এক অখ্যাত চিত্রকর এবং চৌষট্টি খোপে প্রেম
কলকাতা বরাবরই দাবাপ্রেমী শহর। জুলাইয়ের কুড়ি তারিখে বিশ্ব দাবা দিবস উপলক্ষে এই শহরে আয়োজিত হয়ে গেল, ‘অল বেঙ্গল রাপিড চেস টুর্নামেন্ট।’ বিশেষ ভাবে সক্ষম, ছেলেমেয়েদের নিয়ে আয়োজিত হয় এই বিশেষ প্রতিযোগিতা। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হয়ে এসেছিলেন দিব্যেন্দু বড়ুয়া, বিশ্বনাথন আনন্দ। এ দিন উদ্বোধন হয়, বিশেষ ব্রেইল লাইব্রেরির। এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হল কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি-তে।
এ হেন কলকাতা শহরে দাবার পীঠস্থান হচ্ছে আলেখাইন চেস ক্লাব। বহু আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সাক্ষী এই ক্লাব থেকে উঠে এসেছেন অনেক প্রথিতযশা দাবাড়ু।
আর যার নামাঙ্কিত এই ঐতিহ্যশালী দাবা ক্লাব, তিনি হচ্ছেন ‘আলেকজান্ডার আলেখাইন,’ দাবার প্রবাদ পুরুষ। ১৮৯২ সালে রাশিয়ার মস্কো শহরে জন্মগ্রহণ করা আলেকজান্ডার আলেখাইন দাবা বিশ্বকে শাসন করেছেন প্রায় দীর্ঘ দু’দশক।
যদিও ১৯২৭ সালে যখন তিনি আর এক কিংবদন্তি দাবাড়ু, কাপাব্লাঙ্কাকে হারিয়ে বিশ্ব খেতাব জেতেন, তখন তিনি ফরাসি নাগরিক। ১৯২৪ সালের পরেই তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছেড়ে আলেখাইন ফ্রান্সে চলে আসেন।
১৯২৭-১৯৩৫ দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্ব খেতাবকে নিজস্ব সম্পতি করে ফেলেছিলেন আলেখাইন। ১৯৩৫ সালে ম্যাক্স ইউয়ের কাছে খেতাব হারালেও, ১৯৩৭ সালে একই প্রতিপক্ষকে হারিয়ে আলেখাইন খেতাব পুনরুদ্ধার করেন। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ফলে বিভিন্ন প্রতিপক্ষর বিরুদ্ধে আলেখাইনের বিশ্ব খেতাবি লড়াইগুলো বারংবার ভেস্তে যেতে থাকে। শেষে ১৯৪৬ সালে মিখাইল বটভিনিকের বিরুদ্ধে যখন বিশ্ব খেতাবি লড়াইয়ের চূড়ান্ত কথাবার্তা চলছে, সেইসময় আলেখাইন পর্তুগালে মারা যান। সেই মৃত্যুর কারণও বেশ অস্পষ্ট। আলেখাইন দাবা ইতিহাসের একমাত্র বিশ্ব চ্যামপিয়ন যিনি, মৃত্যুকালেও বিশ্ব খেতাবধারী ছিলেন। দাবার রোমান্টিক নায়ক আলেখাইন, চিরকালের মতো দাবা খেলাটাই বদলে দিয়েছিলেন।
“Chess for me is not a game, but an art. Yes, and I take upon myself all those responsibilities which an art imposes on its adherents.” অক্ষরে অক্ষরে নিজের কথা রেখেছিলেন আলেখাইন।
তাঁর আক্রমণাত্মক উদ্ভাবনী খেলার পদ্ধতি, মিডল গেম, এন্ড গেমের কলাকৌশল বহু চর্চিত এবং সংরক্ষিত। যে কোনও দাবাপ্রেমী, চেস লাইব্রেরি ঘেঁটে সমস্তটাই বিস্তারিত দেখে নিতে পারেন।
আমরা বরং আলেখাইনের বিখ্যাত উক্তি থেকে, শুধু ‘আর্ট’ শব্দটা একটু অন্য ভাবে তুলে নিই এবং চৌষট্টি খোপের এই প্রাচীন খেলাকে চিত্রশিল্পীরা কীভাবে ক্যানভাসে চিত্রিত করেছেন, সেটাই যৎসামান্য আলোচনা করি।
নিঃসন্দেহে এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, উনিশ শতকের প্রথমার্ধে আঁকা জার্মান চিত্রশিল্পী Friedrich Moritz August Retzschএর বিখ্যাত পেইন্টিং, ‘দা চেস প্লেয়ার্স।’
‘চেক মেট’ এবং ‘দা গেম অফ লাইফ’ নামেও এই পেইন্টিং ব্যাপকভাবে পরিচিত।
এই ছবিতে দুই যুযুধান দাবাড়ুর একজন শয়তান স্বয়ং। চরম আত্মবিশ্বাসী তার ভঙ্গিমা, জেতার বিষয়ে একশো শতাংশ নিশ্চিত। শয়তান এই খেলায় জয়ী হলেই জিতে নেবে পরাজিত প্রতিপক্ষের আত্মা।
শয়তানের প্রতিপক্ষ মানুষটি দৃশ্যতই হতাশ। ল্যুভর মিউজিয়ামে প্রদর্শিত এই পেইন্টিং দেখতে এসে আমেরিকার বিশ্ব চ্যামপিয়ন দাবাড়ু ‘পল মর্ফি’ আবিষ্কার করেন, আসলে কিন্তু খেলায় জিততে পারে ওই মানুষটি। সাধারণ দর্শক চিত্রশিল্পীর মুনশিয়ানা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন, পল মর্ফি তার সঙ্গে খতিয়ে দেখেছিলেন বোর্ডে ঘুঁটিগুলোর অবস্থান। শয়তানের প্রতিপক্ষর তখনও রাজার একটি চাল বাকি, সেটা সে তখনও আবিষ্কার করতে পারেনি বলে চেহারায় হতাশার ছবি ফুটে উঠেছে। ওই এক চালেই উল্টে যাবে পুরো বাজি।
এতদিন এ ছবির ব্যাখ্যা ছিল, শয়তান মানুষকে চেকমেট করে দিয়েছে। পল মর্ফি নাকি, ল্যুভর মিউজিয়ামের কিউরেটরকে ডেকে ছবিটির ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, এই ছবির ক্ষেত্রে ‘চেকমেট’ টাইটেল যথার্থ নয়।
অনেকে অবশ্য মনে করেন, এটা নিছক গল্প কথা। আবার অনেকে মনে করেন, পল মর্ফির মাপের জিনিয়াসের পক্ষে ওই খেলা ঘুরিয়ে দেওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
এই ছবির আবার একটি আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাও আছে। এই ছবির মাধ্যমে নাকি চিত্রশিল্পী দেখিয়েছেন, পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক, ভগবান শেষ পর্যন্ত তা থেকে পরিত্রাণের রাস্তা তৈরি রাখেন। শয়তানের বিরুদ্ধে ভগবানের জয়ের আখ্যান।
বর্তমানে ছবিটি আর ল্যুভর মিউজিয়ামে নেই, ১৯৯৯ সালে অকশনে বিক্রি হয়ে কোনও এক ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে।
Marcel Duchamp কে বাদ দিয়ে দাবাসংক্রান্ত চিত্রশিল্প নিয়ে কোনও আলোচনাই চলতে পারে না। জগদ্বিখ্যাত এই চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর শুধু নিজে দুর্ধর্ষ দাবাড়ু ছিলেন না, শেষে দাবার জন্য পেন্টিং ক্যারিয়রে ইতি টানতেও দ্বিধা বোধ করেননি।
পাবলো পিকাসোর সমসাময়িক এই শিল্পী বলেছিলেন, “While all artists are not chess players, all chess players are artists.” মার্সেল কোনওমতেই শখের দাবাড়ু ছিলেন না, ফ্রেঞ্চ চেস অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে চেস মাস্টার উপাধিতে ভূষিত করেছিল। দাবা অলিম্পিয়াডে তিনি একাধিক বার ফ্রান্সের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। মার্সেলের শ্রেষ্ঠ চারটি চেস পেইন্টিং হচ্ছে, The chess game (1910), The chess players (1911), Joueurs d’ echecs (Portrait of chess players) (1911), King and Queen surrounded by Swift Nudes (1912).
কিন্তু ১৯২৩ সালের পর থেকে মার্সেল সেভাবে আর পেইন্টিং করেননি। তিনি বলেছিলেন দাবা তাঁর কাছে অনেক আকর্ষক বিষয়, পেইন্টিং করতে তিনি আর উৎসাহ পাচ্ছেন না। খুব সচেতনভাবেই মার্সেল শিল্প পরিমণ্ডলকে এড়িয়ে যাওয়া শুরু করেন, যদিও প্যারিসের সুররিয়ালিস্টদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বজায় ছিল।
১৯২৫ সালে মার্সেল তৃতীয় ফ্রেঞ্চ চেস চ্যামপিয়নশিপের পোস্টার তৈরি করে দিয়েছিলেন। ১৯৩২ সালে প্যারিস চ্যামপিয়নশিপে জয়লাভ করা দাবাড়ু মার্সেলের এক উল্লেখযোগ্য কীর্তি।
‘PORTRAIT OF AN ARTIST: MARCEL DUCHAMP – A GAME OF CHESS,’ ১৯৬৩ সালে তৈরি এই চলচ্চিত্রে মার্সেল দাবার থিয়োরির সঙ্গে সঙ্গে ১৯২৩ সালে শিল্পী জীবন ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েও মুখ খুলেছিলেন।
১৯৬৪ সালে তৈরি ফরাসি চলচ্চিত্র, ‘Game of chess with Marcel Duchamp’ সপ্তম বাৎসরিক বার্গেমো চলচ্চিত্র উৎসবে গ্র্যান্ড পিক্স খেতাব জিতে নেয়। এই ছবিতে দাবা নিয়ে মার্সেলের একটি দীর্ঘ ইন্টারভিউ দেখানো হয়। আসলে Marcel Duchamp এমনই এক বর্ণময় চরিত্র, যাকে নিয়ে এত স্বল্প পরিসরে লেখা অসম্ভব। অন্যান্য বহু বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর দাবাসংক্রান্ত ছবি নিয়ে আলোচনা বাকি রয়ে গেল, কিন্তু আমি নিরুপায়। এক অখ্যাত স্প্যানিশ চিত্রশিল্পীর কথা আমাকে বলতেই হবে।
কর্মসূত্রে আমাকে কয়েকবার স্পেনে যেতে হয়েছে। স্পেনে আমার কর্মকাণ্ড মাদ্রিদ শহরেই সীমাবদ্ধ থাকে, তার বাইরে বেরনোর সুযোগ খুব একটা হয় না। সেবার আমার বন্ধু জোসে মাতেও একপ্রকার জোর করেই ধরে নিয়ে গেল, ওরিহুয়েলা শহরে, ওর বাড়িতে। ওরিহুয়েলার সৌন্দর্য বা স্প্যানিশ আতিথেয়তার প্রসঙ্গ থাক। মাতেওর বাড়িতে আমার নজর কেড়েছিল, ড্রইং রুমে দেওয়াল জোড়া একটা অয়েল পেন্টিঙের উপর। স্প্যানিশ ভাষায় লেখা টাইটেল অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘চৌষট্টি খোপে প্রেম।’ চিত্রশিল্পীর নাম, ‘মিগুয়েল।’
চৌষট্টি খোপের রং এখানে সাদা-কালোর বদলে লাল-হলুদ। তাতে খুব বেশি অবাক হইনি, কারণ স্পেনের জাতীয় পতাকায় ওই দু’টো রং আছে। ছবিতে প্রথমেই আকর্ষণ করে দাবার ঘুঁটিগুলো। সাদা ঘুঁটির জায়গা নিয়েছে সাদা পোশাকে এক নারী, কালো ঘুঁটির জায়গায় ওই রঙের পোশাকে একজন পুরুষ। রং এক থাকলেও ভিন্ন ভিন্ন পোশাক ব্যবহার করা হয়েছে। বোড়ে, গজ, ঘোড়া, নৌকো বলে এই ছবিতে কিছু নেই, শুধুই রাজা আর রানি।
দাবার বোর্ডে আদতে অভিনীত হয়েছে একটি প্রেমকাহিনি, যার পরিণতি শেষ হচ্ছে বিচ্ছেদে। রানি দাবার বোর্ড থেকে রাজার হাত ছেড়ে নেমে দাঁড়াচ্ছে, হতাশ রাজার মুখে বিষণ্ণ হাসি।
মাতেওকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, ওটা ওর এক বন্ধুর করা পেন্টিং এবং সেই বন্ধুও আজকে আমন্ত্রিত। আমার একটু আধটু পেন্টিং দেখার শখ আছে বলেই, মাতেও তার চিত্রশিল্পীর বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করাতে চায়।
মায়াবী চোখের প্রৌঢ় মিগুয়েলকে দেখলেই মনে হয়, এ কবি বা শিল্পী না হয়ে যায় না। ওর ব্যবহারে মনে হল, আমায় যেন বহুদিন ধরেই চেনে। আমি ওকে স্পেনের জাতীয় পতাকার সঙ্গে ওর আঁকা দাবার বোর্ডের রঙের সাদৃশ্যর কথা উল্লেখ করতে, স্মিত হেসে বলল, আসলে পুরো বোর্ডটাই প্রথমে লাল রং করেছিল, পরে মারিয়ার জন্য হলুদ রং জুড়ে দিয়েছে। আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে, মাতেও বলল, “আরে মারিয়া হচ্ছে মিগুয়েলের বাল্য প্রেমিকা। মিগুয়েলকে ছেড়ে এক ধনী ব্যবসায়ীকে বিয়ে করার পর, মিগুয়েল নিজের রক্তাক্ত হৃদয়ের বর্ণনায় পুরো চৌষট্টি খোপ লাল রঙে রাঙিয়েছিল। তারপর খেয়াল হল, মারিয়ার সঙ্গে কত অসাধারণ মুহূর্ত কাটিয়েছে। পুরো লাল রং করে নাকি সেই স্মৃতির প্রতি অবিচার করা হয়েছে, তাই পরে বন্ধুত্বর রং হলুদের আমদানি। বুঝলে, আসলে এই পেন্টিঙের টাইটেল হওয়া উচিত ছিল ‘চৌষট্টি খোপে ব্যর্থ প্রেম।’”
মিগুয়েল আমাদের ধরে নিয়ে গেল ডিনারে, রাস্তার ওপারে ওর অ্যাপার্টমেন্টে। মাতেও আর মিগুয়েল ঢুকল কিচেনে, আমি ঘুরে ঘুরে মিগুয়েলের আঁকা ছবি দেখতে লাগলাম। একটা ছবির টাইটেল, ‘কোল্ড ওয়ার।’ সেখানে দাবার বোর্ডের দু’পাশে মানুষের বদলে দু’টো যুদ্ধের ট্যাঙ্ক।
ঘুঁটিগুলো কেউ চাষি, কেউ কামার, কেউ ছুতোর। অর্থাৎ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, তাদের অনাবৃত শরীরে রক্তের দাগ। এই ছবি যে একদা সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকার ঠান্ডা যুদ্ধকে ঘিরে একটা বিরাট অংশের মানুষের বিড়ম্বনাকে ইঙ্গিত করছে, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
অকৃতদার শখের এই চিত্রকরের জীবনে দু’টো প্রেম – মারিয়া এবং দাবা। ওর আঁকা ছবিগুলো সে কথা নিরচ্চারে উচ্চারণ করছিল। মারিয়া মিগুয়েলকে ছেড়ে গেলেও, চৌষট্টি খোপের মহাকাব্য ওকে ত্যাগ করেনি।
মাতেও ঠিক বলেনি, মিগুয়েলের চৌষট্টি খোপের প্রেম ব্যর্থ হয়নি।
তথ্য ঋণ :
A closer look at “Checkmate” by Charles Morris
Faith lift checkmate by Rob Weatherby
The Chess Player As An Artist – Marcel Duchamp
অবসর পত্রিকা গ্ৰুপের ইভেন্টে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখা