ওয়াজির (চলচ্চিত্র)

ওয়াজির (চলচ্চিত্র)

দাবাখেলা নিয়ে অবসর পত্রিকা গ্ৰুপের ইভেন্টে আসা অন্য লেখাগুলোর থেকে এ লেখাটি কিছুটা আলাদা, হয়তো অনেকটাই লঘু। কারণ আমি লিখছি কোনো কালজয়ী সাহিত্য বা ইতিহাস নিয়ে নয়, এটা লেখা হচ্ছে একটি আদ্যন্ত বাণিজ্যিক বলিউডি সিনেমা দেখে। যদি মনে হয় বিষয়টা একটু লঘু হয়ে গেল, তবে আমি মার্জনাপ্রার্থী। তবে কেন জানিনা, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই ছবিটির কথা আমার মনে পড়ছে।
একটি পিতা। পথদুর্ঘটনায় নিজের স্ত্রী এবং নিজের দুটি পা হারানো একটি পিতা, যাঁর জীবনের একমাত্র অবলম্বন তাঁর কন্যা। একদিন এই বাবা একটি ফোন পান, একটি অঘটন ঘটে গেছে, হঠাৎ মারা গেছে তাঁর একমাত্র সন্তান। অকুস্থলে পৌঁছে সেখানে উপস্থিত এক অতি প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার চোখে উনি সত্যিটা পড়তে পারেন। দুর্ঘটনা নয়, তাঁর মেয়ের মৃত্যুর কারণ হত্যা। কিছু একটা সে জেনেছিল, জেনে ফেলেছিল , যে তথ্য সামনে এলে অনেক লোকের সাজানো গোছানো রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়ে যাবে। তাই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, প্রমাণ? আইন তো প্রমাণ চায়, যা এই বাবার কাছে নেই। এবং সেই প্রমাণ জোগাড় করার কোনও উপায় বা শারীরিক ক্ষমতাও তাঁর নেই।
এর মধ্যে তাঁর আলাপ হয় আরেকটি বাবার সঙ্গে, সেও অকালে নিজের শিশুকন্যাকে হারিয়েছে।। এই দুজন অসমবয়সী সন্তানহারা পিতার বন্ধুত্ব হয়, প্রথমজনের যুদ্ধে সামিল হয় দ্বিতীয়জনও। এমন কী তাঁর মৃত্যুর পরেও লড়ে যায় এই বন্ধু, সত্য উদঘাটিত হয়, বিচার পায় অকালমৃতা।
এত কথা বলছি, কিন্তু এর মধ্যে দাবা কোথায়? আছে। শিশুসন্তানের মৃত্যুশোক ভোলাতে দাবা খেলতে ডাকেন এক পিতা আরেকজনকে, দুজনে কাছে আসেন এইভাবেই। অন্তত সিনেমাটি কিছুটা দেখে এইটুকুই মনে হয়। চমক আসে শেষে।
কন্যাহারা মানুষটি তাঁর কন্যার স্মৃতিতে একটি নৃত্যনাট্য পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে সেই নাটকটি দেখতে বসে চমকে ওঠেন তাঁর বন্ধু। নাটকের মঞ্চ একটি দাবার ছক, নায়ক একটি ছোট্ট বোড়ে। অত্যাচারী রাজার জুলুমে অতিষ্ঠ বোড়েটি, কিন্তু সে যে অসহায়! তাই সে সাহায্য নেয় Wazir, অর্থাৎ মন্ত্রীর। মন্ত্রীর চালে মাত হয় রাজা, পতন হয় অত্যাচারী স্বৈরাচারী রাজার। দাবার চাল চালে মন্ত্রী, কিন্তু বুদ্ধি, পরিকল্পনা এবং বাজিমাত বোড়ের।
বন্ধুটি ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, তার সঙ্গে আলাপ, বন্ধুত্ব, নিজের যুদ্ধে তাকে সামিল করা, কোনকিছুই অকস্মাৎ বা কাকতালীয় নয়। একটি অসহায় পিতা, একটি নিছক বোড়ে, শক্তিশালী রাজার অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে তার মত একজন শারীরিক ও মানসিক শক্তিমান পুলিশ আধিকারিককে নিজের মন্ত্রী বানিয়েছেন, একটি একটি করে দাবার চাল চেলেছেন, এবং কিস্তিমাত করেছেন। নিজের নিহত মেয়ের জন্য বিচার পাওয়ার আর অন্য কোনো পথ তাঁর সামনে খোলা রাখেনি এই সমাজের প্রতিপত্তিশালী মানুষগুলো, দাবার ছক এবং দাবার চাল ছিল তাঁর ন্যায় পাওয়ার একমাত্র পথ।
বাণিজ্যিক সিনেমার জাঁকজমক সরিয়ে রেখে যদি ভাবি, কিছু ঘটনাক্রম চেনা চেনা লাগছে কি? একটি তরুণী, যে কিছু গোপন তথ্য জেনে ফেলেছিল বলে তাকে মরতে হল। তার বাবা-মায়ের কাছে যাওয়া একটি ফোন, যা বলে যে হঠাৎ অপঘাতে তরুণীর মৃত্যু হয়েছে! নিতান্ত সাধারণ অক্ষম অসহায় বাবা-মা, যাঁরা এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। তাঁরা চান সত্য সামনে আসুক। তাঁরা বিচার চান।
জীবন বলিউডি সিনেমা নয়, এখানে ঠাঁই-ঠাঁই গুলি চালিয়ে শত্রুর নিধন করে দেবে না কোনো বন্ধু, দাবার চাল চেলে আদায় হবে না বিচার। গণতন্ত্রে সেটা অভিপ্রেতও নয়।
তবে সাধারণ জনগণ Wazir হয়ে অসহায় বোড়ের জন্য বিচার ছিনিয়ে আনতে পারে কি না, সেটা সময়ই একমাত্র বলতে পারে।
চলচ্চিত্র: Wazir (2016)
চিত্রঋণ: অন্তর্জাল

অবসর পত্রিকা গ্ৰুপের ইভেন্টে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখা

আনন্দিতা চৌধুরীর জন্ম বেড়ে ওঠা কলকাতায়, তবে গত দুই দশক ধরে ঘর বেঁধেছেন নিউ জার্সিতে। তাই তাঁর লেখাতে যেমন উঠে আসে বাঙালি মধ্যবিত্ত যাপনের রোজনামচা, তেমনই থাকে প্রবাসী মনের টানাপোড়েন। পেশার ক্ষেত্র লাইব্রেরি, বইয়ের সঙ্গে কাটে দিন। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা সারাদিন। মানুষ দেখা, মানুষের কথা শোনা, মানুষের গল্প লেখা তাঁর নেশা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *