ফার্স্ট এইড কিট

তৃতীয় দিন

ইচ্ছেমত ঘোরার মস্ত সুবিধে হলো যেদিন যখন যেখানে ইচ্ছে চলে যাওয়া যায়। তাতে যদি দুচারটে দর্শনীয় স্থানে বুড়ি না ছোঁওয়া হয় তাইই সই। রিচমন্ড পার্ক থেকে কেমব্রিজ শহর গাড়িতে সোওয়া একঘন্টার রাস্তা। তাই আগের রাতে ঠিক করে পরদিন সকালে প্রাতরাশের পর বেরিয়ে গুগলবাবার ম্যাপ ধরে গাড়ি চালিয়ে দিলাম কেমব্রিজের উদ্দেশ্যে।

কেমব্রিজে পৌঁছে একটা শপিং মলে গাড়ি পার্ক করে ছাদ-খোলা এক দোতলা সাইট-সিয়িং বাসে চেপে বসলাম। নীল আকাশ আর ঝকঝকে রোদ থাকলে কী হবে, হাড়-কাঁপানো হাওয়া বইছিল। তাও নিজেদের আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে বাসের সিটের সাথে লাগানো ইয়ারফোন কানে গুঁজে শুরু করলাম ইংল্যান্ডের কেমব্রিজশায়ার কাউন্টিতে অবস্থিত কেমব্রিজ শহরের অবিস্মরণীয় সফর।

পুরোনো ঐতিহ্যময় শহর কেমব্রিজ। গুরুমশাই আর ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে গড়ে ওঠা এক বিস্ময়কর গুরুকুল, যেখানে আধুনিকতার সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে ঐতিহ্য এবং সাবেকিয়ানা। ১২০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত জগতের অন্যতম শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে ধারাবাহিক ভাবে স্থান করে নেওয়া কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তো আছেই, সঙ্গে আছে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বিখ্যাত একত্রিশটি কলেজ, যেমন ট্রিনিটি কলেজ, কিংস কলেজ, ক্রাইস্ট কলেজ এবং সেন্ট জবস কলেজ (বাকি নামগুলো মনে নেই)। কলেজগুলির অত্যাশ্চর্য স্থাপত্য এবং মনোরম পরিবেশ তো আছেই, তবে তার থেকেও বড়ো সেগুলোর গর্ব করার মত ইতিহাস। যেমন আইজ্যাক নিউটন সাহেব এই কলেজে পড়াকালীন তার বিখ্যাত গতি এবং সর্বজনীন মহাকর্ষের সূত্র তৈরি করেছিলেন। পরবর্তী কালে তিনি কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে অধ্যয়ন করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আধুনিক যুগের অন্যতম বিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, স্টিফেন হকিং তার অধ্যয়ন জীবনের বেশিরভাগ সময় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়েছেন। এখানে তিনি গণিতের লুকাসিয়ান অধ্যাপকের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ঐ মর্যাদাপূর্ণ পদটি একসময় স্যার আইজ্যাক নিউটন নামে জনৈক ভদ্রলোকের অধীনে ছিল। বার্ট্রান্ড রাসেলও ছিলেন এই ট্রিনিটি কলেজের ছাত্র। বিশিষ্ট প্রকৃতিবিদ, ভূতত্ত্ববিদ, জীববিজ্ঞানী এবং বিবর্তন তত্ত্ব আবিষ্কারক চার্লস ডারউইন কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে অধ্যয়ন করেছিলেন। এছাড়া প্রভাবশালী ইংরেজ লেখক এবং আধুনিক সাহিত্যের প্রবর্তক ভার্জিনিয়া উলফ, প্রখ্যাত আণবিক জীববিজ্ঞানী রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিনের মত ব্যক্তিত্বের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে কেমব্রিজের ইতিহাস। যাঁরা সিনেমা থিয়েটার ভালবাসেন তাঁদের জানিয়ে রাখি একাডেমি পুরস্কার বিজয়ী অভিনেত্রী, চিত্রনাট্যকার এবং লেখক এমা টমসনও কেমব্রিজে ইংরেজি সাহিত্য অধ্যয়ন করেছেন। কেমব্রিজের ব্যক্তিত্বের গপ্প বলতে গেলে মহাভারত রচনা হয়ে যাবে। বাসে প্রথমবার চক্কর মেরে মাথা ভনভন করছিল, তাই সিটি স্কোয়ারে লাঞ্চ সেরে আমি আর শ্রীমতি ফের চড়ে বসলাম ঐ হপ-ইন-হপ-অফ বাসে, কারণ টিকিটের মেয়াদ চব্বিশ ঘন্টা। দ্বিতীয়বার জায়গাগুলো আরো ভালো করে দেখলাম, সেগুলোর ইতিহাসে সিঞ্চিত করলাম নিজেদের… বাসের টিকিটের পয়সা উশুল…
তিনটি ছোট ট্রিভিয়া লিখে কেমব্রিজ পর্বে ইতি টানবো।

১) কেমব্রিজের বুক চিড়ে বয়ে চলেছে ক্যাম নদী (প্রসঙ্গত জানানো দরকার অনেকে কেমব্রিজের উচ্চারণ করে ‘ক্যামব্রিজ’, তবে আমরা কেমব্রিজ বলি বলে ওটাই ব্যবহার করলাম)। খেলাধুলাতে অক্সফোর্ডের সঙ্গে কেমব্রিজের রেষারেষি সর্বজনবিদিত। অক্সফোর্ডের ক্যানোয়িং দল টেমসের উপর অনুশীলন করে। তাই, লন্ডনের টেমসের স্রোতকে অনুকরণ করার জন্য ক্যাম নদীর প্রবাহ একটি উইয়্যারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় যাতে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি ক্যানোয়িং দল ঠিকমত অনুশীলন করে অক্সফোর্ডের ছাত্রদের হারাতে পারে।
২) পার্কার্স পিস পার্ক হল একটি বড় পাবলিক পার্ক। আধুনিক ফুটবলের বিকাশে পার্কটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। এখানে ফুটবলের (সকার) প্রথম দিকের কিছু নিয়ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল গোলপোস্টের পরিমাপের প্রমিতকরণও। পার্কের একধারে সমদূরত্বে বেড়ে ওঠা বড়ো বড়ো চেস্টনাট গাছের গুঁড়ির দূরত্বের মাপেই আধুনিক ফুটবলের গোলপোস্ট।
৩) জ্যাক হবস ছিলেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি ক্রিকেট ক্লাবে টিমের সদস্য, পরে ক্লাবের দীর্ঘকালীন কোচ, এবং কেমব্রিজের খুব ভালবাসার মানুষ। পার্কার্স পিস পার্কে তাঁর নামে একটি প্যাভিলিয়ন আছে। প্যাভিলিয়নের মাথায় ওয়েদার ভেনটি আসলে ব্যাটিং স্টান্স নেওয়া ক্রিকেটার জ্যাক হবস।

মলের পার্কিং-এ পার্কিং মাশুল দিলাম ৩০ পাউন্ড (তিন হাজার টাকার উপর)। একটু আগে পয়সা উশুলের কথা লিখেছিলাম, কেমব্রিজের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব নিউটন সাহেবের থিয়োরি মেনে এটা তার বিপরীত প্রতিক্রিয়া। তা সত্ত্বেও বলবো ভালোই কাটলো দিনটা। একমাথা স্মৃতি আর ইতিহাস সম্বল করে সন্ধেবেলায় ফিরে এলাম আমাদের রিচমন্ড পার্কের ডেরায়। জয় বাবা গুগলনাথ।

কেউ যদি ইংল্যান্ড বেড়াতে যান এবং যদি ইতিহাস ভালোবাসেন, একবার এই শহরটাতে অবশ্যই ঢুঁ মারবেন। অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হবে।

পার্কার্স পিস পার্ক। এর এক কোণে স্যর জ্যাক হবস প্যাভিলিয়ন
কেমব্রিজের বহমান নদী ক্যাম। ক্যামের ব্রিজ থেকেই কেমব্রিজ
কেমব্রিজ সিটি স্কোয়ারে রবিবারের হাট
কেমব্রিজের রয়াল অ্যালবার্ট হোম
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত জাজ বিজনেস স্কুল, পৃথিবীর প্রখ্যাত বিজনেস স্কুলের অন্যতম
সামনের কিনস কলেজের তোরণ, পিছনে কিনস কলেজের চ্যাপেল

চতুর্থ দিন

আগেই লিখেছিলাম প্রথমে আমাদের যে সিট্রন মিনিভ্যানটা দিয়েছিল, সেটার চাবিটা ভুলবশত আমার শ্রীমতির ব্যাগে রয়ে গেছিল। গতকাল সেটা নিয়ে হিথরো থেকে ফোন করেছিল আলমা নামের মেয়েটা। ভুলটা যে একা আমাদের নয়, ওদেরও সেটা স্বীকার করে বলল চাবিটা পোস্টে ওদের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে। গতকাল রবিবার – সম্ভব ছিল না। আজ সকালে প্রথমে ঐ কাজটা করলাম। আমাদের কটেজ থেকে অনতিদূরেই একটি স্টেশনারি দোকানের মধ্যে দুটো কাউন্টারের পোস্ট অফিস। দোকান থেকে এক পাউন্ড দিয়ে একটা প্যাড দেওয়া খাম কিনলাম। তারপর আলমার পাঠানো ঠিকানায়, চাবিটাকে খামবন্দি করে পোস্ট করে দিলাম। সব মিলিয়ে খরচা হলো দু পাউন্ড বিশ পেনস। আমার সবচেয়ে যেটা ভালো লাগলো তা হলো একটি স্টেশনারি দোকানে পোস্ট অফিসের কাউন্টারের রাখার সরল কিন্তু কার্যকর চিন্তাটি। এই কনসেপ্টটা আমাদের দেশে প্রচলিত করা যায় না?
আজ ছিল আমাদের রেস্ট-ডে। কিন্তু একেবারে তো আর ঘরে বসে থাকা যায় না, তাই চোদ্দ মাইল দূরে ডেরেহ্যাম নামের একটা ছোট্ট শহরে চলে গেলাম। শ্রীমতি এটা ইন্টারনেট ঘেঁটে আবিষ্কার করেছিলেন, কারণ সেখানে দোকান বাজার মোটামুটি বড়ো। ছবির মতো সবুজ মেডোর (ঘাসজমি) বুক চিড়ে এঁকে-বেঁকে যাওয়া রাস্তা ধরে ডেরেহ্যাম গিয়ে একটু উইন্ডো শপিং করলাম। তারপর নিজেদের জন্য কিছু খাবার আর পানীয় কিনে ঘরে ফিরে লাঞ্চ করলাম। সোমবার আমাদের শাকাহারি দিন। ডেরেহ্যাম থেকে সেমি-প্রসেসড শাকাহারি খাবার এনেছিলাম। ঘরে মাইক্রোওয়েভে গরম করে দিব্যি লাগলো। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি ইংল্যান্ডের পল্লী অঞ্চলে বাইরে শাকাহারি খাবার পাওয়া একটু মুস্কিল। তবে ঘরে বা হোটেলে (এখানে অনেক ছোট হোটেলেই কমন-কিচেনের ব্যবস্থা থাকে) মাইক্রোওয়েভ থাকলে ঘরে খাওয়াটাই বেশ তৃপ্তিদায়ক।

পড়ন্ত সন্ধেবেলায় পায়ে হেঁটে অনেক দূর অবধি ঘুরে এলাম। রাস্তায় অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা বাইসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে – এখানে দেখলাম বাইসাইকেলের চল খুব। হেঁটে ফেরার পথে ফের ঐ ছেলেমেয়েদের দলের সঙ্গে দেখা। আমায় দেখে হাত নাড়ল। ওই নির্জন রাস্তায় একমাত্র পদাতিককে ওরাও মনে রেখেছে… দূষণমুক্ত ঠাণ্ডা পরিবেশে পাঁচ-ছয় মাইল হেঁটেও ক্লান্তি এলো না।

রিচমন্ড পার্কে সন্ধে নামছে
তখন আটটা বেজে গেছে
ইংল্যান্ডের পল্লী অঞ্চলে
নির্জন রাস্তা ধরে হাঁটা…

পঞ্চম দিন

২০০৬ সালে আমার একবার কর্মসূত্রে লিঙ্কনশায়ার কাউন্টির লিঙ্কন শহরে আসার সুযোগ ঘটেছিল। সিমেন্সের গ্যাস টারবাইনের কারখানা। জায়গাটা তখন খুব মনে ধরেছিল, ইচ্ছে ছিল শ্রীমতীকে জায়গাটা দর্শন করানোর। ম্যাপ ঘেঁটে দেখলাম শহরটা আমাদের ওয়াটন থেকে দু-আড়াই ঘন্টার দূরত্বে। ইংল্যান্ডে আসা ইস্তক আমরা সুন্দর ঝকঝকে আবহাওয়া উপভোগ করেছিলাম, আজ ছিল তার ব্যতিক্রম। সকাল থেকেই ছিঁচকাঁদুনে বৃষ্টি এবং হু হু বইতে থাকা হাড় হিম করা বাতাস। সেটা উপেক্ষা করে সকালে প্রাতরাশের পর গাড়ি ছোটালাম লিঙ্কনের উদ্দেশ্যে।

লিঙ্কনকে বলা হয় ক্যাথিড্রাল সিটি, কারণ এখানে এক পাহাড়চূড়ায় রয়েছে একটি দুর্দান্ত গথিক ক্যাথিড্রাল যা অনেক দূর থেকে দেখতে পাওয়া যায়। ক্যাথিড্রালটি মধ্যযুগীয় গথিক স্থাপত্যের একটি শ্বাসরুদ্ধকর নিদর্শন। সরু সরু পাথর-বাঁধানো রাস্তায় টক্‌টক্‌ শব্দ করে ঘুরে বেড়ানো ঘোড়াগাড়ি সোজা আমাদের নিয়ে গিয়ে ফেলল মধ্যযুগে, যখন বর্ম আর শিরস্ত্রাণ পরে ঘুরে বেড়াতো মহাপরাক্রমশালী নাইটরা। ক্যাথিড্রালের সূক্ষ্ম স্থাপত্যকীর্তি দেখে আমার মনে এল টম দ্য বিল্ডারের কথা। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি মধ্যযুগীয় ইয়োরোপে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য বহু বড়ো বড়ো ক্যাথিড্রাল এবং ব্যাসিলিকা নির্মাণ করা হয়। লন্ডনের সেইন্ট পল্‌স ক্যাথিড্রাল, মিলান ক্যাথিড্রাল, ভ্যাটিক্যানের সেন্ট পিটার্‌স ব্যাসিলিকা – এই সব মধ্যযুগীয় ক্যাথিড্রাল এবং ব্যাসিলিকাগুলোর ইতিহাস এবং নির্মাণশৈলী সম্পর্কে যদি কেউ উৎসাহী হন তাহলে তাঁকে আমি কেন ফলেটের একটি মহান উপন্যাস ‘দ্য পিলার্স অফ দ্য আর্থ’ পড়তে অনুরোধ করবো। প্রায় একহাজার পৃষ্ঠার এই উপন্যাসের নায়ক রাজমিস্ত্রি টম – যার পেশা ছিল ক্যাথিড্রাল নির্মাণ।

লিঙ্কন শহরের আরেকটি বিশিষ্ট ল্যান্ডমার্ক হল লিঙ্কন ক্যাথিড্রালের অনতিদূরে অবস্থিত লিঙ্কন ক্যাসল বা দুর্গ। এটিও নির্মিত হয়েছিল একহাজার শতাব্দীতে। লিঙ্কনের সুরক্ষা (মনে রাখা দরকার মধ্যযুগীয় ইয়োরোপে কাউন্টির অন্তর্দ্বন্দ্বও ছিল প্রচলিত ব্যাপার, মানে কোনো এক ব্যারন তার আধিপত্য বিস্তারের জন্য পাশের কাউন্টির আর্ল-কে আক্রমণ করে বসল, এই রকম) ছাড়াও পরবর্তীকালে এটিকে রাজকোষাগার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আঠারোশো শতাব্দীতে এটা ছিল রাজ-কারাগার। আর এখন এটা ক্রাউন-কোর্ট বা ইংল্যান্ডের অন্যতম বিচারক ভবন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দুর্গ হিসেবে এর ব্যাপ্তি আহামরি কিছু নয়। জয়পুর, যোধপুর, চিতোরে আমি এর চেয়ে ঢের বড়ো দুর্গ দেখেছি। কিন্তু ইংরেজরা ওদের ক্যাসলগুলোকে এতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে আর এতো সুন্দর ভাবে মার্কেট করে যে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। শীতকালে (ভারতে একমাত্র ঐ সময়টাই ভ্রমণযোগ্য) আমাদের দুর্গগুলোতে এত অতিরিক্ত ভিড় থাকে যে খানিক পর মনে হয় পালাই পালাই।

লিঙ্কন ক্যাথিড্রাল আর ক্যাসল নিয়ে বহু তথ্য গুগল করলেই পাওয়া যাবে, তাই ওসব নিয়ে আর লিখবো না। কেবল ছোট্ট একটু ট্রিভিয়া দিয়ে লিঙ্কন পর্ব শেষ করবো।

টম হ্যাঙ্কস অভিনীত হলিউডের বিখ্যাত ছবি ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ এর অনেকটা শুটিং এই লিঙ্কন ক্যাথিড্রালে হয়েছিল। ড্যান ব্রাউনের বইতে বেশ কিছু দৃশ্য লন্ডনের ওয়েস্টমিন্‌স্টার অ্যাবির মধ্যে ঘটেছে। কিন্তু সেখানে শ্যুটিং-এর অনুমতি না পাওয়ায় সেই জায়গাগুলি এই ক্যাথিড্রালে শ্যুট করা হয়। পরে সি.জি.আই বা কম্প্যুটার জেনারেটেড ইমেজ দিয়ে সেটাকে ওয়েস্টমিন্‌স্টার অ্যাবি করে দেখানো হয়।

ক্যাথিড্রাল আর ক্যাসল দেখার পর পাহাড়চূড়া থেকে নেমে এলাম লিঙ্কন সিটিসেন্টারে, যার বুক চিড়ে বয়ে চলেছে উইটহ্যাম নদী। দুপাশে বড়ো বড়ো শপিং মল, বার আর রেস্তোরাঁ। শ্রীমতির সঙ্গে জমিয়ে গ্রিক লাঞ্চ সেরে রওনা দিলাম আমাদের ডেরা – ওয়াটন, রিচমন্ড পার্কে…

লিঙ্কন ক্যাথিড্রাল
লিঙ্কন ক্যাসল-এর একাংশ
পাথর বাঁধানো রাস্তায় এক্কা গাড়ি
লিঙ্কন সিটি সেন্টার

ষষ্ঠ দিন

ছুটির মধ্যে ছুটি রাখাটা অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায় ছুটি এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে তার মৌলিক আনন্দ – ছুটির উপভোগ্যতাই হারিয়ে যায়। আজ ছিল আমাদের ছুটির দিন। গতকাল বৃষ্টি হয়ে আজ আবার পরিষ্কার আকাশ, ঝকঝকে রোদ্দুর, কিন্তু কনকনে ঠাণ্ডা। গুগল জানাল স্থানীয় তাপমান তিন ডিগ্রি। ডেরেহ্যাম বাজার থেকে কিছু খাবারদাবার আর একটা বই – ড. রিচার্ড শেফার্ডের ‘সেভেন এজেস অফ ডেথ’ – কিনে নিয়ে এলাম। তার পর রোদে বসে বসে ওয়াইন খেতে খেতে বই পড়া। শ্রীমতির বানানো খাবার খেয়ে সামান্য ভাতঘুম। বিকেলে অনেকদূর পর্যন্ত হেঁটে আসা। আজ ফের আবার সেই সাইকেলযাত্রীদের সঙ্গে দেখা। আমায় দেখে হাসলো, হাত নাড়লো। আমিও তাইই করলাম। একটা কথা না বলেও আমরা এখন বেশ পরিচিত। মজার না?

ডেরেহ্যামের বাজারে সস্ত্রীক লেখক
ওয়াটন শহরের নির্জন রাস্তা। স্পিড লিমিট ঘন্টায় কুড়ি মাইল। ফাঁকা রাস্তা সত্ত্বেও কাউকে দেখিনি গাঁক গাঁক করে উন্মাদের মতো গাড়ি চালাতে।

সপ্তম দিন

নরফক্‌ কাউন্টি – যেখানে আমরা আছি – ইংল্যান্ডের পূর্ব উপকূল থেকে বেশি দূরে নয়। নর্থ সি-এর এত কাছে রয়েছি অথচ কোনো উপকূলবর্তী শহর দেখিনি, এই চিন্তাটা মাথায় আসতেই শ্রীমতি ম্যাপ ঘেঁটে হানস্ট্যানটন শহরের খোঁজ বের করলেন। আমাদের রিচমন্ড পার্ক থেকে একঘন্টার দূরত্বে। আজ দিনটাও সুন্দর, অপেক্ষাকৃত ভাবে উষ্ণ। দুপুরে তাপমান বিশ ডিগ্রি ছোঁয়ার পূর্বাভাস। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সৈকত-শহর হানস্ট্যানটনের উদ্দেশ্যে।

সৈকত-শহরের এর প্রথম দর্শনেই চোখ জুড়িয়ে গেল। সবুজ প্রান্তরের পাশে ছোট ছোট দ্বিতল কুটির। পিছনে ছবির মত বেলাভূমি। এখানকার সমুদ্র কিন্তু নর্থ-সি নয়, ওরই এক উপসাগর, নাম ওয়াশ। তাই বোধহয় জলের রং নীল নয়, ঘোলাটে। ওয়াশ উপসাগরে বড়ো বড়ো ঢেউ এবং বোল্ডার থাকার জন্য নাব্যতার পক্ষে যথেষ্ট বিপদসংকুল। তাই জাহাজকে পথ দেখানোর জন্য একলা প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে বাতিঘর।

বাতিঘর দেখলেই আমি মনে মনে রোমাঞ্চ অনুভব করি। আমি যেন এক পালতোলা জাহাজের কাপ্তেন। রাতের অন্ধকারে উথাল-পাথাল সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে বাতিঘরের আলোক-সঙ্কেত দেখে নিয়ে চলেছি আমার জাহাজ। বাতিঘরের উপর পেতলের ফলক থেকে জানতে পারলাম এটি ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ অবধি জাহাজদের নাব্যতাতে সহায়তা করতো। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটি পর্যবেক্ষণ পোস্ট হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৮৪০ সালে নির্মিত বাতিঘরটি সেই সময়ের তুলনায় ছিল যুগান্তকারী। এটি ব্রিটেনের অন্যতম প্রথম বাতিঘর যেখানে আলোকসম্পাতের জন্য কয়লার আগুনের পরিবর্তে প্যারাবোলিক প্রতিফলক এবং তেলের বাতি ব্যবহার করা হতো।

বেলাভূমির একদিক যথেষ্ট পাথুরে। সেখান থেকে খাড়া উঠে গেছে হানস্ট্যানটন ক্লিফ। বেলাভূমিতে স্থানীয় লোকজন তাদের পোষা কুকুর নিয়ে খেলা করছে, কেউ বা শতরঞ্চি পেতে পান-ভোজনে ব্যস্ত। দেখলাম এখানে প্রায় সব পরিবারেরই একজন সারমেয় সদস্য রয়েছে, এবং তাদের আচার ব্যবহারে বেশ বোঝা যায় যে সারমেয়ত্ব ভুলে গিয়ে তাদের ক্রমশ মনুষ্যপ্রাপ্তি ঘটছে। অনতিদূরে গলফ কোর্সে গলফ খেলছে কিছু বুড়োবুড়ি – উইক ডে, তাই কমবয়সী লোকজনের ভিড় কম। খানিক ঘুরেটুরে, বিচের ধারের একমাত্র কাফেতে কফি খেয়ে, পথে ডেরেহ্যাম বাজার থেকে কিছু খাবারদাবার কিনে, আমরা ফের রওনা দিলাম রিচমন্ড পার্কের দিকে।

আজ আমাদের রিচমন্ড পার্কে থাকার শেষ দিন। কাল সকালে আমরা যাবো আরও উত্তরে, স্কটল্যান্ডের পথে, ইয়র্কশায়ার কাউন্টিতে।

সৈকতশহর হানস্ট্যানটন
হানস্ট্যানটন ক্লিফ
হানস্ট্যানটন বাতিঘর
ক্লিফে যাওয়ার জাঙ্গল-ট্রেইল

অষ্টম দিন

রিচমন্ড পার্ক থেকে স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবারার দূরত্ব সাত ঘন্টার। তাই একটানা গাড়ি না চালিয়ে ঠিক করেছিলাম মাঝামাঝি দূরত্বে কোনো শহরে রাত কাটাবো। তাই আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল উত্তর ইয়র্কশায়ারের রিপন শহর। আগে একবার ইয়র্কশায়ারের লিড্‌স শহরে আসার সুযোগ ঘটেছিল। তবে এবার লিড্‌সের খুব কাছাকাছি গেলেও শহর বাইপাস করে রিপন পৌঁছে গেলাম লাঞ্চের আগেই। ছোটো-বড়ো যে কোনো ইয়োরোপীয় শহরে কয়েকটা জিনিস খুব কমন। একটা পাথর বাঁধানো বড়ো সিটি স্কোয়ার, সঙ্গে একটা টাউন হল, শহর-চৌহদ্দির কাছাকাছি একটি ক্যাথিড্রাল – বা নিদেনপক্ষে একটি চার্চ। সিটি স্কোয়ারের চারপাশে হোটেল, কাফে, বার এবং রেস্তোরাঁ। ছুটির দিনে ঐ সিটি স্কোয়ারেই জমায়েত হয় শহরের জনতা। রেস্তোরাঁগুলোর বাইরে ফোল্ডেবল চেয়ার টেবিলে আড্ডা দেয় পান ভোজনকারীরা। ঐ চৌহদ্দিতেই বসে রবিবারের হাট। শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোটো নদী, তার উপর অসংখ্য পায়ে চলা সাঁকো। নদীর জলে সাঁতার কেটে বেড়ানো সাদা-কালো রাজহাঁস আর রংচং-এ পাতিহাঁস। রিপন শহরে এ সবই রয়েছে। অনায়াসে একে ইয়োরোপের এক মডেল টাউন হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যায়। ছবির মত শহর। আমাদের হোটেলটা সিটি স্কোয়ারের উপরেই। আর হোটেলের নীচতলার পুরোটা জুড়ে রিপনের সবথেকে জমজমাট বার এবং রেস্তোরাঁ। চেক-ইন করে সেখানে লাঞ্চ করতে গিয়ে দেখি একটাও টেবিল খালি নেই। তা যা হোক খানিক বাদে, উঁচু বার স্টুলে বসে বিয়ার আর ফিস-অ্যান্ড-চিপস দিয়ে লাঞ্চ সারলাম। এখানে ফিস-অ্যান্ড-চিপসে যে মাছ দেয় সেটা হলো কড মাছ। ভারি সুস্বাদু। এবং একটা প্লেটে যথেষ্ট পরিমাণ থাকে, একটা প্লেটে দিব্যি দুজনার পেট ভরে যায়। লন্ডনে প্রথম রাতে দু প্লেট নিয়ে বেজায় ফেঁসে গেছিলাম।

খাওয়াদাওয়া করে পায়ে হেঁটে বেড়াতে বেরোলাম। সিটি-স্কোয়ারের পাঁচ মিনিটের দূরত্বে রিপন ক্যাথিড্রাল। সেটা দেখে এলোমেলো ঘুরলাম খানিক। ঘুরতে ঘুরতেই আবিষ্কার করে ফেললাম শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া রিপন ক্যানাল। বাঁধানো ঘাট দিয়ে নীচে নেমে ক্যানালের ঠিক পাশের ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে গেলাম অনেক দূর। বেশ খানিকটা দূরে দেখি ক্যানালের পাশেই ‘দ্য র‍্যাট হোল’ নামের একটা পাব। ঠাণ্ডায় হাত পা জমে যাচ্ছিল। একটু উষ্ণতার জন্য ঢুকে গেলাম সেখানে। তারপর সেখানে দু পাঁইট (১ ব্রিটিশ বা ইম্পিরিয়াল পাঁইট = ৫৬৮ মিলি) গিনেস ড্রাফট খেতে খেতে উপভোগ করলাম রিপনের সূর্যাস্ত। এখানে দেখলাম সন্ধ্যে সাড়ে আটটা অবধি বেশ আলো থাকে। এরকম করে যত উত্তরে যাবো, তত বাড়তে থাকবে দিনের দৈর্ঘ্য।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি রিপনের কাছেই স্টাডলি রয়্যাল পার্ক নামে একটি ল্যান্ডস্কেপ বাগান রয়েছে যা ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত। আর তারই সংলগ্ন একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মধ্যযুগীয় সিস্টারসিয়ান অ্যাবি (অ্যাবি হলো চার্চ বা ক্যাথিড্রাল সংলগ্ন মোনাসট্রি যেখানে ধর্মযাজকরা বসবাস করেন) যা নাকি স্থাপত্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক চিত্তাকর্ষক মিশ্রণ। ইচ্ছে ছিল সেখানে যাবার, কিন্তু গয়লাপাড়া জানালো সেটা নাকি সন্ধ্যে ছটায় বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া খোঁজ নিয়ে জানলাম জায়গাটা ভালো করে দেখতে অন্তত তিন-চার ঘন্টা লাগবে। এ যাত্রায় হলো না। পরে কখনো দেখা যাবে…

রিপনের সিটি স্কোয়ার
রিপন ক্যাথিড্রালের ভিতর
সিটি স্কোয়ার টাউন হল রাত এগারোটায়
ছবিসদৃশ রিপন ক্যানাল

নবম দিন (ইংল্যান্ড – স্কটল্যান্ড)

রিপন থেকে এডিনবরা, স্কটল্যান্ডের দূরত্ব প্রায় ১৯০ মাইল (৩০৫ কিমি)। গুগল ম্যাপ দেখাবে সাড়ে তিন ঘন্টা, আমাদের লেগেছিল চারঘন্টার কিছু বেশী। এ-১ মোটরওয়ে ধরে নর্থ-সির পাশ দিয়ে সোজা রাস্তা। মেঘ, বৃষ্টি আর রোদ্দুরের খামখেয়ালি আবহাওয়া। এই মেঘ করে বৃষ্টি এল, গাড়ির ওয়াইপার ফুল স্পিডে চলতে না চলতেই মেঘ কেটে গিয়ে নীল আকাশ আর ঝলমলে রোদ। বাইরে খ্যাপা হাওয়া, এতো জোরালো যে জায়গায় জায়গায় সাইনবোর্ডে সাবধানবাণী দেওয়া আছে ‘বিওয়্যার, স্ট্রং ক্রস উইন্ড অ্যাহেড।’ বাত্যার দাপটে গাড়ি দুলে উঠছিল। কোথাও আবার দু’পাশে ঘন জঙ্গল – সেখানে হরিণের সাইনবোর্ড দেওয়া – মানে সেইখান দিয়ে হরিণ রাস্তা পার করে, তাই চালকেরা সাবধান। ঘন্টা প্রতি সত্তর মাইলের গতিতে বড়ো কোনো জানোয়ারকে ধাক্কা মারলে সেটার মৃত্যু তো নিশ্চিত, গাড়িরও ব্যাপক ক্ষতি হবার সম্ভাবনা।

জঙ্গল মিলিয়ে যেতেই ফের সবুজ গালচের উপর সাদা টিপের মতো মাঠে চড়ে বেড়ানো ছোটো সাদা সাদা ভেড়ার পাল। কোথাও রাস্তা বাঁক নিতেই ডানপাশে নর্থ-সি এর সুনীল জলরাশি, এখন জোরালো বাতাসে সেই জলের উপর ছোটো-বড়ো শ্বেত অশ্বের মত টগবগ করে বেড়াচ্ছে ঢেউ। স্বয়ং ভগবান যেন নিজে হাতে ক্যানভাসের সামনে যত্ন করে এঁকেছেন এই দৃশ্যপট। খানিক পরপরই মোটরওয়ের পাশে পার্কিং-এর জায়গা। অনেকক্ষণ টানা গাড়ি চালানোর পর যাতে চালকেরা একঘেয়েমি কাটানোর জন্য সেখানে বিশ্রাম নিতে পারে। প্রায় প্রতিটা পার্কিং স্পটে এমার্জেন্সি টেলিফোনের হটলাইন, যাতে কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হলে বা কারো গাড়ি বিগড়োলে হাইওয়ে হেল্প সার্ভিসে জানানো যায়।
স্কটল্যান্ডে আমরা যে অ্যাপার্টমেন্টটা ভাড়া নিয়েছিলাম সেটা ঠিক এডিনবরাতে নয়, এডিনবরা থেকে সতেরো মাইল দূরে ডানফার্মলাইন নামে একটা ছবির মতো শহরে। হাইওয়ে থেকে ডানফার্মলাইনে প্রবেশ করতে গেলে ফার্থ অফ ফোর্থ খাঁড়ির উপর অবস্থিত কুইনস্‌ফেরি ব্রিজ অতিক্রম করে যেতে হবে। ফার্থ অফ ফোর্থ হলো উত্তর-সাগরের থেকে উদ্ভূত এসচুয়েরি। ডানফার্মলাইনে প্রবেশ করার অনেক আগে থেকে অতি সুদৃশ্য ওই কুইনস্‌ফেরি সাঁকো দেখতে পাওয়া যায়। ওটা দেখে আমাদের মুম্বই-এ বান্দ্রা-ওরলি সি-লিঙ্কের কথা মনে পড়লো, তবে এই ব্রিজটাতে কেব্‌ল সাসপেনশন তিন দফায়। ভাবলাম নির্ঘাত চড়া টোল দিতে হবে। অবাক হলাম যখন কোনোরকম টোল ছাড়াই দিব্যি খাঁড়ি ক্রস করে গেলাম। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা উচিৎ, আজ আটদিন হলো আমরা গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আজ অবধি এক ফুটো-পয়সাও টোল দিতে হয়নি। এটা উল্লেখ করার মতো ঘটনা, কারণ মুম্বই থেকে সুরত, মাত্র আড়াইশো কিলোমিটার যেতে আমাদের পাঁচ দফায় প্রায় পাঁচশো টাকা টোল দিতে হয়। দিল্লি-মুম্বই এক্সপ্রেসওয়ে হবার আগে আমি একবার এন.এইচ ৮ (এখন এন.এইচ ৪৮) ধরে দিল্লি থেকে মুম্বই এসেছিলাম – আমায় তখন – ২০১৬ সালে – টোল দিতে হয়েছিল দুহাজার টাকার উপর।

ডানফার্মলাইনে আমরা যে বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম তার মালকিন সামান্‌থা আর্মস্ট্রং নামের এক মহিলা। আমরা ক’টা নাগাদ পৌঁছবো সেটা তাকে জানিয়েছিলাম। তার উত্তরে তিনি এক বিস্তারিত ইমেইলে আমাদের জানিয়েছিলেন তিনি দুঃখিত, ঐসময় তিনি উপস্থিত থাকতে পারবেন না, তবে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকতে যাতে অসুবিধে না হয় তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিখে জানিয়েছিলেন। সেই বিবরণ দেখে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ! এ যেন সেই ছোটবেলাকার ট্রেজার-হান্ট বা গুপ্তধন খোঁজার খেলা। ওনার বিবরণের একটু নমুনা না জানিয়ে পারছি না…

…রাস্তা ধরে প্রথম রাউন্ড-অ্যাবাউটের তৃতীয় এক্সিট দিয়ে রাস্তা উপরে উঠে গেছে, একটু গিয়েই ফের ডানদিকে ঘুরলেই বাঁদিকে দেখবেন চারটে কটেজ। এর চার নম্বরটা আমার। চার নম্বর কটেজের পাশেই গ্রাউন্ড ফ্লোরে দেখবেন একটা অ্যানেক্স (সংলগ্ন কটেজ)। সেটাই আপনাদের বাসস্থান। অ্যানেক্সের সামনের জায়গাটাতে গাড়ি পার্ক করবেন। তার ডান পাশে দেখবেন বাগানে জল দেবার জন্য একটা সবুজ হোস পাইপ। তার পাশ দিয়ে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে যাবেন – সেখানেই আমি থাকি। সদর দরজার ডানপাশের দেয়ালে দেখবেন একটা ছবি, কিন্তু আসলে ওটা ছবি নয়। ওটার ফ্রেম ধরে টানলেই ওটা খুলে যাবে, দেখতে পাবেন ভিতরে একটা কম্বিনেশন লক লাগানো লকার। আজকে ওটার কম্বিনেশন ৪৮৭৩। সঠিক কম্বিনেশন ঘুরিয়ে ওটা খুললে দেখবেন একটা চাবি। আপনি ওটা খুললেই আমার কাছে নোটিফিকেশান আসবে, আমি জানতে পারবো। চাবি নিয়ে সেফ বন্ধ করে কম্বিনেশন এলোমেলো করে দেবেন…

দুরু দুরু বুকে ভদ্রমহিলার নির্দেশ মেনে চাবি পেলাম। তাতেও স্বস্তি নেই। চাবি ঘুরিয়ে দরজা খোলে না। ফের ই-মেল খুললাম। সেখানে লেখা আছে, ‘দরজা খুলতে গেলে প্রথমে ওর স্টিলের লিভারটা অ্যান্টিক্লকওয়াইজ উপরে তুলে তারপর চাবি ঘোরাতে হবে…’

তা যা হোক, কটেজটা সুন্দর। একটা ছোট লিভিং রুমে একটা গোল টেবিল আর মুখোমুখি দুটো চেয়ার। একটা সোফা। সুসজ্জিত কিচেন। হট প্লেট, মাইক্রোওয়েভ, আভেন, রাইস-কুকার, টোস্টার, প্রচুর বাসনপত্র, কাটলারি, ওয়াশিং মেশিন, ফ্রিজ ইত্যাদি সবই রয়েছে। আর রয়েছে একটা ঢাউস অপারেটিং ম্যানুয়াল – ঐ যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহার করার ডুজ-অ্যান্ড-ডোন্‌টস।
নিজেরাই নিজেদের চেক-ইন করে (পুরো পয়সা আগে থেকেই দেওয়া ছিল) বিকেল বিকেল চলে গেলাম এডিনবরা। পুরোনো এডিনবরা শহর আর বিখ্যাত এডিনবরা ক্যাসলটা বাইরে থেকে দেখে রাত ন’টা নাগাদ কিছু খাবার-দাবার আর পানীয় কিনে ঘরে ফিরলাম। শ্রীমতীকে দেখলাম রাইস-কুকারে ভাত ফোটাবে বলে অপারেটিং ম্যানুয়াল খুলে বাবু হয়ে বসেছে। রাইস কুকারটার সামনে একটা খটমট বৈদ্যুতিণ প্যানেল – আমাদের বাড়ির মতো সাদামাঠা নয়। আমি বললাম, ‘ওটা বুঝে উঠে ভাত বানাতে রাত কাবার হয়ে যাবে। তুমি বরং সস-প্যানে ডাল-ভাত ফোটাও গো…’

খাওয়াদাওয়ার পর ফের ম্যানুয়াল খুলে বসলেন শ্রীমতি। ওয়াশিং মেশিন চালাবার জন্যে…। এটার প্রয়োজন ছিল…

ডানফার্মলাইনে ঢোকার মুখে
কুইন্‌সফেরি ব্রিজ
ডানফার্মলাইনে আমাদের ডেরা, সামনে বাহন
পুরাতন এডিনবরার একটি রাস্তা

দশম দিন

স্কটল্যান্ডের অন্যতম চিত্তাকর্ষক অঞ্চল হল হাইল্যান্ডস – অর্থাৎ সমতল থেকে পাহাড়ের উপরে উচ্চভূমি। হাইল্যান্ডসের কথা অনেক শুনেছিলাম। তাই হাইল্যান্ডসের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান গ্লেনকো-র উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। স্কটিশ গ্যালিক ভাষায় ‘গ্লেন’ শব্দটার অর্থ হলো ভ্যালি বা উপত্যকা, যা সাধারণত মৃদু ঢাল আবদ্ধ পর্বতের কোলে অবস্থিত। এই গ্লেন শব্দটা এদেশে বহুব্যবহৃত। অনেক বিখ্যাত স্কচের নামের শুরুতেই ‘গ্লেন’ – যেমন গ্লেনফিদিক, গ্লেনলিভেত, গ্লেনমোরাঞ্জি, গ্লেনহার্ট ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে আর একটা ট্রিভিয়া জানাই – গ্যালিক ভাষায় হরিণকে বলে Fiodhaich – উচ্চারণ ফিয়োয়াইচ। পৃথিবীর সবচাইতে জনপ্রিয় সিঙ্গল মল্ট গ্লেনফিদিক হুইস্কির নাম এর থেকেই উদ্ভূত গ্লেন-ফিদিক – অর্থাৎ ‘ভ্যালি অফ ডিয়ার’, হরিণের উপত্যকা…

ডানফার্মলাইন থেকে প্রায় দুশো মাইল দূরত্বে গ্লেনকো, সাড়ে তিন ঘন্টার ড্রাইভ। বাইরে পর্যায়ক্রমে মেঘ, বৃষ্টি রোদ্দুরের খেলা চলেছে অবিরত। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়ির ভিতরে বোঝা যায় না, কিন্তু মাঝে মাঝে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার জন্য যখন বাইরে বেরোচ্ছিলাম, টের পাচ্ছিলাম ঠাণ্ডার দাপট। মনে পড়লো আজ পয়লা বৈশাখ। পশ্চিমবাংলায় বর্ষবরণ উৎসব। হোয়াটস-অ্যাপ ভ’রে নববর্ষের শুভেচ্ছা ও সম্ভাষণ। সেইসঙ্গে ওখানে গরমে ভাজাভাজা হবার অনেক মজার মিম। বৈশাখের প্রথমদিন বাংলা নববর্ষ হবার কারণ নিশ্চয় একটা আছে; ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও ঐদিন বা একদিন আগুপিছু বর্ষবরণ উৎসব হয়, কিন্তু আমরা, বাঙ্গালিরা কেন বর্ষবরণ উৎসবটা শীতকালেই সেরে ফেলি না? সেই সময় বেশ পেট পুরে খাওয়াটাওয়া যায়, হৈ-হল্লা করার এনার্জি থাকে। এত ওষ্ঠাগত ঘামজ্যাবজ্যাবে গরমে কি আর উৎসব জমে?
গাড়ি চালাতে চালাতে বাইরের দৃশ্য এবং আবহাওয়া পরিবর্তনের ঘনঘটা দেখতে দেখতে আমার মনে হলো গত ন’দিন ধরে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমরা দেখেছি এ যেন তাকেও ছাপিয়ে গেছে। সুন্দর রাস্তা এঁকে বেঁকে উঠে গেছে উপরে। পাশে অজস্র নাম না জানা জলাশয় বা লেক। এখানকার ভাষায় লক্‌। কোনো কোনো লক্‌-এ ছোট ছোট কাঠের জেটি। কতবার যে পার্কিং-এ গাড়ি দাঁড় করিয়ে ছবি তুললাম তার হিসেব নেই। গ্লেনকো পৌঁছতে আমাদের যে তখনো অনেকটা পথ যেতে হবে সেই কথাটা বারবার ভুলে যাচ্ছিলাম। নাটকীয়ভাবে বদলাচ্ছিল দৃশ্যপট। লক্‌-এর পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখতে পেলাম ফুটে আছে বুনো গোলাপি গোলাপ – আমার হাতের ব্যাসের চেয়ে বড়ো বড়ো। লক্‌ অতিক্রম করতেই গভীর অরণ্য। অরণ্য ছাড়াতেই সামনে বড়ো বড়ো পাহাড়, তার কোল বেয়ে নেমে আসছে শত সহস্র বারিধারা। এখানকার ঝর্ণার জলে যে প্রাকৃতিক খনিজ উপাদান পাওয়া যায় তা নাকি বিশ্বের আর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। খাঁটি স্কচ হুইস্কির অন্যতম প্রধান উপাদান হলো এই প্রাকৃতিক জল। এই জল ছাড়া স্কচের, বিশেষ করে সিংগল মল্টের স্বাদ এবং সুবাস আনা অসম্ভব। এমন সময় একটা পাহাড় অতিক্রম করতেই দেখতে পেলাম শুভ্র তুষারশৃংগ।

গ্লেনকোতে বৃষ্টি পেলাম। তাই ছবির মত ঐ জায়গাটা হেঁটে ঘোরার সৌভাগ্য হল না। তিন-ডিগ্রিতে বৃষ্টিতে ভেজা মোটেও সুখপ্রদ নয়। গ্লেনকো উপত্যকার চারপাশে অজস্র জলপ্রপাত আর ট্রেকিং ট্রেইল। কষ্ট করে ট্রেইলে গেলে এখানকার বিখ্যাত লাল হরিণ ও সোনালি ঈগল দেখতে পাওয়া যায়। মূলত আউটডোর অ্যাক্টিভিটির জায়গা। কিন্তু বয়স এবং আবহাওয়া আমাদের অন্তরায়। একটা আরামদায়কভাবে উষ্ণ রেস্তোরাঁতে লাঞ্চ সেরে, মনভরা এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির পথে।
বাড়ি ফিরে দেখলাম সারাদিনে প্রায় ৪০০ মাইল (৬৫০ কিমি) গাড়ি চালিয়েছি। আশ্চর্য, কোনো ক্লান্তি বোধ করলাম না। তার পর রাতে ডিমের কারি দিয়ে গরম গরম ভাত…

গ্লেনকো-র পথে একটি লক্‌-এর পাড়ে
লক্‌ টির নাম ভুলে গেছি।
তুষারশৃংগমালার প্রথম দর্শন
পথের ধারে ইয়া বড়ো বড়ো বুনো গোলাপি গোলাপ
তথাগত মুখোপাধ্যায়ের জন্ম হুগলি জেলার চুঁচুড়া শহরে। ছাত্রজীবন হুগলি কলেজিয়েট স্কুলে। পরবর্তীকালে ধানবাদে ইন্ডিয়ান স্কুল অফ্‌ মাইনস থেকে পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে বি টেক্‌ এবং এম টেক্‌। চাকরি জীবন কেটেছে দেশ এবং বিদেশের বহু জায়গায়। প্রথম জীবনে তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস অপারেশনস, এবং পরে প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টে। কর্মজীবনের অনেকটাই কেটেছে গভীর সমুদ্রবক্ষের তেল এবং গ্যাস প্ল্যাটফর্মে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাংলা এবং ইংরাজি ভাষায় লিখেছেন বেশ কিছু শিল্পভিত্তিক থ্রিলার, রহস্য উপন্যাস, ছোট গল্প, ভ্রমণ-আলেখ্য এবং সায়েন্স ফিকশন। লেখকের প্রথম উপন্যাস ‘পিচ্ছিল’ ধারাবাহিকভাবে সানন্দা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৯১-৯২ সালে। লেখকের অন্যান্য প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে যুযুধান, রুহিতন চিড়িতন ইস্কাবন, চতুরঙ্গ, অন্তরাল, স্মৃতি-বিস্মৃতি, পাপু ও তার কথা-বলা-পুতুল, ভুতুখুড়োর সিরাম, The Fountain Pen plus Five এবং The Serum and a Triple উল্লেখযোগ্য। লেখককে যোগাযোগের ই-মেইল – tm.sohariwp@gmail.com

4 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Maha Nagar , July 16, 2024 @ 7:17 am

    Tathagata Anuradha has (or is it have) been my dear friend for a looong time. He writes very well, in both Bengali and English, and this wonderful account of their visit to UK is worth every minute of my reading time. I do note that he avoids writing about monuments and museums, it makes sense for a lay reader. All the best to him (rather ‘them’).

  • T Mukhopadhyay , July 19, 2024 @ 6:42 am

    Thanks.

  • Alok Basu , August 3, 2024 @ 1:31 am

    খুব ভাল লাগল। আগামী মাসে যাচ্ছি বিলেত ভ্রমণে। তার আগে ছবির মতন আপনার লেখনীর মাধ্যমে জায়গাগুলোর সাথে প্রাথমিক পরিচয় হয়ে গেলো।

  • Arijit Chaudhuri , August 19, 2024 @ 7:58 am

    খুব ভাল লেখা। সাবলীল, অন্তরঙ্গ আর ইনফরমেটিভ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *