চৌষট্টি ঘরের বাসিন্দারা
মির্জা সাজ্জাদের মাথায় বাহারি টুপি। রুপোর হুঁকোদানের পাইপটা মুখে ঢুকিয়ে গভীর মনোযোগে তাকিয়ে আছেন চৌষট্টি ঘরের দিকে। মির রোশন আলিও চিন্তায়, ভাবছেন এই মুহূর্তে ঠিক কোন চালটা দিলে খেলাটা আরেকটু জমে উঠবে। লক্ষ্ণৌ শহরের দুই অভিজাত মুসলিমকে এই শতরঞ্জের খেলাটা ধীরে ধীরে পেয়ে বসছে। বসারই কথা। প্রত্যেকটা মুহূর্তই উত্তেজনায় কানায় কানায় ভরে থাকে। একটু অসতর্ক হলেই শত্রুপক্ষের বেঁটে সৈনিক ছোঁ মেরে উল্টে দেবে অশ্বারোহীকে। আসলে যুদ্ধ তো তাদের রক্তে! বাড়ির দেওয়ালে ঝোলে বাপ ঠাকুর্দার আমলের তলোয়ার। সেই ইতিহাসের কথা মনে পড়লে গর্বে তাদের চোখগুলো মরকত মণির মতো চকচক করে ওঠে। কিন্তু সে সব বীরত্বের বারুদ ফুরিয়ে গেছে, এখন তারা যোদ্ধা থেকে শুধুই খেলোয়াড়। লড়েন কেবলই দাবার ঘুঁটিতে।
সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ বলেছিলেন, “Literature is nothing but carpentry. With both you are working with reality, a material as hard as wood.” জীবন এবং কাঠ দুটোই একই রকমের কঠিন। কিন্তু সেই জীবন ছেনে ছেনেও যা উঠে আসে তাই হল প্রকৃত সাহিত্য, যেমন “শতরঞ্জ কি খিলাড়ি।” মুন্সি প্রেমচাঁদের গল্পটাই সত্যজিৎ রায় পরিচালিত সিনেমার মূল আকর। যে পটভূমিতে লেখা, সে সময় গোটা ভারতবর্ষই ছিল এক সুবিস্তৃত দাবার ছক। একদিকে ভেঙে পড়ছে মোগল সালতানাতের সুরক্ষা বলয়, ঢুকে পড়ছে কলোনিয়ালিস্ট ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। তাদের রানি ভিক্টোরিয়ার সৈন্যসামন্ত যেমন খুশি চালে পাল্টে দিচ্ছে ইতিহাসের চতুরঙ্গ। অন্যদিকে প্রিন্সলি স্টেট আওয়াধের শেষ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ তাঁর রত্নখচিত সিংহাসনটিকে আঁকড়ে ধরতে চাইছেন। লর্ড ডালহৌসির নির্দেশনামা পৌঁছে গেছে জেনারেল আউটরামের কাছে। রানি আওয়াধের দখল নেবেন। তাহলে কি এবার গর্জে উঠবেন নবাব? তাঁর হাতি, ঘোড়া এবং পদাতিক সৈন্যরা কি বিদ্রোহ করবে? আওয়াধের দুই জায়গিরদার হলেন মির্জা সাজ্জাদ আলি এবং মির রোশন আলি। কাহিনি আবর্তিত হয় মূলত এই দুজন এবং নবাবকে নিয়ে। তবে ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ তে আরেকটা মূল চরিত্র অবশ্যই দাবা। তাই সিনেমাটি শুরুই হয় যুযুধান একটা দাবার বোর্ডের শট দিয়ে। থরে থরে সাজানো সাদা এবং লাল দুই দল। দুটো হাত তাদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কাপড়ের খোপকাটা ঘরের প্রান্ত থেকে সামনের দিকে।
জীবনকে যদি বলা হয়, তোমার গল্প বল, তাহলে জীবন যেভাবে বলবে, একজন সাহিত্যিক তার অনন্য ক্ষমতায় তার থেকেও সুচারুভাবে সেই কাহিনি শোনান। ১৮৫৬ সালে লক্ষ্ণৌ ডুবে ছিল বিলাসে – শ্রেণী, বর্গ নির্বিশেষে। সমাজের ছোট বড় প্রত্যেকের বিনোদনের নিজস্ব উপাদান ছিল। রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতবদলের লগ্নে মানুষ দিশাহীন, বেপরোয়া। এই আত্মমগ্ন জাতির কোন হুঁশ নেই! কে তাদের ঘর ভাঙছে? অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে থেকে তা পাহারা দেওয়ার বদলে তারা মোরগের লড়াই দেখে, আকাশে চাঁদিয়াল ঘুড়ি ওড়ায়। মির্জা সাজ্জাদ আর মির রোশনের দাবার বোর্ড সেই আপামর জনতার নিস্পৃহতার রূপক। সাহিত্যিকের মিডাস টাচ।
সকাল হলেই মির্জা সাজ্জাদের বাড়ি চলে আসেন মির। দাবা খেলতে সঙ্গ লাগে, অনুষঙ্গও লাগে। রুপোর চেনের গুচ্ছে বাহারি পান ঝোলে, পাশে হুঁকো। খেলতে খেলতে বেলা বয়ে যায়। মির্জার গিন্নি খুরশিদ ভাবেন, এইবার বোধহয় ফিরে আসবেন তাঁর আদরের স্বামীটি। পাশাপাশি বসে খাবেন। বুড়ো চাকরকে দিয়ে বারবার ডাক পাঠান, কিন্তু সাজ্জাদের যে অন্য টান! বেগম মনে মনে অভিসম্পাত দেন দাবার বোর্ডটাকে। একটা সময় ছিল যখন রাতের পর রাত বাড়ি ফিরতেন না সাজ্জাদ। বাঈজির ঠুমরিতে বাঁধা পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই বিরহ তাও সহ্য হয়ে গিয়েছিল খুরশিদের, এই অপেক্ষায় সে বেচারি ক্ষয়ে যায়। কী করে মন ভোলাবে খুরশিদ? তার সবুজ ওড়না, গলার মিনাকারি হার, মাথার ঝাপটা – সবই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। রাগ গিয়ে পড়ে দাবার ঘুঁটির ওপর। চুরি করে নেয় সেগুলো। আর কীই বা করতে পারে এই অভিমানী বেগম? তার দাসীও যে একই গল্প রোজ শোনায়, বিরক্তি ধরে যায় তার। এত প্রেম কাকে দেবে সে? কাকে কাছে টানবে? মিরের বউয়ের মতো অন্য পুরুষের প্রতি তো ঝুঁকতে পারে না! মাথা তার ছিঁড়ে যাচ্ছে, অন্দরমহল থেকে এমন খবর পাঠালেও যে তার স্বামী আসতে চান না। যদিও বা আসেন, সবসময় মাথায় ঘুরতে থাকে দাবার ছক, অবিন্যস্ত ঘুঁটি আর প্রিয় বন্ধুটি। খুরশিদের খুনসুটি কিংবা গভীর দীর্ঘশ্বাস কোনটাই ছুঁতে পারে না সাজ্জাদকে। বেগম বুঝে যান, ঐ খেলাটাই তার ভাগের সমস্ত সময় আর ভালোবাসা নিংড়ে নিয়ে ছিবড়ে করে দিচ্ছে মানুষটাকে। বন্ধ করতে হবে খেলাটা।
বেগমের উষ্মা আঁচ করতে পারে মির্জা। চাকরবাকরদের ধমকেও দাবার ঘুঁটি আর খুঁজে পান না তিনি। শেষে মির প্রস্তাব দেন তার বাড়িতেই খেলা হোক। মিরের বউ নাফিসা তার স্বামীর দাবা খেলা নিয়ে কোন আপত্তি করে না। সে বরং খুশি। এই যে সারাদিন মির বাড়ি থাকে না, নাফিসা রাস্তার দিকের জানালাটায় চোখ মেলে থাকে। সেখানে চোরা পথ। সেই পথে আসে এক যুবক। তার বুক পাখির ছোট্ট ছানার মতো ধুকপুক করে কিন্তু তাও সে আসে। নাফিসা কান পেতে সেই ধুকপুকানি শোনে। আনন্দে টলমল করে। মিরের দাবার এই নেশাটা নাফিসার গোপন পৃথিবীর চাবিকাঠি। ভাগ্যিস এমন খেলা ছিল! দোঁহের এই পৃথিবীটাকে নিজের সমস্ত উষ্ণতা উজাড় করে লালন করে নাফিসা। যদিও সে ভাবে এই অভিসার গুপ্ত, কিন্তু আসলে গোটা লক্ষ্ণৌ শহর জানে তার আশনাই। আর মির? সে কি জানে না? বোঝে না, কেন বন্ধুপত্নীর মতো কোন অভিযোগ নেই তার স্ত্রীর? রাতে বাড়ি ফিরলে সুগন্ধি বাদাম তেল দিয়ে মালিশ করে দেয় নাফিসা। চোখ জুড়ে সহজে ঘুম নেমে আসে, কেন? দাবার বোর্ডের রানিকে তো দাঁওয়ের মারপ্যাঁচে বাঁচিয়ে নেয় মির, কিন্তু তার নিজের বেগম? হাওয়ায় যে খবর ভেসে বেড়ায় তা শুনেও কেন শুনতে পায় না মির রোশন আলি? এতটাই কাঁচা খেলোয়াড় সে? জীবনের বাজি এমন সহজে ছেড়ে দেয়? হ্যাঁ দেয়। কারণ ততদিনে দাবার নেশায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। তার কাছে বাকি সবকিছু তুচ্ছ।
প্রেমচাঁদের গল্পে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ্এর বিশেষ ভূমিকা নেই, কিন্তু সত্যজিৎ রায় তাঁর সিনেমায় এই নবাবকে মরমী হাতে এঁকেছেন। অদ্ভুতভাবে অভিনেতা আমজাদ খানের সাথে মিলেও গিয়েছিল আওয়াধের দশম এবং শেষতম নবাবের ছবি। ওয়াটসন সাহেবের কাছে আউটরাম জানতে চান কেমন লোক এই নবাব। ক্রিটিকরা এই সিনটাকে শেক্সপিয়ারের নাটকের সঙ্গে তুলনা করেন। মাত্র কয়েকটা শব্দে যেখানে গোটা একটা চরিত্র উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ওয়াটসন সাহেব জেনারেল আউটরামকে নবাবের লেখা কবিতার অনুবাদ শোনান:
Wound not my bleeding body
Throw flowers gently on my grave
Though mingled with the earth, I Rose up to the skies,
People mistake my rising dask for the heavens.
এই হলেন ওয়াজিদ আলি শাহ। লোকটাকে জড়িয়ে ধরলে গায়ে এমন আতরের গন্ধ লেগে যায় যে সাতদিনেও তা যেতে চায় না। তিনি কত্থক নাচে পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, এতটাই যে নর্তকীর সাথে নিজেও নেচে উঠতেন। নবাব কবিতা লেখেন, তাতে সুর দেন, কথায় কথায় হারিয়েও যান। হয়তো সিংহাসনে বসে আছেন, কিন্তু মনের মধ্যে কে যেন নতুন গান বাঁধছে, জগৎ সংসারে উদাসীন সন্ন্যাসী অথচ সিংহাসনের প্রতি কী অনিবার্য, অমোঘ আকর্ষণ তাঁর! বিনা যুদ্ধে আউটরামকে তা ছেড়ে দেবেন না। জেনারেল আউটরামও তাঁকে বুঝতে পারেন না। তাঁর কথায়, he is bundle of contradiction। এই নবাবকেই একলাখ টাকা মাসোহারায় রাজ্যপাট ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। সমস্ত বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তি বাতিল করে চেকমেট বলে নবাবের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন আউটরাম। জানেন না কী দান চালবেন প্রতিপক্ষ। ওয়াজিদের তালুকদাররা অবশ্য তৈরিই ছিলেন তাদের এক লাখ পদাতিক সৈনিক আর এক হাজার তোপ নিয়ে। বিনা যুদ্ধে কি সমস্ত অধিকার নবাবের ছাড়া উচিত?
দাবার বোর্ড নয়, এবার এই প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়েছে আসল রাজার সামনে। ওয়াজেদ আলি সেই মুহূর্তেই গান ধরলেন, তাঁর লেখা ঠুমরি,
যব ছোড় চলে লক্ষ্ণৌ নগরী
কহো হাম আদম পর কেয়া গুজরি।
এই বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করলে রক্তাক্ত হবে আওয়াধ। মরবে সাধারণ মানুষ। তাই রাজা তার সমস্ত সেপাইদের বললেন তারা যেন অস্ত্র ফেলে দেয়। বিনা যুদ্ধে হেরে গেলেন।
যেদিন কোম্পানির সেপাইরা দখল করে নিচ্ছিল আওয়াধ, সেদিনও কিন্তু মির আর মির্জা শহর ছেড়ে পালিয়েছিল। সঙ্গে নিয়েছিল দাবার বোর্ড আর হুঁকো। খেলতে যে তাদের হবেই। আর কোনও উপায় নেই। গোমতী নদীর তীর, ভাঙা মসজিদ, গরীবের মাটির উঠোন যে কোন একটা নির্জন শান্ত জায়গা পেলেই বসে পড়েন দুই খিলাড়ি। খেলতে খেলতেই একসময় তাদের বাইরের মুখোশ খুলে ভেতরের শ্বাপদও উঁকি মারে। এ ওর টুঁটি টিপে ধরে। মিরের স্বৈরিণী স্ত্রী নাফিসার প্রসঙ্গ তুলেছিল মির্জা, সেই থেকেই গণ্ডগোলের সূত্রপাত। শেষপর্যন্ত গুলি চালিয়ে দেয় মির, প্রাণের বন্ধু মির্জার পশমিনা শাল ছুঁয়ে বেরিয়ে যায় বুলেটটা। তারপরেই স্তব্ধতা। কিন্তু তারপরেও কি শেষ হয় এই খেলা?
নাহ্, কালো শালটা গায়ে দিয়ে খুব ধীর পায়ে আবার গাছ তলায় ফিরে আসে মির। মির্জাও যেন অপেক্ষায় ছিল। খেলা শুরু করে তারা। ঠিক যেন অভিশপ্ত দুজন দাবাড়ু, শতরঞ্জ তাদের গ্রাস করেছে। ধীরে ধীরে গিলে নিয়েছে মাথা, ধড়, পা। আর কিচ্ছু পারে না তারা, শুধু খেলে চলে, খেলেই চলে।
অবসর পত্রিকা গ্ৰুপের ইভেন্টে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখা