রবি-কবির বর্ষাসঙ্গীত – ‘সকল রসের ধারা’য় সিক্ত জীবনদর্শন

রবি-কবির বর্ষাসঙ্গীত - ‘সকল রসের ধারা'য় সিক্ত জীবনদর্শন

রবীন্দ্রনাথ তখন শিশু। তাঁর মনোজগতে মেঘদূতের বার্তা এনে দিয়েছিল বিদ্যাসাগরের ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে।’ তাঁর শিশুমনে এই বারিপাতের মধুর ধ্বনি আদিকবির রচিত প্রথম ছন্দের মতই বেজে উঠেছিল। তাঁর বালক-বয়সে এক শিক্ষক কবিতার দুই চরণ লিখে পাদপূরণ করতে বলেন রবিকে। সেই পংক্তি দুটি ছিল-

রবিকরে জ্বালাতন আছিল সবাই,
বরষা ভরসা দিল আর ভয় নাই।

কিন্তু স্বয়ং রবি যেখানে প্রোজ্জ্বল, স্বীয় প্রতিভার তেজে প্রবলভাবে প্রতিভাত, ‘প্রখর তপনতাপে আকাশ তৃষায় কাঁপে’, সেখানে বর্ষার আশা কোথায়?

আশা দেবেন রবি নিজেই। শিশুকালেই যে তাঁর মনোজগতকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে নবীন মেঘের সুর আর অবিশ্রাম শ্রাবণধারার ছন্দ!

ভয় নাহি ভয় নাহি, গগনে রয়েছি চাহি।
জানি ঝঞ্ঝার বেশে দিবে দেখা তুমি এসে-
একদা তাপিত প্রাণে রে।

হয়ত প্রতিভার রুদ্রতেজ সহজাত কবচ-কুণ্ডলের মত জন্মসূত্রে পেয়েছিলেন বলেই মঙ্গলময় ধারাবর্ষণের প্রতি তিনি আজন্ম অনুভব করেছেন বৈপরীত্যের এক প্রবল আকর্ষণ। পৃথিবীর প্রায় সব কবিই নন্দনকাননে পিকমুখরিত মধুঋতুর আবাহনে সময়যাপন করেন, রবীন্দ্রনাথও বসন্তকে অবহেলা করেননি। তবু তারই মধ্যে তাঁর মধুরতম গীতসুধারসসিক্ত গানগুলি অবিরল বর্ষিত করেছেন মেঘমেদুর প্রাবৃটের উদ্দেশ্যে। সেখানে বর্ষাঋতু কখনও এসেছে প্রত্যক্ষভাবে প্রকৃতির সহচর-রূপে, আবার কখনও প্রেম বা পূজায় আত্মনিবেদনের ছদ্মরূপে।

কথা জিনিসটা মানুষেরই, আর গানটি প্রকৃতির। কথা সুস্পষ্ট এবং বিশেষ প্রয়োজনের দ্বারা সীমাবদ্ধ আর গান অস্পষ্ট এবং সীমাহীনের ব্যাকুলতায় উৎকণ্ঠিত। সেই জন্যে কথায় মানুষ মনুষ্যলোকের এবং গানে মানুষ বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গে মেলে। আজ এই ঘনঘোর বর্ষার সন্ধ্যায় প্রকৃতির শ্রাবণ-অন্ধকারে ভাষা আমাদের ভাষার সঙ্গে মিলতে চাচ্ছে। অব্যক্ত আজ ব্যক্তের সঙ্গে লীলা করবে বলে আমাদের দ্বারে এসে আঘাত করছে। আজ গান ছাড়া কোন কথা নেই।

এই কথাগুলি কবি ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থের ‘শ্রাবণসন্ধ্যা’ নিবন্ধে লিখেছিলেন। তাঁর রচিত বর্ষার গানগুলো যেন তাঁর গভীরতম চেতনার প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথের কাছে বর্ষা মানেই সকল প্রকার জীবন-রসের উৎস আর শ্রাবণ ছিল সমগ্র বর্ষার জীবন্ত, সাকার রূপ। তাঁর জীবনে বাইশে শ্রাবণ এক গভীর শোকের কারণে স্মরণীয়, কিন্তু তা তো কবির অজ্ঞাত ছিল। অতএব কবিজীবনে শ্রাবণের আরও অন্য দ্যোতনা আছে।

কবি তখন শিলাইদহে। সালটা ছিল ১৮৯৪। তারিখটা বাইশে শ্রাবণ, দিয়ে যায় যেন কোন অজানা ভবিষ্যতের পূর্বাভাস। ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে চিঠি লিখেছেন কবি – 

এখানকার প্রকৃতির সঙ্গে সেই আমার একটি মানসিক ঘরকন্নার সম্পর্ক। …জীবনের যে গভীরতম অংশ সর্বদা মৌন এবং সর্বদা গুপ্ত, সেই অংশটি আস্তে আস্তে বের হয়ে এসে এখনকার অনাবৃত সন্ধ্যা এবং অনাবৃত মধ্যাহ্নের মধ্যে নীরবে এবং নির্ভয়ে সঞ্চরণ করে বেড়িয়েছে। এখনকার দিনগুলো তার সেই অনেক কালের পদচিহ্ন দ্বারা যেন অঙ্কিত। (ছিন্নপত্রাবলী)

প্রকৃতিপর্যায়ে মোট ১১৫টি বর্ষা অঙ্গের রবীন্দ্রসঙ্গীত সংকলিত হয়েছে যা তিনি রচনা করেছেন ষোলো বছর বয়স থেকে শুরু করে প্রায় মৃত্যুর-প্রাক্কাল পর্যন্ত। বিদ্যাপতির অনুসরণে ভানুসিংহ ছদ্মনামে মৈথিলী-ব্রজবুলি ভাষায় রচিত পদ ‘শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা’ ছিল তাঁর লেখা প্রথম বর্ষার গান, প্রকাশিত হয় আশ্বিন ১৮৭৭ সংখ্যা ভারতী পত্রিকায়, তার বাণী অবশ্য ছিল ‘সজনী গো- আঁধার রজনী ঘোর ঘনঘটা।’ তারপর ১৮৮২-তে তানসেন-রচিত একটি ধ্রুপদ ভেঙে রচনা করেন বর্ষার দ্বিতীয় গানটি- ‘গহন ঘন ছাইল।’ বস্তুতঃ বর্ষার গান রচনা করার জন্যে যে গভীর ভাবের প্রয়োজন, একুশ বছর বয়সে তা আশা করা যায়না, গানটি ‘কালমৃগয়া’ নৃত্যনাট্যের জন্যে কবিকে লিখতে হয়েছিল। এরপর দীর্ঘকাল তিনি কোনও বর্ষার গান লেখেননি। তের বছর পরে পতিসরে ১৮৯৫-এর জ্যৈষ্ঠের ঝড়বৃষ্টির মধ্যে ইন্দিরাকে চিঠি লেখার সময় তাঁর মাথায় ১৮৮২ সালে লেখা ‘গহন ঘন ছাইল’ গানটির সুর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, তবু বর্ষার পরের গানটি লিখতে লেগে গেল আরও কয়েকমাস। সে বছর আশ্বিনের গোড়ায় শিলাইদহে স্টিমারের খোলা ছাদের ওপর বসে অবিরাম ঝড় বৃষ্টিবাদলের আবহে তিনি রচনা করেন তাঁর তৃতীয় বর্ষাসঙ্গীত ‘ঝর ঝর বরিষে বারিধারা।’ এই গানটিকে রবীন্দ্রনাথ রচিত সুরে ও কথায় প্রথম মৌলিক বর্ষাগীতি বলে গণ্য করা যেতে পারে।

কিন্তু বর্ষার গান মানে কি তা শুধু বর্ষারই গান? সযত্নকল্পিত পর্যায়ের পরিধি ছাড়িয়ে তাঁর গানে কি প্রকৃতি-পূজা-প্রেম-স্বদেশ-বিচিত্র সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়নি? ‘গীতাঞ্জলি’ তো তাঁর জীবন দেবতার চরণে শ্রদ্ধার্ঘ্য, যেখানে বর্ষার গানের ছড়াছড়ি। দেখা যায় যে, ঠিক গীতাঞ্জলি পর্বের আগে বা সমসময়ে রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানের ঢল নামে। গীতাঞ্জলিতেই আমরা মোট একুশটি বর্ষার গান পাই (এর মধ্যে ‘আজ বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে’ গানটির সুর পাওয়া যায় না)। এই নিয়ে প্রভাত মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রজীবনী ২য় খণ্ডে লেখেন-

এই বর্ষাসঙ্গীতের সুরে কেবল বর্ষার ঝংকার নাই, বর্ষণের অন্তরালে যিনি আছেন তাঁহারই নূপুরনিক্কন শোনা যায়, সৌন্দর্যের অন্তরালে সুন্দরকে যেন দেখা যায়…এই গীতধারায় দেবতা ও প্রকৃতি এবং তাহার সঙ্গে মানব অচ্ছেদ্যবন্ধনে বাঁধা পড়িয়াছে- সৌন্দর্য ও সুন্দর একাঙ্গীভূত অদ্বৈত হইয়াছে।…তাই গীতাঞ্জলি প্রমুখ কাব্যে ঈশ্বর ও প্রকৃতি এমন ওতপ্রোতভাবে মিলিত, প্রিয়তমের বিরহ-বেদনা ছন্দে ও সুরে মুখর; …কিন্তু কবির জীবন যতই গভীরে প্রবেশ করিল, প্রকাশের ভাষা ততই রূপকের সুরে ছন্দে-রহস্যে ভরিয়া উঠিল; পরে ঈশ্বর ও প্রকৃতির মধ্যে মুখ্য-গৌণ ভেদ ঘুচিয়া গিয়া অখণ্ড রস-বোধে সমস্ত চিত্ত প্লাবিয়া একাকার হইয়াছিল।

এই কথাগুলো স্মরণ করেই আমি এই প্রবন্ধে বর্ষার গান বলতে শুধু প্রকৃতি-পর্যায়ভুক্ত গানের কথা বলছি না। তারা তো আছেই, এ ছাড়া আরও বেশ কিছু গানের কথা জানাতে চাই যেগুলো অন্য পর্যায়ে থাকলেও বর্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। কয়েকটা উদাহরণ দিই।

প্রেম-পর্যায়ে-
– আজি গোধূলিলগন ওই বাদলগগনে
– আমার নিশীথরাতের বাদলধারা
– এমন দিনে তারে বলা যায়
– কে দিল আবার আঘাত (বসন্তে শুরু, বর্ষায় পরিসমাপ্তি)
– গোধূলিগগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা
– জানি জানি তুমি এসেছ এ পথে
– তোমার গীতি জাগালো স্মৃতি
– তোমার মনের একটি কথা আমায় বলো
– নীলাঞ্জনছায়া, প্রফুল্ল কদম্ববন
– বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে এসেছি
– শ্রাবণের পবনে আকুল বিষণ্ন সন্ধ্যায়
– সখী আঁধারে একেলা ঘরে
– হে নিরুপমা, গানে যদি লাগে

পূজা-পর্যায়ে-
– আজি নাহি নাহি নিদ্রা আঁখিপাতে
– আমার প্রাণে গভীর গোপন
– গানের সুরের আসনখানি পাতি পথে
– কোথায় আলো ওরে কোথায় আলো
– প্রচণ্ড গর্জনে আসিল একি দুর্দিন
– যে রাতে মোর দুয়ারগুলি
– বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি
– শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে

বিচিত্র ও অন্যান্য-
– দেখা না দেখায় মেশা
– মাটির বুকের মাঝে বন্দী যে জল
– (আমি) শ্রাবণ-আকাশে ওই দেয়েছি পাতি (আখরযুক্ত)

ঠিক সেইরকমই প্রকৃতি পর্যায়ভুক্ত বর্ষার গানেও মাঝে মাঝেই এসে পড়ে ধারাজলের অন্তরালবর্তী কোনও অরূপের রূপমহিমা, অন্য কারও চরণনিক্কনধ্বনি। সে কি কবির প্রিয়তম, না তাঁর জীবনদেবতা? এই প্রসঙ্গে গীতাঞ্জলির একটি গানের উল্লেখ করছি-

আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার,
পরাণসখা বন্ধু হে আমার।
আকাশ কাঁদে হতাশ-সম
নাই যে ঘুম নয়নে মম,
দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম,
চাই যে বারে বার।।

পাণ্ডুলিপি অনুসারে গানটির রচনাকাল শ্রাবণ ১৩১৬, কবি তখন শিলাইদহে বোটে অবস্থান করছিলেন। প্রবল বেগে পূবে বাতাস বইছে, পদ্মা একূল থেকে ওকূল পর্যন্ত তরঙ্গিত- মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে, এমন এক প্রাকৃতিক পরিবেশে তিনি গানটি লেখেন ও দেশরাগে সুরারোপিত করেন। গানটি যখন ‘কেতকী’র অন্তর্ভুক্ত হয়ে গীত হয়, তখন এটি শুধু বর্ষারই গান, কিন্তু যেমনি বলা হল এটি গীতাঞ্জলির গান, এর আরেক আধ্যাত্মিক রূপ চোখের উপর ফুটে উঠল। এখানে বর্ষার মেঘের অন্তরালে যে প্রিয়তমের উল্লেখ কবি করছেন, তিনি প্রভু হতে পারেন, প্রেমিক হতেও বাধা নেই। অতএব এই গীত পূজা বা প্রেম পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে ফেললে কারো আপত্তি থাকবে না- শুধু গায়কের গায়কী, তাঁর নিবেদনের ভঙ্গী আমূল বদলে যাবে।

আরেকটি সুন্দর গান নিয়ে কিছু বলতে চাই। কথা নিচে দিলাম-

কে দিল আবার আঘাত আমার দুয়ারে
এ নিশীথকালে কে আসি দাঁড়ালে খুঁজিতে আসিলে কাহারে।।
বহুকাল হল বসন্তদিন, এসেছিল এক অতিথি নবীন
আকুল জীবন করিল মগন অকূল পুলকপাথারে।।
আজি এ বরষা নিবিড়তিমির, ঝরোঝরো জল, জীর্ণ কুটীর
বাদলের বায়ে প্রদীপ নিবায়ে জেগে বসে আছি একা রে।
অতিথি অজানা, তব গীতসুর লাগিতেছে কানে ভীষণমধুর
ভাবিতেছি মনে যাব তব সনে অচেনা অসীম আঁধারে।।

গানটি প্রেমপর্যায়ের, সেটাই যথাযথ। কবি বলছেন, তাঁর কল্পনার প্রেমিক বা জীবন-দেবতা একবার এসেছিল এক বসন্তের দিনে, প্রাণে অজানা পুলকরাশি জাগিয়ে সে চলে গিয়েছিল কোন কল্পলোকে। আজ হয়ত সে-ই ফিরে এসেছে বর্ষাবিঘ্নিত তাঁর দুঃখরাতের জীর্ণ-কুটিরে। বসন্তের সুখের দিনে তাকে তিনি পেয়েও পাননি। তবে আজ এই নিষ্প্রদীপ অন্ধকারে দুঃখের বেশে ডাক দেওয়া এই অতিথিকে তিনি আপন বলে জেনেছেন, তাই আজ তার সঙ্গে যেতে কবি আর কোন দ্বিধা রাখবেন না।

লক্ষণীয় যে গানের কথায় বর্ষার উল্লেখ রইলেও বক্তব্য কিন্তু অন্য কিছু বোঝাচ্ছে। এখানে বসন্তদিন সুখ আর বর্ষারাত্রি দুঃখের সূচক।

তুলনীয় পূজার দুঃখ-বিভাগের এই গানটি-

আঘাত করে নিলে জিনে,
কাড়িলে মন দিনে দিনে।।
সুখের বাধা ভেঙে ফেলে তবে আমার প্রাণে এলে-
বারে বারে মরার মুখে অনেক দুখে নিলেম চিনে।।

তফাৎ এটুকুই যে ‘দুঃখ’ বিভাগটি কবিকৃত বিষয়বিন্যাসে পূজা-পর্যায়েই রয়েছে, প্রেমপর্যায়ে এমন কিছু নেই। তবে ‘দুঃখ’ বিভাগে এরকম আরও কিছু গান আছে যেখানে ঝড়-বজ্র-বিদ্যুৎ-বর্ষণকে দুঃখের উপমায় প্রয়োগ করা হয়েছে, যেমন- ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ বা ‘বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি।’ সঙ্গত কারণেই গানদুটি পূজা-পর্যায়ভুক্ত, আবার প্রয়োজনে বর্ষার ব্যঞ্জনা আনতেও সক্ষম।

প্রসঙ্গতঃ বলি, পৃথিবীর মধুরতম প্রেমগীতিগুলি বুঝি গাওয়া হয় সঙ্গোপনে, শুধু চোখ আর হৃদয় দিয়ে। এখানে প্রেমিকযুগল বাদে তৃতীয় প্রাণীর উপস্থিতি বাহুল্য, এমনকি গানের কথাও অনাবশ্যক। তবু যেন আসল কথাটি উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে সারাজীবন না বলাই রয়ে যায়। প্রকৃতির বদান্যতায় যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি হয় কী? কবিগুরু-রচিত এই অসাধারণ গানটি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রেমের গান বললে বোধহয় অতিশয়োক্তি হবে না-

এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়,
এমন দিনে মন খোলা যায়-
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরোঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়॥
সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
নিভৃত নির্জন চারি ধার।
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবার –
জগতে কেহ যেন নাহি আর।
সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব।
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব–
আঁধারে মিশে গেছে আর সব।…

এই গান বর্ষা-পর্যায়ে রাখলে কি ক্ষতি ছিল? আমার মনে হয়, এখানে লক্ষ্য প্রেম, উপলক্ষ হল বর্ষামুখর পরিবেশ। উভয়ের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই, নেই কোন মুখ্য-গৌণের বিভেদ।

অনুরূপ একটি গানের কথা বলি, যেখানে প্রেম আছে, বর্ষার মেঘমেদুর আবহ আছে। অথচ প্রেমের আভাস-মাধুর্য আছে মাত্র, না বলা কথাটি বলা হয়নি, পরিবেশের মোহমায়া কবিকে নিয়ে গেছে অন্য এক অরূপের জগতে।

কিছু বলব ব’লে এসেছিলেম,
রইনু চেয়ে না ব’লে॥
দেখিলাম খোলা বাতায়নে মালা গাঁথো আপন-মনে,
গাও গুন্‌-গুন্‌ গুঞ্জরিয়া যূথীকুঁড়ি নিয়ে কোলে॥
সারা আকাশ তোমার দিকে
চেয়ে ছিল অনিমিখে।
মেঘ-ছেঁড়া আলো এসে পড়েছিল কালো কেশে,
বাদল-মেঘে মৃদুল হাওয়ায় অলক দোলে॥

অসামান্য চিত্রকল্প! এ যাবৎ জানতাম যে নারীর সৌন্দর্য সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলার পরিবেশ গড়ে ওঠে অপরাহ্ণের ‘কনে-দেখা-আলো’তে, রবীন্দ্রনাথ এখানে এনেছেন এক অপরূপ সুন্দর উপমা- ‘মেঘছেঁড়া আলো।’ এই আলোকরশ্মির সঙ্গে বিজ্ঞানের তথ্য হাত মিলিয়ে অমর্ত্যলোকের ইন্দ্রধনুর সৃষ্টি করে- সে প্রসঙ্গে কবি যাননি, অথচ দু’টি মাত্র শব্দের প্রয়োগে এমন এক অত্যাশ্চর্য রূপকল্প সৃষ্টি করেছেন যে আকাশও নিমেষহীন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার দিকে।

১৮৯৫ থেকে ১৯২১এর মধ্যে কবি মাঝে মাঝেই খাপছাড়া ভাবে বেশ কিছু বর্ষার গান রচনা করেন যার অধিকাংশই মূলতঃ গীতাঞ্জলির জন্যে, পরে বেশ কিছু ‘কেতকী’ ও গীতবিতানের প্রকৃতি পর্যায়ে সংকলিত হয়। তবে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতরঙ্গিনীতে বর্ষাসঙ্গীতের প্লাবনের সূত্রপাত হয় ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে (সন ১৩২৮)। স্বরাজের উদ্দেশ্যে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের জোয়ারে যখন দেশের রাজনীতিতে উথাল-পাথাল পরিস্থিতি, সঙ্গে ঘনঘোর বর্ষার আবহ, কবির গুণগ্রাহীদের সনির্বন্ধ অনুরোধে ১৭-১৮ই ভাদ্রে কবিরচিত কিছু নতুন-পুরনো বর্ষার গান আর কবিতা আবৃত্তি-সহযোগে কিছুটা অনাড়ম্বরভাবেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বর্ষামঙ্গল আলেখ্য। এই উপলক্ষে কবি রচনা করেন ‘ওগো আমার শ্রাবণমেঘের,’ ‘বাদলমেঘে মাদল বাজে,’ ‘তিমির অবগুণ্ঠনে,’ ‘মেঘের কোলে কোলে,’ ইত্যাদি গানগুলি। দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কাব্য-গীতির অনুষ্ঠানের কবির ভাগ্নি সরলা দেবী-সমেত অনেকেই বিরূপ সমালোচনা করেন, কিন্তু রবি ঠাকুর, যিনি এককালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হাতিয়ার করেছিলেন তাঁর দেশাত্মবোধক সঙ্গীতকে, তিনি স্বভাবতই এতে বিচলিত হননি।

পরের বছর থেকে শান্তিনিকেতনে বর্ষামঙ্গল যেন একটা নিয়মিত বার্ষিক অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে। রবিজীবনে বাইশে শ্রাবণের ভূমিকা সম্বন্ধে একটা পূর্বাভাস দেয় বুঝি ১৯২২-এর (১৩২৯ সন), সে বছর বাইশে শ্রাবণ কবি শান্তিনিকেতনে বর্ষামঙ্গল উৎসব পালন করেছিলেন। সেদিনটা সকাল থেকেই অবিরাম বৃষ্টির ঝমঝম। ’আজ আকাশের মনের কথা ঝরঝর বাজে’ গানটি সেদিনের অনুষ্ঠানে তিনি নিজকণ্ঠে গেয়েছিলেন, আবৃত্তি করেছিলেন ‘ঝুলন,’ ‘বর্ষামঙ্গল,’ ‘নিরুপমা,’ এইসব বর্ষার কবিতা। এই সময় থেকে প্রতিবছর শান্তিনিকেতনের বর্ষামঙ্গল উৎসবকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ বর্ষার গান রচনা করে গেছেন ধারাবাহিকভাবে। এই বার্ষিক বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠানে তাঁর ভক্ত-শিষ্য দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শান্তিদেব ঘোষ আর শৈলজারঞ্জন মজুমদারের দল নতুন নতুন গানের আবদার রাখতেন গুরুদেবের কাছে, তাঁদের সস্নেহ প্রশ্রয় দিয়ে কবি লিখে গেছেন একের পর এক বর্ষাসংগীত। আর এই খেলা খেলতেই তিনি আবহমান-পালিত ভারতীয় সংগীতের চিরাচরিত ছক ভাঙতে শুরু করেন। এ পর্যন্ত তাঁর বর্ষার গানগুলি ছিল প্রথানুকূল দেশ, মল্লার বা মিঞা-নট-মেঘ-পিলু মিশ্র মল্লার রাগাশ্রিত*। প্রথা ভেঙে নতুনকে গ্রহণযোগ্য করে নেয়ার ইচ্ছে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বরাবর ছিল। নতুন নতুন বর্ষার গানে নবধারার সুরসৃষ্টির তাগিদে প্রথাসিদ্ধতার এই অচলায়তন ভাঙতে তিনি সানন্দে অগ্রসর হলেন। তাই তাঁর বর্ষার গানে আমরা প্রচুর পরিমাণে ইমন-ভৈরবী-বেহাগ প্রভৃতি রাগের সুরের এবং তার সঙ্গে সঙ্গে বাউল ও কীর্তন সুরেরও প্রয়োগ পাই, এমনকি রাঢ় অঞ্চলের ঝুমুরের সুরও। তাঁর অচলায়তনকে ভাঙার প্রথম পদক্ষেপ ছিল প্রত্যয়ী সুরের প্রথম বর্ষার গান ‘আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল’। এটি বর্ষার কোনো রাগে নয়, ইমনকল্যাণের আধারে রচনা করেন। গানটি গীতাঞ্জলি পর্যায়ের রচনা, যখন রবীন্দ্রনাথ সুরযোজনার সনাতন পন্থা ছেড়ে রাগসঙ্গীতের বেড়াজালের নিষেধ ভেঙে স্বতন্ত্র হয়ে উঠছেন।

আগেই বলেছি প্রারম্ভিক তিনটি বর্ষার সঙ্গীতের পর কবিগুরু গীতাঞ্জলির জন্যে বেশ কিছু বর্ষার সংগীত রচনা করেন, যেগুলি পরবর্তী কালে পূজা ও প্রকৃতি পর্যায়ভুক্ত হয়। ১৩১৮-’১৯-এ গীতাঞ্জলির রচনা সম্পন্ন হয়। তারপর ১৩২৮ থেকে বর্ষামঙ্গল উৎসব শুরু হয়। অতঃপর রবীন্দ্র-শিষ্যেরা বর্ষামঙ্গলের নামে প্রতিবছর কবির দরবারে আবদার করতে থাকেন বর্ষার নতুন নতুন গানের জন্যে। এই প্রসঙ্গে সঙ্গীতাচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদার রচিত ‘যাত্রাপথের আনন্দগান’ বইয়ে একটি চমৎকার স্মৃতিচারণ আছে। ১৩৪৬ বঙ্গাব্দে বর্ষামঙ্গলের জন্য অনুরোধে অনেকগুলি গান লিখে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

শৈলজারঞ্জন লিখেছেনঃ

১৯৩৯ সাল। বর্ষামঙ্গলের প্রস্তুতি চলছিল। …আমি গুরুদেবকে বললাম যে, ছেলেমেয়েরা বলছে নতুন গান চাই, পুরানো গানে ওরা আর বর্ষামঙ্গল করবে না। গুরুদেব বললেন, এই অল্প সময়ের মধ্যে কি করে আর নতুন গান লেখা যায়। …পরদিন বেলা এগারোটায় গুরুদেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই নতুন লেখা একটি গান হাতে দিলেন। গানটি- ‘ওগো সাঁওতালি ছেলে।’
দ্বিতীয় গান ‘বাদলদিনের প্রথম কদমফুল’ পেলাম তার পরের দিনেই। …পরের দিন আবার কাগজে লিখে দিয়ে এলাম, ‘ইমন,’ পেলামও- ‘এসো গো জ্বেলে দিয়ে যাও’ গানটি। এভাবেই একে একে লেখা হয়েছিল ‘আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে,’ ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে,’ ‘সঘন গহন রাত্রি’ প্রভৃতি।

সেবার বর্ষামঙ্গলের জন্যে তিনি নয়-নয় করে ষোল-কলা পূর্ণ করে ষোলটি নতুন গান উপহার দিয়েছিলেন।

এটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় শেষ বর্ষামঙ্গল। তাই উপলব্ধি করেই বুঝি তিনি লিখে যান ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ গানটি ও মল্লারে সুরবদ্ধ করেন। এই গানটির একটি বিশেষত্ব আছে যা অন্য কোন প্রকৃতির গানে পাওয়া যায় না। সুধীর চক্রবর্তী রচিত ‘রবীন্দ্র অনেকান্ত’ থেকে ঋণস্বীকার করে এই আলোচনা দিয়ে আমার এই লেখার উপসংহার টানতে চাই। সম্পূর্ণ গানটি এরকম-

বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান,
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান॥
মেঘের ছায়ায় অন্ধকারে রেখেছি ঢেকে তারে
এই-যে আমার সুরের ক্ষেতের প্রথম সোনার ধান।
আজ এনে দিলে, হয়তো দিবে না কাল-
রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল।
এ গান আমার শ্রাবণে শ্রাবণে তব বিস্মৃতিস্রোতের প্লাবনে
ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে তরণী বহি তব সম্মান॥

আপাতদৃষ্টিতে বর্ষার গান হলেও আসলে এটি ভক্ত ও ভগবানের, প্রার্থীর ও দাতার, মানব ও প্রকৃতির পারস্পরিক দেয়া-নেয়ার গান। ‘বলাকা’ কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাটি দেখুন, এ গানের বড় কাছাকাছি যায়-

…আর সকলেরে তুমি দাও,
শুধু মোর কাছে তুমি চাও।
আমি যাহা দিতে পারি আপনার প্রেমে,
সিংহাসন হতে নেমে
হাসিমুখে বক্ষে তুলে নাও।
মোর হাতে যাহা দাও
তোমার আপন হাতে তার বেশি ফিরে তুমি পাও।

মনে পড়ে এই বইয়েরই ‘শাজাহান’ কবিতায় তাজমহলের স্রষ্টার জয়গান গেয়েছিলেন কবি- “তোমার সৃষ্টির চেয়ে তুমি যে মহৎ।” এখানে কবি বিশ্বস্রষ্টাকে উপযুক্ত স্বীকৃতি দিয়েও রচনার উৎকর্ষেই যে রচয়িতার পরম সার্থকতা, তারই দাবি রেখেছেন।

তবু প্রশ্ন জাগে,

প্রকৃতিজ যা কিছু তার চেয়েও বড় কি মানুষের সৃষ্টি? ‘মেঘের ছায়ায় অন্ধকারে রেখেছি ঢেকে তারে’ অংশে সুরের ক্রমোচ্চ ঊর্ধ্বায়ন এই গানে এমন কথা বোঝাতে চায় যেন পুষ্পসম্পদকে অতিক্রম করে অনেক অপ্রাপণীয় স্তরে রাখা আছে আপন গানের গূঢ় সঞ্চয়, বাদল দিনের সীমায়িত সময়ে ফোটে যে কদমফুল তার চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী অনেক শমিত অঙ্গীকারময় শ্রাবণের গান, যা মনুষ্যরচিত। কদম ফুটেছে আবার ঝরে যাবে কিন্তু গান চিরঞ্জীব। যাকে বলে নেচারের ওপর আর্টের জয়। তাঁর গানটি সব ঋতু পেরিয়ে গেছে।

যখন সজল হয় বাতাস, তখন মনে হয় এমন গানেই বুঝি মিশে যায় পুরুষ এবং প্রকৃতি, চিরবিচ্ছেদের, বেদনার অন্তরালে এই নিবিড় মিলনের জন্যই তো বার বার ফিরে এসে বলা— ‘আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।’

পরিশেষে উপযুক্ত শিল্পীরা কিভাবে রবীন্দ্রসৃষ্ট এই বর্ষার গানগুলিকে অমর করে গেছেন, তাই নিয়ে দু-চারটি কথা বলে প্রবন্ধটি শেষ করছি। কবিগুরু-রচিত কয়েকটি বর্ষার গান বাঙালির পরম প্রিয় কয়েকজন শিল্পীর কণ্ঠে অমর হয়ে আছে। ‘বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে এসেছি’ আর ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’ দুটি গানে বর্ষার আবহ থাকলেও এগুলি প্রেম পর্যায়ভুক্ত। ভোলা যায় কিংবদন্তী পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে গানদুটির অসামান্য পরিবেশন? ‘আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল’ তে হেমন্ত সঞ্চারীর ‘সৌরভে প্রাণ কাঁদিয়ে তোলে ভিজে বনের ফুল’ অংশে যেন সত্যি সত্যি শ্রোতাদের চোখে আনন্দাশ্রু এনে দেন। গানে নাটকীয়তা আনতে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সুচিত্রা মিত্র, তাঁর উপমা এক্ষেত্রে টানলে কূল পাওয়া যাবে না। তবে এ বিষয়ে পীযূষকান্তি সরকার কম যান না। ‘আমি তখন ছিলেম মগন গহন’ গানটিতে ‘আমার দেহের সীমা গেল পারায়ে’- এই সঞ্চারী অংশটির সুরের সাথে অন্তরা এবং আভোগের সমন্বয়ের অত্যন্ত মাধুর্যপূর্ণ দিকটি তিনি বিস্ময়করভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। শ্যামল মিত্র রবীন্দ্রসংগীত কম গাইলেও তাঁকে মনে রাখা যায় ‘আবার এসেছে আষাঢ়’ গানে।

কণ্ঠের বলিষ্ঠতা আর উচ্চারণের স্বচ্ছতা দিয়ে গানের অন্তর্লীন বাণীর চিত্ররূপ দেওয়ার কাজে অনন্য ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস। রবীন্দ্রনাথের দেহাবসানের এতকাল পরেও তাঁর সংগীতের আজকের এই বহুল জনপ্রিয়তার সিংহভাগের কৃতিত্ব তাঁকে দিলেও তা অতিশয়োক্তি হবে না। ‘এসো গো জ্বেলে দিয়ে যাও’ গানটির কথা ধরা যাক। দেবব্রত বিশ্বাস গেয়েছেন তাঁর মন্দ্রসপ্তক-নির্ভর নিনাদে। ‘নামিল শ্রাবণ সন্ধ্যা’ গাইবার সঙ্গে সঙ্গে যেন জমাট অন্ধকারের মাঝে এক পশলা বৃষ্টির আমেজ। ‘বিজন ঘরের কোণে,’ ‘কালো ছায়া’ শব্দবন্ধের উচ্চারণে শ্রাবণ সন্ধ্যার নির্জনতার ছবিখানা স্পষ্ট হয়ে ওঠে একটু একটু করে। বর্ষণমুখর সন্ধ্যার অন্তরালে এই একা হতে পারার, নিজেকে খুঁজে পাবার এক গভীর চেতনা মূর্ত হয়ে ওঠে তাঁর পরিবেশনায়।

গানটি সাগর সেন, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় ও আরও অনেকেই গেয়েছেন। পরে এই গান আবারও গেয়েছেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, আশিস ভট্টাচার্য প্রমুখ। হেমন্ত গেয়েছেন ১৯৭০ সালে এক অনাড়ম্বর অথচ অতলস্পর্শী ঈশ্বরীয় কণ্ঠস্বরে, ডাক দিলেন, ‘এসো গো…।’ চমকে তাকাল শ্রোতা, সাড়া দিল তার সমগ্র চিত্ত.. এখানেও শিল্পী বহিরঙ্গে আত্মগত, একা, কিন্তু অন্তরঙ্গে তিনি এক অপার্থিব সংলাপ রচনা করে চলেন যেন এক পরম বাঞ্ছিতের উদ্দেশে- যার জন্য তাঁর ‘নিভৃত প্রতীক্ষা’ এমন অপরূপ হয়ে ওঠে। বর্ষার রাতে বাঁশি শুনে যেমন প্রত্যেক গোপিনী ভেবেছিলেন, এ বাঁশি কেবল তাকেই ডাকে। এ গানে অবশ্য ‘হারিয়ে গেছে মোর বাঁশি, আমি কোন সুরে ডাকি তোমারে…।’ তাই বুঝি ‘পথে চেয়ে থাকা’ দৃষ্টি দিয়েই ডাক দিতে হয় তাঁকে সেই মনের মানুষ ঠিকই শুনতে পাবেন সে অব্যক্ত বাণী।

সব শেষে শ্রদ্ধেয় মান্না দে-র আত্মজীবনী থেকে একটি ঘটনা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। মান্না ছিলেন মূলতঃ আধুনিক সংগীতের গায়ক, কিন্তু হৃদয়-গহনে বিরাজ করত শুধু রবীন্দ্রসংগীত। তিনি একদিন কথায় কথায় গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলছিলেন রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীর ভাষা ও আবেদন সম্পর্কে। বলছেন-

লেখার কয়েক লাইন পড়তে না পড়তেই চোখের সামনে দেখতে পাবেন সে দৃশ্যটা। আমি যখনই গাই- ‘নাই, রস নাই, দারুণ দহনবেলা’- তখন যেন সেই রোদে পোড়া গরমের একটা হলকা হাওয়া এসে গায়ে লাগে। আবার যখন গাই বা শুনি- ‘শ্রাবণের গগনের গায়’- মনে হয়, সেই শ্রাবণের বাদলধারার একটা ভিজে বাতাসের ছোঁয়া পাচ্ছি দেহে, মনে। (জীবনের জলসাঘরে)

এই সূত্র ধরে পুলক লেখেন তাঁর বহুশ্রুত গানটি- ‘গহন মেঘের ছায়া ঘনাইয়া সে আসে, ঐ আসে,’ যা মান্নার কণ্ঠে বিখ্যাত হয়ে আছে প্রভাস দে-র সুরে।

* শাঙন গগনে- পিলু মল্লার
গহন ঘন ছাইল ও ঝর ঝর বরিষে- মেঘমল্লার

শিক্ষা- ইঞ্জিনিয়ারিং, কর্মসূত্রে ভারত ও অন্যান্য দেশের পেট্রোলিয়াম তৈলখনি অঞ্চলে কাটিয়েছেন সারাজীবন, সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত। লেখালেখি শুরু হয় ২০১১তে কম্প্যুটারে বাংলা ফন্টের আমদানির সূত্র ধরে, ‘অবসর’ সমেত বিভিন্ন নেট-পত্রিকা ও বম্বে ডাক, পশ্চিমঘাট ইত্যাদি মুদ্রিত পত্রিকায় গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। গত ২০২২ থেকে তিনটি ছোটগল্পের ও একটি প্রবন্ধের সঙ্কলন প্রকাশিত হয় এযাবৎ। দুটি নেট পত্রিকার সম্পাদনার কাজে যুক্ত আছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *