এগারো চাল ও একটি মেয়ে
“অ্যালিস নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কয়েক মিনিট, চারিদিকটা ভালো করে দেখে নিতে থাকল। এ বড় আজব দেশ বটে। অসংখ্য সরু সরু জলের ধারা আড়াআড়িভাবে চলেছে যতদূর চোখ যায়, মাঝের জমিতে সবুজ সবুজ ঝোপ দিয়ে যেন চৌকো খোপ কাটা। প্রতিটা খোপ এক জলের ধারা থেকে তার পাশের জলের ধারা পর্যন্ত বিস্তৃত। অবাক অ্যালিস দেখতে দেখতে একসময়ে বলে ওঠে, “এ দেশ তো দাবার ছকের মতো চৌখুপি কাটা!” – থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস, লিউয়িস ক্যারল
বিজ্ঞজনরা বলে থাকেন, মানবসভ্যতার ইতিহাস আসলে এক নিরন্তর যুদ্ধের ইতিহাস। ইজিপ্টের সেনাই হোক বা গুপ্তযুগের চতুরঙ্গ, পারস্যের শতরঞ্জ হোক বা ভাইকিংদের টাফল্, মানুষের যুদ্ধপ্রিয়তাই যে এ খেলার জন্ম দিয়েছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। বস্তুত রাজকীয় হলেও ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও কখন যেন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই ক্রীড়া। অবশ্যই বিবর্তন ঘটেছে তার নীতি নিয়মের, চালচলনের। সাধারণ জনজীবনের অংশ হয়ে পড়ার ফলে সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে বার বার উল্লেখ ঘটেছে মস্তিষ্কে শান দেওয়া এই ক্রীড়ার, কখনও বা শতরঞ্জের ছক ঘিরেই গড়ে উঠেছে কাহিনি।
এমনই এক আশ্চর্য কাহিনির নাম থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস। সাধারণ কাহিনি নয়, তুমুল ফ্যান্টাসির দাপট এর প্রতিটা পাতায়। লিখেছিলেন এক গণিতজ্ঞ, চার্লস লাটউইজ ডজসন। আমরা অবশ্য তাঁকে লিউয়িস ক্যারল বলেই বেশি চিনি। কাহিনি জুড়ে চলছে এক আজব দাবাখেলা, আর কাহিনির আপাতসাধারণ পটভূমির আড়ালে রয়েছে এক মস্ত দাবার ছক। আদতে ছোটদের জন্য লেখা হলেও এ কাহিনির বহুমাত্রিক স্তর আকর্ষণ করবে সব বয়সের পাঠকদের। বইয়ের শুরুতেই লেখক পাঠকদের উদ্দেশ্যে রেখে যান এক তৈরী দাবার ছক (ছবি দ্রষ্টব্য), চরিত্ররা সেই ছকের নির্দিষ্ট স্থানে দণ্ডায়মান, আর যাকে কেন্দ্র করে এই কাহিনি, সেই অ্যালিস, কাহিনি (নাকি খেলা?) শুরু করে নগণ্য এক সাদা বোড়ের ভূমিকায়। বলা আছে খেলা শুরুর পর অ্যালিসকে জিততে হবে এগারোটা চালে। তখন অ্যালিস আর বোড়ে থাকবে না, হয়ে যাবে রানি। বলাই বাহুল্য, ভূমিকারূপী প্রথম অধ্যায়টি বাদ দিলে কাহিনিতে থাকে ঠিক এগারোটি অধ্যায়।
সে এক ছোট্ট মেয়ে অ্যালিস, আয়নার দিকে তাকালেই আয়নার ওপারের দুনিয়াটা তাকে টানে। ওদিকের দুনিয়াটা এদিকের মতই, তাও যেন কিছুটা আলাদা। লেখাগুলো উল্টো, পুরোটা যেন দৃশ্যমান নয়। একদিন কিন্তু সত্যি সত্যি আয়নার ভিতরে ঢুকে গিয়ে ওদিকের অন্য দেশটায় পৌঁছে যায় অ্যালিস। প্রথমেই দেখা হয় শ্বেতরাজা আর শ্বেতরানির সাথে। তখনও অবশ্য অ্যালিস বা পাঠকরা টের পায় না সে একটা মস্ত দাবার ছকে ঢুকে গেছে। সেটা বোঝা যায় লালরানির সাথে দেখা হওয়ার পর। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, লিউয়িস ক্যারলের সময়ে ভারতবর্ষ আর চীনদেশের গজদন্ত নির্মিত দাবার ঘুঁটির রঙ সাদা কালো হত না, কালোর বদলে লাল রঙ ব্যবহার করার প্রচলন ছিল। ক্যারল সম্ভবত সেরকম কোনো ঘুঁটিই দেখে, বা ব্যবহার করে থাকবেন। তাই তাঁর আয়নার দেশের শতরঞ্জের ছকে রয়েছে সাদা আর লাল পক্ষ। ক্রমে অ্যালিস বুঝতে পারে আসলে একটা দাবার ছকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে, আর এগোতে গেলে নিয়ম মেনে খেলেই এগোতে হবে। এইখানে ছোট্ট অ্যালিসকে দিয়ে ভারি গভীর একটা কথা বলিয়ে নেন ক্যারল, “সারা পৃথিবী জুড়ে মস্ত একটা দাবা খেলা হচ্ছে, যদি এটা আদৌ পৃথিবী হয়। যোগ দিতে গেলে যদি বোড়ে হতে হয় তাতে অবশ্য আমার আপত্তি নেই, তবে রানি হতেই আমি পছন্দ করব নির্ঘাত।”
মুহূর্তে ছোটদের জন্য লেখা এক উদ্ভটরসের কাহিনি যেন অন্য এক মাত্রা পেয়ে বসে। দুনিয়া জুড়েই তো চলছে এক নিরন্তর দাবাখেলা। এগিয়ে চলেছে বোড়ের দল, কেউ কাটা পড়ছে, কারুর কপালে লক্ষ্যে পৌঁছানোর গৌরব।
মনের ইচ্ছাটা লালরানিকে জানাতেই অ্যালিস বুঝতে পারে ছকের দ্বিতীয় খোপে, অর্থাৎ বোড়েদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গাতেই সে দাঁড়িয়ে আছে। আট নম্বর খোপে পৌঁছাতে পারলেই সে রানি। নির্দেশ দিয়েই লালরানি অদৃশ্য হয়। দাবার নিয়ম মেনে রানি যে কোন দিকে যতটা খুশি যেতে পারে, তাই লালরানির এহেন অদৃশ্য হওয়াটা যুক্তিযুক্ত বটে। শুরু হয়ে যায় অ্যালিসের চতুরঙ্গ যাত্রা। বোড়েরা যেহেতু প্রথম চালে একসাথে দুটো খোপ সরতে পারে, তাই অ্যালিস তৃতীয় খোপের উপর দিয়ে ট্রেনে চেপে চতুর্থ খোপে পৌঁছে যায়। এবার সঙ্গে জোটে নানা চরিত্র, দাবার অন্যান্য ঘুঁটির আদলে তারা তৈরী। ক্যারল অসামান্য দক্ষতার সাথে দাবার ঘুঁটির বৈশিষ্ট্য বুনে দিয়েছেন এই চরিত্রগুলির ভিতরে। তাই রাজাকে ঝিমোতে দেখা যায়, রানিরা ভীষণ দ্রুতগতিতে যত্রতত্র দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঘুরে বেড়ায়, সাদা আর লাল নাইটদ্বয়ের (আসলে ঘোড়া) সোজা পথ ধরে চলতে গেলে ভারি অসুবিধায় পড়তে হয়। সেটাই তো হওয়া স্বাভাবিক, কারণ দাবার ছকে ঘোড়া তো সোজা রাস্তা ধরে চলে না।
নানা আশ্চর্য অভিজ্ঞতার শেষে অবশেষে অ্যালিস তার গন্তব্যে পৌঁছায়। বোড়ে ছকের অন্য ধারে পৌঁছালে যে কোন কিছুতে রূপান্তরিত হতে পারে, সেই নিয়ম মেনেই শ্বেতরানি আর লালরানিকে দুইপাশে রেখে অ্যালিসের এবার রানি হওয়ার পালা। কিন্তু তখনও কিস্তিমাত হতে বাকি। ক্যারল তাঁর আশ্চর্য প্রতিভার শীর্ষ ছুঁয়ে ফেলেন এইবার। অ্যালিসের রানি হওয়ার উৎসবে পৌঁছে যাই আমরা। অ্যালিস সেখানে তার দুর্গে মস্ত এক টেবিলে বসে আছে তার অতিথিদের নিয়ে। অর্থাৎ অষ্টম খোপ থেকে পুরো ছকটাকে দেখতে পাচ্ছে সে। এই টেবিলটা আসলে অ্যালিসের বাড়ির টেবিল। এই টেবিলটার পাশেই চেয়ারে বসে অ্যালিস ঘুমিয়ে পড়েছে, আর গোটা ব্যাপারটা স্বপ্নে দেখছে। ভুললে চলবে না, এই টেবিলের উপরে কিন্তু একটা দাবার ছকও রাখা আছে। শ্বেতরানি এরপর গিয়ে পড়ে টেবিলের উপরে রাখা স্যুপের পাত্রে, যার ফলে অন্যপাশে বসা লালরানি কিস্তিমাত করে শ্বেতরাজাকে। এরপর ক্যারলের অননুকরণীয় রীতিতে শুরু হয় তুমুল গোলমাল, অ্যালিস লালরানিকে পাকড়াও করে, লালরানি ছোট হতে হতে পুতুলের মত হয়ে যায়, অ্যালিস স্বপ্ন ভেঙে জেগে ওঠে। এর তাৎপর্য বুঝতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না। লালরানিকে কব্জা করার ফলে লালরাজাকে কিস্তিমাত করার সুযোগ পায় অ্যালিস নিজে। খেলা শেষ হয়, আর ঘুম ভেঙে উঠে পড়ে আমাদের অ্যালিস।
সবথেকে অবাক হতে হয় এটা ভেবে, গোটা গল্পে বা খেলায় যাই বলা হোক না কেন, ক্যারল মুহূর্তের জন্যও তাঁর উদ্ভট রস থেকে সরে আসেননি, ছন্দপতন হয়নি একবারও। দাবার মতো এক হিসেবী খেলার সাথে বেহিসাবী আজব দুনিয়ার এই মিশেল চিরকাল মুগ্ধ করেছে পাঠকদের। হয়ত গণিতজ্ঞ ছিলেন বলেই এমন খাপছাড়া হিসেবটি নিপুণভাবে মেলাতে পেরেছিলেন তিনি।
বাচ্ছাদের জন্য এই গল্পের শেষ এখানেই। কিন্তু আমরা বরং আরো একটু এগিয়ে যাই।
এ কি শুধুই একটা স্বপ্নের গল্প? বিচ্ছিন্ন এবং দ্যোতনাহীন? সেটা হলে বোধহয় আমরা পাঠকরা একটু হতাশই হতাম,তা সে যতই অদ্ভুতুড়ে দাবাখেলার চমৎকার গল্প হোক না কেন। অ্যালিস লিডেল নামে সত্যিই এক প্রতিবেশী কন্যা ছিল চার্লস ডজসনের জীবনে। তিনি তখন সদ্য লিউয়িস ক্যারল ছদ্মনামে লিখতে শুরু করেছেন, যদিও ছাপাখানার মুখ তখনও দেখেনি সেসব লেখা। লিডেল পরিবারের সঙ্গে, বিশেষ করে তাদের খুদে সদস্যদের সাথে বেশ একটা সখ্যতা তৈরী হয়ে যায় তাঁর। নৌকায় করে ঘুরতে ঘুরতে অ্যালিস আর তার ভাই-বোনদের মুখে মুখে গল্প শোনান তিনি, অ্যালিসেরই অনুরোধে লিখেও ফেলেন সে গল্প। পরবর্তীতে অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড নামে সে বই জগদ্বিখ্যাত হয়। এর পরেই আসে থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস। এই দুইয়ের মাঝে অ্যালিসকে নিয়ে কিছু জটিলতা তৈরী হয়েছিল ক্যারলের মনে। যদিও এই নিয়ে বহু বিতর্কের সুযোগ আছে, তাও বলা যেতে পারে অ্যালিসকে হয়ত তখন একটু অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছিলেন তিনি। জীবনীলেখক মর্টন কোহেনের মতে তিনি হয়তো বিবাহের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন লিডেল পরিবারকে। অ্যালিস তখন মোটে এগারো। উল্লেখ করা যেতে পারে, লিডেলদের সাথে সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছিল ক্যারলের। কী কারণে এই ভাঙন তা নিয়ে কোনদিন মুখ খোলেননি লিডেল পরিবার বা ক্যারল নিজে। তবে এসব ঘটনা থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস লেখার পরে। তবু, ক্যারল সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন কী ঘটতে চলেছে, অন্তত নিজের মনের ছবিটা তার কাছে পরিষ্কার ছিল। আর বুঝেছিলেন ছোট্ট অ্যালিস এবার বড় হয়ে উঠছে, নিয়মের নিগড়ে বাঁধা বোড়ে থেকে স্বাধীনচেতা রানি হয়ে উঠছে। এই গল্প তাই শৈশব থেকে কৈশোর পার হয়ে যৌবনে উত্তীর্ণ হওয়ার গল্প। যে যাত্রায় সঙ্গ দেয় অদ্ভুত ব্যাখ্যাহীন সব অভিজ্ঞতা। শ্বেত নাইটের কথা আগেই বলেছি, ঠিক ছকের শেষ প্রান্তে অ্যালিসের সাথে দেখা হয় তার। লাল নাইটের খপ্পর থেকে অ্যালিসকে বাঁচিয়ে অন্তিম খোপে পৌঁছানোর মুখে বিদায় নেয় সে। শ্বেত নাইটের বর্ণনার সঙ্গে ক্যারলের নিজের চেহারার আশ্চর্য মিলটা অবশ্যই কাকতালীয় নয়। অ্যালিসকে রানি হওয়ার মুখে দাঁড় করিয়ে ফিরে যায় শ্বেত নাইট, নাকি তাকে যৌবনে পদার্পণের মুখে দাঁড় করিয়ে ফিরে আসেন বিষণ্ণ ক্যারল?
এই বইয়ের একটা টীকাও লিখে ফেলেছেন মার্কিন লেখক মার্টিন গার্ডেনার, সে বইয়ের নাম দ্য অ্যানোটেটেড অ্যালিস। সেখানে ওই এগারোটা চালের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।
দাবার সমস্ত নিয়ম যে তিনি মানেননি, সে কথা ক্যারল নিজ মুখেই স্বীকার করেছেন। তবু জীবনের দাবাখেলার ছকে তিনি দাঁড় করিয়ে দেন সমস্ত বয়সের পাঠককে। আমরাও বোড়ে সেজে দাঁড়িয়ে পড়ি অ্যালিসের পাশে, কোন একদিন জীবনের ছকের শেষ প্রান্তে রানি হওয়ার গৌরব নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর আশায়।
চিত্রঋণ: অন্তর্জাল
অবসর পত্রিকা গ্ৰুপের ইভেন্টে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখা