ওদের স্বচ্ছন্দ জীবন

ওদের স্বচ্ছন্দ জীবন

“পর পর খোপগুলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যায় আজকাল।”
একভাবে তাকিয়ে থেকে ঘোলাটে হয়ে আসে দৃষ্টি।
“কেন যে কিছুতেই গুটির চাল মনে রাখতে পারি না! সোজাসুজি কোণাকুণি কে কতো ঘর!”
উল্টোদিকের চেয়ারে ওয়ার্নার সিনড্রোমের মানুষটা বসে। কোঁচকানো ভুরু থমকে থাকে তার। তারপর বিকৃত হাসিমুখে গর্জন করে ওঠে ,”কিস্তিমাত!”
আমি অপ্রস্তুত হাসি। বোর্ড উল্টে দিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে আরো কতো কী। আগে সুস্থ ছিল। রোগে ক্রমেই শেষ হয়েছে স্কুলজীবন। থেকে গেছে শুধু দাবাখেলাটা।
হারলে পিস্তল বের করে মাথায় গুলি চালিয়ে দিতে পারেন মানসিক ভারসাম্যহীন প্রাক্তন দাবার চ্যাম্পিয়ন এই মানুষটি। যেন চৌষট্টি খোপের রাজা সে। উন্নাসিক, স্বৈরাচারী, স্বেচ্ছাচারী। তাই তাকে রক্ষার দায়িত্ব আমার। আমি মন্ত্রী। আমি মরেকুটে সকলকে রক্ষা করি। আমি বোড়ে। তাই সাদাকালোই আমার মালিক। এখন আমার হারাতেই জিৎ। ওর চিকিৎসা দরকার।
দেশ, কাল, সময়ের গণ্ডী ছাড়িয়ে একটা খেলা, যাকে বিশ্লেষণ করলে ফুলের পাপড়ির মতো ছড়িয়ে পড়ে রঙিন নানা দিক। বিলিয়ে যায় গন্ধ। সে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যেমন উপরে বর্ণিত ঘটনাক্রম আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কেন একজন মানসিক বিকারগ্রস্তের কাছে দাবার ভাষা, তার অঙ্গ সঞ্চালন অপরিহার্য। তাকে ঘেরাটোপে ঘিরে রেখে পৃথকভাবে শান্তি পৌঁছে দিয়েই তার আনন্দ। ঠিক যেমন পুরাকালে রানি মন্দোদরী সারাক্ষণ যুদ্ধে ব্যস্ত স্বামী রাবণকে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্তি দিতে তাঁকে নিয়ে আসতেন দাবার আঙ্গিনায়। দাবা খেলতেন স্বামীর সঙ্গে। যুদ্ধ বা লড়াই বন্ধের উদ্দেশ্যে এই ভারতবর্ষেই তাঁর হাত ধরে দাবা খেলার প্রচলন।
শরীরের কসরত নিয়ে অনেক কথাই শোনা যায়। কিন্তু মনের কসরত? দাবাখেলা এ ব্যাপারে দুরন্ত কাজের। এটি মনোবিজ্ঞানী ও মনোবিশারদের রিসার্চ মতে মনের ব্যায়ামাগার। মূলত ডিপ্রেশন, ডিমেনশিয়া ও অ্যালঝাইমার্স রোগের ‘জিমনেসিয়াম অফ দ্য মাইন্ড।’ নেশার প্রক্রিয়াকরণ হলে বিশ্বের জন্য এটি ইতিবাচক ড্রাগ।
বুদ্ধি এবং কৌশলী চাল, দুয়ের দুরন্ত সমন্বয় ঘটে এই খেলায়। সকলেই মনে করেন, দাবা মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। দীর্ঘক্ষণ ধরে ফোকাস ধরে রাখা এই খেলার বৈশিষ্ট্য। স্মরণশক্তির ধার বাড়াতেও উপকারী। কোন চালে প্রতিপক্ষকে কী ভাবে মাত দেওয়া যাবে, সেটা মনে রাখার জন্য স্মৃতিশক্তির চর্চা জরুরি।
প্রবলেম সলভিং বা সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ে নিয়মিত দাবা খেলায়। যে কোনও পরিস্থিতি নিয়ে কী ভাবে ভাবতে হবে,সেটা শেখায় দাবা।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, দাবাখেলা আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে। যেহেতু খেলার সময় সিদ্ধান্ত খেলোয়াড়ের, তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ে।
এমনও দেশ আছে যেখানে দাবা খেলা স্কুল থেকেই বাধ্যতামূলক।
এমনও দেশ আছে যেখানে দাবাড়ুরাই দেশের সবচেয়ে বড় তারকা।
ইউরোপের আর্মেনিয়া এমনই এক দেশ যেখানে ছ-বছরের ওপর সকল শিশুদেরকেই দাবা খেলা শেখানো হয়।
কর্তৃপক্ষ মনে করেন ছোটবেলা থেকে দাবা খেললে শিশুরা বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাবে, যা ভবিষ্যতে চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে কাজে দেবে।
যেকোনও বিষয়ে বিশ্লেষণ করতে, শিশুটিকে স্পষ্ট ধারণা পেতে সাহায্য করবে দাবাখেলা।
শিশুদের দাবা কৌশলী হতে শেখায়। দাবা খেলে যারা, তাদের রিডিং ও আইকিউ টেস্টের স্কোর ভালো হয়। এটা শুধু চিন্তার গভীরতা, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি, হিসাবনিকাশ ও মনোযোগ আনতেই সাহায্য করে না, এটা বাচ্চাদের নিজের দায়িত্ব নিতেও শেখায়। সামাজিক ভেদাভেদ ভুলে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে।
দাবা খেলাটাকে অনেকে প্রতিপত্তির প্রতীক হিসেবে দেখলেও অলিম্পিক্সের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। দাবাখেলা নাইজেরিয়ার একটি বস্তিতে স্বস্তি নিয়ে এসেছিল কারণ 2018 সালে চেজ ইন স্লামস আফ্রিকা নামে একটি সফল উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
আবার অপরজনের কাছে এ বিমূর্ত কৌশল খেলা নিঃশব্দ ভালবাসার সমর্পণ। কারণ তা কোনও গোপন তথ্য ও গোপন সুযোগের উপাদান রাখে না।
দাবা বা তার অপর নাম শতরঞ্জ, এ খেলার বোর্ডে বর্গাকৃতি চৌষট্টি টি সাদা-কালো ঘর থাকে। ঘরগুলোতে প্রতিটি খেলোয়াড়ের একটি করে রাজা, মন্ত্রী, দু’টি করে নৌকা, ঘোড়া ও গজ এবং আটটি করে বোড়ে সহ মোট ষোলোটি গুটি থাকে। অর্থাৎ, দু’জন খেলোয়াড়ের সর্বমোট বত্রিশটি গুটি থাকে।
আবার এই দাবাই হয়ে ওঠে কারোর রুজিরুটির খোঁজ। এ খেলার ট্রেনারদের অক্লান্ত পরিশ্রম পৃথিবী জুড়ে রেখেছে তার নিদর্শন।
দাবার নথিভুক্ত ইতিহাস অন্তত সপ্তম শতাব্দীর। ভারতে চতুরঙ্গ নামে একটি অনুরূপ খেলার আবির্ভাব হয়েছিল। পারস্যে প্রবর্তনের পর এটি আরব দুনিয়া, তারপর ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমশ বিস্তৃত হয়েছে চিন ও জাপানে। বিশুদ্ধ নামে যোগ হয়েছে ডাকনাম। দাবা খেলার নিয়ম আজ যেভাবে পরিচিত, তা ইউরোপে পনেরো শতকের শেষের দিকে আবির্ভূত হয়েছিল। উনিশ শতকের শেষের দিকে প্রমিতকরণ এবং সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা সহ রমরমিয়ে চালু হয় খেলাটি। বর্তমানে দাবা হল ক্রীড়াপিয়াসী বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা।
একটি দাবা খেলার ম্যাচে তিনটি স্বীকৃত পর্যায় রয়েছে। উদ্বোধন, যেখানে কেন্দ্রের অংশ বিকাশ এবং নিয়ন্ত্রণ প্রাধান্য পায়। প্রথম দশ-বারোটি চাল। সেই দশ থেকে বারোটি চালের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নাম আছে পজিশন ভেদে। যেমন,সাদা গুটির রাজার দিকের ঘোড়া শুরুতেই বের করলে সেটিকে বলা হয় ‘রেটি’ ওপেনিং। রিচার্ড রেটি নামক জনৈক মাস্টারের নামানুসারে।
সেরকমই ‘গিয়াকো পিয়ানো’ যার অর্থ কোয়াইট গেম, দাবার ‘ওপেনিং’এর অন্যতম একটি ‘ভ্যারিয়েশনের’ নাম।
মিডলগেম, যেখানে প্রতিপক্ষের রাজা বা দুর্বলতার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা এবং আক্রমণে কৌশল করা হয়।
এবং শেষ খেলা, যেখানে সাধারণত বিভিন্ন টুকরা বিনিময় হয়। মন্ত্রী হল দাবা খেলার সবচেয়ে শক্তিশালী গুটি।
বাংলাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছিলেন দাবাড়ু গ্রান্ডমাস্টার সূর্যশেখর গঙ্গোপাধ্যায়। ‘বিস্ময় বালক,’ ‘খুদে প্রতিভা’ ইত্যাদি তকমা পেলেও লড়াইটা কিন্তু তার সহজ ছিল না। চরম বাধা পেরিয়ে তবেই এসেছিল সাফল্য। শূন্য থেকে শুরু করে তাঁর সেই আকাশছোঁয়ার ছকভাঙা গল্প আমাদের চমৎকৃত করে।
সূর্যশেখরের ছোটোবেলায় এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের বাগানে তিনবার ক্রিকেট বল ফেরতের শর্ত ছিল তিনবার দাবা খেলা। অসমবয়সী প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়ে কিছুক্ষণের জন্য বৃদ্ধের হারিয়েছিল একাকিত্ব। অজানা খেলায় তিনবারের সেই জিত ছিল সূর্যশেখরের কাছে দাবার হাতেখড়ি। প্রশিক্ষণহীন প্রতিভা দেখে অবাক হয়েছিলেন ভদ্রলোক। কখনও যে কোনও অবাস্তব এবং উদ্ভট খেয়াল চমৎকারভাবে বিশ্বাসযোগ্যতা পায়। চরম চঞ্চল ছোট ছেলেটি দাবার কোর্ট এ শান্ত হত দেখে পাঁচবছরে তার হাতেখড়ি হয়।
পরবর্তী সময়ে সূর্যশেখর তার সীমিত আর্থসামাজিক পরিস্থিতি থেকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত নিজের জীবনকে একে একে বিশ্লেষণ করেছিলেন দাবার পরিপ্রেক্ষিতে।
প্রকৃতপক্ষে দাবা খেলাটা জীবন খেলার বা জীবন দর্শনের নামান্তর মনে হয় আমার কাছে।
দাবা খেলায় প্রথমত দুটি পক্ষ থাকে। আমাদের জীবনের দুটি পক্ষ হলো আমরা এবং পৃথিবী।
গুটি চালাগুলো হচ্ছে কর্ম-সম্পাদন। আমাদের কাজ সম্পাদনের সঙ্গেই পৃথিবী তার ফিডব্যাক দিচ্ছে। দাবা বোর্ডের সৈন্যগুলো সেক্ষেত্রে প্রতিদিনকার কাজকর্ম অর্থাৎ ছোট ছোট সিদ্ধান্তসমূহ। যেগুলোর প্রত্যুত্তর হিসেবে ছোট-ছোট ফলাফলগুলো।
রয়েছে দুটি করে হাতি,ঘোড়া ও নৌকা। এগুলো হতে পারে আমাদের জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি ও বড় সিদ্ধান্তসমূহ। হাতি,ঘোড়া ও নৌকা অবশ্যই সৈন্যদলের থেকে বেশি শক্তিশালী। আমরা প্রতিদিন ছোটোর সঙ্গে বড় সিদ্ধান্তের কাজও করে থাকি। যার ফলাফলটাও আসে সমমানের।
আমরা রাজার আসনে রয়েছি এবং মন্ত্রী সর্বদা সহযোগিতা করছে। মন্ত্রী সকল ধরনের ক্ষমতার অধিকারী এবং কিছু ক্ষেত্রে রাজার থেকে অগ্রগামী। আমাদের বুদ্ধিমত্তা আমাদের থেকে অবশ্যই বেশি শক্তিশালী। আমরা আবেগ বা কর্ম দিয়ে যতটুকু করতে পারি বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তারও বেশি করতে পারি। তাই মন্ত্রী ও রাজার চালগুলো আরো বেশি তীক্ষ্ণ, গুরুত্বপূর্ণ।
অপরদিকে পৃথিবী প্রতিনিয়ত ছোট-বড় চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে আবার জীবন-মরণ প্রশ্নের সম্মুখীনও করছে। পৃথিবীরও রয়েছে এমন কিছু চ্যালেঞ্জ, যা ভীষণ শক্তিশালী ও জীবন লণ্ডভণ্ড করে দেয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন।
জীবনে বড় সঙ্কটগুলো আসে ছোট ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। দাবা খেলায়ও বড় সঙ্কটে পড়ার পেছনে থাকে ছোট চালের ভুল। সৈন্য গুটিগুলো কম ক্ষমতা সম্পন্ন হলেও তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ।
হয়তো খেলার শুরু থেকেই ভুল চালে জর্জরিত আপনি। প্রতিপক্ষ আনন্দে আক্রমণ করছে। একে একে হাতি, ঘোড়া সব হারিয়ে রক্ষাকবচ মন্ত্রীও মারা পড়েছে। তার মানেই কি হেরে যাওয়া? দাবাখেলা অদ্ভুত, পরিস্থিতি ঘুরতে সময় লাগে না। জীবনও তেমনি। ব্যর্থতার বদলে সফলতা আসতে পারে যখন-তখন। সুতরাং দাবায় প্রতিটি চালের মতো জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ ভেবেচিন্তে এগোতে হবে।
মাত্র উনিশ বছর বয়সে দেশের সপ্তম গ্র্যান্ডমাস্টার হন সূর্যশেখর। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দাবায় চল্লিশটি সোনা জিতেছেন। দুহাজার পাঁচ সালে পেয়েছেন অর্জুন পুরস্কার। ছ’বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। বিশ্বনাথন আনন্দকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জিততে তাঁর টিমে সহকারী হিসেবে ছিলেন তিনি।
নয়ের দশকে দাবাকে ঘিরে যে ঔদাসীন্য, বঞ্চনা, জাতীয়তাবাদ, সেই প্রেক্ষাপটে রেখে সেই বৈষম্যকে তুলে ধরেছে তার জীবনের আধারিত সিনেমা ‘দাবাড়ু।’ দর্শককে মনে করিয়ে দিয়েছে দাবার ইতিহাস ও সুপ্রাচীন ঐতিহ্যকে। সেটা যে জুয়া খেলার সমার্থক নয়, সেই বস্তাপচা ধারণা নির্মূল হয়েছে।
অনেকে দরিদ্র হন এতটাই যে শৈশবে একটা দাবার বোর্ডও কেনার সামর্থ্য থাকে না। আবার কেউ একমাত্র ভারতীয় দাবাড়ু হন যিনি তিনবার ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করেন পরপর।
এ লেখাটি বিচ্ছিন্ন-অবিচ্ছিন্নভাবে সাজালাম। নিজেই হয়ে উঠল আপনায় আপনি স্বাধীন। অর্থাৎ লিখলাম দাবাখেলার প্রতি চরম ভালবাসা থেকে। আর ভালবাসা কবেই বা খুব গোছানো, বিন্যস্ত ছিল!

অবসর পত্রিকা গ্ৰুপের ইভেন্টে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *