পিতা

পিতা

বাবা। মেয়ের বাবা। কেমন ভাবে আসে এই চরিত্রটি সাধারণ সিনেমার পর্দায়? বিশেষ করে, হিন্দি সিনেমার কথা যদি ভাবি?

একটি ধারা আছে, অত্যন্ত স্নেহময় বাবা, মেয়ে তার আদুরে ‘পাপা-কি-পরী’। কিন্তু এই মেয়ে যেই একটি গরীব ছেলের প্রেমে পড়ে, অমনি এতদিনের প্রশ্রয়ের মুখোশ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে পিতৃতন্ত্রের সাবেক চেহারা। বাবা হুংকার ছাড়েন, “তোমায় এত স্বাধীনতা দিয়েছি মানে এই নয় যে তুমি যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াবে!”

আরেকটি ধারা, গোবেচারা পিতা, তাঁর মেয়ের মূল্য ধার্য হয় দহেজের পরিমাণে, উনি সেটা মেনে নেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেই পরিমাণ অর্থ জোগাড় করে উঠতে পারেন না বলে পাত্রপক্ষ বিয়ের আসর ছেড়ে উঠে যায়। মাথার পাগড়ি খুলে বেয়াইয়ের পায়ে রাখেন মেয়ের বাবা। বিয়ে ভেঙে গেলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে তাঁর মেয়ের! দয়াভিক্ষা করেন তিনি। ঘোমটার নীচে সজল চোখে সেই দৃশ্য দেখে নীরব কন্যা।

এই দুই চলতি ধারার বাইরে একটি অন্য রকম বাবার চরিত্র দেখার সুযোগ হল। যে বাবা মেয়েকে স্বাধীনতা দেওয়ার দম্ভ করেন না। কারণ সেই স্বাধীনতাকে মেয়ের স্বাভাবিক অধিকার বলেই মনে করেন যে উনি। আর বিয়ে ভেঙে গেলে জীবন বৃথা – নাহ, তেমনটাও তাঁর মনে আসে বলে তো মনে হয় না।

মন ভরিয়ে দেওয়া সেই সিনেমা, এমন সিনেমার সেই পিতার চরিত্রটির কথা বলতে এলাম।

 চলচ্চিত্র: Thappad/থাপ্পড় (হিন্দি)

চরিত্র: নায়িকা অমৃতার পিতা, অভিনেতা কুমুদ মিশ্র

————————————————————–

অমৃতা নামের মেয়েটি গৃহবধূ। তার স্বামীর প্রচন্ড ব্যস্ত কর্মজীবনের সাফল্যের জন্য পদে পদে তাকে সাহায্য করা, সকাল থেকে রাত অবধি ঘরের কাজ, শাশুড়ি মায়ের দেখভাল, এই ভাবেই কেটে যায় তার সুখী সংসারের দিনগুলি। মানে, তার সংসারটা সুখী বলেই তো সে জানত। একটা আচমকা ধাক্কা লাগে তার সেই জানায়, যখন বাড়িতে একটি পার্টিতে ঘরভর্তি অতিথির সামনে তার স্বামী তাকে একটি থাপ্পড় মারে।

অকস্মাৎ এই আঘাতে দিশেহারা অমৃতার চোখ ভিড়ের মধ্যে তার বাবাকে খোঁজে। চোখাচোখি হয় বাবা-মেয়ের। তখন কিছু বলে উঠতে না পারলেও বাড়ি ফিরে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন, যেন মেয়ের আঘাত নিজের দেহে ধারণ করে জ্বর আসে তাঁর । স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেন, “জামাই মেয়ের গায়ে হাত তোলে, তুমি জানতে?” এই বিচলিত বাবা কিন্তু মেয়ের ফোন পেয়েই গলায় প্রত্যয়ের সুর এনে বলেন, “আমি ঠিক আছি… তুই ঠিক আছিস তো, আমরা তো strong, তাই না রে মা?”

মেয়েটি সেদিনের অপমানের জ্বালা ভুলতে না পেরে কিছুদিনের জন্য পিতৃগৃহে আসার পরিকল্পনা করে। তার নিতান্ত সংসারী মা, তার আধুনিক ভাই, সবাই জানতে চায় – কেন? শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আসা কেন? কী এমন আর হয়েছে! বাবা, শুধু তার বাবা বলেন, “নিজের বাড়ি আসবে মেয়ে, তার আবার এত কৈফিয়ত দেওয়ার কী আছে!” নিজের বাড়ি। বিয়ের পরেও এটা তার নিজের বাড়ি। কটা মেয়ের যে এইটুকু শোনার সৌভাগ্য হয় আজকের দিনেও!

যে মেয়েটি রোজ অ্যালার্মের শব্দে ঘুম থেকে উঠে শ্বশুরবাড়ির সবার মুখে মুখে চা ধরত, আজ বাবা তাকে চা করে দেন। সারাদিন দাবা খেলে, হাসিঠাট্টা করে মেয়েকে সহজ করে তুলতে চান। ওদিকে সংসারটা অমৃতাকে ছাড়া অচল হয়ে পড়েছে, তাই জামাই তাকে ফেরাতে আসে। শ্বশুরমশাইকে সে বলে তাঁর মেয়েকে বোঝাতে যে হঠাৎ এমনটা হয়ে গেছিল সেদিন। অমৃতার বাবা জামাইয়ের সামনে গলা তোলেন না, মৃদু স্বরে শুধু জানতে চান, “হয়ে গেছে তো বুঝলাম, কিন্তু এমনটা হল কেন?” 

অতি সফল, উচ্চবিত্ত, প্রতিবার দেখা হলেই প্রণাম করা অতি ভদ্র জামাইয়ের কাছে এর উত্তর নেই কোনো।

অমৃতা ফেরে না, ফিরিয়ে দেয় স্বামীকে। এই নিয়ে যখন অশান্তি হয়, অমৃতার ভাই যখন তার হবু স্ত্রীকে অমৃতার পাশে দাঁড়ানোর জন্য ভর্ৎসনা করে, ধমক দেয়, ধাক্কা দেয়, তখন সেই মৃদুভাষী বাবা বাঘের মত এসে দাঁড়ান হবু পুত্রবধূর পাশে। মেয়েদের অসম্মান তিনি বাড়িতে বরদাস্ত করবেন না –  সে কন্যা হোক বা পুত্রবধূ। তাঁর পুত্র মেয়েটির কাছে ক্ষমা চাইবে, নাহলে বেরিয়ে যেতে পারে বাড়ি ছেড়ে।

ঘটনা জটিল হতে থাকে। অমৃতার মনে হতে থাকে, কেউ যেন বুঝছে না তার অপমানের জ্বালাটা, শুধু তার বাবা ছাড়া। সবাই বলে, “একটা ছোট্ট ভুল, ভুলে যাও, মানিয়ে নাও, মেয়েদের মানিয়ে নিতে হয়।” মাঝে মাঝে একা ঘরে বসে ছোটোবেলার ছবি দেখে, যেগুলো বাবা পুরোনো অ্যালবাম ঘেঁটে উদ্ধার করেছেন তার জন্য। সেই হাসিখুশি মেয়েটাকে দেখে, আর ভাবে। বাবা বলেন, “নাচটা না ছাড়লেই পারতিস।” কিন্তু সে তো ভেবেছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গৃহবধূ হবে। নাচ বা কেরিয়ারের ইচ্ছে ছাড়তে সত্যি কষ্ট হয়নি তার। স্বামীর ভালোটা নিজের ভালো মনে করে সে তো খুশিই ছিল। চোরাবালির ওপর ঘর বেঁধেছে, বোঝেনি তো সে!

চারপাশে সবার কথা শুনে একবার দ্বিধাও হয় মনে। এই দ্বিধা এই সংশয়ের নিরসন করতে কার কাছে যাবে সে, আর কে বোঝে তাকে এত ভালো করে, তার বাবা ছাড়া?

তাই অমৃতা বাবাকে প্রশ্ন করে, “আমি ঠিক করছি তো বাবা?”

বাবা কোনো ঠিক ভুল নিদান দেন না। নিজের মতামত মেয়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়াতে কোনোদিনই বিশ্বাস করেননি তো উনি। শুধু বলেন, “যা করছ, নিছক জেদের বশে করছ না তো? হৃদয়ের ভিতর থেকে, একেবারে ভিতর থেকে আসছে তো তোমার এই বিশ্বাস? তাহলেই হবে। তবে মনে রেখো, ঠিক কাজের ফল অনেক সময় সুখী করে না। ঠিক আছে, না করুক, কাজটা তো করতে হবে!”

বাবার সত্ত্বায় এমন মিশে গেছেন অভিনেতা, প্রকৃত আধুনিক, এত সংবেদনশীল মানবিক এই চরিত্রটি, যে সিনেমায় তার নাম কী ছিল খেয়াল থাকে না। শুধু প্রতিটি মেয়ে চায় সুখে দুঃখে এমন বাবা যদি তার পাশে থাকত!

মেয়ের জন্মের সময় বাবা একটি কবিতা পড়ছিলেন, নাম অমৃতা, সেই নামেই মেয়ের নাম। বিবাহবিচ্ছেদ মামলার শেষ দিনে, আদালত যাওয়ার সময় মেয়েকে সাহস জোগাতে আবার সেই কবিতাটি শোনান বাবা মেয়েকে।

হ্যাঁ… আঁচল উড়িয়ে আকাশ মেলেছি আমি
যদি পথভ্রষ্ট হই… যদি শ্বাস থেমে আসে… যদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলি নিজেকে…
তুমি দিকে দিকে খুঁজো আমায়… যদি পাও জড়িয়ে ধরো বুকে
কিন্তু আমার আকাশ আমায় ফেরত দিও।
তোমার একটা আকাশ থাক।
আমার থাক নিজের একটা আকাশ।
আমারও থাক… নিজের একটা আকাশ

নিজের একটা আকাশ খুঁজতে বাবাই তো শিখিয়েছেন অমৃতাকে।

<অবসর পিতৃদিবস ইভেন্টে পুরস্কৃত লেখা>
চিত্রঋণ: অন্তর্জাল
আনন্দিতা চৌধুরীর জন্ম বেড়ে ওঠা কলকাতায়, তবে গত দুই দশক ধরে ঘর বেঁধেছেন নিউ জার্সিতে। তাই তাঁর লেখাতে যেমন উঠে আসে বাঙালি মধ্যবিত্ত যাপনের রোজনামচা, তেমনই থাকে প্রবাসী মনের টানাপোড়েন। পেশার ক্ষেত্র লাইব্রেরি, বইয়ের সঙ্গে কাটে দিন। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা সারাদিন। মানুষ দেখা, মানুষের কথা শোনা, মানুষের গল্প লেখা তাঁর নেশা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *