মহাকাব্য, পুরাণ ও ভাস্কর্যে দাবা

মহাকাব্য, পুরাণ ও ভাস্কর্যে দাবা

দাবার সূচনা হয় চতুরঙ্গের রূপ ধরে প্রাচীন ভারতবর্ষে। চতুরঙ্গ অর্থাৎ চতুষ্পদ, যা মূলত যুদ্ধে চার প্রকার সেনাবাহিনীর বিন্যাসকে ইঙ্গিত করে – পদাতিক, অশ্বারোহী, হস্তীবাহিনী, রথারোহী। রাজা-রাজড়াদের রণকৌশলের জ্ঞান ৮x৮ বোর্ডে ঝালিয়ে নেওয়ার একপ্রকার ব্যবস্থাপনা বলা যেতে পারে।
স্কন্দপুরাণের স্তোত্রে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় – ‘তথৈবস্য চতুরঙ্গম বিজ্ঞানম্’ – অর্থাৎ তিনিই দক্ষ রাজা, যিনি চতুরঙ্গে পারদর্শী। অর্থাৎ চতুরঙ্গ নিছক খেলাই নয়, এ হল রাজার রণকৌশল পারদর্শিতার পরিবেশন।
সময়ের সঙ্গে চতুরঙ্গের পট পরিবর্তন হলেও, এই প্রাচীন খেলাটি যে পুরাকালে লোকমানসে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে, তার অস্তিত্ব বহন করে এদেশের পুরাণ, মহাকাব্য, ভাস্কর্য তথা স্থাপত্য, সর্বোপরি সংস্কৃত সাহিত্য।
কথিত আছে, লঙ্কেশ রাবণের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তার স্ত্রী মন্দোদরী গণেশের শরণাপন্ন হন। গণেশ তাঁকে দাবা খেলার পদ্ধতি বর্ণনা করেন। সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে মন্দোদরী তার স্বামী রাবণকে দাবা খেলায় আগ্রহী করে তোলেন।
চতুরঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায় কবি কালিদাসের কুমারসম্ভবমে।
চতুরঙ্গ বেদি সমাবেশ স্থিতা
কৃতা অন্ত:
কৈলাস শিখরে স্থিতৈভ্য
স্বরা জ্যোতি সমচেতনা
যার অর্থ, কৈলাসশিখরে দেবী পার্বতী উপবিষ্টমানা। চতুরঙ্গের ঘুঁটির চলনে নিমগ্না । যেন আপন আলোয় উদ্ভাসিতা এক নক্ষত্র।
শিবপুরাণ এবং ভবিষ্যপুরাণে শিব-পার্বতীর চতুরঙ্গ খেলার কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।
লোককথা অনুযায়ী, একবার নারদ মুনি কৈলাস পর্বতে উপস্থিত হলেন। পার্বতী মুনিকে তাঁর আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে, নারদ বলেন, তিনি শিব-পার্বতীর ক্রীড়া দর্শন হেতু মনোরঞ্জনের অভিপ্রায়ে এসেছেন।
পার্বতী অবাক হলেন, কী এমন খেলা দেখতে চান মুনিবর!
উত্তরে নারদ জানালেন, যে খেলা ঘুঁটি সহযোগে খেলা যাবে, তেমন কোনও খেলা।
দেবজগতে মহাদেব দাবা খেলায় পণ্ডিত। তাই শিব-পার্বতী চতুরঙ্গ খেলায় মগ্ন হলেন।
প্রথম পর্বে শম্ভু জয়লাভ করলেন। তিনি খেলায় তাঁর মাথায় শোভিত বক্র শশী, গলার হার, কানের কুণ্ডল বাজি রাখলেন। পরবর্তী পর্বে পার্বতী জিতলেন। শর্তানুযায়ী শিবের বাজি রাখা সমস্ত সম্পদ অধিকার করতে গেলে দুজনের মধ্যে প্রবল বচসা শুরু হল। শংকর দাবি করলেন, এ জগতে কোনও জীব তাঁকে পরাজিত করতে সমর্থ নয়। নারদ, নন্দী, ভৃঙ্গী তাঁকে সমর্থন করলেন। কিন্তু পার্বতী তো ছাড়ার পাত্রী নন। পত্নীর অপমান সহ্য করতে না পেরে দেবাদিদেব সব ছেড়ে সিদ্ধাতাভি অরণ্যবাসী হলেন। অবশেষে দেবী পার্বতী এক আদিবাসী শবরী বালিকার বেশ ধরে স্বামীর মানভঞ্জনে সফল হন। সামান্য এক দাবা খেলায় হার-জিত নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে কতই না কলহ!
এই কাহিনির ভাস্কর্য রূপের নিদর্শন পাওয়া যায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের মন্দিরগাত্রে, এবং বহু আলোচিত এলিফ্যান্টা, রামেশ্বর, ইলোরার দুমার গুহায়।
অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলামে মুখলিঙ্গম মন্দির প্রাঙ্গণে এবং ছত্রিশগড়ে মল্লার প্রদেশে পাতালেশ্বর মন্দিরগাত্রে একাধিক ফলকে পর্যায়ক্রমে দাবা খেলাকে কেন্দ্র করে শিব-পার্বতীর মান-অভিমানের কাহিনি সমন্বিত প্রস্তরীকৃত ভাস্কর্য ফুটিয়ে তুলেছেন কোনও অজ্ঞাত শিল্পী।
রামেশ্বর গুহার গায়ে একটি ফলকে উপর-নিচে দু ভাগে এই কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। উপরিভাগে দেখা যায় শিব-পার্বতী চতুরঙ্গ খেলছেন। নিচের ভাগে পরাজিত শিবকে অপমান করছেন পার্বতী এবং অপরটিতে পার্বতীর গণেরা (বামন সহচরীরা) নন্দীকে টেনে নিয়ে চলেছে। কেউ তার লেজ ধরে টানছে, কেউ তার উপর উঠে বসেছে, কেউ তার শিং-এ হাত রেখেছে।
মল্লারে মন্দিরের দ্বারশাখার ফলকে অপর ভাস্কর্য ফুটে উঠেছে। যেখানে ফলকের মধ্যভাগে রয়েছে চতুরঙ্গের পাটাতন। যার দুপাশে ডানে ও বামে শিব ও পার্বতী দুজনে বসেছেন একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে। এই অভাবনীয় মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন শ্রীগণেশ।
অন্যভাবে দেখতে গেলে শিব-পার্বতীর এই শাশ্বত ক্রীড়া এক অন্তর্নিহিত সত্যকে উন্মোচন করে। তা হল নারী-পুরুষের চিরকালীন দ্বন্দ্ব। পুরুষ মনে করে সে অজেয়। যদিও প্রকৃত সত্য হল অজেয় কেউ নয়। যে আজ জয়ী, কাল সে পরাজিত। চতুরঙ্গ এক্ষেত্রে মহাকালের বা সময়ের প্রতীক। যে খেলা একবার শুরু হলে তাকে মধ্যপথে অবরুদ্ধ করা যায় না। সে খেলার শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। মহাকালের গতি মাঝপথে অবরুদ্ধ করা যায় না, পরিশেষে তার পরিণতিকে মেনে নিতে হবে। চতুরঙ্গ চতুর্যুগের নির্দেশক।
পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ভারতবর্ষের ৮৫ জন গ্র্যান্ড মাস্টার এর মধ্যে ২৯ জনই তামিলনাড়ুর। মনে করা হয়, দাবাখেলা, তামিলে যাকে বলা হয় সাথুরাঙ্গাম, ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার আগে দক্ষিণ ভারতে তামিলনাড়ুতে উদ্ভূত হয়েছিল।
মন্দিরনগরী হিসেবে তামিলনাড়ু সুপরিচিত। দাবার সঙ্গে এই নগরীর ঐতিহাসিক সূত্রে সুপ্রাচীন যোগ রয়েছে।
দক্ষিণ ভারতীয় সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক উৎকর্ষতার সঙ্গে নানা কাহিনি বপন করা আছে তামিলনাড়ুর আনাচে-কানাচে নানা মন্দিরে। এরই মধ্যে একটি মন্দির নির্মিত হয়েছে, যে মন্দিরে পূজিত হন স্বামী বল্লভানাথার ও দেবী রাজরাজেশ্বরী, দাবার দেবদেবী রূপে।
মন্দিরটি হল সাথুরাঙ্গা বল্লভানাথার মন্দির। দাবাকে কেন্দ্র করে এই রাজ্যে এক পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত আছে, যার উপর ভিত্তি করে এই মন্দিরে দাবার দেবতা অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
প্রাচীনকালে বাসুদেবন নামে এক রাজা তিরুনেলভেলি রাজ্যে রাজত্ব করতেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী গান্ধীমতি ছিলেন শিবের একনিষ্ঠ উপাসক। তাঁরা সুখে দিনযাপন করলেও তাঁদের জীবনে অসম্পূর্ণতা ছিল। কারণ তাঁরা ছিলেন নিঃসন্তান।
সন্তান লাভের আশায় তাঁরা বহু মন্দির পরিদর্শন করেন। দিনের পর দিন উপবাস করেন। তিরুনেলভেলিতে নেল্লাই আপ্পার মন্দিরে তাঁরা কঠোর শিবসাধনায় মগ্ন হন। ভগবানের স্থান থেকে তাঁরা কিছুতেই খালি হাতে ফিরবেন না।
তাঁদের কঠোর সাধনা ও প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব পার্বতীকে তাদের কন্যারূপে মর্ত্যে প্রেরণ করেন। মর্ত্যে আগমন করলে সহচরী রূপে দেবী পার্বতীর সঙ্গী হন দেবী চামুন্ডেশ্বরী।
একদিন রাজদম্পতি থামিরাবরণী নদীতে স্নান করছিলেন। হঠাৎ তাঁরা অনতিদূরে নদীর জলে ভাসমান পদ্মপাতায় এক শ্বেতশুভ্র শঙ্খ দেখতে পান। তাঁরা লক্ষ করেন পদ্মপাতায় শঙ্খটি তাঁদের দিকেই ভেসে আসছে। সেটি তাদের কাছে আসতে রানি সেটিকে তার করপুটে তুলে নিতেই অকস্মাৎ শঙ্খটি এক শিশু কন্যায় পরিণত হয়। শিশুকন্যার ক্রন্দনধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত হয়। তার দ্যুতিতে আলোকিত হয় নদীতট। নিক্কণ ছন্দে প্রবাহিত হয় থামিরাবরণী।
রাজদম্পতি উচ্ছসিত হয়ে ওঠেন। এতদিনে তাঁদের তপস্যা সফল হয়েছে। মহাদেব তাঁদের মনোবাসনা পূর্ণ করেছেন। তাঁরা শিশুকন্যার নামকরণ করেন রাজরাজেশ্বরী। রাজা বাসুদেবন ও রানি গান্ধীমতির স্নেহ ভালোবাসার ছত্রছায়ায় রাজমহলে বড় হতে লাগলো রাজকন্যা রাজরাজেশ্বরী। শাস্ত্রে বিদ্যা অর্জনের সাথে সাথে তিনি দাবা শিখতে লাগলেন। ক্রমশই তিনি এই খেলায় পারদর্শী হয়ে উঠলেন। এমন এক সময় এল, যখন রাজনন্দিনী রাজরাজেশ্বরী দাবা খেলায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলেন।
তাঁর এই ক্রীড়ায় পারদর্শিতা দেখে রাজা বাসুদেবন এক স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করলেন এবং ঘোষণা করলেন, যিনি তাঁর কন্যাকে দাবা খেলায় পরাজিত করতে পারবেন, তার সঙ্গেই তিনি তাঁর কন্যার বিবাহ দেবেন। সেইমতো দাবা খেলার আয়োজন করা হলো। দেশের নানা রাজ্যের রাজপুরুষগণ রাজেশ্বরীর সঙ্গে দাবা খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন। কিন্তু কেউই রাজকুমারীকে পরাজিত করতে পারলেন না।
একদিন এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসী রাজদরবারে উপস্থিত হলেন এবং রাজরাজেশ্বরীকে দাবা খেলায় আহ্বান করলেন। রাজনন্দিনী ভাবলেন, এক ভবঘুরে বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর সঙ্গে দাবা খেলা নিতান্তই বালখিল্যতার সমতুল্য। তবুও তাঁর পিতার ঘোষণা অনুযায়ী সকলের সঙ্গে দাবা খেলতে তিনি বাধ্য। তাই তিনি সন্ন্যাসীর সঙ্গে দাবা খেলায় লিপ্ত হলেন।
যত খেলা এগোতে লাগল রাজকুমারী বুঝতে পারলেন প্রতিপক্ষ তাঁকে ছাপিয়ে যাচ্ছেন। তিনি তাঁর সকল জ্ঞানলব্ধ কৌশল অবলম্বন করলেও শেষ হাসি হাসলেন সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসীর চালেই হল কিস্তিমাত।
রাজা বাসুদেবনের শর্তানুযায়ী সন্ন্যাসীকেই বিয়ে করতে হবে রাজরাজেশ্বরীকে। কিন্তু রাজা তাঁর মেয়েকে এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর সঙ্গে বিয়ে দিতে ইতস্তত বোধ করলেন। তখন সকলকে বিস্মিত করে সন্ন্যাসী এবার নিজের রূপ ধারণ করলেন। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব। সভায় উপস্থিত সকলকে তিনি দর্শন দিলেন এবং বললেন রাজরাজেশ্বরী দেবী পার্বতীর প্রতিরূপ।
শেষে মহাদেবের সঙ্গে মহা ধুমধাম করে ঢাক ঢোল বাদ্য সহযোগে রাজকন্যা রাজরাজেশ্বরীর বিবাহ সম্পন্ন হল।
যেহেতু রাজরাজেশ্বরীকে মহাদেব দাবায় পরাজিত করেছিলেন তাই তিনি সাথুরাঙ্গা বল্লভানাথার অর্থাৎ দাবার দেবতা নামে পরিচিত হলেন। তিরুভারুর জেলায় থিরুপুভানুরে অবস্থিত মন্দিরটি তাই সাথুরাঙ্গা বল্লভানাথারের নামে উৎসর্গীকৃত।
তাঁর এবং দাবায় পারদর্শিনী তাঁর স্ত্রী রাজরাজেশ্বরীর এই মন্দিরে পূজা হয়। এটি শিবের ১০৩ তম মন্দির। মন্দিরের ইনস্ক্রিপশন পর্যালোচনা করে ঐতিহাসিকরা মনে করেন ১৫০০ বছর আগে তামিলনাড়ুতে দাবা খেলা হত।
২০২২ সালের ২৮শে জুলাই সর্বভারতীয় চেস ফেডারেশন এবং তামিলনাড়ু সরকারের তত্ত্বাবধানে মহাবলিপুরমে চেস অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হয়। ১০ই আগস্ট পর্যন্ত চলে ৪৪তম চেস অলিম্পিয়াড ক্রীড়া অনুষ্ঠান। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিযোগী দাবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন।
এই অনুষ্ঠানটিকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য সেসময় এই মন্দিরে দাবার দেবতা বল্লভানাথারের পূজা করে প্রতিযোগিতার শুভারম্ভ করা হয়।
ভারতীয় সংস্কৃতি এবং দাবা, একে অন্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এই খেলা ভারতের সমৃদ্ধ ইতিহাস-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের পরিচায়ক।

তথ্যসূত্র:
দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন অন্তর্জাল সংস্করণ

অবসর পত্রিকা গ্ৰুপের ইভেন্টে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *