দাবাকাহন
আশৈশবই স্বভাব-আহ্লাদী আমি, তাই লম্ফঝম্ফ খেলাধুলায় প্রীতি ছিল কম। তবে হ্যাঁ, পুতুল খেলতে ভালোবাসতাম বেশ, নানান নিধি পুতুলও ছিল আমার। মেমপুতুল, বৌপুতুল, বরপুতুল, আরও কত কী।
সময়টা সম্ভবতঃ পুজোর ছুটি, পঞ্চমশ্রেণীর ছাত্রী। দেশের বাড়ি গিয়েছি। বিশাল ঠাকুরদালানের সাদা-কালো চৌখুপির একপাশে চোখে পড়েছিল একটি বর্গক্ষেত্র আকৃতির ছক, একটু অন্যধরনের ডিজাইন।
তখন সদ্য বড় হওয়ার কাল, সব বিষয়েই অগাধ আগ্রহ। মুশকিল আসান বাবার কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম বৃত্তান্ত।
“ওটা কী গো?”
“বাঘবন্দী খেলার ছক।”
“সে আবার কী?”
“ওটা একধরনের খেলা। সারাদিনের কাজের শেষে, গ্রামের মানুষেরা গুটি সাজিয়ে সন্ধ্যার মজলিসে খেলে। বুদ্ধির খেলা, অনেকটা দাবার মতো। প্রায় সব দালানে, চণ্ডীমণ্ডপেও এই ছক পাতা আছে, লক্ষ্য করিস।”
বাবার কথায় তো আকাশ থেকে পড়লে মেয়ে! গুটি সাজিয়ে সাজিয়ে খেলা, দাবার মতো…
“দাবা কী গো বাবা?”
গ্লোবালাইজেশনের অনেক আগের সময়ের এক মফস্বলী শিশুকন্যার সেই প্রথম দাবার কথা শোনা, দাবার গল্প শোনা…
পরে পরে অবশ্য সে জেনেছে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় বৌদ্ধিক খেলাটির কথা। মিখাইল তাল, আনাতোলি কারপভ, গ্যারি কাসপারভ, বিশ্বনাথন আনন্দ, গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেতাব বা আরও অনেক গ্র্যান্ড মাস্টারের কথা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অযুত তথ্যাদিও এসে জমা হয়েছে হাতের মুঠোয়। তবু অবসর পত্রিকার দাবাখেলার ওপর এই অভিনব ইভেন্টটি চোখে পড়তেই সেই কবেকার শৈশব যেন মনশ্চক্ষে তাথৈ আনন্দে নেচে উঠল, খুলে গেল উপচে-পড়া আলো-আঁধারি স্মৃতির ঝাঁপি। পারি বা না পারি কলম খুলে বসতে ইচ্ছে হল খুব।
সেই সেদিন বাবার গল্পে শুনেছিলাম, অনেক অনেক দিন আগে, এক দেশে বাস করতেন এক বুদ্ধিমান মানুষ। তাঁর নাম চিশা। তবে যত প্রখর বুদ্ধিই তাঁর থাক না কেন, মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন ভীষণ অলস। সবসময়েই চেষ্টা থাকত বিনাশ্রমে কৌশলের আশ্রয়ে জীবিকানির্বাহের এবং দিনাতিপাতের, তবে সেটি নিত্যনতুন অভিনব পদ্ধতিতে। সেই উদ্দেশ্যে তিনি একদিন বেশ কয়েকটি বিভিন্ন আকৃতির পুতুল নিয়ে গিয়ে হাজির হলেন সেই দেশের রাজা সেহরামের কাছে।
সেহরাম তাঁর কথা আগেই জানতেন। যথারীতি সম্ভাষণ করে বসাতেই তিনি রাজাকে দেখালেন অদ্ভুত এক লিখনপাটি। তাতে জ্যামিতিক ছকে আঁকা এক নতুন খেলার কৌশল। দেখা গেল, খেলার সময় সঙ্গে আনা ছোট্ট ছোট্ট পুতুলগুলিকে নিয়ে সেই ছকের দুই প্রান্তে বসিয়ে দেওয়া হল। পুতুলগুলি নির্দিষ্ট গতিপথে নির্দিষ্ট ছন্দে এগিয়ে বা পিছিয়ে যায়। এক আকর্ষণীয় ক্ষেত্র প্রস্তুত করে খেলা, শেষে জয়-পরাজয়। যেন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা।
খেলাটি দেখে রাজা যুগপৎ বিস্মিত এবং খুশি হন। তিনি চিশাকে যথাবিহিত পুরস্কার দেন এবং সভাসদ হিসেবে নির্বাচনের অঙ্গীকার করেন।
উত্তরে জ্ঞানী মানুষটি বলে বসেন, “আমি তুচ্ছ মানুষ। অগাধ অর্থসম্পদ বা প্রতিপত্তিতে আমার স্পৃহা নেই। বরং আপনি যদি আমায় গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থাটুকু করে দেন, তাহলেই ধন্য হই। থেকে যাই আপনার রাজ্যেই।”
“এ আর এমন কী! কতখানি জমি বা আর কী কী চাও বলো!”
“ও মা! জমি-জায়গার তো শুনি অনেক হ্যাপা! চাষ করো রে,ফসল তোলো রে… আমি অতশত পারব না মহারাজ!”
“তবে?”
“আমার চাহিদা যৎসামান্য।এই খেলাঘরের খোপগুলি ভর্তি করা শস্যদানা দিলেই হবে।”
“মানে! আমার সঙ্গে কি তুমি রহস্য করতে চাইছ? আমি তোমায় সম্মান দিয়ে সভাসদ করতে চাইছি, আর তুমি কী না…”
-’না মহারাজ। সত্যিই আমি চাইছি এই ছোট্ট খেলাঘর ভরা শস্যদানা। তবে ঐ খেলার কৌশলের মতোই এগিয়ে পিছিয়ে তা দিতে হবে। অবশ্যই যদি আপনি চান, তবেই।”
সকৌতুকে রাজা প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে দেন। কিন্তু তারপরেই শুরু হয় আসল খেলা। বুদ্ধিমান চিশা
খেলনা-ছকের প্রথম বর্গক্ষেত্রে মাত্র একটি শস্য, তারপরের বর্গক্ষেত্রে প্রথমটির চেয়ে দ্বিগুণ, তৃতীয় বর্গক্ষেত্রে দ্বিতীয়টির দ্বিগুণ… এভাবে পুরো ৬৪টি বর্গক্ষেত্র পূরণ করার কথা বলেন।
প্রথমে না বুঝে সম্মতি দিলেও ক্রমে দেখা যায়, শস্যগোলার শস্য সব শেষ, তবু শর্ত অনুযায়ী চৌষট্টি ঘর ভর্তি হয়নি এখনও! রাজা হতবাক, এবার মুখে হাসি ধুরন্ধর চিশার।
৬৪টি বর্গক্ষেত্রে ঠিক কী পরিমাণ শস্যকণা থাকতে পারে? হিসেবমত, ৬৪তম বর্গক্ষেত্রে শস্যের পরিমাণ হবে ২-এর ঘাত ৬৩। কারণ প্রথম ঘরটিতে ছিল একটি শস্য। দ্বিতীয়টিতে ২টি, তৃতীয়টিতে ৪টি (২-এর ঘাত ২), চতুর্থটিতে ৮টি (২-এর ঘাত ৩)… এভাবে ৬৪তম বর্গক্ষেত্রে ২-এর ঘাত ৬৩ সংখ্যাটি হওয়ার কথা।
হিসেব করলে পাওয়া যায়, ছকভর্তি শস্যের মোট পরিমাণ হয় ১৮,৪৪৬,৭৪৪,০৭৩,৭০৯,৫৫১,৬১৫টি – যা দেওয়া এবং গোনা প্রায় অসম্ভব!
রাজার মাথায় হাত। এত শস্য দেবেন কী ভাবে? এ যে অসম্ভব! এই পরিমাণ ধানের স্তুপ তো হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া মাউন্ট এভারেস্টকেও ছাড়িয়ে যাবে! ঠিক যেভাবে বুদ্ধিমত্তার সঠিক প্রক্ষেপণে আমরা পেরিয়ে যাই সাধারণ পেরিয়ে অসাধারণে, মনে ভাবি, তাহলে কি জন্মলগ্ন থেকে সেই স্পর্ধাই আহরণ করেছিল এই খেলা!
যা হোক, গল্পের শেষে সভাসদ হিসেবে নির্বাচিত হয়ে রাজা ও অন্য সভাসদদের খেলাটি শেখাবার দায়িত্ব পান চিশা। সেখান থেকে সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই অভিনব খেলা, সামান্য অনুষঙ্গে বৃহত্তর স্বার্থসিদ্ধির কৌশল। নাম হয় চতুরঙ্গ; খেলার পুতুলগুলিও পাল্টে পাল্টে যায় দেশ ও অঞ্চলভেদে। সময়রেখা ছিল যুদ্ধপ্রবণ, সুতরাং ভীষণভাবে জনপ্রিয় হয় এই যুদ্ধ-খেলা।
পারস্যের কবি ফিরদৌসির বিখ্যাত ‘শাহনামা’য় এই অদ্ভুত গল্পটির উল্লেখ আছে। পরে নিজেও পড়েছি সেই ছোট্টবেলায় শোনা রূপকথার গল্পটি। সেখানে লেখা আছে হরাব-রুস্তমের কথাও। তবে এগুলি সত্য না কিংবদন্তি, তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও খেলাটির উৎপত্তিস্থান যে ভারতবর্ষই, তা নিয়ে দ্বিমত নেই কোনও। সেই মহাকাব্যিক যুগ থেকেই হয়ত এর প্রচলন ছিল এদেশে। তবে প্রামাণ্য তথ্য বলে, খ্রিস্টিয় সপ্তম শতাব্দীতে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর আগে ভারতেই প্রথম অধুনা প্রচলিত দাবাখেলা চালু হয়।
হাতি, ঘোড়া, রথ ও পদাতিক সৈন্য – এই চারটি নিয়েই প্রাথমিকভাবে হত খেলা, তাই তার নাম ছিল চতুরঙ্গ।
তখনকার দিনে আরব এবং পারস্যের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য স্বীকৃত ছিল। হয়ত সাহিত্য, বিজ্ঞান,রসায়ন চর্চার মতো তাদের হাত ধরেই এই খেলা দেশ ছেড়ে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। নতুন নাম হয় শতরঞ্জ। আবার চিনে গিয়ে তার নাম হয় জিয়ানকুই।
দ্বাদশ শতাব্দীতে পারস্যের সুলতান সালাউদ্দিনের শাসনকালে ঘটে যাওয়া ধর্মযুদ্ধের সময়ে ইউরোপের ক্রুসেডাররা জেরুজালেম রক্ষার নামে দলে দলে ভিড় জমায় আরবে ও পারস্যে। এবং দীর্ঘদিন সেখানে থাকার সুবাদে সেখানকার অনেক কিছুর সঙ্গে সঙ্গে শতরঞ্জের বিনোদনটিকেও সঙ্গে নিয়ে যায় আপনদেশে। একই সময়ে স্পেনে মুসলিম মুরদের শাসনকালে শতরঞ্জ ইউরোপসহ রাশিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ে। সেখানেই খেলাটির নতুন নাম হয় ‘চেস’, যা তৎকালীন ফরাসি ভাষা ‘echec’ (অর্থ চেক) থেকে এসেছে। তবে শুধু নামে নয়, খেলাটির আরও অনেক অনুষঙ্গও পরিবর্তিত হয় এই সময়ে। এখানেই ক্যাথলিক ধর্মের প্রভাবে খেলাটিতে বিশপ পুতুল যুক্ত হয়। তারও পরে যুক্ত হয় রানি পুতুল। এইভাবে অবসর বিনোদন অথবা বৌদ্ধিকচর্চার ক্ষেত্র হিসেবে দাবার গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে। সাহিত্যে, সিনেমায়, অঙ্কনে, বিনোদনের সর্বক্ষেত্রে দাবা নিজের জায়গা করে নেয় আরও প্রিয় পরিসরে।
১৯২৪ সালে দ্য ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল ডেস চেস (এফআইডিই) গঠিত হয় জনপ্রিয় এই খেলাটির আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন নির্ধারণ-নিয়ন্ত্রণের জন্য। এই সংস্থাই এখন আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতার আয়োজক। দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে এফআইডিই খেলোয়াড়দের ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার ও গ্র্যান্ড মাস্টার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যে সব খেলোয়াড় প্রতিযোগিতায় সবার সেরা হয় তারাই গ্র্যান্ড মাস্টার।
আধুনিক ভারতবর্ষের প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টার হলেন বিশ্বনাথন আনন্দ। তাছাড়াও সূর্যশেখর গাঙ্গুলি, জয়শ্রী খাদিলকার, সুব্বারমন বিজয়লক্ষ্মীর নামও করা যায়।
১৯৯৬ সালটি দাবার ইতিহাসে এক যুগান্তর এনেছে।কারণ, ঐ বছরেই আন্তর্জাতিক গ্র্যান্ড মাস্টার গ্যারি কাসপারভ দাবা খেলেন ডিপ-ব্লু নামের এক কম্পিউটারের সঙ্গে। সেই প্রথম মানুষের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এবং আনন্দের কথা এই যে, সে খেলায় কাসপারভ জিতে যান। যদিও ঠিক পরের বছরেই তাঁকে হার মানতে হয় একই প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে।
তবে ততদিনে বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই পদ্ধতি। এখন তো হামেশাই শোনা যায় কম্পিউটারের সঙ্গে দাবা খেলার কথা।
তবে যত প্রযুক্তি কৌশলেরই জয় হোক না কেন, আমাদের সেই চিরাচরিত পাটিপাতা রাজা-রানির খেলার রোমান্টিসিজমের কোন বিকল্প কিন্তু এখনও নেই।বর্ষার রিমঝিম দুপুরে, হেমন্তের ধূসর অবসন্নতায় দেরাজের এককোনে পড়ে থাকা দাবাবাক্সের দিকে তাকালেই কবেকার ফেলে আসা ঘোড়ার আড়াই পায়ের ভুল চাল মনে পড়ে, মনে পড়ে খোয়া যাওয়া নৌকার দিগভ্রান্ততা, গা-ঘেঁষাঘেঁষি অন্তরঙ্গতার খুনসুটি। ব্যস্ততাবিরহিত সেই সব বিধুর দিনগুলি যেন মনের আয়নায় ছায়া ফেলে মায়ায়।
তাই হয়তো শতরঞ্জ কি খিলাড়ির বৈভবময়তায়, চন্দ্রনাথ উপন্যাসের দাদুর অসহায় একাকীত্বের মাঝেও প্রাণদায়িনী কিস্তিমাতের বিশল্যকরণী ম্মৃতির দুয়ার ধরে ডাকে, শকুনির পাশার দান উল্টে যাবে, এই ভরসায়।
সায়াহ্নে এসে মনে হয়, জীবনখানিই তো এক বিশাল দাবাক্ষেত্র! সুখে দুঃখে,পতনে সংগ্রামে বোড়ের মতো আমরা এগোই, পিছোই অদৃশ্য ক্রীড়নকের ইঙ্গিত দোলনে। ঠিক যেমনটি বলেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দাবাড়ু মিখাইল তাল।
“আপনাকে আপনার প্রতিপক্ষকে দাবার বোর্ডে এক গভীর, ঘন জঙ্গলে নিয়ে যেতে হবে, যেখানে দুয়ে দুয়ে পাঁচ হয়! সেখান থেকে বেরোবার রাস্তাটা যেন কেবল একজনেরই জানা থাকে।”
এবং সেই বিশেষ একজনটি যেন আত্মবিশ্বাসী আমিই! এখানেই হয়তো খেলাটি খেলা ছাড়িয়ে জীবন হয়ে ওঠে, রূপকথার মায়াজাল ছিঁড়ে বাস্তব সুন্দর হয়ে ওঠে। শুভমস্তু।
অবসর পত্রিকা গ্ৰুপের ইভেন্টে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখা