বাদশাওঁ কা খেল, খেলোঁ কা বাদশা
মুনসি নন্দলাল বলছিলেন যে দাবা খেলা ভারত থেকে পারস্য হয়ে ইরানে পৌঁছেছে। আর তাঁর কথা শুনে ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ী’র শৌখিন দুই জায়গিরদার মির্জা সাজ্জাদ আলি আর মির রওশন আলির বিস্মিত মুখগুলো নিশ্চয়ই অনেকেরই মনে আছে।
প্রচলিত Staunton প্যাটার্নে খোপ কাটা ৬৪ ঘরের ৮×৮ বোর্ডে ৩২টি সাদা কালো ঘুঁটি নিয়ে দুই খেলোয়াড়ের খেলাই আধুনিক দাবা। ভারতের প্রাচীন ফলক/বোর্ড গেম চতুরঙ্গকে দাবার পূর্বসূরী বলা হয়। খ্রিস্টপূর্ব আমলের খেলাটিতে সময়ের সাথে নাম, চেহারায় এবং নিয়মে অনেক পরিবর্তন এসেছে। দানভিত্তিক ছক্কার খেলা হয়েছে মগজনির্ভর। কিন্তু চতুরঙ্গ থেকে আধুনিক দাবায় বিবর্তন কিভাবে ঘটেছে? পুরাণ, ইতিহাস, সাহিত্য, শিল্প কী বলে?
পৌরাণিক জনশ্রুতি, ত্রেতাযুগে রাবণকে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করতে মন্দোদরী দাবার উদ্ভাবন করেন।
মহাভারতেও সভাপর্বে যুধিষ্ঠিরকে শকুনির সঙ্গে পণ রেখে পাশার দান ফেলতে, বিরাটপর্বে বিরাটরাজের সাথে অক্ষ খেলতে দেখা গেছে। পাশা আর অক্ষ খেলাও ঘুঁটির চালনির্ভর বোর্ড গেম।
ঐতিহাসিকরা সকলেই একমত যে এশিয়া মহাদেশই দাবার জন্মস্থল। প্রাচীনকালে রণভূমিতে পদাতিক, অশ্বারোহী, গজারোহী ও রথারোহী সমৃদ্ধ সৈন্যসজ্জার সংস্কৃত নাম ছিল চতুরঙ্গ। ফলক খেলাটির ঘুঁটির বিন্যাস অনুরূপ সজ্জাতে করা হত বলে খেলাটিকে চতুরঙ্গ বলা হত।
ঐতিহাসিকদের মতে, খননকালে প্রাপ্ত সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন মাটি আর পাথরের ছোট ছোট পুতুলগুলো সে যুগে প্রচলিত বোর্ড গেমের ইঙ্গিত দেয়, প্রাচীন মিশরীয় “সেনেত” খেলার সাথে যার কিছুটা মিল আছে।
পাণিনির “মহাভাষ্য”তেও অষ্টপদ (৮×৮) ও দশপদ (১০×১০) বোর্ড গেমের উল্লেখ আছে। আধুনিক লুডো, দাবা এই বোর্ড গেমেরই বিভিন্ন বিবর্তিত রূপ। বহুযুগ ধরে দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত অষ্টপদ ছকে “থাইয়্যাম” খেলাটিতে চতুরঙ্গের ছাপ আছে। চার রাজার খেলা চতুরঙ্গতে প্রতি দলে থাকত রাজা/শাহ, মন্ত্রী/পিল, চার বোড়ে/বৈদ্যোক, এক নৌকা/রূক ও এক অশ্ব/ফরাস। খেলার পরিণতিতে তিন রাজার পরাজয়, সমকালীন ক্ষত্রিয়দের রাজ্য বিস্তারের ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীকালে জনপ্রিয় হয় চতুরাজি, সিংহলে যার নাম সাদুরঙ্গম। পণ ভিত্তিক ছক্কার চালে খেলাকে জুয়া ভাবা হত, তাই,দাবায় ক্রমশঃ ছক্কার ব্যবহার পরিত্যক্ত হয় ।
স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে আলেকজান্ডারের সঙ্গে ভারতে গ্রিসের সংস্কৃতির প্রবেশ ঘটেছিল। দার্শনিক প্লেটোর লেখায় গ্রিসের যে মনন নির্ভর “পেটিয়া” (petteia) খেলাটির উল্লেখ আছে, প্রামাণ্য দলিল না থাকলেও অনুমিত হয়, গ্রীক পেটিয়া ও ভারতীয় অষ্টপদের মিলিত ও বিবর্তিত চেহারাই আজকের দাবা।
ষষ্ঠ শতকে গুপ্তসাম্রাজ্যের এক রাজকুমার যুদ্ধে মারা যাওয়ায় যুদ্ধ পরিস্থিতির বর্ণনার সময়ে একটি ৮×৮ ছকে রাজা, মন্ত্রী ও সৈন্যদের অবস্থান চিহ্নিত করা হয়। এইসময় থেকেই রাজদরবারে চতুরঙ্গ খেলাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। মুঘল বাদশাহদের দাবার ছকে মানবঘুঁটি ব্যবহারের চিত্রিত প্রমাণ আছে।
মধ্যযুগে ভারতবর্ষ এবং পারস্যের বাণিজ্যিক যোগাযোগ থাকায় চতুরঙ্গ সহজেই পারস্যে পৌঁছয়। সেখানে খেলাটি প্রথমে চাতরাং (ফার্সিতে), পরে রাশিদুন খিলাফত পারস্য জয় করলে (আরবি ভাষায় চ এবং ঙ্গ ধ্বনি নেই) শতরঞ্জ নামে পরিচিত হয়। পারস্যেই খেলায় প্রতিপক্ষের রাজা (শাহ), মাত হলে “শাহ-মাত” শব্দটির সৃষ্টি হয়।
সেই সময়ে স্পেনে মুসলিম শাসন হওয়ায়, শতরঞ্জ পারস্য থেকে স্পেনে (ইওরোপে) পৌঁছয় এবং ইসলামিক দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। শতরঞ্জ পর্তুগিজ ভাষায় হয়ে যায় ‘Xadrez’, যাকে ইংরেজিতে ‘Ajedrez’, ‘Acedrex’, ‘Axedrez’ ইত্যাদি বিভিন্নভাবে লেখা হয়। গ্রিসে খেলাটির নাম ইয়াট্রিকিওন (Zatrikion), যার অর্থ রাজা। একটি স্প্যানিশ পাণ্ডুলিপিতে দাবা সংক্রান্ত বেশ কিছু আরবি শব্দ যেমন, আলবিল (হাতি), অ্যালফেরজা (ওয়াজির), রোক (রথ), রাজা, ঘোড়া ইত্যাদির উল্লেখ আছে। স্পেন থেকে দাবা ক্রমশ ইওরোপের ইতালি, বাইজেন্টাইন, জার্মানি, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে পৌঁছয়। দেশ বদলের সাথেই ‘শাহ-মাত’ শব্দটির চেকমেটে রূপান্তর ঘটে । এছাড়া ল্যাটিন ভাষায় Ludus Scacchorum, ইতালিয়ান ভাষায় scacchi, কাতালান ভাষায় escacs, ফ্রেঞ্চ ভাষায় échecs, ওলন্দাজ ভাষায় schaken – দেশভেদে দাবা বিভিন্ন নামে সম্বোধিত হয়। পরে ইওরোপ ও রাশিয়ায় খেলাটি চেস (প্রাচীন ফরাসি শব্দ ‘échecs’ বা চেক থেকে উৎপন্ন) নামে ছড়িয়ে পড়ে।
ইওরোপে দাবায় ‘বিশপ’ (হাতি) যুক্ত হয়, আরও পরে যোগ হয় মন্ত্রী। ধীরে ধীরে ‘চেস’ বা দাবা ইউরোপ থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ঐতিহাসিকদের মতে রাজাদের রাজ্য জয়, অন্য দেশে অভিবাসন, বণিকদের বাণিজ্যযাত্রা ও তীর্থযাত্রীদের তীর্থভ্রমণের পথেই চতুরঙ্গ দেশান্তরে ছড়িয়েছে। পারস্যের সঙ্গেই ভারত থেকে খেলাটি চিনেও পাড়ি দেয়। খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দীর চৈনিক সাহিত্যের দাবি, দাবা ওদের এক রাজার আবিষ্কার। চিনা ঐতিহাসিকদের মতে দাবার অনুরূপ চিনের জিয়ানকি বা শিয়াংচি (Xiangqi) তাদের দেশীয় খেলা। তাঁদের এমনকি দাবি যে দাবাখেলা চিনেই উদ্ভাবিত এবং চিন থেকেই খেলাটি জাপান, কোরিয়া, জাভা, তিব্বত, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পৌঁছেছে। যদিও চিনের দাবিটির যাথার্থ্য অপ্রমাণিত।
একাদশ শতকে দাবা ক্রমশ দরবারি শিক্ষার অংশ হয়ে ওঠে। ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দাবার নিয়মকানুনে মূল পরিবর্তন ঘটে। ত্রয়োদশ শতকে ফ্রান্সে সাধারণ মানুষের মধ্যে টাকার জন্য দাবা খেলার পরিমাণ এত বেড়ে যায় যে ১২৫৪ খৃষ্টাব্দে সম্রাট নবম লুই এর বিরুদ্ধে আইন জারি করেন।
সাহিত্যে দাবা
ভারতে দাবা খেলার উৎপত্তির স্বপক্ষে বলা যায় যে রামায়ণ মহাভারতের মত মহাকাব্যে চতুরঙ্গ নামটির উল্লেখ আছে। পাণিনি, কৌটিল্যের রচনায়, মনুসংহিতাতে, সপ্তম শতকে লেখা “হর্ষচরিতে” চতুরঙ্গর উল্লেখ রয়েছে। ৯৭৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১০১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ফার্সি কবি ফিরদৌসি রচিত ‘শাহনাম’ কাব্যগ্রন্থে একটি কিংবদন্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। কিংবদন্তি অনুসারে, ৫৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫৩৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে খসরু নুসিরওয়ানের রাজত্বকালে এক ভারতীয় ঋষি পারস্যে আসেন। ঋষি নিজের উদ্ভাবিত একটি খেলায় যুদ্ধের রণসজ্জার কৌশল দেখিয়ে পারস্যের শাহকে মুগ্ধ করলে, তিনি ঋষিকে পুরস্কার দিতে চান। ঋষি খেলার জন্য কাটা ৬৪টি খোপের প্রথম খোপে একটি, দ্বিতীয়টিতে দুটি, তৃতীয়টিতে চারটি , চতুর্থটিতে ষোলোটি – এরকম বর্ধিত হারে শস্যদানা দিতে বলেন। প্রথমে তুচ্ছ ভাবলেও দেয় শস্যদানার মোট পরিমাণ হিসেব করে ঋষির বুদ্ধিমত্তায় শাহ চমকিত হন। আরবি লেখক ইবনে খালিক্কানের লেখাতেও এই কিংবদন্তির উল্লেখ আছে ,তবে তিনি চতুরঙ্গকে পারস্যের নিজস্ব খেলা বলেছেন।
অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে ১৮৮০ সাল পর্যন্ত দাবা খেলায় দীর্ঘসূত্রিতাকে রোমান্টিক দাবা বলা হয়। এরপর থেকেই দাবায় দ্রুত শেষ করার কৌশল লক্ষিত হয়। ১৮৫১ সালে লন্ডনে আধুনিক দাবার প্রথম টুর্নামেন্টের আয়োজন করেন ব্রিটিশ দাবাড়ু হাওয়ার্ডস স্ট্যাউনটন। চ্যাম্পিয়ন হন জার্মানির দাবাড়ু অ্যাডলফ অ্যান্ডারসন। ১৮৮৩ সালে লন্ডনের একটি টুর্নামেন্টে খেলার সময় নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রথম দাবা ঘড়ির ব্যবহার শুরু হয়। ১৮৮৬ সালে প্রথম দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হন আধুনিক দাবার জনক উইলিয়াম স্টেইনিজ ( জন্ম ১৮৩৬ সালে, প্রাগ শহরে)। উইলিয়াম স্টেইনিজ তাঁর লেখা ‘দা মডার্ন ইনস্ট্রাক্টর’ বইটিতে দাবা খেলার বিভিন্ন তত্ত্ব ও চালের ধারণাগুলির বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ করেছেন। ১৯২৪ সালের ২০শে জুলাই ফ্রান্সে বিশ্ব দাবা ফেডারেশন বা ফিডে (FIDE) স্থাপিত হয়। ফিডে বিভিন্ন জাতীয় দাবা সংস্থাগুলির নিয়ামক হিসেবে এবং দাবার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাগুলি নিয়ন্ত্রণের কাজ করে। ১৯৯৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি ফিডেকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বর্তমানে ফিডে ২০৩টি জাতীয় দাবা সংস্থার নিয়ামক।
দাবাড়ুদের মধ্যে একাধারে একাগ্রতা, বুদ্ধিমত্তা, মানসিক দৃঢ়তা ও শারীরিক সুস্থতা থাকা প্রয়োজন। ১৯৭২ সালে আমেরিকান দাবাড়ু ববি ফিশার তাঁর রুশ কাউন্টারপার্ট ববি স্প্যাসকিকে দাবাযুদ্ধে হারিয়ে দেন| দাবায় রাশিয়ার প্রতিপত্তি খর্ব করা আমেরিকানদের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়াও যাতে দাবাড়ুরা দাবা অভ্যাস করে নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে পারে সেই কারণে কম্পিউটারে দাবাখেলার চালগুলির প্রোগ্রামিং করা শুরু হয়। ১৯৫০এর দশকে প্রথম দাবা কম্পিউটার তৈরী হলেও এর প্রোগ্রামিং কোয়ালিটি খুবই খারাপ ছিল। আরও চল্লিশ বছর সময় লাগে সুপার দাবা কম্পিউটার তৈরি করতে। ১৯৯৭ খৃষ্টাব্দে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন রাশিয়ান দাবাড়ু গ্যারি কাসপারভ উন্নত মানের প্রোগ্রামিং করা ‘Deep Blue’ সুপার কম্পিউটারের চ্যালেঞ্জের সামনে পরাজিত হন। পরবর্তীতে তৈরি হয়েছে ‘The Turk’ বা ‘Fritz’ এর মত দক্ষ যন্ত্রগণক।
ভারতে দাবার উদ্ভাবনকে বিষয়বস্তু করে তৈরি হয়েছে Searching For Bobby Fisher,’ ‘The Dark Horse,’ ‘Pawn Sacrifice,’ ‘Brooklyn Castle’ ও আরও অনেক চলচ্চিত্র।
সৈন্যজীবনে যুদ্ধের উত্তেজনা জিইয়ে রাখতে যে চতুরঙ্গর উদ্ভব, সেটি ,আজ ‘চেস’ নাম নিয়ে আন্তর্জাতিক আঙিনায় পা রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ২০শে জুলাই তারিখটিকে আন্তর্জাতিক বিশ্ব দাবা দিবসের মান্যতা পেয়েছে। বিশ্ব দাবা ফেডারেশন বা ফিডে-র তালিকা অনুযায়ী বিশ্বদাবাকে ভারত উপহার দিয়েছে ৮৫ জন পুরুষ ও ২৩ জন মহিলা গ্র্যান্ডমাস্টার, ১২৪ জন ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার, এবং আরও অনেক কুশলী খেলোয়াড়। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বিশ্বনাথন আনন্দ, গ্র্যান্ডমাস্টার দিব্যেন্দু বড়ুয়া, সূর্যশেখর গাঙ্গুলী, রমেশ বাবু প্রজ্ঞানন্দ, বিজয় লক্ষ্মী, বৈশালী রমেশ বাবুদের আইকন মেনে আজ নতুন নতুন ছেলে মেয়েরা রাজ্য ও জাতীয় স্তরের খেলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আঙিনায় নিজেদের কেরিয়ার গড়তে আগ্রহী হয়েছে। আশা করি তারা দাবার জগতে ভারতের তথা নিজেদের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখবে।
তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা: সপ্তর্ষি রায়বর্ধন, অন্তর্জাল ও ব্যক্তিগত সূত্র
অবসর পত্রিকা গ্ৰুপের ইভেন্টে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখা